হিটলার যে শুধুই একটি ধর্মের, মানে ইহুদি দের, বিরুদ্ধে ছিল ও তাদের ধবংস করেছিল তা নয়, একটি জাতি র বংশ লোপ করতে চেয়েছিল। ঠিক যেমন আজ মোদী সরকার NRC, CAA এর মাধ্যমে করতে চাইছে বলেই মনে হচ্ছে। কেন বলছি সেটা বিশদে বলার আগে "বাস্টার্ড" দের ইতিহাস একটু বলে নি -
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রেঞ্চ সৈন্য রা জার্মানির রাইন নদীর ধারের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করলে, ফ্রেঞ্চ সৈন্য রা ওই অঞ্চলের জার্মান মহিলাদের উপর গণধর্ষণ নামিয়ে আনে। তার ফলে জার্মান মহিলাদের গর্ভে ফ্রেঞ্চ সৈন্যবাহিনী তে থাকা প্রচুর আফ্রিকান সৈন্যের সন্তান জন্ম নেয়। হিটলার এদের "রাইনল্যান্ড বাস্টার্ড" বলে ডাকতেন। ১৯৩৫ সালে "ন্যুরেমবার্গ আইন" পাশ হওয়ার পর হিটলার এদের খুঁজে বের করে অপারেশন এর মাধ্যমে এদের জনন ক্ষমতা ধংস করে বন্ধ্যা করে দেন যাতে এদের থেকে আর কোনো তথাকথিত "বাস্টার্ড" অর্থাৎ অ-জার্মান জন্ম না নেয়। কতোটা স্বজাতির প্রতি গর্ব ও অন্য জাতির প্রতি ঘৃনা থাকলে এতটা অমানবিক ও নৃশংস হওয়া যায় ভাবুন। শুধু এটাই না ন্যুরেমবার্গ আইন মূলত পাশ হয়েছিল, জার্মান দের থেকে অ-জার্মান দের আলাদা করে জার্মান বংশোদ্ভুত দের স্বার্থ রক্ষার সাথে মূলত ইহুদি বংশোদ্ভুত দের খুঁজে বের করে তাদের সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা ও শেষে হত্যা করার উদ্দেশ্যে।
ন্যুরেমবার্গ আইনেও সকল কে কাগজ জমা দিতে বলা হয়েছিল যে কাগজের মাধ্যমে সব বাসিন্দাদের প্রমাণ করতে বলা হয়েছিল তার আগের তিনটি প্রজন্ম জার্মান না ইহুদি ছিলেন। যদি তার আগের তিনটি প্রজন্ম ( দাদুর বাবা ও মা, দাদু + দিদিমা, মা + বাবা) জার্মান তাহলে তিনি ও জার্মান। যদি সবাই ইহুদি তাহলে তিনি ও ইহুদি। আর যদি আগের কোনো এক প্রজন্ম জার্মান ও ইহুদি এর মিশ্রণ হয় তাহলে, তাকে "মিশেলিং" বলা হতো। মিশেলিং এর অর্থ মিশ্রজাতি। শুধুমাত্র ইহুদি ধর্ম টাই যে হিটলার ঘৃনা করতো তা নয়। কারণ সে সময় প্রচুর ইহুদি বংশোদ্ভুত রা ক্রিশ্চান ধর্ম মূলত প্রোটেস্ট্যান্ট ক্রিশ্চান ধর্মে ধর্ম পরিবর্তন করেছিল। তাতেও তারা ছার পায়নি। তাদের পূর্ব প্রজন্ম কে খুঁজে খুঁজে বের করা হয়েছিল।
পরবর্তী তে এই শ্রেণীবিভাগ সম্পূর্ন হলে ইহুদি ও মিশেলিং দের বিভিন্ন সরকারি সুবিধা, এমনকি সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত করে হয়। এদের বাচ্ছাদের জার্মান বাচ্চাদের সঙ্গে স্কুলে পড়াশোনা নিষিদ্ধ হয়। এই জাতির কেউ ডাক্তার হলে সে জার্মান রোগী দের চিকিৎসা করতে পারবে না বলে ঘোষণা করা হয়। ইহুদি শিক্ষক রা পাবলিক স্কুল থেকে বিতাড়িত হন। বিয়ের উপর হয় নিষেধাজ্ঞা। এরা বিয়ে করতে চাইলে সরকারের কাছে নথি দিয়ে প্রমাণ করতে হতো তারা নিজেদের জাতির মধ্যেই বিয়ে করছেন। সব থেকে আশ্চর্য্যের বিষয় হিটলার জার্মান বাসী কে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে এটাই ঠিক, এটাই জার্মানির বিকাশ এর জন্য দরকার। তৎকালীন জার্মান রা ঢেলে সমর্থন করেছিল হিটলার কে তার এই দেশভক্তি দেখে। জার্মান জাতি র প্রতি এই উগ্র ভালোবাসা দেখে। ইহুদি দের প্রতি উগ্র ঘৃনা দেখে।
এবার ভাবুন, এক ই ভাবে ফ্যাসিষ্ট বিজেপি সরকার ও তাদের পৃষ্ঠপোষক আরএসএস মনে করে ভারতবর্ষ শুধুমাত্র হিন্দু জাতির বসবাসের জায়গা আর তাই এই সরকার আমাদেরও তিন পুরুষের কাগজ দেখতে চাইছে। হিটলার যেমন অ-জার্মান দের খুঁজে বের করতে চেয়েছিল আজ বিজেপি অ-হিন্দু খুঁজে বের করতে চাইছে আর সেটা শুধুমাত্র ধর্ম দেখে না হিটলারের মত একইভাবে আমাদের পূর্ব পুরুষের ঠিকুজি কুষ্টি দেখে। যে একজন ইসলাম ধর্মের মানুষ বা ক্রিশ্চান ধর্মের মানুষ শুধুমাত্র ধর্ম পরিবর্তন করে হিন্দু হয়েও এই গভীর চক্রান্তের হাত থেকে মুক্তি পাবেন না। একবার এই শ্রেণী বিন্যাস সম্পূর্ন হলেই, আর কেন্দ্রে মেজরিটি ক্ষমতা পেয়ে গেলেই হিন্দুরাষ্ট্রের ঘোষণার মাধ্যমে অহিন্দু সকলের উপর নেমে আসবে একই রকম হিটলারিয় বিধি নিষেধ। প্রথমে মুসলিম দের উপর, পরে অন্য অহিন্দু ধর্মের উপর। তারা পাবেন না সরকারি চাকরি, তারা তাদের বাচ্ছা দের সরকারি স্কুলে পড়াতে পারবেন না, তারা সরকারি হাসপাতালে যেতে পারবেন না। তারা হিন্দু মেয়ে বা ছেলে কে বিয়ে করতে পারবেন না এরকম কতো কিছু নিয়ম তাদের উপর চাপানো হবে। এখন ই "লাভ জিহাদ" আখ্যা দিয়ে হিন্দু মুসলিম ছেলে মেয়ে দের মধ্যে সম্পর্ক কে নিষিদ্ধ ঘোষণা শুরু করে দিয়েছে। হিটলার তো শুধু এখানেই থামেন নি। ইহুদি দের দেশ বিরোধী আখ্যা দিয়ে তাদের জার্মানি ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছিল, ঠিক যেমন আজ মোদী বাহিনী মুসলিম দের দেশবিরোধী আখ্যা দিয়ে পাকিস্তান বা অন্য কোথাও চলে যেতে বলে। ইহুদি দের কয়েক হাজার লাইব্রেরী ও বই পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল ইহুদি ইতিহাস কে মুছে ফেলার জন্য। ঠিক যেভাবে আজ বিজেপি ইতিহাস কে মুছে ফেলার জন্য ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য পরিবর্তন ও ভুল ইতিহাস পড়ানোর চেষ্টা করছে। হিটলার এর এই কাজ যেমন সেইসময় জার্মান রা সমর্থন করেছিলেন এটা বিশ্বাস করে যে হিটলার ই হলেন একমাত্র দেশভক্ত, ইহুদি রা জার্মানি র শত্রু আজ একইভাবে ভারতের বেশীর ভাগ হিন্দু মোদীর এই উগ্র দেশভক্তি ও উগ্র হিন্দুত্ববাদ দেখে তাকে বিশ্বাস করছেন ও ঢেলে সমর্থন করছেন আর ভাবছেন মুসলিম রাই তাদের শত্রু। আসল সত্য কিন্তু অন্য।
হিটলার দেশদ্রোহী ইহুদি দের দেশ ছাড়তে বললেও যারা দেশ ছেড়ে যেতে পারেন নি তাদের শহরের বাইরে নির্দিষ্ট এলাকায় চলে যেতে বলা হয়। যেগুলোকে ঘেটো বলা হতো। সেই ঘেটো গুলো কে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হতো যাতে তারা জার্মান দের সঙ্গে মেলামেশা করতে না পারে। মোদী সরকার ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিরাট বিরাট জায়গা নিয়ে, বিশাল বিশাল নুতন জেলখানা বানিয়েছে তাদের জন্য যারা এই NRC CAA আইনে ভারতীয় নয় বলে গণ্য হবে বা ভারত ছেড়ে যেতে পারবে না তাদের জন্য। কি মিল দেখতে পাচ্ছেন!! ঘেটোগুলোতে ইয়ং ইহুদি দের নাৎসি পুলিশের পাহারায় বেগার খাটানো শুরু হলো। মোদী ও এই নুতন তৈরী জেলখানা গুলিতে এই অভারতীয় আখ্যা পাওয়া লোক গুলো কে তো আর এমনি এমনি বসিয়ে খাওয়াবে না, ওই হিটলারি কায়দায় পুলিশ দিয়ে চাবুক মেরে বিনা পারিশ্রমিকে খাটতে বাধ্য করাবে।
এর পর হিটলার দেখলো শুধু আলাদা করলেই হলো না এদের বরং ধংস করে ফেলা দরকার। ১৯৪১ এ ইহুদি দের প্রশ্নে "ফাইনাল সলিউশন" হিসাবে প্রায় ১ কোটি ১০ লক্ষ ইহুদি দের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন। শুরু হলো হলোকাস্ট। হলোকাস্ট শব্দের অর্থ ই আগুনে পুড়িয়ে মারা। প্রথমে লাখ লাখ বৃদ্ধ আর বাচ্ছা দের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হলো। পরে সেই লাশ আগুনে পুরিয়ে দেওয়া হলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রে। আর ইয়ং দের রেখে দেওয়া হলো গরু ছাগল রাখার মতো একটা শোয়ার জায়গা দিয়ে, যাদের সারাদিন বিভিন্ন রাস্তা ঘাট ও বিল্ডিং তৈরীতে বা কলকারখানায় খাটানো হতো শুধুমাত্র দিনের শেষে একটুকরো পাউরুটির বিনিময়ে। একটু এদিক ওদিক হলেই বা একটু দুর্বল বা বয়স এর ভার দেখা গেলেই সবার সামনে গুলি করে মেরে ফেলা হতো। ঠিক যেমন এখন বিজেপি "গোলি মারো সালো কো" আওয়াজ তুলছে। অর্থাৎ, আইন বলে কিছু থাকবে না। পুরোটাই শাসকের ইচ্ছায় শাস্তি। মানবাধিকার বলে কিছু থাকবে না, কথায় কথায় গুলি করে দেওয়া যাবে এরকম ই একটা হিটলারি শাসন চাইছে এই বিজেপি। হিটলারি কায়দার প্রতিটি ধাপ যেভাবে ধাপে ধাপে মিলে যাচ্ছে, তাতে ভয় হয়, এদের আসল লক্ষ্য সমস্ত অহিন্দু জাতি মুসলিম, ক্রিশ্চান শিখ বা মিশ্র ধর্মের লোকজন দের সমূলে নিধন করা নয় তো? এদের মূল লক্ষ্য আবার একটা হলোকাস্ট নয় তো?
যদিও হলোকাস্ট এর বিভৎসতা র ( প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি কে হত্যা করা হয়েছিল) জন্য আজ জার্মান জনগণ নিজেদের কে দায়ী ও অপরাধী ভাবে, নিজেরা লজ্জিত হিটলার কে সমর্থন করার জন্য। আর হিটলার এর পরিণতি? সে তো নিজের মাথায় গুলি করে সুইসাইড করতে বাধ্য হয় আর তার স্ত্রী সায়ানাইড খেয়ে সুইসাইড করতে বাধ্য হয় দ্বিতীয় যুদ্ধের ঠিক পরে পরেই ১৯৪৫ সালে। আজ জার্মানি তে হিটলার শব্দ টা উচ্চারণ করাটা ই অপরাধ। দেরীতে হলেও জার্মানরা তাদের ভুল বুঝেছেন। আমরা ভারতীয় রা একই ভাবে দেরী করে ফেলেছি না তো?
আপনার বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত । ইতিহাসের পাতায় এক অসামান্য মিলে দেখা যায় ১৯৩৫ সালের নুরেমবেরগ জাতিগত আইনের সঙ্গে আজকের CAA, NRCর সঙ্গে ।
তবে তথ্যগত ব্যাপারে কিছুটা ব্যাখ্যা দরকার । ইহুদি বিদ্বেষের জনক হিটলার নন সেটা এক হাজার বছরের ইতিহাস। তিনি শুধু এটাকে উচ্চাঙ্গের পর্যায়ে নিয়ে যান রক্ত সংমিশ্রণ সমস্যার যথার্থ জনক আরেক জার্মান ।
অইগেন ফিশার নামে এক জার্মান নৃতাত্ত্বিক জার্মান দক্ষিণ পশ্চিম আফ্রিকাতে এসে ( ১৯০৩-৪) হেরেরো জাতির কাটা মাথা নিয়ে তাঁর নিরীক্ষা শুরু করেন- আলোচ্য বিষয় ছিল কালো মানুষের চেয়ে শাদা ইউরোপিয়ানরা উচ্চ স্তরের মনুষ্য । সুপার ম্যান। তাঁর আরেক বিষয় ছিল জার্মান/আফ্রিকানার ও স্থানীয় মহিলাদের মিশ্রিত বিবাহের বর্ণ সঙ্কর সন্তান সন্ততি। তাঁর হিসেবে এই প্রজন্মের মেধা হবে নিম্ন মানের । এই ধরনের বিবাহ ক্ষতিকর । তাই হল । ১৯১২ সালে আফ্রিকার সমস্ত জার্মান কলোনিতে মিশ্র বিবাহ বে আইনি ঘোষিত হল ।১১ বছর বাদে হিটলার তাঁর আত্মজীবনীতে লিখলেন , “ উচ্চতর ও নিম্নতর প্রজাতির মিলনের সন্তান সন্ততি হবে নিম্নমানের “ ( একাদশ অধ্যায় জাতি ও জনতা -মাইন কাম্ফ )। এই দীর্ঘ অধ্যায়ে অইগেন ফিশারের নামটি তিনি করেন নি
নুরেমবেরগে রচিত আইনে যোগ করা হল ইহুদিদের । লক্ষণীয় সকল মিশলিং ( মিশ্রিত ) জাতিকে বঞ্চিত করা হয় নি । সেখানে আধা ইহুদী বা ৩/৮ ইহুদীকেও জার্মান নাগরিকত্ব দেয়া হল। কিন্তু পৌনে বা পুরো ইহুদি ( যারা এতদিন জার্মান ছিলেন) হারালেন নাগরিকত্ব । বিয়ের ব্যাপারটা অবশ্যই জটিল হল ।
সভ্য শিক্ষিত জার্মানরা এটাকে মেনে নিলেন । যেন এই রকমই হওয়া উচিত ।
এই আজ যেমন দেখছি এদেশে ।