এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • একুশে আইনের দেশ ভারতবর্ষ;কলকাতার এই রাস্তায় দেওয়া হতো প্রকাশ্যে ফাঁসি

    Debabrata Mondal লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৯ মার্চ ২০২১ | ১৭৪৫ বার পঠিত
  • এই বাংলার বুকেই একসময় দেওয়া হতো প্রকাশ্যে ফাঁসি আরও ভালোভাবে বলতে গেলে একসময়কার ভারতের রাজধানী কলকাতার বুকে প্রচলন ছিল এই প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ার। হ্যাঁ চমকে ওঠার মতোই ঘটনা বটে, প্রকাশ্যে ফাঁসি তাও আবার খোদ কলকাতার বুকে!

    রাজভবনের অদূরেই অবস্থিত একটা গলি, ওয়েলেসলি প্লেস থেকে সোজা চলে গেছে কাউন্সিল হাউজ স্ট্রিটের দিকে। কল্লোলিনী তিলোত্তমার সমস্ত ব্যস্ততা যেনো এক লহমায় থমকে গেছে এই গলির মধ্যে। ব্যস্ত অফিস টাইম হোক বা মনখারাপ করা বিকেল খাস কলকাতা শহরের মধ্যে অবস্থিত এই গলি জুড়ে সবসময় বিরাজ করে একরাশ অদ্ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা। সময়ও যেনো কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেছে এখানে, কলকাতার মধ্যে অবস্থিত হয়েও যেনো একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে থেকে গেছে ওয়েলেসলি প্লেস থেকে কাউন্সিল হাউজ স্ট্রিট পর্যন্ত বিস্তৃত এই গলিটা, যার বর্তমান নাম পান্নালাল সরণি।

    তবে কল্লোলিনী তিলোত্তমার কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা এই গলির ইতিউতি ছড়িয়ে আছে ইতিহাস। ব্রিটিশ সূর্য তখনও মধ্যগগনে। বেশিরভাগ দেশেই গড়ে উঠেছে ব্রিটিশ উপনিবেশ। এক সময় তাদের নজর পড়লো ভারতের মাটিতে। সাবর্ণ চৌধুরীদের থেকে একসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মাত্র ১৩০০ টাকার বিনিময়ে কিনে নেয় সুতানুটি গোবিন্দপুর এবং কলকাতা নামের তিনটি গ্রাম। কোম্পানির লক্ষ্য ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের বিপুল বিস্তার। ফলে ব্রিটিশদের হাতে পড়ে কিছুদিনের ভোল বদলাতে শুরু করলো কলকাতা। অন্যদিকে কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারলো হুগলি নদীর তীরে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূল প্রতিবন্ধকতা লুটতরাজ এবং জলদস্যুর প্রকোপ। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই লুঠতরাজ আর জলদস্যুদের দাপট কমাতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আনলো কড়া আইন। তবে সেই আইন যে শুধু দুষ্কৃতিদের ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হতো এমন নয়, বহু সাধারণ মানুষের প্রাণ যেত এই সর্বনেশে কানুনের কালো ফাঁদে। এমনকি অনেকক্ষেত্রে সাধারণ অপরাধের ক্ষেত্রেও ধার্য করা হতো মৃত্যুদণ্ড।

    ব্রিটিশ শাসন ভারতের বুকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় জমিদারদের প্রভাব প্রতিপত্তি প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে পর্যন্ত এই জমিদারদের মাধ্যমেই অনেকক্ষেত্রে ঠিক করা হতো শাস্তির নিদান। আর ঠিক এই ক্ষেত্রেই কলকাতার পান্নালাল সরণি উঠে আসে ইতিহাসের পাতায়। এই পান্নালাল সরণি আগে পরিচিত ছিল ফ্যান্সি লেন নামে। তবে শৌখিনতা নয়, ফাঁসি দেওয়া থেকেই কলকাতার এই রাস্তার নাম হয়ে ওঠে ফ্যান্সি লেন।

    সালটা ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ। ব্রজমোহন নামক প্রথম একজনের ফাঁসি হয় এই ফ্যান্সি লেনে। কিন্তু তার অপরাধ কি ছিল? সে নাকি অভিযুক্ত ছিল ঘড়ি চুরির অপরাধে, সেই সময়ে যে ঘড়ির দাম নির্ধারণ করা হয় মাত্র পঁচিশ টাকা। অর্থাৎ পঁচিশ টাকার মূল্য ব্রজমোহনকে চোকাতে হলো তার প্রাণ দিয়ে। ফাঁসির মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয় ফ্যান্সি লেনের মধ্যে থাকা বড়ো গাছকে। তবে সেই সময় যে শুধুমাত্র ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হতো তা নয়, তোপ দেগেও হত্যা করা হতো মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত অপরাধীদের। যে শাস্তির নিদান দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতেন দেশীয় জমিদাররা। রীতিমতো সালিশি সভা বসিয়ে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা করা হতো অপরাধীদের। এখানেই শেষ নয়, ফ্যান্সি স্ট্রিটে ফাঁসি দিয়ে বেশ কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখা হতো সেই মৃতদেহ। শাস্তির বহর দেখে অন্য কেউ যাতে সেই অপরাধ করতে সাহস না পায় তার ব্যবস্থা আর কি। পরবর্তীকালে কোম্পানির লোকেরা ফাঁসির আগে থেকেই প্রচার করতো ফাঁসির দিনক্ষণ। ফলে ফাঁসির দিন জনতার ঢল নামতো কল্লোলিনী তিলোত্তমার রাস্তায়। এরও পরে ওল্ড কাউন্সিল হাউজ স্ট্রিটে আলাদাভাবে তৈরি হয় ফাঁসির মঞ্চ, এবং এরপরই ফাঁসি দেওয়ার পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।

    শহর কলকাতাও কোনো একসময় সাক্ষী ছিল এমন মধ্যযুগীয় প্রথার, যেখানে প্রকাশ্য রাস্তায় মানুষকে ফাঁসি দেওয়ার মতো নারকীয় ঘটনা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তবে সাদা চামড়ার ইংরেজ অথবা তাদের চাটুকারদের জন্য এই আইন কোনোদিনই বলবৎ হত না। আইনের বাড়বাড়ন্ত দেখা যেত শুধুমাত্র কালো চামড়ার 'নেটিভ'-দের ক্ষেত্রে। ইংরেজরা 'ফাঁসি' শব্দটি উচ্চারণ করতে পারতো না ফলে কিছুটা বিকৃত হয়ে রাজভবনের সামনের এই রাস্তার নাম হয় 'ফ্যান্সি স্ট্রিট'। আইন কানুনের এই বহর দেখে পরিশেষে ব্রিটিশ অধিকৃত ভারত সম্পর্কে একটা কথায় বলা চলে -

    "শিবঠাকুরের আপন দেশে
    আইন-কানুন সর্বনেশে।"


    তথ্যসূত্র - 'কলকাতা' - শ্রীপান্থ
    বর্তমান পত্রিকা - ১ অক্টোবর ২০২০
    আনন্দবাজার পত্রিকা
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন