(গতকাল ১৬ই ফেব্রুয়ারি ছিল বিশিষ্ট বাঙ্গালী অ্যাস্ট্রোফিজিসিট ও সাহা আয়োনাইজেশন ইকুয়েশনের জনক মেঘনাদ সাহার মৃত্যুবার্ষিকি। তারও কিছুদিন আগে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ছিল আরেক বাঙ্গালী তাত্ত্বিক পদার্থবিদ ও বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান ও বোস-আইনস্টাইন কনডেন্সেটের উদ্ভাবক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর মৃত্যুবার্ষিকী। তারা দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। এই মাসে তাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষেই তাদের নিয়ে দুটো লেখা শেয়ার করছি। মেঘনাদ সাহা নিয়ে শেয়ার করছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় গণিত বিভাগের প্রেসিডেন্ট ও অধ্যাপক মোঃ শরিফ উদ্দিনের একটি প্রবন্ধ, আর সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে নিয়ে শেয়ার করছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব এর একটি প্রবন্ধ। দুটোই ণিকবার্তা প্রকাশনীর "কালপুরুষ : উপনিবেশ-পরবর্তী বাংলা গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।)
আলােকিত বিজ্ঞানী ও সমাজচিন্তক মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬) বিজ্ঞানের ইতিহাসে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। একজন বিজ্ঞানী, শিক্ষক, বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সফল প্রতিষ্ঠাতা, জনপ্রতিনিধি, চিন্তাবিদ এবং সমাজ সংস্কারক— এ ধরনের বহু অভিধায় তাঁকে পরিচিত করিয়ে দেয়া যায়। বহুগুণের সমন্বয় একজন মানুষের ভেতরে কীভাবে ঘটতে পারে, তার সবচেয়ে কাছের উদাহরণ মেঘনাদ সাহা। তিনি এ ঢাকার সন্তান, এ দেশের আলাে-বাতাসেই বেড়ে উঠেছেন। অবিভক্ত ভারতের ঢাকার শহরতলিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম এ পথপ্রদর্শক, দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীরা স্বীকার করেছেন জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে তার সে অবদানের কথা। তিনি পৃথিবীর সামনে ‘আনয়নের সমীকরণ’ রহস্য উন্মােচন করে কার্যত পৃথিবীখ্যাত বিজ্ঞানীদের সামনে ঘাের তৈরি করেন।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া মেঘনাদ সাহা তার সমকালের অন্যতম। একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী। পরবর্তীতে যার অনন্য গুণ আর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছেন পৃথিবীখ্যাত, নােবেল পুরস্কারজয়ী বিজ্ঞানীরাও। তৎকালীন বিজ্ঞানের গতিধারার সঙ্গে ভারতের বিজ্ঞানচর্চার একটি অপূর্ব সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানের জয়জয়কার ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা নেয়ার জন্য তাঁকে কল্পনাতীত সংগ্রাম করতে হয়েছে, প্রাথমিক পাঠ শেষ হওয়ার পর তাঁর মুদিদোকানি পিতা সন্তানের জন্য এর বেশি পড়াশােনায় আগ্রহ দেখাননি। শেষ পর্যন্ত শিক্ষকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় তার শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা পায়। এভাবে শেষ পর্যন্ত মেঘনাদ সাহাই তাঁর সমকালের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অনন্য উচ্চতায় আরােহণ করেন, নােবেল কমিতিতে অন্তত চারবার পেয়েছেন মনােনয়ন। সারা জীবনে পেয়েছেন অসংখ্য ফেলােশিপ ও সম্মাননা।
দেশে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান পড়ানাের হাতেখড়ি তাঁর হাত ধরেই। ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স, ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সােসাইটি প্রভৃতি বিশ্বমানের বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান তাঁর নেতৃত্বেই আলােয় আসতে পেরেছে। শুধু প্রবল আগ্রহ আর ইচ্ছাশক্তির জোরে গণিতের ছাত্র হয়েও শিখরে পৌঁছেছেন পদার্থবিদ্যায়; যার প্রমাণ মেলে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা যখন তার লেখা ‘টেক্সট বুক অব হিট’ বইটি আবশ্যক মনে করে পড়েন। রাজনীতিসচেতন এ বিজ্ঞানী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভারতের লােকসভার সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। উপমহাদেশে প্রথম বিগ ব্যাং, পারমাণবিক তত্ত্বের পরীক্ষণ সহজ করা যন্ত্র সাইক্লোট্রনের প্রতিষ্ঠাও হয়েছে তার হাতে।
নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় সমগ্র ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম হয়ে মাসিক ৪ টাকা বৃত্তিলাভ মেঘনাদের বড় হওয়ার মনােবল বাড়িয়ে দিয়েছিল সেই ছেলেবেলাতেই। এন্ট্রান্স ও উচ্চ মাধ্যমিকে পূর্ববঙ্গে প্রথম হওয়া ছিল তারই ধারাবাহিকতা। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় কলেজ ম্যাগাজিনে হ্যালির ধূমকেতু নিয়ে প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশ হয় তার। কথিত আছে, ভীষণ ঝড়বৃষ্টির মধ্যে জন্মেছিলেন বলে ঠাকুরমা তার নাম রেখেছিলেন মেঘনাথ, পরে স্কুলে ভর্তি হলে নাম হয় মেঘনাদ। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯১৩ সালে গণিতে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়ে বিএসসি পাস করেন মেঘনাদ। প্রেসিডেন্সিতে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় প্রমুখ ছিলেন তার সরাসরি শিক্ষক। বিএসসি পড়ার সময় সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে সরিয়ে রাখলেও নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু, বাঘা যতীন প্রমুখ বিপ্লবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল ধর্মীয় শ্ৰেণীবৈষম্যে বিরক্ত মেঘনাদের। বয়সে সুভাস চন্দ্র বসুর চেয়ে তিন বছরের বড় ছিলেন মেঘনাদ। ১৯১৫ সালে প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হয়ে এমএসসি পাস করেও টিউশনি ছিল তার উপার্জনের একমাত্র উপায়, কারণ মেঘনাদের সঙ্গে বিপ্লবীদের যােগাযােগ রয়েছে বলে সরকারের কাছে রিপাের্ট ছিল। কলকাতায় বিজ্ঞান কলেজে গণিতের প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স-মাস্টার্স না হয়েও বছর না পেরুতেই যােগ দেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে। পড়াতে পড়াতে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের ভালােবাসায় পড়ে যান মেঘনাদ সাহা।
কলকাতার ইউনিভার্সিটি কলেজ অব সায়েন্সের গণিত বিভাগে তিনি ১৯১৬ সালে প্রভাষক হিসেবে যােগদানের মধ্য দিয়ে প্রথাগত শিক্ষকতা জীবনে প্রবেশ করেন। প্রায় একই সময়ে একই কলেজে তার সহপাঠী সত্যেন্দ্রনাথ বসুও শিক্ষক হিসেবে যােগদান করেন। কিছুদিনের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং মেঘনাদ সাহা দুজনই গণিত বিভাগ ছেড়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যােগ দেন। তখন যদিও ওই কলেজটির কোনাে সমৃদ্ধ গবেষণাগার ছিল না, তবু শিক্ষকতার পাশাপাশি মেঘনাদ সাহা গবেষণায় আগ্রহ দেখান।
১৯১৭ সালে তিনি সিলেক্টিভ রেডিয়েশন প্রেসার বিষয়ে একটি দীর্ঘ আর্টিকেল রচনা করেন এবং জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান-বিষয়ক জার্নালে প্রকাশের জন্য পাঠান। কিছুদিন পর তাঁর গবেষণার একটি সংক্ষিপ্ত নােট জার্নালটিতে ছাপা হয়। ১৯১৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন। একই বছর তিনি তার গবেষণার (Harvard Classification of Stellar Spectra) জন্য প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২০ সালে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ওপর তার চারটি গবেষণা প্রবন্ধ ফিলােসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশ হয়। মূলত তিনি তার এসব গবেষণাপত্রে Thermal lonization তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। একই বছর তিনি তার এ গবেষণার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের Griffith Prize লাভ করেন।
প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি নিয়ে তিনি অধিকতর গবেষণার উদ্দেশ্যে দুই বছরের জন্য ইউরােপে পাড়ি জমান, আলফ্রেড ফুলারের সঙ্গে কয়েক মাস কাজ করার পর তিনি বার্লিনে যান পদার্থবিজ্ঞানী ওয়াল্টার নার্নেস্টের গবেষণাগারে গবেষণা অভিজ্ঞতাকে ঋদ্ধ করার জন্য। এর পর দেশে ফিরে ১৯২৩ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যােগদান করেন এবং পরবর্তী ১৫ বছর সেখানেই কাটান। এ দীর্ঘ সময়ে তিনি অসংখ্য পুরস্কারের জন্য মনােনীত হন এবং ১৯২৫ সালে তাঁকে ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেস অ্যাসােসিয়েশনের সভাপতি হিসেবে মনােনীত করা হয়। ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন। এ সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের এমএসসি সিলেবাসে নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যুক্ত করেন। সেখানে পরমাণুবিদ্যার ওপর স্নাতকোত্তর-পরবর্তী একটি কোর্স চালু করেন। একজন মহান বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি বহু প্রতিষ্ঠানের পত্তন করেছেন। তিনি কলকাতায় ১৯৩৫ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসােসিয়েশন, ১৯৫০ সালে ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স প্রতিষ্ঠা করেন। এবং তিনিই মূলত দামােদর ভ্যালি প্রজেক্টের প্রকৃত ডিজাইনার।
একজন বিজ্ঞানী এবং রাজনীতিসচেতন নাগরিক হিসেবে তিন ম্যাগাজিন পত্রিকা প্রকাশের গুরুত্ব অনুভব করেন। যেখানে বিজ্ঞান থেকে শুরু করে সমাজ, অর্থনীতি, পরিবেশসহ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বিজ্ঞজনদের লেখা প্রকাশ হবে। এভাবে বন্ধু এবং সহকর্মীদের সহায়তা তিনি সায়েন্স এবং কালচার নামে একটি মাসিক পত্রিকা বের করেন। পত্রিকাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে তার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সমাজের শিক্ষিত মানুষকে সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষার সংকট ও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সচেতন করা এবং সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে বের করা। তিনি তাঁর অনেক প্রবন্ধে দেখানাের চেষ্টা করেছেন একই সমস্যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশ কীভাবে সমাধান করেছে। যেহেতু তার সময়ের যােগাযােগের মাধ্যমগুলাে আজকের তুলনায় দুর্বল ছিল, সে সময়ও তিনি তার ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় এবং অন্যান্য প্রবন্ধে অভূতপূর্ব চমক দেখান। যেমন ধরা যাক, হাইড্রোলিক গবেষণাগার, ভারতের সেচ পদ্ধতির গবেষণা, দামােদর ভ্যালির পরিকল্পনা, ভারতের বহুমুখী নদী প্রকল্পের উন্নয়ন, জনগণের জন্য বিদ্যুতায়ন, তেল এবং অদৃশ্য সাম্রাজ্যবাদ, জাতীয় জ্বালানি নীতি ইত্যাদি।
ক্যালেন্ডার পুনর্গঠন ছিল তার জীবনের অন্যতম একটি বড় অবদান, তাকে ১৯৫২ সালে ক্যালেন্ডার পুনর্গঠন কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। এ সময় তিনি কঠোর পরিশ্রম করে ভারতের বিভিন্ন অংশের অন্তত ৩০টি ক্যালেন্ডার এবং পৃথিবীর ক্যালেন্ডারগুলাে অধ্যয়ন করেন। মেঘনাদ সাহার বিভিন্ন লেখা, তার বক্তৃতা এবং গবেষণা, ক্যালেন্ডার পুনর্গঠনে ভূমিকা, স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে বিভিন্ন কমিশনের নেতৃত্ব দেয়া এসবই এ বিজ্ঞানীকে একজন মহান সমাজ সংস্কারকের সারিতে স্থান দেয়।
মেঘনাদ সাহা তাঁর সারা জীবনের চিন্তা-গবেষণায় দেখিয়ে গেছেন যে, কীভাবে যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে শিক্ষা, বস্ত্র, ক্ষুধা এবং প্রযুক্তির অপ্রতুলতার সংকট কাটিয়ে উঠতে হয়। কীভাবে বিজ্ঞানের সুফল ঘরে তুলতে হয়। ভারতীয় উপমহাদেশ এবং বিশেষভাবে বাঙালির এ পরম ঘনিষ্ঠজনের অবদান আজো উপমহাদেশের মানুষকে আলাে দিয়ে চলেছে, করছে আলােকিত।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু (১৮৯৪-১৯৭৪)
দৃশ্যমান মহাবিশ্বের বয়স ১৪ বিলিয়ন বছরের কাছাকাছি। পদার্থবিজ্ঞানীরা এ মহাবিশ্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার কণা, শক্তি, তরঙ্গ— এ শব্দত্রয়ের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। তবে মনে রাখা ভালাে, কণা, শক্তি, তরঙ্গ— এ শব্দগুলাের দৈনন্দিন জীবনে যে অর্থ, তা কিন্তু সবসময় পদার্থবিজ্ঞানের ধ্যানধারণার সঙ্গে মেলে না। পদার্থবিজ্ঞানে কণা-তরঙ্গ দ্বৈততা (wave-particle duality) আছে, আছে ক্ষেত্রতত্ত্বে (field theory) শক্তিকণা আর বস্তুকণার ভেতরকার রূপান্তর, যা অহরহ ঘটে চলে। এ জগৎ যেন এক ছায়াজগৎ, যেখানে রূপান্তর ও সতত পরিবর্তনই মুখ্য, ‘আসল’ চেহারা নিয়ে কেউ যেন ধরা দিতে চায় না। হয়তাে আসল চেহারার ধারণাটিই নকল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ ছায়াজগতের বাসিন্দারা সদাপরিবর্তনশীল হওয়া সত্ত্বেও কিছু নিয়মনীতির বাঁধনে দৃঢ়বদ্ধ। শক্তি, কণা বা তরঙ্গ যে চেহারাতেই প্রতিভাত হােক না কেন, শেষ বিচারে মহাবিশ্বের সব মৌলিক উপাদানকে দুই ভাগে ভাগ করা চলে বােসন আর ফার্মিয়ন। এর কোনাে ব্যতিক্রম নেই। এ বােসন নামটি এসেছে বিখ্যাত বাঙালি পদার্থবিদ অধ্যাপক সত্যেন বােসের নামানুসারে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অভিধানে বােসন শব্দটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গুটিকয়েক শব্দের অন্যতম। বছরখানেক আগে হিগস্ বােসন নিয়ে মাতামাতি আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি।
অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ (সত্যেন) বসু ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষা ও পারিবারিক জীবন নিয়ে বেশ লেখালিখি হয়েছে। পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু ও মা আমােদিনী বসুর সাত সন্তানের ভেতর সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রথম। দুই পুরুষ ধরে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত এ পরিবারটিতে একই সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বিলেতি সংস্কৃতির প্রভাব দেখা যায়। সত্যেন বসু ১৯০৯ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশােনা শুরু করেন। শৈশব থেকেই প্রতিভাবান সত্যেন বসু প্রেসিডেন্সি কলেজে এসে সহপাঠী হিসেবে পান সাহাকে। মেঘনাদ সাহা কালক্রমে একজন শ্রেষ্ঠ বাঙালি পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। বসু ও সাহার ভেতর গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং তারা একত্রে বেশকিছু প্রকল্প নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান
সত্যেন বসু ১৯১৩ সালে বিএসসি ও ১৯১৫ সালে এমএসসি সমাপ্ত করেন। উভয় পরীক্ষায়ই তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। দ্বিতীয় স্থান ছিল মেঘনাদ সাহার। সে যুগেও চাকরি পাওয়া সহজ ছিল না। বসু ও সাহা দুজনকেই একটি বছর বেকার থাকতে হয়। এ দুঃসময়ে আশীর্বাদ হিসেবে উদয় হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি। তিনি রত্ন চিনতে ভুল করেননি। ১৯১৬ সালে বসু ও সাহা উভয়েই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসিক ১২৫ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেন।
বিংশ শতাব্দীর কুড়ির দশক পদার্থবিজ্ঞানের জন্য এক দারুণ সময়। প্ল্যাঙ্ক, বাের, আইনস্টাইন তাদের যুগান্তকারী সব আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে সাড়া জাগিয়েছেন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা তার শিকড় বিস্তার করছে। বােলৎসম্যান আর গিবস পরিসংখ্যানিক বলবিদ্যাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছেন। বিজ্ঞান জগজ্জুড়ে এক অতুলনীয় রােমাঞ্চ। এ পটভূমিতে বসু ও সাহা ছাত্রদের কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও আপেক্ষিক তত্ত্ব পড়াতে শুরু করেন।
১৯২১-এ সত্যেন বসু সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে রিডার (সহযােগী অধ্যাপক সমতুল্য) পদের জন্য আবেদন করেন এবং যােগদানের সুযােগ পান। বেতন মাসিক ৪০০ টাকা। বসুর ওপর দায়িত্ব বর্তায় তড়িৎগতিবিদ্যা ও তাপগতিবিদ্যা বিষয় দুটির। তাপগতিবিদ্যা পড়াতে গিয়েই বসু প্ল্যাঙ্কের বিকিরণতত্ত্বে অন্তর্গত এক অসংলগ্নতা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্ল্যাঙ্কের যুগান্তকারী বিকিরণতত্ত্বে শােষিত ও বিকিরিত আলােকে বিচ্ছিন্ন শক্তিকণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে শক্তি ঘনত্বের জন্য রাশিমালায় একটি প্রাক-গুণিতক (pre-factor) নিণয় করা হয়েছে আলােকরশ্মিকে নিরবচ্ছিন্ন তরঙ্গ কল্পনা করে। এ অসঙ্গতি সম্পর্কে আইনস্টাইনসহ আরাে কিছু বিখ্যাত পদার্থবিদ সচেতন ছিলেন। তবে এ ত্রুটি দূর করার কোনাে উপায়ই তারা খুঁজে পাননি। সত্যেন আলােককণাগুলােকে (ফোটন) সমরূপ (indistinguishable) বিবেচনা করে সমাহারতত্ত্বের (combinatorics) একটি চমৎকার প্রয়ােগ করেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল প্রাক-গুণিতকটি নিরূপণে দশা-স্থানের (phase-space) একটি ক্ষুদ্রতম আয়তনের ধারণা। সত্যেন বসু বললেন, এ ক্ষুদ্রতম হচ্ছে h3, যেখানে h হচ্ছে প্ল্যাঙ্কের ধ্রুবক। অধ্যাপক বসুর এ ধারণা উদ্দীপ্ত ভাবনার (inspired thinking) একটি শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। সংক্ষেপে বলা যায়, বসু প্ল্যাঙ্কের বিকিরণতত্ত্বের এমন একটি বিকল্প প্রতিপাদন পেশ করেন যা অন্তর্নিহিত অসংলগ্নতা থেকে মুক্ত। বসুর এ আবিষ্কার কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিকসের সূচনা।
বসু তার কাজটি বিলেতের ফিলােসফিক্যাল ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য প্রেরণ করেন ১৯২৪ সালের প্রথম দিকে। পত্রিকার সম্পাদক প্রায় ছয় মাস পর প্রকাশনার অনুপযুক্ত বলে তা ফেরত পাঠান। সত্যেন বসু হতােদ্যম হননি। তিনি আইনস্টাইনের শরণাপন্ন হলেন এবং তাকে অনুরােধ জানালেন। প্রবন্ধটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে সাইটশ্রিফট ফুর ফিজিকে প্রকাশের উদ্যোগ নিতে। প্রবন্ধের তাৎপর্য বুঝতে আইনস্টাইনের বেগ পেতে হয়নি । তিনি অকপটে স্বীকার করলেন, প্রবন্ধটি পদার্থবিজ্ঞানে এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। জার্মান ভাষায় অনূদিত প্রবন্ধটি বসু ও আইনস্টাইনের যৌথ নামে দ্রুত ১৯২৪ সালেই প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধটির শিরােনামের ইংরেজি অনুবাদ Planck's Law and Light-Quantum Hypothesis. বিজ্ঞানজগৎ এক নতুন পরিসংখ্যানের সঙ্গে পরিচিত হয়, যা আজ বসু-আইনস্টাইন স্ট্যাটিস্টিকস নামে বিজ্ঞানের ছাত্রদের কাছে অবশ্যপাঠ্য। এ পরিসংখ্যান যেসব কণা মেনে চলে তাদের বােসন বলা হয়। যত দিন বিজ্ঞান আছে, তত দিন বােসন নামটির ভেতরে সত্যেন্দ্রনাথ বসু অমর হয়ে থাকবেন। এর পর ১৯২৬ সালে দুই বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ফার্মি ও ডিরাক আরেকটি কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিকসের ধারণা প্রকাশ করেন, যা ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিকস নামে পরিচিত। এ পরিসংখ্যান ফার্মিয়নদের জন্য প্রযােজ্য। ফার্মিয়নরা পাউলির বর্জননীতি মেনে চলে, অন্যদিকে বােসনরা বর্জননীতির তােয়াক্কা করে না
সত্যেন বসুর এ আবিষ্কার বিশ্বমানচিত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশিষ্ট আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। বােসের এ আবিষ্কার বিংশ শতাব্দীর অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ আবিষ্কার বললে ভুল হবে না। বােসের এ আবিষ্কারের পথ ধরেই বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবনের (Bose-Einstein condensation) ধারণা পাওয়া যায়। ধারণা থেকে ল্যাবরেটরিতে বাস্তবতায় রূপ নিতে বসু-আইনস্টাইন ঘনীভবনের সময় লাগে প্রায় ৭০ বছর। আবিষ্কারকারীরা নােবেল পুরস্কার লাভ করেন।
প্রকৃতপক্ষে বসুর এ আবিষ্কারের পূর্ণ তাৎপর্য তখনকার পদার্থবিজ্ঞানীরা পুরােটা অনুধাবন করতে পারেননি। এমনকি আইনস্টাইন নিজেও নন। প্লাঙ্কের সূত্রের প্রতিপাদনের ক্ষেত্রে বসু প্রাক-গুণিতক নির্ণয় করতে গিয়ে প্রথমে যা পান, তা ঈপ্সিত মানের অর্ধেক। বসুকে এ মানটির সঙ্গে দুই গুণ করতে হয়। এ দুইয়ের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বসু ফোটনের স্পিনের ধারণা সামনে নিয়ে আসেন। কিন্তু স্পিনের ধারণা আইনস্টাইন পছন্দ করেননি। তিনি পােলারাইজেশনকে ভিত্তি করে দুই সংখ্যাটিকে সামনে নিয়ে আসেন। কিছুদিন পর বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, ফোটনের স্পিন আছে এবং বসু সঠিক পথেই ছিলেন। ফোটনের স্পিনের মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা বসুর হাতছাড়া হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বসু দুঃখ করে বলেছেন, ‘বুড়ো কেটে দিল, একটা পার্টিক্যালের আবার পােলারাইজেশন কি রে?।' আইনস্টাইনের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধাবােধ থেকেই বসু এ ব্যাপারে কখনাে উচ্চবাচ্য করেননি। আজীবন আইনস্টাইন বসুর কাছে ছিলেন পরম আরাধ্য।'
১৯২৪ সালের আবিষ্কার সত্যেন বসুর জন্য প্রথিবী উন্মুক্ত করে দেয়। ১৯২৫ সালে ইউরােপ ভ্রমণের সুযােগ আসে। তিনি ফ্রান্সে মাদাম কুরির গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। ডি-ব্ৰগলির গবেষণাগারেও কাজ করার সুযােগ পান। সংস্পর্শে আসেন ল্যাঞ্জেভাঁর মতাে বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের। কিছু সময় জার্মানিতে কাইজার ভিলহেলম ইনস্টিটিউটে কাজ করেন এক্স-রে নিয়ে। ঢাকায় ফিরে তিনি নিজ বিভাগে একটি এক্স-রে ক্রিস্টালােগ্রাফি ল্যাবরেটরি গড়ে তােলেন।
অধ্যাপক সত্যেন বসু পদার্থবিজ্ঞানের অনেক শাখায় কাজ করেছেন । প্রথম দিকে মেঘনাদ সাহার সঙ্গে কাজ করেছেন চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানকালে কাজ করেছেন কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান ও কোয়ান্টাম পরিসংখ্যান নিয়ে। এছাড়া কাজ করেছেন গাণিতিক পদার্থবিদ্যা ও একীভূত ক্ষেত্রতত্ত্ব নিয়ে। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোয়ান্টাম স্ট্যাটিস্টিক্যাল মেকানিকসে তাঁর অবদানই তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
সত্যেন বসুর বর্ণাঢ্য জীবনের বিভিন্ন দিক অল্প পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দুটি ঘটনার উল্লেখ করে এ লেখার ইতি টানব। ১৯৪৫ সালে অধ্যাপক বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে কলকাতায় ফিরে যান। সেখানে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারতের বিভিন্ন আইআইটিতে অধ্যাপক বসু সিলেকশন বাের্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। যােগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের ব্যাপারে তিনি আপসহীন ছিলেন। একবার একটি প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং জনৈক প্রার্থীর নিয়ােগের জন্য সর্বশক্তি প্রয়ােগ করেন। সত্যেন বসুকে টলানাে যায়নি। বরং সত্যেন বসু এমন ব্যবস্থ নিয়েছিলেন যে, ভারতে আইআইটিগুলােয় নিয়ােগ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের সংশ্লিষ্ট হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় ঘটনা অনেক সময় আগের। ১৯২৬ সালে সত্যেন বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক বিভাগের জন্য আবেদন করেন। এক্সপার্ট হিসেবে ছিলেন নােবেল বিজয়ী আর্নল্ড সমারফেল্ড। সমারফেন্ডের বিবেচনায় প্রথম পছন্দ হিসেবে সত্যেন বসু স্থান পাননি! অথচ আজকাল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলােয় অতি সহজেই সবাই অধ্যাপক হচ্ছেন। যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় একটি বড় ধরনের অধঃপতন ঘটে গেছে।
অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ৮০ বছর বয়সে কলতায় পরলােকগমন করেন। সত্যেন বসু বাঙালি বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণার নিরন্তর উৎস।