এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আমাদের ছোটবাড়ি

    Bandana Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ নভেম্বর ২০২০ | ১৯৩৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • আমাদের ছোটবাড়ি

    আমি যখন ছোট ছিলাম সংসারে সব জড়, স্থাবর, অস্থাবর পদার্থ ছিল পরিবারের সদস্য, তাদের একটা করে নাম ছিল, নিজস্ব পরিসর, কর্তব্য, স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল। ফুলকাটা কাঁসার বাটি মানে মাঝারি মাপের, নীচে একটু টোল খাওয়া, বাবার রাতে দুধ খাওয়ার বাটি – সে কাজ অন্য কোন কাঁসার বাটি দিয়ে হবে না। বড় বাড়ি মানে আমাদের সাত পুরুষের মিত্র বাড়ি আর নববসু লেন এ আমার দাদার (ঠাকুর্দার) কেনা মাঠ ও বাগান শুদ্ধু দোতলা বাড়িটি ছিল ছোট বাড়ি – প্রবীণতার দাবীতে বরাবর এক পা পিছিয়ে রইল সে।

    আমাদের ছোট বাড়ি ছিল একটা ছোট দোতলা টালির ছাদ ছাওয়া বাড়ি, আসল রঙ ছিল গোলাপি, রোদে বৃষ্টিতে জ্বলে পুড়ে শ্যাওলা মেখে সারা গায়ে কেমন একটা মায়াবী রূপকথা রঙের আস্তর পড়ে গিয়েছিল। আমার শৈশবের রঙ তাই শ্যাওলামাখা সবজেটে রঙ জ্বলে যাওয়া বিষণ্ণ মনকেমন করা গোলাপি। পূর্বমুখী বাড়ির সামনে ফাঁকা খোলামেলা রেললাইন দোতলার জানলা বরাবর লাইন পাতা। মালগাড়ি চলত যখন বাড়ি কাঁপত থরথর করে, শোবার ঘরের লাল সিমেন্টের মেঝে ফেটে ফুটিফাটা হয়ে গিয়েছিল। ফাটলের ভেতর ছিল পিঁপড়ের বাসা – মেঝেতে ফ্রক পরে পড়তে বসে লাল পিঁপড়ের কামড়ে ফুলে লাল হয়ে যেত দুই পা। পাশাপাশি দুটো ঘর দোতলায় – শোবার ঘরকে ডাকি বড় ঘর আর পাশের টুকটাক কাজের ঘরটিকে ছোট ঘর । দরজার মাপে লোহার শিক বসানো জানলা, ফ্রেঞ্চ উইন্ডো ধাঁচে, সবুজ কাঠের পাল্লায় খড়খড়ি দেওয়া। কিছু। ঘরের মগডালে হলদে কড়িকাঠ, একটু উই ধরেছে, বাবা সময় পেলে কেরোসিন দিয়ে উই ছাড়াবে। লম্বালম্বি ছটা কড়ি, মাঝে বারোটা করে কাঠ - দেখে দেখে প্রথম নামতা শিখি, যোগ বিয়োগ গুণ শিখি, আমার প্রথম পাটিগণিত বই - বড় ঘরের কড়িকাঠ । সন্ধেবেলা দেওয়ালে মোটা

    মোটা টিকটিকি দেখে ভয় পাই, মাঝে মাঝেই বারান্দার কোণে মৌমাছির চাক, বোলতা বাসা বাঁধে, শিউলিগাছ থেকে শুয়োঁপোকা উড়ে এসে পড়ে, খালি পায়ে হাঁটলে পায়ে শুঁয়ো ফুটে যায়, মা ব্লেড দিয়ে চেঁছে দেয়। ছুটির দিনে ছোটছাদে খেলতে বসি ডাক্তারি সেট নিয়ে – আবিস্কার করি, ডেটলের খালি শিশিতে জল ঢাললে সাদা হয়ে যায়, তাতে আলতা ঢেলে হয় গোলাপি। সুলেখা কালির শিশি থেকে কয়েকফোঁটা নিয়ে নীল, লুচিপাতা ছেঁচে সবুজ, আলতা আর কালি মিশিয়ে বেগুনি , ডেটলজল আর কালি মিশিয়ে আকাশি নীল – হোমিওপ্যাথির খালি শিশিতে সাত আট রঙের ওষুধ ঢেলে জুতোর বাক্সে গুছিয়ে রাখি। আমাদের ঘর দুটো ঘিরে সমকোণে লাল সিমেন্টের বারান্দা, বারান্দার ওপর টালির ছাদ – দুয়েক জায়গায় ভাঙা, বৃষ্টি পড়লে ছাঁট আসে। পশ্চিমে ছোট ছাদ রান্নাঘর আর ভাঁড়ার ঘরের ওপরটা জুড়ে , দক্ষিণে পাঁচিল ঘেরা মাঠ, আমাদের মাঠ হলেও পাড়ার ছেলেরা ফুটবল খেলে বিকেলবেলা। একতলায় এক চিলতে বারান্দা, একধারে সিমেন্টের বেদী, সবুজ রঙ করা কাঠের মজবুত দরজা পেরিয়ে বাইরের ঘর , ঘরে কয়েকটা বইএর আলমারী, পুরোনো কাঠের চেয়ার আর একটা ভাঙা স্প্রিং দেওয়া খাট, তার ওপর উঠে লাফালাফি করলে কেউ তেমন কিছু বলে না। বাইরের ঘরের পাশের বড়সড় ঘরটাকে বলা হত খাবার ঘর । চওড়া ইঁটের চুনকাম করা নীলচে সাদা দেয়াল, মাঝে মাঝে চুন সুড়কি খসে নানা অজানা দেশের ম্যাপ হয়ে গেছে। কালো সিমেন্টের মেঝে, ব্লটিং কাগজের মত ভেপসে গর্ত গর্ত হয়ে গেছে, চক দিয়ে আঁক কাটতে ভারি আরাম, শতরঞ্জের ছক কেটে আমি নামতা লিখি, মেঝেটা জলমাখা ন্যাকড়া দিয়ে ভিজিয়ে নিলে জ্বলজ্বল করে আখরগুলো। মা রান্নাঘরে তোলা উনুনে কড়া বসিয়ে খুন্তি নাড়তে নাড়তে উঁচু গলায় পড়া ধরে, না পারলে উঠে এসে ঢিপিয়ে দেয় দুমদাম।

    খাবার ঘর থেকে বেড়িয়ে রোয়াক যার ডাক নাম রক, একধাপ নামলে উঠোন। পাশ দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়, মাথার ওপর খোলা আকাশ, বৃষ্টি পড়লে জল জমে যায় উঠোনে। আনন্দে কাগজের নৌকো ভাসাই, জল থিতিয়ে গেলে নেতিয়ে পড়া কাগজ নৌকার মৃতদেহ নালির মুখ থেকে উদ্ধার হয়। উঠোনে সিঁড়ির তলায় একরত্তি চৌবাচ্চা, কয়েক বালতি জল ভরলেই ভর্তি হয়ে যায়। সংসারের পাঁচটা কাজে লাগে । রোববার সে চৌবাচ্চার পাপস্খালন করা হত ব্লিচিং পাউডার ও সমার্জনী সহযোগে। – আমার খুব মজা, হাঁটু জল থাকতে থাকতে সেই চৌবাচ্চাকে দেশি বাথটব বানিয়ে ঝাঁপা ঝাঁপি করা খানিকক্ষণ । উঠোনের একপাশে ছোট ছোট ভাঁড়ার ঘর ও রান্না ঘর – বেশি বৃষ্টি হলে রান্নাঘরে জল উঠে যায় । বাড়ির পিছনে লাগোয়া পোড়ো জমি, যাকে আদর করে বলা হয় বাগান, পাঁচিল ঘেরা। তার এককোণে কুয়ো, সিমেন্ট বাঁধানো, তার ডাক নাম পাতকো। মাঝেমাঝেই বালতি পড়ে যায় দড়ি ছিঁড়ে – লোক ডাকা হয়। আঙুলের মত বাঁকা একগোছা লোহার আঁকড়ি – যার ডাক নাম কাঁটা, জলে ফেলে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাছ ধরার কায়দায় বালতি ধরা হয়। উত্তাল সত্তরের দশকে আমাদের কুখ্যাত পাড়ায় আগুনে কিশোর ও তরুণেরা নিরিবিলি বাড়ির সদর পাঁচিল ডিঙিয়ে কোণাকুণি মাঠ বাগান পেরিয়ে খিড়কি পাঁচিল টপকে পালাতো পুলিশের তাড়া খেয়ে, মা জেনেও জানত না, বাবা বাড়ি ফিরে না শোনার ভান করত।

    একসময় সামনের মাঠে শুরু হল ভিত খোঁড়া, ছোট বাড়ি বড় হবে, জ্যেঠু, মামণি ছোদ্দিভাই আসবে, এখন থেকে নতুন ঘরের ওপরের ছাদ হল বড় ছাদআর পশ্চিমের ছাদ হল ছোট ছাদ। দোতলায় থাকার সুবাদে আমি ফাউ পেলাম বড় ছাদটাকে। ঘরের চেয়ে বেশি সময় কাটতে লাগল ছাদে । বড় ছাদের পশ্চিম দিক ঢেকে দাঁড়িয়ে একটা মহানিম গাছ , ছোট ছোট ফলগুলো ঠিক মিনিয়েচার আম। বাগানে অজস্র বুনো ঝোপঝাড়, অযত্নে বেড়ে ওঠা ভারি সুবাসযুক্ত গন্ধরাজ আর অবাক করা স্থলপদ্মের গাছ, সকালবেলা কুঁড়ি খুলে ধবধবে সাদা ফুল, যত বেলা বাড়ে গোলাপীর ছোঁয়া লাগে, দুপুর বেলা বেবি পিঙ্ক, বিকেল হলে টকটকে লাল রঙে রাঙা হয়ে শুকিয়ে যায়, যতবার দেখো, রূপ বদলায়। এছাড়া পেয়ারা গাছ, ছোট ছোট কষ্টানো পেয়ারা, মুখে তুলে থু থু করে ফেলে দিতে হয়। ডুমুরপাতা ঘসতে হয় শুঁয়োপোকা লাগলে, তুলসীপাতা খেতে বেশ, ঝাঁঝ ঝাঁঝ, জ্যেঠুর লাগানো গোলাপ – লাল, মভ, সাদা – যে ডালে পাঁচটা পাতা সে ডালে কুঁড়ি আসে, সাতটা পাতার ডালে কুঁড়ি ধরে না। মিস্টি গন্ধের বেলফুল, ডবল টগর, ঝিম ঝিম গন্ধের হাস্নুহানা । ছুটির দিনে সকাল নটায় উঁকি মারি, নাইন ও ক্লক ফুটল কিনা ! শিউলিগাছ ছিল থিক থিক শুঁয়ো পোকা ভর্তি – ছাদে উড়ে এসে পড়ত, ম্যগনোলিয়া গাছ ছিল, খুব যত্ন করা হত – একদিন ফুল ফুটবে ! সে ফুল ফোটা আর দেখা হয় নি। কলাগাছ ছিল একটা, তবে গাছের কলা খেয়েছি বলে মনে পড়ে না। বাগান ঘেঁসে কলতলা, ওপরে টালির ছাদ, ফাঁক দিয়ে গায়ে টুকরো রোদ এসে পড়ে, রাতের বেলা গা ধুতে এলে ভয় করে, ভাঙা জানলা দিয়ে ওপারে বাগানের থিকথিক অন্ধকার, বাইরে লাগানো টিমটিমে হলদে বাল্বের আলো, ছাদ আর দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়েছে, নীচে অবধি পৌঁছোয় নি, আধো অন্ধকারে নীচের চৌবাচ্চা থেকে জল তুলে গায়র ঢালি আর ভয়ে ভয়ে থাকি, দক্ষিণ আকাশে হিংস্র দাঁড়া মেলা অতিকায় কাঁকরাবিছেটা টালির ফাঁক দিয়ে এই বুঝি ঢুকে পড়ল কলতলার ঘেরাটোপে।

    গরমের ছুটির দুপুরবেলা সব দরজা জানালা বন্ধ করে মা ঘুমোয়। ঘরটা আলো আঁধারে কেমন ফিসফিস করে যেন। জানলার ফাঁক দিয়ে আলো চুঁইয়ে পড়ে, কিন্তু ভাল করে দেখা যায় না আমি মেঝেতে বসে, জানলার ধাপে গল্পের বই রেখে একহাতে খড়খড়ি তুলে অন্য হাতে ডালমুট খেতে খেতে গল্পের বই পড়ি। বই দুই প্রকার, বড়দের বই, যেগুলো আমার পড়া মানা আর ছোটদের বই মানে – রুশদেশের উপকথা - খুদে ইভান বড় বুদ্ধিমান । সুখলতা রাও এর গল্প আর গল্প, জয়ন্ত মাণিক, বিমল কুমার এর অ্যাডভেঞ্চার, সন্দেশ, শিশুসাথী, শুকতারা । বইএর পাতার ঘটনাগুলো ঘটে চলে আমাদের ছোটবাড়ির আনাচে কানাচে – সিঁড়ির নীচে, কলতলায়, বাগানে, কুয়োতলায়, রেললাইনের পাহাড়ে, জঙ্গলে , রেললাইন পেরিয়ে ঐ যে ছোট ছোট খুদে খুদে বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে তার কোথাও একটায়। সুবার্বন রিডিং ক্লাব থেকে বাবা আমার জন্য দুটো, মার জন্যে দুটো বই নিয়ে আসে। আমার দুটো বই শেষ করতে দুদিন লাগে, মার দু সপ্তাহেও হয় না। তাই লুকিয়ে মার বই পড়ি, ধরা পড়লে বকুনি খাইনা, একটু হাসাহাসি হয়। আমাদের ছোটবাড়িতে আনাচে কানাচে ডাঁই করে রাখা কতকালের পুরোনো ধুলো মাখা বই, উল্টেপাল্টে দেখার কি রোমাঞ্চ - দেখি চেনা অচেনা কাছের দূরের কত নাম, কোন তামাদি হয়ে যাওয়া সাল – বইএর ওপর খুদি খুদি লিখে রাখা । ছেঁড়াখোঁড়া শারদীয়া দেবসাহিত্য কুটির, পড়তে দেখি গল্পের শেষটা উধাও, মন খারাপ হয়ে যায়। আবার কোনদিন অন্য বই ঘাঁটতে গিয়ে পেয়ে যাই সেই অসমাপ্ত গল্পের ছেঁড়া পাতা, সাতরাজার ধন একমাণিক। রঙিন ছবিওলা কাশিদাসী মহাভারত পড়তে পড়তে সবার সামনে বাবাকে জিগ্যেস করে বসি "রজস্বলা মানে কি?" অপ্রস্তুত বাবা মার মুখের দিকে চায়, বুঝতে পারি কিছু ভুল হয়ে গেছে। তবে ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ মহাভারত পড়তে বারণ করে না কেউ, ক্লাসিকে দোষ নেই, তখনকার বিশ্বাস! আবছা আবছা বুঝি রতি, শৃঙ্গার, ঋতু, বীর্য ইত্যাদি শব্দের মানে জানতে চাওয়া চলবে না। এ ও বুঝি যে সত্যিই বড়দের বই বলে কিছু আছে।

    শীতকালে সূর্য দক্ষিণ কোণে সরে যায়, লাল মেঝের ওপর তেরছা করে রোদ পড়ে, জানলার লোহার শিকের ছায়া শুদ্ধ, আমি বই খাতা নিয়ে রোদের সঙ্গে সরে সরে যাই। পশ্চিমের ছোটছাদে দুপুরবেলা আমার তাঁবু পড়ে – বুক সমান পাঁচিলে কোণাকুণি লেপ মেলে দেওয়া হয়েছে রোদে, নীচে মাদুর পেতে, বালিশ বুকে – পায়ের পাতা রোদে বেড়িয়ে, ছায়ায় বাকি শরীর, সামনে খোলা কম্বল নিরুদ্দেশ বা হট্টমালার দেশে বা মিতুল নামে পুতুলটি – সঙ্গে জিভ জ্বলে যাওয়া ডালমুট, বেশি ঝাল লাগলে মিস্টি কমলালেবু। কোয়া ছাড়িয়ে ওপরটা দাঁত দিয়ে কেটে হালকা চাপে উলটে দিলে কমলালেবু প্রজাপতি হয়ে যায়! বিকেল চারটে বাজতে না বাজতেই রোদের তেজ নিভে আসে, মা তাড়া দেয় সোয়েটার পরতে, দিন শেষ হয়ে যায়। আর বর্ষা কালে সবচেয়ে মজা। পুরোনো দরজা জানলা যতই বন্ধ করোনা কেন কাঠের ফাঁকফোকর দিয়ে বৃষ্টির জল ঢুকবেই ঘরে, জানলার ধারে বসে খড়খড়ি তুলে বৃষ্টি দেখা, কত রকমের আলপনা আঁকে বৃষ্টির ধারা, কখনো সোজা, তীব্র , কখনও তেরছা, ঝিরঝিরে , কখনও মনে হয় কমা সেমিকোলন ফুলস্টপ কে যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছে চারদিকে। ছাদের ওপর বর্ষার ফোঁটা টুপ করে পড়েই যেন জলের পাপড়ি মেলে ফুল ফুটছে। বেশি বৃষ্টি হলে আলো থাকে না, হ্যারিকেন জ্বেলে সন্ধে বেলা ঘরে বসে পড়ি। মৃদু আলোর গন্ডী পেরোলেই চাপা অন্ধকার, দেয়ালে আঙুলের ছায়া ফেলে পাখি বানাই, হরিণ বানাই আর মনে মনে বলে চলি – মনে পড়ে ঘরের কোণে মিটি মিটি আলো
    চারিদিকের দেয়াল জুড়ে ছায়া কালো কালো
    বাইরে কেবল জলের শব্দ ঝুপ ঝুপ ঝুপ ---
    ঘুম পেয়ে যায় তড়াতাড়ি, কেরোসিন ফুরিয়ে যায়, মা বলে খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ো, কাল সকালে উঠে পড়বে। শুয়ে শুয়ে শুনি ঝিঁ ঝিঁ র একঘেয়ে ঝন ঝন ডাক, ব্যাঙের গ্যাঙর গ্যাং ডাক, পোকা মাকড়ের কটকট ডাক রেললাইনের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে বন্ধ জানালার ওপারে রেললাইনের জঙ্গলে পাতার ওপর বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ , কাঠের ফাঁক দিয়ে সজল হাওয়া শরীরে কদম্ব ফোটায় । কি ভাল লাগে ! ভাইয়ার কাছে শোনা যত হাড় হিম ভুতের গল্প মনে পড়ে যায়, মা ঘুমোয়, বাবা ঘুমোয়, বোন ঘুমোয় – আমি একা জেগে থাকি, ভয়ে মাথা মুখ মুড়ি দিয়ে। বড় হয়ে শুনেছি সেই গান – অশ্বথ পল্লবে বৃষ্টি পড়িয়া/ মর্মর শব্দে /নিশীথের অনিদ্রা দেয় যে ভরিয়া – দেবব্রত বিশ্বাসের সমুদ্রস্বরে – যতবার শুনি, ছেলেবেলা ফিরে আসে। বর্ষা তাই আজও আমার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু।

    আষাঢ় পূর্ণিমায় রথযাত্রা, দোতলা কাঠের রথ সাজাই গন্ধরাজ ফুল, রেললাইনের ধার থেকে তুলে আনা বনতুলসী ফুল, আর বাগানের ডালপালাশুদ্ধ পাতা দিয়ে, এবড়ো খেবড়ো মাঠের পথে চলতে চলতে দড়ির টানে জগন্নাথ, বলরাম সুভদ্রা রথের ওপর টলমল করেন। শ্রাবণ মাসে রাখি পূর্ণিমা, ভবতারণ ঠাকুর রাখি দিয়ে যায় আগের দিন, জরির ফিতেয় তুলোর বল আটকানো, মাদুলির মত হাতে পরি। এরপর কালো মেঘ রঙ পালটায়, চোখ ধাঁধানো নীলরঙে ছেয়ে যায় আকাশ, নীলকান্ত, ইন্দ্রনীল এমন বিশেষণ বসিয়ে শরতকালের রচনা লিখি স্কুলের খাতায়। মন ভাল হয়ে যায়। সকালে উঠে মনে হয় সত্যি ই রোদে সোনালী ছোঁয়া, দুহাতের পাতা একসঙ্গে করে মুখ ঢাকি, লালচে আভায় হাত ভরে যায়, স্থলপদ্ম ফুটতে শুরু করে, শিউলির গন্ধ , রোজ ভোরবেলা মনে হয় আজ একটা খুব আশ্চর্য ঘটনা ঘটবে। ভোররাতে বাথরুমে যেতে বাইরে বেরিয়ে দেখি কালপুরুষ তার সব অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে ঝুঁকে আছে আমাদের ছাদের ওপর, সাথে থাকে প্রভুভক্ত লুব্ধক - গায়ে কাঁটা দেয়, তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে ঝুপ করে শুয়ে পড়ি। দেখতেদেখতে পূজো এসে যায়।

    এভাবে চলতে থাকে, বাড়ি বুড়ো হয়, আমি বড় হই । শৈশবের মায়াজাল কেটে গেলে বুঝি স্মৃতি সততই সুখের হয় না। কালের নিয়মে পথ বেঁকে যায় অন্যদিকে। ছোটবাড়ি তার লোলপ্রাংশু দেহ নিয়ে অপেক্ষা করে - আজ বাদে কাল প্রোমোটারের বুলডোজার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেবে টালির ছাদ ছাওয়া , বড় বড় সবুজ খড়খড়ি তোলা জানলাশুদ্ধ শ্যাওলা ধরা বিষণ্ণ গোলাপি রঙের ইমারত ।

    যত দিন যায় বুকের মধ্যে এক লুকোনো ক্যানভাসে উজ্বল থেকে উজ্বলতর হয় আমাদের ছোটবাড়ি – সেই রঙ মুছবে, সে সাধ্য কারো নেই।

    বন্দনা মিত্র
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ০৮ নভেম্বর ২০২০ ০৮:৪৯99748
  • কি মায়াময় শৈশব! কি অপূর্ব লেখনি! 


    এই লেখায় আজকের সকালটা আরও উজ্জ্বল হলো। ব্রেভো...

  • Pragga Moushumi | ০৮ নভেম্বর ২০২০ ১২:১৪99754
  • কমায় মুড়িয়ে ছোট ছোট মনে পড়া যেন একেকটা তারা ফুটিয়ে দিলেন। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন