(১)
শহর কলকাতায় জন্ম আমার। পুরোনো দিনের পার্টিশনড হয়ে যাওয়া একটা ছোট্ট দোতলা বাড়িতে। তখনো পার্টিশন এর পাঁচিল ওঠে নি। তাই তিনখানা সংসারের বারো ঘর আর একখানা উঠোন থাকলেও সিঁড়ি ছিল তিনখানা। এর মধ্যে যে সিড়িটা সবচেয়ে পুরোনো, একমাত্র সেটা দিয়েই তিনতলায় ওঠা যেত। এক একটা তলায় ওঠার জন্য সে সিঁড়িটার ছিল তিনখানা বাঁক। সেই তিনটে বাঁক পেরিয়ে একতলা থেকে দোতলায় উঠেই সামনের আয়তাকার চাতালটাকে তখন বলা হত “সাজা’। যার একদিক দিয়ে ঘরে ঢোকা যেত। সেই সাজায় ছিল দুখানা জানলা। সেই রঙিন কাঁচের খিলান মাথায়, দুখানা করে পেল্লায় পাল্লা। গোটা সিঁড়িটায় থাকতো একটা আবছা অন্ধকার। তখন সিঁড়ির ওপরে দিয়ে কোনো আলোর ব্যবস্থা আমরা দেখিনি অন্তত।
আমাদের অংশের বাড়িটার ছাদে ওঠার জন্য ছিল ঘোরানো লোহার সিঁড়ি। শরীরকে যতটা সম্ভব সোজা করে নিয়ে উঠতে হত ছাদে। যদিও ছোটোবেলায় ওই লোহার সিঁড়ির ধাপে বসেই চলতো আমাদের খেলাধুলো।
আমাদের একতলা থেকে দোতলায় ওঠার সিঁড়িখানা ছিল উঠোনের এক পাশ দিয়ে। একবারেই উঠে গেছিল দোতলার বারান্দায়। মাথার ওপরে খোলা আকাশ। সে সিঁড়ির একদিকে পাশের বাড়ির দেয়াল আর রেলিঙের দিকে উঠোন। সিঁড়ির দেয়ালের একটু ওপরে গুটিয়ে রাখা থাকতো একটা ত্রিপল। যাকে আমরা তখন টের্পল-ই বলতাম। ঘোর বর্ষায় সেই ত্রিপল খুলে টাঙানো হত উঠোন জুড়ে। সাবেকি কলকাতার বাড়িগুলো ঘুরলে এখনো হয়তো দেখা যাবে এমন একেকখানা খাড়াই সিঁড়ি।
এই সমস্ত সিঁড়ি নিয়েই কতো দেখা না-দেখার স্মৃতির উপাদান আজও। কতোদিনের খেলার স্মৃতি। হাফ-প্যান্ট থেকে ফুল-প্যান্ট কিংবা ফ্রক থেকে শাড়ির কতো না রোমাঞ্চিত নির্জন দুপুর। যৌথ পরিবারের চলাচলের মধ্যে কতোই না আনন্দের হিল্লোল। আবার কখনো কখনো সিঁড়ির একেবারে ওপরের ধাপগুলোয় বিষাদের জলধারা। সবকিছু হারিয়ে গেল আমাদের এই নতুন কলকাতায়। সিসিটিভি’র কঠিন দৃষ্টি আজকালকার ফ্ল্যাটের সিঁড়ির প্রতিটা ধাপে। ঠোঁটে ঠোঁট রাখার সেই রোমাঞ্চিত দিনগুলো কোথায় যে হারিয়ে গেল !
চিৎপুর রোড আর বিবেকানন্দ রোডের যেখানে মিশেছে সেইখানে গণেশ টকিজ। আর আশে। পাশে অনেকগুলো বড়ো বড়ো বাড়ি। ঢের পুরোনো। কারা সেখানে থাকত, কত সালে তৈরি তা, সব ঠিকঠাক জানাও যায় না। বাড়ির বাসিন্দা বদলেছে। চারপাশের পরিস্থিতি বদলেছে। যে পথে পালকি চলত, সেখানে এখন ট্রামলাইনেও জং ধরেছে। শুধু ইমারৎটি রয়ে গেছে। আরো কিছু বছর পরে তাও থাকবে কিনা সন্দেহ।
তেমনি একটি বাড়ি লোহিয়া মাতৃসদন।
একটু গল্পে যাই...
কার ছিল এই বিশাল প্রাসাদটি ? মাতৃসদন তো পরের যুগের কথা।
“কালের অনন্ত লীলা নাহি বোঝা যায়।
কালের প্রভাবে দেখ কিবা শোভা পায়।
শ্রীকৃষ্ণ মল্লিকের এই প্রাসাদরতন।
হল আদি প্রদ্যুম্নের লীলানিকেতন।”
এই বাড়ির পৈঠার ধাপে (পৈঠা মানে সিঁড়ি) নাকি একসময় লেখা ছিল এই পয়ারি ছত্রগুলি। বাড়িটি যে একদা মল্লিক বাড়ি ছিল—তার প্রমাণ দেয় এই ছত্রগুলি। শ্রীকৃষ্ণ মল্লিকের সাহস, বাবুয়ানি সবই ছিল আকাশছোঁয়া। বিশাল বাড়ি বানানোর পরেও আশ মেটেনি। ঠিক করলেন, লাটসাহেবের সিংহদুয়ারের মতো হবে তাঁর বাড়ির সদর দুয়ার। কিন্তু অনুমতি মিলল না আদালতের। লাট সাহেব আর বাঙালিবাবু কি সমমর্যাদার? শ্রীকৃষ্ণ মল্লিক লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত দৌড় দেন। জেতেনও। সিংহদুয়ার গড়েই তবে শান্ত হন। একজন। সিংহদুয়ার গড়ার অনুমতি পেতে মামলা চালাচ্ছেন কালাপানির ওইপারের বিলেতে! নিছক বাবুয়ানি দিয়ে একে ব্যাখ্যা করা মুস্কিল। অর্থের আর তার দেমাক, লালমুখো লাটসাহেবের সমান হয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা—যাই হোক না কেন, এইসব গল্প শহরের ইতিহাসকে আরো রঙিন করে।
তবে, সুখ সইল না বেশিদিন। বিপর্যয় নেমে এল। অর্থের অভাবে হরেন্দ্রকৃষ্ণ শীলকে বাড়ি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলেন। মাতৃসদন হওয়ার আগে অবধি বাড়িটি হরেন শীলের বাড়ি হিসেবেই পরিচিত ছিল। সুবর্ণবণিক সমাজের কৃতি মানুষ হরেন শীল। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে বিশেষ পারদর্শী। বাংলাভাষায় লিখতেন খেয়াল সঙ্গীত। কথা, সুর দুটোই দিতেন। তাঁর ছেলে উমাপতি ছিলেন সেতারবাদক ও কীর্তনীয়া। শ্রীরাধাদামোদর কীর্তন সমাজের কাণ্ডারি ছিলেন তিনি। হরেন শীলের আমলে অনেক বড়ো বড়ো সঙ্গীতকারদের আনাগোনা থাকত সেখানে। দিলীপ কুমার মুখোপাধ্যায়, গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের পায়ের চিহ্ন মিশে আছে এই বাড়ির ধুলোয়। অর্থাৎ শুধু অর্থ, প্রতিপত্তির দিকে ছুটে যায়নি শীল পরিবার। তাকে ছাপিয়ে অন্য এক জীবনের খোঁজ ছিল।
তবে, হরেন শীল ও তার পরিবারও বেশিদিন সেই বাড়ির মালিকানা ভোগ করেনি। শ্রীকৃষ্ণ মল্লিকের বংশধর প্রদ্যুম্ন মল্লিক ফের সেই বাড়ির দখল নেন। একবাড়ি, তার বাসিন্দা অনেক। আর পরবর্তীকালে তা হয়ে গেল মাতৃসদন। আরো অনেকগুলো প্রজন্মের সাক্ষী।
“আমার রাজার বাড়ি কোথায় কেউ জানে না সে তো;
সে বাড়ি কি থাকত যদি লোকে জানতে পেত।
রুপো দিয়ে দেয়াল গাঁথা, সোনা দিয়ে ছাত,
থাকে থাকে সিঁড়ি ওঠে সাদা হাতির দাঁত”। রাজার বাড়ি – শিশু - রবীন্দ্রনাথ
ছোটবেলার সেই কবিতা। সুর করে পড়া। মাথাটাও যেন দুলে দুলে উঠত এসব কবিতার ছন্দে-গন্ধে।
বরানগরে এসে দেখলাম খাদ্য আন্দোলনের চরম বিক্ষোভ। তখন ক্লাস ফাইভ।
উচ্চ-মাধ্যমিক দেবো যখন মাথার মধ্যে বাম রাজনীতির ভাসা ভাসা পরিচয়। প্রোলিতারিয়েত আর বুর্জোয়া’র অর্থ জানার তীব্র আগ্রহ। নকশাল আন্দোলন আস্তে আস্তে ঢিমে। সেই সময় একদিন হাতে এল কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য’র কবিতা ‘সিঁড়ি।
“আমরা সিঁড়ি,
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে;
তোমাদের পদধূলিধন্য আমাদের বুক।
পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন।
তোমরাও তা জানো,
তাই কার্পেটে মুড়ে রাখতে চাও আমাদের বুকের ক্ষত
ঢেকে রাখতে চাও তোমাদের অত্যাচারের চিহ্নকে
আর চেপে রাখতে চাও পৃথিবীর কাছে
তোমাদের গর্বোদ্ধত, অত্যাচারী পদধ্বনি।
তবুও আমরা জানি,
চিরকাল আর পৃথিবীর কাছে
চাপা থাকবে না।
আমাদের দেহে তোমাদের এই পদাঘাত।
আর সম্রাট হুমায়ুনের মতো
একদিন তোমাদেরও হতে পারে পদস্থলন।।
এ কবিতার পংক্তিতে পংক্তিতে সেই দ্বন্দমূলক ভাবনা বোঝার সূচনা। কবিতার মাধুর্য তখন আঠারো বছরের দুরন্ত যৌবনে যেন বিপ্লবের ডাক। এক বছর আগেই প্রাপ্তবয়স্কের ভান।
অভিধান আজকাল হাতের নাগালেই। গুগুলের পাতায় পাতায়। তাই সিঁড়ি’র ‘সি’ লিখতে না। লিখতেই চলে আসে কতো না-জানা তথ্য। যেমন -
সিঁড়ি, সিঁড়ী – (বিশেষ্য পদ) - সোপান, পইঠা, মই, নামা-ওঠার জন্য ধাপ। ইত্যাদি।
বা
সিঁড়ি - (noun) - staircase; ladder; stair; stair way; mount।
একটু গভীরে যেতে গেলেই ইংরেজী ভরোসা, এখনো ! তাই যেতেই হয়।
শব্দটার ইংরেজি অর্থ “stair” | ওল্ড ইংরেজিতে "সিঁড়ি" শব্দটি হবে "stǣger"। এই শব্দটার উৎস জার্মান থেকে। এবং ডাচ শব্দ “steiger” এর সাথে ইংরেজি শব্দটার ভারী। মিল। আর এই ডাচ্ শব্দটির অর্থ হল "আরোহণ"।
পুরাতন ইংরেজিতে "সিঁড়ি" শব্দটি হবে "stǣger" - জার্মানিক উৎসযুক্ত একটি শব্দ যা ডাচ্ শব্দ "স্টাইগার" এর সাথেও সম্পর্কিত, যার অর্থ "আরোহণ"। অদ্ভুত ব্যাপার দেখুন, এই সিঁড়ি’র সাথে যদি আমরা পাতি ‘স্কেল’ (যেটা দিয়ে প্রচুর মাথায় মার খেয়েছি উচ্চারণে ভুল হলেই, ছেলেবেলায়) শব্দটার যোগাযোগ খুঁজতে চেষ্টা করি, সেখানে পাই ল্যাটিন ভাষায় সিঁড়ি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত পরিভাষা হল “scala”, কি মিল ! তাই না ?
খ্রিঃপূঃ ১ম শতাব্দীতে মার্কাস ট্রিভিয়াস পোলিও নামে এক রোমান লেখক যিনি আবার স্থপতি, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার এবং সামরিক প্রকৌশলীও ছিলেন তিনি একখানা প্রামান্য বই | লেখেন। যার নাম “De architectura”
(Manuscript of Vitruvius; parchment dating from about 1390; the Wolbert H.M. Vroom Collection, Amsterdam (on exhibition in Brussels).
এই প্রাচীন গ্রন্থে ভিট্রভিয়াস উল্লেখ করেছেন যে ল্যাটিনের বহুবচন “scalaria” শব্দটি “escalera” (স্পেনীয় – “এসকালেরা”), “escada” (পর্তুগিজ – “এস্কাডা”) অথবা “escalier ” (ফরাসী - "এস্কালিয়ার") শব্দগুলির পূর্বসূরীই।
কতো কি-ই না জানার আছে বলুন তো!
সিঁড়ি নিয়ে লিখতে লিখতে মন দৌড়চ্ছে এই “De architectura” বইটার ব্যাপারে। কিঞ্চিৎ যদি জানা যেত।
শুনুন তবে। স্থাপত্য বিদ্যার ইতিহাসে এই বইটি একটা মাইলস্টোন বলা যায়। ভিট্রভিয়াস এই গ্রন্থখানি উৎসর্গ করেছিলেন তখনকার রোমান সম্রাট অগাস্টাস’কে। কি উদ্দেশ্য ছিল তাঁর ? না, যাতে মহান সম্রাটকে এই স্থাপত্যবিদ্যা সম্পর্কে কিছুটা অবহিত করা যায়। সম্রাট যাতে বুঝতে পারেন যে একটা বাড়ি বা প্রাসাদ তৈরি করতে গেলে কি কি উপাচার দরকার।
পেট্রি লিউককোনেনের মতে এই বইটি রেনেসাঁর প্রথম দিক থেকে শিল্পী, চিন্তাবিদ এবং স্থপতিদেরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, তাদের মধ্যে লিওন বটিস্তা আলবার্তি (১৪০৪-১৪৭২), লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) এবং মাইকেলেঞ্জেলো (১৪৭৫-১৫১৫) উল্লেখযোগ্য। ভিট্রভিয়াসের মতে, স্থাপত্য হ’ল প্রকৃতির একটি অনুকরণ। পাখি এবং মৌমাছিরা যেমন বাসা তৈরি করে, তেমনি।
*আরো জানতে চাইলে উইকিপিডিয়া দেখতে পারেন। *(https://en.wikipedia.org/wiki/Vitruvius#cite note-Vitruvius, Pollio 1960-23)
(২)
“পাষাণে ঘটনা যদি অঙ্কিত হইত তবে কতদিনকার কত কথা আমার সোপানে সোপানে পাঠ করিতে পারিতে। পুরাতন কথা যদি শুনিতে চাও, তবে আমার এই ধাপে বইস; মনোযোগ দিয়া জলকল্লোলে কান পাতিয়া থাকো, বহুদিনকার কত বিস্মৃত কথা শুনিতে পাইবে।
আমার আর-একদিনের কথা মনে পড়িতেছে। সেও ঠিক এইরূপ দিন। আশ্বিন মাস পড়িতে আর দুই-চারি দিন বাকি আছে। ভোরের বেলায় অতি ঈষৎ মধুর নবীন শীতের বাতাস। নিদ্রোখিতের দেহে নূতন প্রাণ আনিয়া দিতেছে। তরু-পল্লব অমনি একটু একটু শিহরিয়া উঠিতেছে।
ভরা গঙ্গা। আমার চারিটিমাত্র ধাপ জলের উপরে জাগিয়া আছে। জলের সঙ্গে স্থলের সঙ্গে যেন গলাগলি। তীরে আম্রকাননের নীচে যেখানে কচুবন জন্মিয়াছে, যেখান পর্যন্ত গঙ্গার জল গিয়াছে। নদীর ঐ বাঁকের কাছে তিনটে পুরাতন ইঁটের পাঁজা চারি দিকে জলের মধ্যে জাগিয়া রহিয়াছে। জেলেদের যে নৌকাগুলি ডাঙার বাবলাগাছের গুড়ির সঙ্গে বাঁধা ছিল সেগুলি প্রভাতে জোয়ারের জলে ভাসিয়া উঠিয়া টলমল করিতেছে — দুরন্তযৌবন জোয়ারের জল রঙ্গ করিয়া তাহাদের দুই পাশে ছল ছল আঘাত করিতেছে, তাহাদের কর্ণ ধরিয়া মধুর পরিহাসে নাড়া দিয়া যাইতেছে”।
চেনা যাচ্ছে ? সিঁড়ির ধাপ নিয়ে কি অসাধারণ বর্ণনা। গল্পগুচ্ছে’র প্রথম গল্প। ঘাটের কথা’। এটি প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকার কার্তিক ১২৯১ সংখ্যায়। পল্লীগ্রামের একটি সাধারণ মেয়ের সারাটা জীবনকে রবীন্দ্রনাথ কি অসম্ভব নিপুনতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
“যে মেয়েটির কথা বলিতেছি ঘাটের অন্যান্য মেয়েরা তাহাকে কুসুম বলিয়া ডাকিত। বোধ করি কুসুমই তাহার নাম হইবে। জলের উপরে যখন কুসুমের ছোটো ছায়াটি পড়িত, তখন আমার সাধ হইত সে ছায়াটি যদি ধরিয়া রাখিতে পারি, সে ছায়াটি যদি আমার পাষাণে বাঁধিয়া রাখিতে পারি; এমনি তাহার একটি মাধুরী ছিল। সে যখন আমার পাষাণের উপর পা ফেলিত ও তাহার চারিগাছি মল বাজিতে থাকিত, তখন আমার শৈবালগুল্মগুলি যেন পুলকিত হইয়া উঠে......”
“কিছুদিন পরে কুসুমকে আর দেখিতে পাই না। ভুবন আর স্বর্ণ ঘাটে আসিয়া কাঁদিত। শুনিলাম তাহাদের কুসি-খুশি-রাক্কুসিকে শ্বশুরবাড়ি লইয়া গিয়াছে। শুনিলাম, যেখানে তাহাকে লইয়া গেছে, সেখানে নাকি গঙ্গা নাই। সেখানে আবার কারা সব নূতন লোক, নূতন ঘরবাড়ি, নূতন পথঘাট। জলের পদ্মটিকে কে যেন ডাঙায় রোপণ করিতে লইয়া গেল”।
“ক্রমে কুসুমের কথা একরকম ভুলিয়া গেছি। এক বৎসর হইয়া গেছে। ঘাটের মেয়েরা কুসুমের গল্পও বড়ো করে না। একদিন সন্ধ্যার সময়ে বহুকালের পরিচিত পায়ের স্পর্শে সহসা যেন চমক লাগিল। মনে হইল যেন কুসুমের পা। তাহাই বটে, কিন্তু সে পায়ে আর মল বাজিতেছে না। সে পায়ের সে সংগীত নাই। কুসুমের পায়ের স্পর্শ ও মলের শব্দ চিরকাল একত্র অনুভব করিয়া আসিতেছি — আজ সহসা সেই মলের শব্দটি না শুনিতে পাইয়া সন্ধ্যাবেলাকার জলের কল্লোল কেমন বিষন্ন শুনাইতে লাগিল, আম্রবনের মধ্যে পাতা ঝরঝর করিয়া বাতাস কেমন হা হা করিয়া উঠিল।
কুসুম বিধবা হইয়াছে”।
‘কুসুম বিধবা হইয়াছে’ এ যেন সেই বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা ‘শোলে’র সেই কার্ট-শর্ট। যেখানে সঞ্জীবকুমার এর মৃতদেহ তার গ্রামের শুন্য বাড়িতে ফিরে আসছে। একটা খণ্ড দৃশ্য। অথচ কি বেদনাময়! তেমন করেই রবীন্দ্রনাথ ছবিখানা এঁকে দিলেন তাঁর ছোটোগল্পের প্রথম গল্পে।
এর পরে গল্পে এক সন্ন্যাসীর আগমন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন...
“......কোথা হইতে গৌরতনু সৌম্যোজ্জ্বলমুখচ্ছবি দীর্ঘকায় এক নবীন সন্ন্যাসী আসিয়া আমার সম্মুখস্থ ঐ শিবমন্দিরে আশ্রয় লইলেন। সন্ন্যাসীর আগমনবার্তা গ্রামে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। মেয়েরা কলসী রাখিয়া বাবাঠাকুরকে প্রণাম করিবার জন্য মন্দিরে গিয়া ভিড় করিল।”
“ক্রমে একদিন কুসুমও আসিয়া সন্ন্যাসীর পা ছুঁলো। তারপর…”
“......সন্ন্যাসী তাহাকে যেমন উপদেশ করিতেন সে অবিকল তাহাই পালন করিত। প্রত্যহ সে মন্দিরের কাজ করিত — দেবসেবায় আলস্য করিত না — পূজার ফুল তুলিত — গঙ্গা হইতে জল তুলিয়া মন্দির ধৌত করিত।
সন্ন্যাসী তাহাকে যে-সকল কথা বলিয়া দিতেন, আমার সোপানে বসিয়া সে তাহাই ভাবিত। ধীরে ধীরে তাহার যেন দৃষ্টি প্রসারিত হইয়া গেল, হৃদয় উদ্ঘাটিত হইয়া গেল। সে যাহা দেখে নাই তাহা দেখিতে লাগিল, যাহা শোনে নাই তাহা শুনিতে লাগিল। তাহার প্রশান্ত মুখে যে একটি ম্লান ছায়া ছিল, তাহা দূর হইয়া গেল। সে যখন ভক্তিভরে প্রভাতে সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে লুটাইয়া পড়িত, তখন তাহাকে দেবতার নিকটে উৎসর্গীকৃত শিশিরধৌত পূজার ফুলের মতো দেখাইত। একটি সুবিমল প্রফুল্লতা তাহার সর্বশরীর আলো করিয়া তুলিল।”
ক্রমে বসন্তকাল এল। কুসুমের মন চঞ্চল। হৃদয়ে মৌমাছির গুঞ্জরন। সন্ন্যাসী অবশেষে প্রশ্নের জবাবদিহিতে জানতে পারলেন যে কুসুম তাঁহাকেই স্বপ্নে দেখেছে।
এ কথা শোনার পর সন্ন্যাসী কুসুম’কে বলেন...
"তবে আমি চলিলাম।"
“কুসুম আর কিছু না বলিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল, তাঁহার পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইল। সন্ন্যাসী চলিয়া গেলেন।
কুসুম কহিল, "তিনি আদেশ করিয়া গিয়াছেন তাঁহাকে ভুলিতে হইবে।" বলিয়া ধীরে ধীরে গঙ্গার জলে নামিল”।
“...... চাঁদ অস্ত গেল, রাত্রি ঘোর অন্ধকার হইল। জলের শব্দ শুনিতে পাইলাম, আর কিছু বুঝিতে পারিলাম না। অন্ধকারে বাতাস হুহু করিতে লাগিল; পাছে তিলমাত্র কিছু দেখা যায় বলিয়া সে যেন ফু দিয়া আকাশের তারাগুলিকে নিবাইয়া দিতে চায়।
আমার কোলে যে খেলা করিত সে আজ তাহার খেলা সমাপন করিয়া আমার কোল হইতে কোথায় সরিয়া গেল, জানিতে পারিলাম না”।
গল্প শেষ হয়। গঙ্গার ধারে সেই সিঁড়ি অপেক্ষা করতেই থাকে আরো নতুন কোনো গল্পের।
“বিফল প্রেমিকা একা নেমে যায় অবতরণের শেষ ধাপে ;
বড় অবসন্ন এই চলে যাওয়া,
রেলিংয়ে হাতের মুঠি খুলে—
যেন ভেসে যায় কোনো জলমগ্ন মানব-শরীর, জলাশয়ে
নীল ঝাঁঝি জলজ গুল্মের নীচে অন্ধকার শীতল শয়নে…
প্রথম দিনের মতো উজ্জ্বল মুখের কোনো প্রিয়-সম্ভাষণ,
মিষ্ট কলস্বর আর থাকে না সিঁড়িতে ;
বিপরীতে শব্দহীন হাওয়া ঘুরে যায়...
ঘরের ভিতরে আছে অদৃশ্য এমন সরোবর ;
জলের কিনার ছুঁয়ে আঁকাবাঁকা হলুদ সাপের মতো একা
ডুবে যায় বিষন্ন প্রেমিক”।
(কবিতা – ‘সিঁড়ি থেকে দূরে’ - কবি শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়)
আবার ফিরি সিঁড়ির ইতিহাসে।
আগেই বলেছি সিঁড়ি শব্দের শুরুয়াৎ। কিন্তু এর ব্যবহার শুরু হ’ল কিভাবে ?
প্রাচীন মই, নিউ মেক্সিকোয়ের লস আলামোসের কাছে আনাসাজীর ধ্বংসাবশেষে।
সিঁড়ি কিন্তু স্থাপত্যবিদ্যার একটি জটিলতম অংশ। সিঁড়ির ব্যবহার যা জানতে পারা যায় তা নিওলিথিক আমল থেকেই। তবে আজকের ‘মই’-ই ছিল সিঁড়ির শুরু। মানুষ প্রথম যখন বাড়ি বানাতে শিখল তখন থেকেই সেই বাড়ি বা কুটিরগুলো মাটি থেকে একটু উঁচু করেই বানাতো যাতে জন্তুজানোয়ার সহজে না ঘরে ঢুকে পড়ে। এবং সেই বাড়িতে ওঠানামার জন্য মানুষের মাথায় এসেছিল এই মই এর ভাবনা। হয়তো আজ আমরা যে শেপে মই দেখে থাকি তা হয়তো ছিল না। কিন্তু একটা পাদানি তো ছিলই যার ওপরে পা রেখে ওঠা নামা করা হ’ত। এখনো বিশ্বের বিভিন্ন উপজাতিরা এই ভাবেই মই ব্যবহার করে থাকে জন্তুজানোয়ার থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্যেই।
ক্রমশঃ মানুষ পাকা বাড়ি তৈরি করতে যখন শুরু করল তার পর থেকেই সেই বাড়ির আকার আর আয়তন অনুযায়ী সিঁড়ি তৈরির নকশাও পাল্টাতে থাকল। পরবর্তীকালে, শাস্ত্রীয় প্রাচীনত্বের সময়কালে, গ্রিকো-রোমান জটিল সিঁড়িগুলি নির্মিত হতে শুরু করে। প্রথমে সোজা খাড়াই সিঁড়ি থেকে সর্পিল, জিগজ্যাগ কিংবা অন্য সব নকশায় সিঁড়ি পালটাতে থাকল। খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে রোমান স্থাপত্যের বোলবোলাও থেকে সিঁড়ি সর্পিল আকার নিতে শুরু করে। অল্প জায়গাকে ব্যবহার করে এই সর্পিল সিঁড়ি বানানো হ’ত।
Château Chambord in the Loire Valley, France (1519–1547). –
ফ্রান্সের লোয়ার উপত্যকায় চিটো চেম্বর্ড (1519-1515)।
মানুষ এর চরিত্রই হল উন্নতির। উন্নতি বিজ্ঞানের, উন্নতি স্থাপত্যের, উন্নতি সাহিত্যের, উন্নতি জীবনের। সেই সূত্র ধরেই ফ্রান্সের লোয়ার ভ্যালিতে তৈরি হয়েছিল এই চিটো চেম্বর্ড। হাজির হ’ল দুদিক দিয়ে ওঠা নামার সিঁড়ি যার পোষাকি নাম ‘ডাবল হেলিক্স’ সিঁড়ি। কি দরকার ছিল অযথা এমন সিঁড়ির ? ছিল মশায়েরা ছিল। তখন তো আর লিফট আসে নি অথচ ভি.আই.পি কল্চর নিঃসন্দেহে এসে গেছে। তাই রাজা রানী পাত্র অমাত্যদের সাথে চাকরবাকরেরা যাতে একসাথে না উঠতে পারে তার জন্য মানুষকে ভাগ করার প্রথা শুরু হ’ল। শোনা যায় এই হেলিক্স সিঁড়ির আসল ডিজাইনার নাকি লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তিনি করলে কি হবে – ব্যবহারের প্রণালী তো শুরু করবে রাজা মন্ত্রীরা। যেমন খ্রীস্টপূর্ব চারশ অব্দে গ্রীক পণ্ডিত ডেমোসিত্রাস (Democritus) যখন প্রথম জেনেছিলেন ‘এটম’ এর অস্তিত্ব, তখন কি ভেবেছিলেন যে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুলাই আমেরিকার বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার তা দিয়ে আস্ত একটা বোমা বানিয়ে একটা নিরীহ দ্বীপ ‘হিরোশিমা’কে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন সে বছরেরই ৬ আগস্ট। তৈরি করবেন মানবজাতের এক স্থায়ী কলঙ্ক !
তবে সেই নিত্যনতুন নকশার সিঁড়িগুলো কিন্তু অবশ্যই তাদের নান্দনিক, স্থাপত্য এবং সাংস্কৃতিক
পরিমণ্ডলে একটা দিক নির্দেশ করেছিল। আমাদের কল্পনার জগতকে উজ্জীবিত করেছিল।
Rembrandt’s painting “Philosopher in Meditation” (1632)
রেমব্রান্টের এই “Philosopher in Meditation” ছবিটিতে সুর্যের আলো একটা দার্শনিক চেতনার প্রতীক। সাথের সিঁড়িটি সেই চেতনাকে পৌঁছে দিতে চায় সেই জ্ঞানের দিকে, যেখানে আলোর ঝকমকানি সর্বদাই। আসলে আরোহণ এই শব্দটি মানুষের জ্ঞান আর অগ্রগতির প্রতীক অনেককালই। হয়তো বা এই ছবি থেকেই জন টেমপ্লারের মত একজন পণ্ডিত সেই ঐতিহাসিক যুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে লিখেছিলেন সে বিখ্যাত বই - “The Staircase:History and Theories”, ১৯৯২ তে।
Quinta da Regaleira, Sintra, Portugal
‘কুইন্টা রে রেজালিরা’ বা ‘অনার সিঁড়ি’
চোদ্দ থেকে সতেরো খ্রীষ্টাব্দ ইউরোপের রেনেসাঁ’র সময়কাল। এই সময়েই প্রাচীন গ্রীক এবং রোমান সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের ফলে শিল্পী আর স্থপতিরা মিলে তৈরি করলেন ‘কুইন্টা রে রেজালিরা’। এটি পর্তুগালের সিন্ট্রায়। একে বলা হ’ত ‘অনার সিঁড়ি’। অনেকটা নাট্যশালার মত সিঁড়ি পথে আরোহণের ছবি যেন।
এরপরে এগিয়ে এলেন গণিতবিদরাও। তাঁরাও সিঁড়ির আকারে আগ্রহী হতে শুরু করলেন !
মোটামুটি বারোশ’ সালের ভেতরেই গণিতবিদ লিওনার্দো ফিবোনাচি (Leonardo Fibonacci
) আবিষ্কার করলেন ‘ফিবোনাচি পরম্পরা’ বা ‘ফিবোনাচি’র সোনার অনুপাত’। তার আবিষ্কৃত সংখ্যার পরম্পরা বা ক্রম অর্থাৎ ( ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪) এই সংখ্যাগুলোকে যদি দৃশ্যমানতায় আনা যায় তাহলে এটা একটা সর্পিল আকার নেয়। এই গাণিতিক সূত্রটি সে সময় এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে সে সময় মানে ঐ রেনেসাঁ পিরিয়ডের স্থাপত্য আর ছবি আঁকাতেও ব্যবহার করেছিলেন প্রচুর তথাকথিত শিল্পীরা মায় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি অব্দি। স্পাইরাল বা পেঁচালো বা সর্পিল যে কোনো সিঁড়িকে এমন একটা কৌণিক জায়গা থেকে যদি দেখা হয় তাহলে মনে হবে যে স্বর্গের সিঁড়ি বা যে সিঁড়ির শেষ নেই আর কি ! অথচ ব্যাপারটাই দৃষ্টির মায়া।
Bramante Staircase, Vatican (1505)
বললে পেত্যয় যাবেন না এই সূত্রের প্রভাব সাহিত্যেও এসে পড়েছিল। যে কোনো সিঁড়ির কাজ কি ? সিঁড়ি দিয়ে ওঠা বা নামা। এই তো ? সে ব্যাপারটাকে প্রতীক করে সাহিত্যে, সিনেমায় আর ছবিতেও ব্যাপক ব্যবহার শুরু হ’ল। মনে করুন এমন একটা সিঁড়ি যা মাঝখানটা চারকোনা ফাঁকা। চারধার দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি। এবারে কুড়ি তলায় সিঁড়ির ধাপ থেকে যদি আপনি নিচে তাকান তাহলে একটু প্যালপিটিশন যে হবে না, সে কে বলতে পারে ? পারেন হিচ্ককের মতো সিনেমার পরিচালকেরা। ঐ সিচুয়েশনটা দিয়েই সৃষ্টি করতে পারেন এক ভয়ার্ত পরিবেশ যা হিচ্কক করেছিলেন ১৯৫৮ তে বিখ্যাত ‘ভার্টিগো’ সিনেমায়। এই সিনেমার প্রধান চরিত্রের একটা বিরল রোগ ছিল। উচ্চতাজনিত রোগ। পরিভাষায় যার নাম এক্রোফোবিয়া। সেই সিনেমাতেও এই সিঁড়ির দৃশ্য অসাধারন সব এঙ্গেলে তোলা হয়েছিল।
“ভার্টিগো” সিনেমার সেই সিঁড়ি।
“অক্ষরে অক্ষরে বোঝে মেয়ে, তার আপেল জীবন,
আকাশ চুমো পাহাড় বরফ আর গ্লেসিয়ার ঢাকা,
কুম্ভীরাশ্রু পড়ে ভারাক্রান্ত নিস্তরঙ্গ ফল্গু শিরে,
দয়ামায়া নিশ্চিহ্ন সবার মুখে, দেবতারাও বাইপাশে ছোটে,
প্রেমের চেয়ে প্রেমিক বড়, বিছানায় মার্জিত অশ্লীল ভাষা,
বাচক্লব শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধ তর্কবিতর্কে, আপোষ না হলে জবর দখল,
ডোরবেল বাজলেই সেবন্তী দরজা খুলবে অকুতো খুঁৎ খুঁৎ,
তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে যুত্সই চুমো,
আর ঘরে কাপড় খুলতে খুলতে উলঙ্গ সমাধি।” ( - সিঁড়ি। কৃষ্ণকুসুম পাল)
কতই না গল্প উপন্যাস। কবিতা বেশ কম যদিও। তবে, যে কোনো গোয়েন্দা উপন্যাসে সিঁড়ি অবধারিত।
“......আগেই বলা হয়েছে জমিদার-বাটী ‘মধু নিবাস’ প্রাসাদতুল্য। চারতলা। গ্রামের বহু দূর থেকেও লাল রঙের জমিদার বাড়ী পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
চারতলার উপরে অবিশ্যি একখানি মাত্রই ঘর : ঠাকুর-ঘর বা গৃহদেবতা লক্ষ্মী-নারায়ণের পূজা-ঘর। ত্রিতলে ও দ্বিতলে আটটি ঘর। অন্যান্য ঘরগুলি মাঝারী গোছের। বাড়ীর সামনে প্রকাণ্ড দেশী-বিলাতী ফুলের এখখানি বাগান। বাগানের মধ্যখানে লাল সুরকীঢালা পায়ে-চলার পথ। বাড়ীর পিছন দিকে প্রায় ১০/১১ কাঠা জমির পরে আম-জাম প্রভৃতি ফলের বাগান, বাগানের সীমানা পেরিয়ে নজরে পড়ে সবুজ মাঠ ও চষা জমি।
বাড়ীর দুই দিক দিয়ে দুটি সিঁড়ি। একটি সিঁড়ি বরাবর চারতলা পর্যন্ত গেছে, অন্যটি তিনতলায় গিয়ে শেষ হয়েছে।
মোট কথা, চারতলার 'পরে ঠাকুর-ঘরে যাবার একটিই মাত্র সিঁড়ি। কিরীটি খুব ভাল করে ঘুরে ঘুরে দেখলে: চারতলার 'পরে ঠাকুর-ঘরে যাবার ঐ সিঁড়ি ভিন্ন আর কোন উপায়ই নেই। ঐটিই একমাত্র পথ।
ঠাকুর-ঘরে যাওয়ার মধ্যে শিবশংকরের বৃদ্ধা জননী ও পূজারী ব্রাহ্মণ রামকুমার সান্যাল, মাঝে মাঝে শিবশংকর যান বটে তবে গত ৭/৮ দিন ওদিকে মোটে যানই নি। আর কারও পূজা-ঘরে প্রবেশাধিকার নেই। শিবশংকরের হুকুম।......”
এ গল্প তো ডিটেকটিভ কিরীটি রায় এর। গল্পের নাম ‘স্বর্ণ-মূর্তি। মূর্তি চুরি হয়েছিল। চারতলার ওই ঠাকুরঘর থেকেই।
“কত রকম সিঁড়ি আছে ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
সরল সিঁড়ি শীতল সিঁড়ি
পদোন্নতির পিছল সিঁড়ি
অন্ধ এবং বন্ধ সিঁড়ি
কদম ফুলের গন্ধা-সিঁড়ি
ওঠার এবং নামার
চলতে চলতে থামার।
কত রকম সিঁড়ির ধাপে কত রকম জল
পা পিছলোলে অধঃপতন
ভাসতে পারো মাছের মতন
ডুব সাঁতারে মুঠোয় পেলে সঠিক ফলাফল।
কত রকম জলের ভিতর কত রকম মাছ।
চুনো পুঁটি রাঘব বোয়াল যার যে রকম নাচ।
পেট চিরলে আংটি কারো।
কারো শুধুই আঁশ।
দীর্ঘতর ফুসফুসে কার ভরাট দীর্ঘশ্বাস।
সিঁড়ির নীচ জল এবং সিঁড়ির উপর ছাদ
মেঘও পাবে মানিক পাবে
বজ্রধ্বনির খানিক পাবে
পুড়তে চাইলে রোদ।
জ্যোৎস্না থেকে চাইতে পার সার্থকতাবোধ।
অনেকরকম সিঁড়ি আছে ওঠা নামা হাঁটার
ঊর্ধ্বে অভিষেকের তোরণ।
নিচের ঝোপটি কাঁটার”। — (কবিতা ‘সিঁড়ি’ - কবি পূর্ণেন্দু পত্রী)
কিংবা আরো পরে যখন হাতে পেলাম…
“...আপনার ঘরটা একবার দেখতে পারি কি?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল। ভদ্রলাকে চৌকাঠের মুখে থেমে গিয়ে বললেন, দেখবেন বইকী। সুবীর দেখিয়ে দেবে। আমি ছাতে সান্ধ্যভ্রমণটা সেরে আসি।'
করিডরে বেরিয়ে এলাম চারজনে। অন্ধকার আরও ঘনিয়ে এসেছে। করিডরের ডাইনে বাঁয়ে ঘরগুলোর ভিতর থেকে মোমবাতির ক্ষীণ আলো বাইরে এসে পড়েছে। নীহারবাবু লাঠি ঠক ঠক করে ছাতের সিড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। শুনলাম তিনি বলছেন, স্টেপ গোনা আছে। সতেরো স্টেপ গিয়ে বাঁয়ে ঘুরে সিঁড়ি। সেভেন প্লাস এইট-পনেরো ধাপ উঠে ছাত। প্রয়োজন হলে খবর দেবেন...?”
— (উপন্যাস – গোলকধাম রহস্য - সত্যজিৎ রায়)।
রহস্য, গোয়েন্দা আর ভূতের গল্পে সিঁড়ি যেন মাস্ট মাস্ট মাস্ট।
জয়বাবা ফেলুনাথ সিনেমাটির সেই অংশটা যেখানে ফেলুদা একা বেরিয়েছে একদিন সকালবেলায়। কাশী’র মুন্সীঘাটে একটা বুরুজের ওপরে বসে চা খেতে খেতে হঠাৎ ফেলুদার চোখে পড়ে মছলীবাবা’র মতো একটা লোক গঙ্গাস্নান সেরে মুন্সীঘাটের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠে আসছে সেই প্রাচীন বাড়িটায়। ফেলুদা ফলো করতে থাকে। প্রথমে একটা বাড়িতে ঢোকে লোকটা। তারপরে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ে আরেকটা বিশাল বাড়ির অভ্যন্তরে। সে বাড়িটা একেবারে গঙ্গার পাশেই। পিছু নিতে নিতে ফেলুদা পৌঁছে যায় সেই বিশাল বাড়ির দুতলায়। এর পরে খাবার আনতে আবার নেমে আসে লোকটা। সেই সুযোগে ফেলুদা তার ঘরে ঢুকে প্রথমেই সন্ধান পায় সেই মাছের আঁশের। তারপরে সেই পুরোনো দিনের ফুল আঁকা টিনের স্যুটকেশ খুলে ফেলুদা খুঁজে পায় নকল কালো দাড়ি আর রিভলভার। এর মধ্যেই। খাবার হাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে লোকটা। ফেলুদা সরে যায়। ভিজে জামা কাপড় মেলতে থাকে লোকটা। ফেলুদা লুকিয়ে লক্ষ্য করতে থাকে। ঘরে ঢুকে লোকটা এরপরে দরজার দিকে পিছন ফিরে উবু হয়ে খেতে বসে। সেই সুযোগে ফেলুদা বেরিয়ে আসে। দমবন্ধ করা এই দৃশ্যাংশটুকু। এর পরেই মূর্তিশিল্পী শশীবাবু খুন আর সেই আখতারী’র গান......
এই দৃশ্যগুলোয় সিঁড়ি’র ব্যবহার কি অসামান্য দক্ষতায় করেছিলেন আমাদের সেই লম্বা ছফুটিয়া পরিচালক মশাই। উপন্যাসে কিন্তু এই ডিটেলস্ নেই।
সাহিত্য, সিনেমা এবং চিত্রকলা সম্পর্কিত চিত্রগুলিতে এক প্রতীকী ব্যঞ্জনা প্রকাশ করতে প্রায়শই সিঁড়ির ব্যবহার হয়ে থাকে। কিছু বিখ্যাত চলচিত্রের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যেও সিঁড়ির ব্যবহার লক্ষ্যনীয়।
খুব গম্ভীর হয়ে পড়ছে আলোচনা। সত্যিই তাই! সিঁড়ি নিয়ে এমন একটা লেখার কথা যখন মাথায় চাপল তখন ভেবেই পাচ্ছিলাম না যে, কি ভাবে শুরু করবো বা কি কি লিখবো। কিন্তু তথ্য খুঁজতে গিয়ে আমি তো দিশেহারা হয়ে পড়ছি। সত্যিই, কতো কিছুই না জানার আছে আমাদের আর সেই জানাকে ঘরের মধ্যে এনে দিয়েছে এই যুগান্তকারী ইন্টারনেট ব্যবস্থা এবং তার সাথে অবশ্যই গুগুল বাবাজীবন। সারা পৃথিবীর অজস্র লাইব্রেরীর তাকগুলো এখন আমার আঙুলের ডগায়। যদিও আমাদের দেশজ লাইব্রেরী এখনো সেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগে।
রবীন্দ্রনাথের গল্প বা উপন্যাসে ‘সিঁড়ি যে কতো ভাবে এসেছে তা বলাই বাহুল্য …
“বরীচ জায়গাটি বড়ো রমণীয়। নির্জন পাহাড়ের নীচে বড়ো বড়ো বনের ভিতর দিয়া শুস্তা নদীটি (সংস্কৃত স্বচ্ছতোয়ার অপভ্রংশ) উপলমুখরিত পথে নিপুণা নর্তকীর মতো পদে পদে বাঁকিয়া বাঁকিয়া দ্রুত নৃত্যে চলিয়া গিয়াছে। ঠিক সেই নদীর ধারেই পাথর-বাঁধানো দেড়-শত-সোপান-ময় অত্যুচ্চ ঘাটের উপরে একটি শ্বেতপ্রস্তরের প্রাসাদ শৈলপদমূলে একাকী দাঁড়াইয়া আছে— নিকটে কোথাও লোকালয় নাই।
তখন গ্রীষ্মকালের আরম্ভে বাজার নরম; আমার হাতে কোনো কাজ ছিল না। সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে আমি সেই নদীতীরে ঘাটের নিম্নতলে একটা আরাম-কেদারা লইয়া বসিয়াছি। তখন শুস্তানদী শীর্ণ হইয়া আসিয়াছে; ও পারে অনেকখানি বালুতট অপরাহ্নের আভায় রঙিন হইয়া উঠিয়াছে; এ পারে ঘাটের সোপানমূলে স্বচ্ছ অগভীর জলের তলে নুড়িগুলি ঝিক ঝিক করিতেছে। সেদিন কোথাও বাতাস ছিল না। নিকটের পাহাড়ে বনতুলসী পুদিনা ও মৌরির জঙ্গল হইতে একটা ঘন সুগন্ধ উঠিয়া স্থির আকাশকে ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিয়াছিল”।
“সূর্য যখন গিরিশিখরের অন্তরালে অবতীর্ণ হইল তৎক্ষণাৎ দিবসের নাট্যশালার একটা দীর্ঘ ছায়াযবনিকা পড়িয়া গেল-- এখানে পর্বতের ব্যবধান থাকাতে সূর্যাস্তের সময় আলো আঁধারের সম্মিলন অধিকক্ষণ স্থায়ী হয় না। ঘোড়ায় চড়িয়া একবার ছুটিয়া বেড়াইয়া আসিব মনে করিয়া উঠিব-উঠিব করিতেছি, এমন সময়ে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম। পিছনে ফিরিয়া দেখিলাম, কেহ নাই”।
রবীন্দ্রনাথে’র ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে শুস্তা নদীর তীরে সিঁড়ি আর প্রাসাদে ওঠবার সিঁড়ি, এই দু’য়ে মিলে এক ভৌতিক অনুভূতির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন। নদীর ধারে পাথর বাঁধানো দেড়শ খানা সিঁড়ি যখন কল্পনা করতে থাকি তখনই মনের মধ্যে এক অকারণ অনুভব। সেই সিঁড়ি দিয়ে একঝাঁক নারী মল ঝমঝমিয়ে স্নানে যায় শুস্তা’য়। আবার স্নান সমাপনে উঠতে থাকে তখন এক মায়াময় জগৎ তৈরি হয় এই সিঁড়িকে ঘিরেই।
“ইন্দ্রিয়ের ভ্রম মনে করিয়া পুনরায় ফিরিয়া বসিতেই একেবারে অনেকগুলি পায়ের শব্দ শোনা গেল, যেন অনেকে মিলিয়া ছুটাছুটি করিয়া নামিয়া আসিতেছে। ঈষৎ ভয়ের সহিত এক অপরূপ পুলক মিশ্রিত হইয়া আমার সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল। যদিও আমার সম্মুখে কোনো মূর্তি ছিল না তথাপি স্পষ্ট প্রত্যক্ষবৎ মনে হইল যে, এই গ্রীষ্মের সায়াহ্নে একদল প্রমোদচঞ্চল নারী শুস্তার জলের মধ্যে স্নান করিতে নামিয়াছে। যদিও সেই সন্ধ্যাকালে নিস্তব্ধ গিরিতটে, নদীতীরে নির্জন প্রাসাদে কোথাও কিছুমাত্র শব্দ ছিল না, তথাপি আমি যেন স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম নির্ঝরের শতধারার মতো সকৌতুক কলহাস্যের সহিত পরস্পরের দ্রুত অনুধাবন করিয়া আমার পার্শ্ব দিয়া স্নানার্থিনীরা চলিয়া গেল। আমাকে যেন লক্ষ্য করিল না। তাহারা যেমন আমার নিকট অদৃশ্য, আমিও যেন সেইরূপ তাহাদের নিকট অদৃশ্য। নদী পূর্ববৎ স্থির ছিল, কিন্তু আমার নিকট স্পষ্ট বোধ হইল, স্বচ্ছতোয়ার অগভীর স্রোত অনেকগুলি বলয়শিঞ্জিত বাহুবিক্ষেপে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে; হাসিয়া হাসিয়া সখীগণ পরস্পরের গায়ে জল ছুঁড়িয়া মারিতেছে, এবং সন্তরণকারিণীদের পদাঘাতে জলবিন্দুরাশি মুক্তামুষ্টির মতো আকাশে ছিটিয়া পড়িতেছে।
আমার বক্ষের মধ্যে একপ্রকার কম্পন হইতে লাগিল; সে উত্তেজনা ভয়ের কি আনন্দের কি কৌতুহলের, ঠিক বলিতে পারি না। বড়ো ইচ্ছা হইতে লাগিল ভালো করিয়া দেখি, কিন্তু সম্মুখে দেখিবার কিছু ছিল না; মনে হইল ভালো করিয়া কান পাতিলেই উহাদের কথা সমস্তই স্পষ্ট শোনা যাইবে, কিন্তু একান্তমনে কান পাতিয়া কেবল অরণ্যের ঝিল্লিরব শোনা যায়। মনে হইল, আড়াই শত বৎসরের কৃষ্ণবর্ণ যবনিকা ঠিক আমার সম্মুখে দুলিতেছে………”
কিরকম করে একটার পর একটা দৃশ্য চোখের সামনে খুলে দিচ্ছেন।
আমাদের ছোটোবেলায় এই বরানগরে কত যে পুকুর ছিল, আর ছিল প্রচুর জমিদার বাড়ির বাগান। পাড়ার পুকুরগুলোয় ছোটো ছোটো সিঁড়ি থাকতো। ইঁট বাঁশ এসব দিয়ে। কিন্তু ওই বড় বড় বাগানবাড়ি’র পুকুরগুলোয় শ্বেতপাথরের সিঁড়ি থাকতোই। এখনো একটা দুটো তার স্মৃতি বহন করে আছে এই অঞ্চলে। বাকিগুলো ‘প্রমোটার’ নামক এক সুনিপুণ জাতিদের কবলে পড়ে সিঁড়ির শ্বেতপাথরগুলো বিক্রিত হয়ে তাদের সিন্দুকে কাঁচা টাকায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। সাথে সাথে চলে গেছে ছায়াসুনিবিড় প্রাচীন বৃক্ষগুলিও।
“একটি অমেয় সিঁড়ি মাটির উপর থেকে নক্ষত্রের
আকাশে উঠেছে;
উঠে ভেঙে গেছে।
কোথাও মহান কিছু নেই আর তারপর।
ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র প্রাণের প্রয়াস র'য়ে গেছে;
তুচ্ছ নদী-সমুদ্রের চোরাগলি ঘিরে
র'য়ে গেছে মাইন, ম্যাগ্নেটিক মাইন, অনন্ত কনভয়,-
মানবিকদের ক্লান্ত সাঁকো
এর চেয়ে মহীয়ান আজ কিছু নেই জেনে নিয়ে
আমাদের প্রাণের উত্তরণ আসেনাকো।
সূর্য অনেক দিন জ্বলে গেছে মিশরের মতো নীলিমায়।…” — (রাত্রির কোরাস - সাতটি তারার তিমির)
(৩)
"আমার রাজার বাড়ি কোথায় কেউ জানে না সে তো;
সে বাড়ি কি থাকত যদি লোকে জানতে পেত।
রুপো দিয়ে দেয়াল গাঁথা, সোনা দিয়ে ছাত,
থাকে থাকে সিঁড়ি ওঠে সাদা হাতির দাঁত"। - রাজার বাড়ি – শিশু
শেষবারের রাজস্থান ভ্রমণে বাছাইকরা জায়গাগুলো তো ছিলই, তার সাথে জুড়েছিলাম নতুন তিনটে জায়গা। বুন্দি, কোটা, রনকপুর আর কুম্ভলগড়। বুন্দি ভ্রমণ আমার এক স্মরণীয় স্মৃতি। তার অন্যতম কারন গাইড-কাম-দাদা অশ্বিনী কুকি। কুকি মশাই এর আন্তরিকতা চিরজীবন মনে থাকবে। তাঁকে নিয়ে লেখার ইচ্ছেও আছে। কুকি আমার কাছে আরেক যুগলপ্রসাদ। মাধ্যমিকের গণ্ডী না পেরোনো আদতে ময়রা এই মানুষটা আজ একজন প্রত্নতাত্ত্বিক। একা একা বুন্দির কাছেদূরে জঙ্গল পাহাড় খুঁজে খুঁজে কত যে আদিম মানুষের আঁকা গুহাচিত্রের সুলুকসন্ধান বার করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। আমার কতই না সৌভাগ্য যে এমন একজন মানুষকে কি করে যেন পেয়ে গেছিলাম গাইড হিসেবে। সে গল্প পরে।
তো এই কুকি মশায়ের দৌলতে বুন্দি’তে প্রথম দেখেছিলাম রানি-কি-বাওরি। উত্তর আর পশ্চিম ভারতেই এই বাওরিকে বাওলি-ও বলা হয়। আসলে ঐ অঞ্চলে জলের কষ্ট চিরিকালই। তাই বিশাল বিশাল জায়গা জুড়ে সেকালের রাজা-মহারাজেরা তৈরি করতেন এই বাওরিগুলো যাকে সাদা বাংলায় আমরা কুয়ো বলতেই পারি। তবে এ কুয়ো এক্কেরে অন্যরকম।
সিঁড়ি গাঁথা কুয়ো বা বাওরি দেখে আমি তো থ হয়ে গেছিলাম। কি অসামান্য শৈল্পিক নিদর্শন এই বাওরিগুলোয়। একটা চারচৌকো জায়গার চতুর্দিক দিয়ে থাকে থাকে নেমে গেছে সিঁড়ি। কত যে ধাপ তা গুণে শেষ করা যাবে না। একেবারে নিচে রয়েছে জল। প্রচণ্ড গ্রীষ্মে জল যখন অনেক নিচে নেমে যায় সেসময় জল আনতে অনেক সিঁড়ি ভেঙে নামতেই হয়। রাজস্থান, গুজরাট, দিল্লি অঞ্চলে তখন এই বাওরিগুলোই ভরোসা।
৪৬ মিটার গভীর এই রানি-কি-বাওরি প্রথম দেখায় আমায় চমকে দিয়েছিল। ওপরে থেকে নিচের দিকে তাকালে রীতিমত ভয় করে। ১৬৯৯ সালে তৈরি রানি নাথাওয়াত জি এটি নির্মাণ করান। এমন স্থাপত্য প্রকৌশলের সাথে সেযুগের মানুষ সিঁড়িকে কি অদ্ভুতভাবে ব্যবহার করেছিলেন তা আজও আমার কাছে বিস্ময়ের। পুরাতত্ত্ব গবেষকদের মতে খোদ দিল্লিতেই নাকি শতাধিক এই বাওরি ছিল।
‘দিল্লির কেন্দ্র বলে পরিচিত কনট প্লেস থেকে কস্তুরবা গান্ধী মার্গ ধরে শ’ পাঁচেক মিটার এগোলেই রাস্তার বাঁ দিকে পড়ে হেলী রোড। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অতিথি নিবাস এই রাস্তাতেই অবস্থিত। তবে অতদুর যেতে হবে না। তার অনেক আগেই বাঁ পাশে একটা সরু গলি চোখে পড়বে। সামনের বোর্ডে লেখা আছে হেলী লেন। ছোট্ট গলি। এখানেই রয়েছে চতুর্দশ শতাব্দীর মহারাজা অগ্রসেন কী বাওলি। মোট একশো পাঁচটি সিঁড়ি। বাওলির জলাধারে জল থাকলেও ব্যবহার করা হয় না। কোলাহল মুখর কনট প্লেসের দু’ পা দূরে আজও শান্ত পরিবেশে বেঁচেবর্তে রয়েছে মহারাজা অগ্রসেন কী বাওলি’।
‘দিল্লি মেট্রোর হলুদ লাইনে কুতব মিনার স্টেশন থেকে একটু এগিয়ে গেলেই মেহেরৌলি প্রত্নতাত্ত্বিক পার্কে পৌঁছনো যায়। এই পার্কের ভিতরে রয়েছে রাজো কী বাওলি। সিকান্দার লোদীর আমলে নির্মিত এই বাওলিটির বৈশিষ্ট্য হল যে এর একটাই সিঁড়ি। দৈর্ঘ্য ও একপাশের প্রস্থ বরাবর গেঁথে তোলা পাথরের দেওয়ালের কারুকাজ বাওলটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে প্রদীপ রাখার ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ এই বাওলি সন্ধ্যার পরেও ব্যবহার করা যেত’।
“লোকশ্রুতি রাম জন্মানোর আগেই নাকি রামায়ণ লেখা হয়েছিল। সেই তর্কে না জড়িয়ে স্পষ্ট করে বলা যায় যে লাল কেল্লা তৈরির অন্তত তিনশো বছর আগেই এই বাওলিটি নির্মিত হয়। ফিরোজ শাহ তুঘলকের উদ্যোগে নির্মিত এই বাওলির প্রকৃত অবস্থান দেখতে হলে কিন্তু লাল কেল্লার পূর্বসূরি এবং প্রতিবেশী সেলিমগড়ের ভিতরে যেতে হবে। সেইসময়কার প্রযুক্তি এবং স্থাপত্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে বলতেই হবে যে এই বাওলিটির নকশা ছিল অনবদ্য। আজও এই বাওলি সক্রিয়। লাল কেল্লা এবং সেলিমগড়ের লন রক্ষণাবেক্ষণের কাজে এই বাওলির জল ব্যবহার করা হয়’।
‘ফিরোজ শাহ কোটলা বাওলি - ক্রিকেট স্টেডিয়াম নয়। অবিশ্যি স্টেডিয়ামের নাম তো সম্প্রতি বদলে গেছে। তবে ফিরোজ শাহ কোটলা বা ফিরোজ শাহ-র দুর্গের নাম পাল্টে যায়নি। এই দুর্গের মধ্যে রয়েছে তৎকালীন প্রযুক্তির সেরা নিদর্শন সমৃদ্ধ বাওলি। অনেকের মতে এই বাওলিটি ছিল দিল্লির সবচেয়ে বড় জলাধার। এবং ভারতের একমাত্র গোলাকার বাওলি হিসেবে পরিচিত। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল এই বাওলি কিন্তু শুধু ভূগর্ভের জলের উপর নির্ভর করে তৈরি হয়নি। টেরাকোটা পাইপ দিয়ে পাশের যমুনা নদীর জল আনার বন্দোবস্ত ছিল। এখনকার ফিরোজ শাহ কোটলা দেখতে গেলে বোঝা যায় যে বাওলিটি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি।
খারি বাওলি - শের শাহ-র পুত্র ইসলাম শাহের উদ্যোগে এই বাওলি নির্মিত হয়। নতুন দিল্লি স্টেশনের পশ্চিম দিকে রেলওয়ে ইয়ার্ডের পাশে ছিল এর অবস্থান। বাওলি নেই। তবে খারি বাওলি নামের জায়গাটা রয়েছে। হারিয়ে গেছে জলাধার। আসলে জলাধারের স্হান নির্বাচন বোধ হয় ঠিক ছিল না। কারণ, এখানকার ভূগর্ভের জল ছিল খর জল বা পরিভাষায় hard water. খর অর্থাৎ হিন্দির খারি জলের সুবাদে বহুদিন আগেই জল শুকিয়ে গেছে। কিন্তু জায়গার নাম মুছে যায়নি। এখানকার খারি বাওলি এশিয়ার সবচেয়ে বড় চাল-ডাল অর্থাৎ দানা শস্য এবং মশলার পাইকারি বাজার।
পরিশেষে যে কথা না বললেই নয় তা হল পূর্ব ভারতের পুকুরপাড় যেমন সামাজিক যোগাযোগের অর্থাৎ আড্ডা-আলোচনা-সমালোচনা-পরনিন্দা-পরচর্চার আদর্শ জায়গা, বাওলির সিঁড়ির ধাপও স্থানীয় সমাজের বিশেষত মহিলাদের মিলনস্থল’।
এবার বলি ভারতের রাজধানী দিল্লির অল্প দূরে এক মিনার বা স্তম্ভের কথা। কুতুব মিনার (উর্দু: قطب منار ক্বুতুব্ মিনার্ বা ক্বুতাব্ মিনার্)। ১১৯৩ সালে ভারতের প্রথম মুসলিম শাসক কুতুবুদ্দিন আইবেক শুরু করেন এ মিনার তৈরির কাজ। কাজ শেষ করেন ফিরোজ শাহ তুঘলক ১৩৮৬ সালে। এক অনন্য স্থাপত্যকীর্তির নিদর্শন এই কুতুব মিনার।
১৮৫৮ সালে কুতুব মিনার।
২৩৪ ফুট উঁচু এই সুউচ্চ মিনারের শীর্ষদেশে পৌছতে হলে চড়তে হয় তিনশ’ ঊনআশি-খানা ঘোরানো সিঁড়ি। পুরো মিনারটির ভেতর বাইরে সম্পূর্ন ইঁটের তৈরি।
‘কুতুবের নীচের তলায় ছাব্বিশটি পল-তোলা। পর্যায়ক্রমে একটি গোলাকৃতি একটি কোণ-বিশিষ্ট। মুজ্তবা আলীর ভাষায়—“একটা বাঁশি, একটা কোনা পর পর সাজানো।” তার মানে পর-পর দুটি বাঁশি কেন্দ্রবিন্দুতে ৩০ ডিগ্রি কোণ রচনা করছে। আর তাকেই দু-আধখানা করে কোণগুলি সাজানো। দ্বিতলেও ছাব্বিশটি খাঁজ, প্রতিটি খাঁজ কেন্দ্রে ১৫ ডিগ্রি কোণ রচনা করছে। এবং তারা গোলাকৃতি বা ‘বাঁশি’। তিনতলাতেও সেই ছাব্বিশ ভাগের ছন্দ, অর্থাৎ ১৫ ডিগ্রির ব্যবস্থাটা পাকা আছে, যদিও এবার বাঁশি খোয়া গেছে, সবই কোণাকৃতি। এর উপরে তূরীয় অবস্থা—না বাঁশির তান, না কৌণিক অন্তরায়; স্রেফ গোলাকার। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এই ছন্দ বদলাবার অনুপ্রেরণাটাও এসেছে গজনীর মাহ্মুদী মিনার থেকে, যদিও ব্যাপকতায়, বিন্যাসে, এবং জ্যামিতিক তুলনামূলকভাবে তার পূর্বসূরীকে অনেক পিছনে ফেলে গেছে।’
আমাদের শহর কলকাতার অক্টারলোনি মনুমেন্ট (ইংরেজি: Ochterlony Monument) যার বর্তমান নাম ‘শহীদ মিনার’ যার নির্মাণের সাথে কিন্তু কোনো শহীদেরই সম্পর্ক নেই। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে অগস্ট মাসে তদনীন্তন যুক্তফ্রন্ট সরকার এই স্মৃতিসৌধটিকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নিহত শহিদদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে এর এই নাম রাখেন। ৪৮ মিটার (১৫৭ ফুট) উঁচু আর গোটা স্তম্ভ বা মিনারটায় অনেক রকম স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন দেখা যায়। যেমন নীচের অংশটি মিশরীয় স্থাপত্যের আদলে, স্তম্ভ অংশটি ক্ল্যাসিকাল ফ্লুটেড ধাঁচের, উপরিভাগটি সিরীয় ধাঁচের এবং গম্বুজটি তুর্কি শৈলীর। উপরে দুটি বারান্দা আছে। মিনারের ওপরের তলায় যেতে ২২৩টি ধাপের একটি কুণ্ডলী-আকারের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়।
১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কম্যান্ডার মেজর-জেনারেল স্যার ডেভিড অক্টারলোনির স্মৃতিতে এই সৌধটি নির্মিত হয়। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে মারাঠাদের বিরুদ্ধে তাঁর সফল আত্মরক্ষা এবং ইঙ্গ-নেপাল যুদ্ধে গোর্খাদের বিরুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে কোম্পানির বাহিনীর বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখতে এই সৌধটি নির্মিত হয়েছিল। সৌধটির নকশা প্রস্তুত করেছিলেন জে পি পার্কার। সরকারি কোষাগারের অর্থসাহায্যে এই সৌধটি নির্মিত হয়। সৌধটির নির্মাণকালীন ব্যয় ছিল ৩৫ হাজার টাকা।
সিঁড়ির ধাপ নিয়েও কতো গল্পগাথা আমাদের।
মোগল সাম্রাজের দ্বিতীয় সম্রাট ছিলেন বাদশা হুমায়ূন। তাঁর মৃত্যুর সাথে জড়িয়ে আছে এক সিঁড়ি। শোনা যায়, রাজত্ব হারিয়ে পনের বছর পরে ১৫৫৫ সালে দিল্লির মসনদ ফিরে পান শাহাজাদা। আর তার মাত্র এক বছরের মধ্যেই ১৫৫৬ সালের ২৪ জানুয়ারি মারা যান তিনি। মৃত্যুর দিন তিনি দিল্লির দিন পনাহ্ লাইব্রেরীর সিঁড়ি দিয়ে যখন নামতে শুরু করেছিলেন, তখন তাঁর হাতে ছিল এক গোছা বই। ঠিক সেই মুহূর্তেই শুনতে পান মুয়াজ্জিন এর আজানের ডাক। আজানের ডাক শুনতে পেয়েই মাগরিবের নামাজ আদায় করার জন্য দ্রুত নামতে থাকেন লাইব্রেরীর সিঁড়ি বেয়ে। সিঁড়ির ধাপে কোনোভাবে পা হড়কে যায় সম্রাটের। তিনি গড়িয়ে পড়েন নীচে। বইপত্তর ছিটকে ছড়িয়ে পড়ে। পাথেরের সিঁড়ির ধাক্কায় তিনি আঘাত পান আর এর ঠিক তিন দিন পরেই সম্রাটের ইন্তেকাল হয়।
ঢাকার টাঙ্গাওয়ালারা সেযুগে খুব রসিক ছিল। আর কিছুতেই হার মানার পাত্র ছিল না। যে কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুম করে মন্তব্য করেই ফেলতেন এই টাঙ্গাওয়ালারা। এঁরা পরিচিত ছিলেন ‘কুট্টি’ নামেই। আগেকার দিনে বিশাল বিশাল বাড়িগুলো স্বাভাবিকভাবেই অনেকটা উঁচুতে হ’ত। আর সে বাড়িতে ওঠা নামা করতে গেলেই সামনের সিঁড়ি ব্যবহার করতেই হ’ত বা এখনো হয়। যেমন আমাদের মেডিকেল কলেজের সিঁড়ি। মনে করুন - উত্তরমকুমার যে কতবার ওঠানামা করেছেন সে সিঁড়ি দিয়ে তা রীতিমত গবেষণার দাবী রাখে।
তা সেই পুরোনো এক সময়ে ঢাকার এমন একটা অফিস বাড়ি’র সিঁড়ি দিয়ে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে এক ভদ্রলোক সেই সম্রাট হুমায়ুনের মত হড়কে গড়িয়ে পড়েন এক্কেবারে নিচে। সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল এক টাঙ্গাওয়ালা। এই দৃশ্য দেখে কিছু তো একটা কমেন্ট করতেই হয়। তো সেই গড়িয়ে পড়া বিধ্বস্ত মানুষটি যখন অতিকষ্টে উঠে দাঁড়ালেন সেসময় চোখ পড়ল ঐ টাঙ্গাওয়ালার দিকে। সপাটে ধেয়ে এল সেই কুট্টির উক্তি : “আহা আহা, কর্তায় পড়সেন দেহি……ব্যাথাও পাইসেন……কিন্তু লামসেন খুব তাড়াতাড়ি”।
“বিস্ময়কর ভাবে বিষিয়ে ওঠা যে বিশ্বে বসবাস আজকাল আমার
এবং সম্ভবত আমাদের
সেখানে সাপেতে সিঁড়িতে অবাক করা বাহ্যিক সখ্যতা চলে প্রত্যহই
তর তর করে ওঠে কিছু মানুষ
আশ্চর্য করা সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে প্রতিনিয়তই ঊর্ধ্ব পানে ।
লুডুর ঘুঁটির অকিঞ্চিৎকর অস্তিত্ব নিয়েই থেকে যাই মইয়ের পাদদেশে
কখনও সখনও সিঁড়ি বেয়ে
যদিবা উঠি ওপরের দিকে , চলে যাই আরো দ্রুত সেই অজগরের পেটে
লোপাট হয় অস্তিত্ব আমার
এমনি করেই সংকটাপন্ন সংগ্রামি শীত-গ্রীষ্ম কেটে যায়, কাটে শরৎ-হেমন্তও।
জীবন সংগ্রামে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার আশা নিয়ে কাটে প্রাত্যহিক সকাল-সন্ধ্যা
অথচ সাপেরাই করে দংশন
নিষিদ্ধ আপেলে লুব্ধ হয়ে আদম যেমন সমর্পিত হন, সিঁড়ি বেয়ে উঠবেন বলে
সাপেতেই যেন হন পতিত
আদি শয়তানের হাত ধরে নেমে আসি এখানেই , লোকে যাকে বলে পৃথিবী।
সেই থেকে মইয়ের সামনে অগুনতি মানুষের ভীড় লুডুর প্রতীক্ষমান ঘুঁটি যেন সবাই
ওপরে ওঠার বর্ধিষ্ণু এ ব্যাকুলতায় চলে যায় মূহুর্তরা সব, বসে বসে বিপন্ন পতাকা নাড়াই।
- ( সাপ-সিঁড়ি-লুডু - অনীশ আহমেদ)
(৪)
“প্রকৃত নোংরা এই সিঁড়ি, ঈশ্বরের কাছে আমি কীভাবে পৌঁছাই?
তিনি থাকেন উপরতলায়, এতটা উপরে যে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে
ক্রমাগত সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ঊর্ধ্বাকাশে চেয়ে দেখি
শূন্যোদ্যানের উপরে বাতাস
আরো ঝুলন্ত, আরো শূন্য, অমানিশা গিরিশৃঙ্গ যত উঠে পড়ি
ঈশ্বর ততই উপরে, উপরন্তু নোংরা রয়েছে সিঁড়ি;
যাবতীয় ভাষণের পাণ্ডুলিপি খসে খসে পড়ে
যাবতীয় মন্ত্রশ্লোক, ষড়যন্ত্রধ্বনি
যতই বাতাসে ভাসে যতই আকাশের দিকে উঠে যায় সিঁড়ি
ততই দূরত্ব বাড়ে, একে আমি কীভাবে ভ্রমণ বলি
বলি ঈশ্বরগৃহযাত্রা?
অন্ধ সমুদ্র সেঁচে আমি কোন ঈশ্বরের প্রাণভোমরাকে পাব?
রচিত গ্রন্থের পৃষ্ঠা পৃষ্ঠাময় অঙ্কিত বনভূমি গিরিশৃঙ্গদল
কেবলি নোয়ায় শির, অত্যুজ্জ্বল ঐক্য ধরে রাখে,
তাদের কপাট খুলে নিরাকার নিভূমে নেমেছে।
এখানে পাতাল সিঁড়ি অন্তহীন পত্রঢাকা পথ… ( - ঈশ্বরগৃহ যাত্রা - কামরুল হাসান )
সেইই যে কবে টাইগার সিনেমায় দেখেছিলাম ‘রোমান হলিডে’। অড্রে হেপবার্ন আর গ্রেগরী পেক। উফফ্ এখনো ভুলতে পারি না রাজবাড়ির বিশাল বিছানায় শুয়ে শুয়ে অড্রে’র কড়িকাঠ দেখার সেই দৃশ্যখানা। বিছানায় নিজেই ঘুরে যাচ্ছে অড্রে বিভিন্ন দিক থেকে, কড়িকাঠ দেখার জন্য। সাদাকালোর সেই ছবি অস্কার জিতেছিল নায়ক নায়িকা সমেত। সিঁড়ি নিয়ে লিখতে গিয়ে ‘রোমান হলিডে’ মাথায় এলো কেন জানেন ?
নায়িকা অড্রে হেপবার্ন রোমের এক সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটা স্কুপ আইসক্রিম খাচ্ছেন। পেছনে একটা চার্জ। আর সেই সুউচ্চ চওড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছেন গ্রেগরি পেক। চার্চের ঘড়িতে তখন সন্ধ্যে ছ’টা বাজব বাজব করছে। সেই মাত্র ১৩৫ খানা ধাপের সিঁড়ি, বিখ্যাত হয়ে গেল এই সিনেমার পরের থেকেই। সে সিঁড়ির নাম স্প্যানিস স্টেপস (Spanish Steps (Italian: Scalinata di Trinità dei Monti)) – যা কিন্তু স্পেনে নয়, ইতালির রোম এ।
১৬২৭-২৯ সালে এই সিঁড়ি তৈরি হয়। সিঁড়িটি নকশা করেছিলেন স্থপতি ফ্রান্সেস্কো ডি সান্টিস এবং আলেসান্দ্রো স্পাচ্চি। বিখ্যাত ইংরেজ কবি জন কীটস জীবনের উপান্তে এসে এই স্প্যানিস স্টেপস এর নিচের ডানদিকের একটা ভিলায় এসে বাস করতে থাকেন এবং এখানের কীটস মারা যান। সে ভিলাটি আজ ‘কীটস-শেলি স্মারক ভবন’ এ রূপান্তরিত।
আরেকটি বিখ্যাত সিঁড়ি ইতালীর সিসিলি’র অন্তর্গত ক্যালটাগিরন (Caltagirone (ইতালীয় - [kaltadʒiroːne] আর সিসিলিয়ান এ - Caltaggiruni [kaltaddʒɪˈɾuːnɪ])। এ শহর মৃৎশিল্পীদের শহর। তাই হয়তো এই সমৃদ্ধ শহরের নামটি আরবী "ক্বালাতুল-জারার" ("মৃৎশিল্পের জারগুলি") থেকে উদ্ভূত - এটি এমন একটি নাম যা মৃৎশিল্পের প্রাচীনতার প্রমাণ দেয়।
তো, এই ক্যালটাগিরন শহরটা ছিল একটা পাহাড়ের ওপরে। আর পুরোনো শহর ছিল নিচে। তাই
এই দুই অংশকে জুড়তে ১৬০৮ সালে পরিকল্পনা করা হল একটা সিঁড়ির। আমাদের যেমন কলকাতা আর হাওড়া জোড়া হাওড়া ব্রিজ দিয়ে তেমনি এই ক্যালটাগিরনের নতুন আর পুরোনো শহরকে জুড়তে দশ বছর ধরে তৈরি হল স্টেয়ারকেস অব সান্তা মারিয়া ডেল মন্টে বা স্ক্যালিনেটা ডি সান্তা মারিয়া দেল মন্টি। ৪৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ঠ এই সিঁড়ি আজ দর্শনার্থীদের খুব প্রিয়।
“রাত্রি হবে দুপুর, ভাগ্নি ঢুকল ঘরে ধীরে;
চুপি চুপি বললে কানে, "যেতে কি চাস ফিরে।'
লাফিয়ে উঠে কেঁদে বললেম, "যাব যাব যাব।'
ভাগ্নি বললে, "আমার সঙ্গে সিঁড়ি বেয়ে নাবো--
কোথায় তোমার খুড়ির বাসা অগস্ত্যকুণ্ডে কি,
যে ক'রে হোক আজকে রাতেই খুঁজে একবার দেখি;
কালকে মামার হাতে আমার হবেই মুণ্ডপাত।'--
আমি তো, ভাই, বেঁচে গেলেম, ফুরিয়ে গেল রাত”। - কাশী – ছড়ার ছবি – রবীন্দ্রনাথ।
রামায়নে দেখি যে লঙ্কার রাজা রাবন স্বর্গে পৌঁছনোর এক সিঁড়ি বানাতে টেন্ডার ডেকে কাজ শুরু করিয়েছিলেন। কিন্তু বেচারা রাবন মশাই মারা গেলেন রামচন্দ্রের হাতে। ফলে পরিকল্পনা মাফিক সেই সিঁড়ির কাজ আর শেষ হ’ল না। কন্ট্রাকটর ‘ময় দানব’ মশাই পুরো টাকা পেয়েছিলেন কিনা তাও জানা যায় না, যেমন জানা যায় না সেকালে এই সব টেণ্ডার কোটেশন পেমেন্ট এসবের কী কী ব্যবস্থা ছিল !
উৎসাহী জনগন ইচ্ছে করলে দেখে আসতে পারেন সেই পুরোটা তৈরি না হওয়া সিঁড়ি। তবে তা দেখতে গেলে আমাদের পাশপোর্ট ভিসা এসব লাগবে এখন, এই আর কি !
শ্রীলঙ্কার সেন্ট্রাল প্রভিন্সের ডাম্বুলা নগরের কাছে মাটালা জেলার মধ্যে রয়েছে ঘন জঙ্গলে ঢাকা শিগিরিয়া নামে এক পাহাড়ি অঞ্চল। আর সেখানে পৌঁছে গেলেই দেখতে পাবেন সেই স্বর্গের সিঁড়ি। এখন শ্রীলঙ্কাবাসীরা সে সিঁড়িকে লায়ন্স রক বা সিংহের প্রস্তর নামেই ডেকে থাকে। একটা বিশাল অতিকায় পাথরের খণ্ডের গা বেয়ে সেই সিঁড়ি চলে গেছে অনেক উঁচু অব্দি। আর সেই পাথরের মাথায় রয়েছে এক পুরোনো রাজবাড়ির ভগ্নস্তূপ। যতদূর জানা গেছে সেকালে শিগিরিয়া অঞ্চলের নাম ছিল অলকামাণ্ডব।
মাটি থেকে প্রায় ছ’শ ফুট উঁচুতে এই রাজবাড়ির ভগ্নস্তূপ। ১৮৩১ সাল। জোনাথন ফরবস নামে এক ইংরেজ সেনাধক্ষ্য’র চোখে পড়ে এই লুকিয়ে থাকা আশ্চর্য সিঁড়িখানা। তিনি এক জায়গায় লিখছেন—“ সভ্য সমাজ থেকে বহুদূরে শিগিরিয়ার ঘন অরন্যে আবৃত পর্বত প্রান্তরে সিংহের পাঞ্জার সাথে সাদৃশ্য যুক্ত শুধু একটিমাত্র সুবিশাল আর সুউচ্চ প্রাকৃতিক প্রস্তর খণ্ডের দুর্গম গিরিপ্রান্ত বেয়ে ধাপে ধাপে উপরে আরও বহু উপরে যেন মহাকাশের দিকে ক্রমান্বয়ে উঠে গিয়েছে একাধিক সোপানশ্রেণী। বহু কষ্ট সহ্য করে আর বহু পরিশ্রম করে অবশেষে উপস্থিত হলাম সেই সোপানশ্রেণীর একেবারে অন্তিম প্রান্তে, লায়ন্স রকের শীর্ষদেশে। সেই শীর্ষদেশে অবস্থান করছে এক বহু শতাব্দী প্রাচীন রহস্যময় রাজপ্রাসাদের ভগ্নস্থুপ”।
স্থানীয় লোককথা বলে, সেকালে এই অলকামাণ্ডবই ছিল রাবনের রাজধানী। আর এই সিঁড়ি আর রাজবাড়ি তৈরির সময়ই রামবাবু লঙ্কা আক্রমন করেন। রাবনের মৃত্যুর পর তাঁর নশ্বর দেহ কোনো এক অজানা জায়গায় লুকিয়ে ফেলেন তাঁর বিশ্বাসঘাতক ভাই ঘরশত্রু বিভীষণ। এরপরে নিজে রাজা হ’য়ে বসেই আর দেরী করেননি বিভীষণ এই রাজধানী শিগিরিয়া বা অলকামাণ্ডব থেকে ‘কেলানিয়া’তে নিয়ে আসতে।
ঐতিহাসিকগণ বলেন যে শিগিরিয়ার এই রহস্যময় রাজবাড়ি খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে নাকি এক বৌদ্ধ মঠ হিসেবে ছিল। কিন্তু তারও পূর্বে আনুমানিক ৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত শিগিরিয়ার এই রাজপ্রাসাদ কোন এক স্থানীয় শক্তিশালী হিন্দু রাজার রাজপ্রাসাদ ছিল। এই লায়ন্স রকের মাথআয় রাজবাড়ি চত্বরে রয়েছে সুন্দর এক বাগান আর বেশ কটি পুকুরের ভগ্নাবশেষ। আর এই বাড়ি বা প্রাসাদের গুহার দেওয়ালে রয়েছে সে যুগের সুন্দরীদের কিছু অপরূপ ছবি। সেই সব মেয়েরা ভাসমান মেঘের ওপরে। লোকশ্রুতি বলে এরা নাকি স্বর্গ থেকে আসা অপ্সরা। শিগিরিয়ার রহস্যময় এই স্বর্গের সিঁড়ির চারপাশে আর শীর্ষদেশে রয়েছে আরও বহু অজানা বন্ধ গুহামুখ। পুরাতত্ত্ববীদদের ধারনা এইসব রহস্যময় বন্ধ গুহামুখের মধ্যে লুকিয়ে আছে আরও অনেক অজানা রহস্য। হয়তো এইসব বদ্ধ গুহার ভেতরে, হাজার হাজার বছর ধরে লুকিয়ে রয়েছে রাবনের সেই রহস্যময় পুষ্পকরথ বা তাঁর মরদেহ। এইসব রুদ্ধ গুহামুখের রহস্যের সমাধান হলে উন্মোচিত হবে রামায়নের অন্তিম পর্বের বহু অজানা রহস্য।
মলটবি কবরস্থানের একাংশ
স্থানীয়দের মতে— দিনেরবেলায় এই কবরস্থানটি একদম স্বাভাবিক। রাত হলেই নাকি নেমে আসে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা। জাগতিক কোনো শব্দই নাকি সেখানে পৌঁছায় না। রাত বাড়লেই কবরটির চারপাশে অট্টহাসি, ফিসফিস শব্দ আর নারী কণ্ঠের হাহাকার শোনা যায়। প্রশ্ন উঠেছে, এত সংখ্যা থাকতে কবরটির ভেতরে কেন ১৩টি সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। অনেকে মনে করছেন— খ্রিষ্ট ধর্ম মতে ১৩ সংখ্যাটি অশুভ। বাইবেল অনুযায়ী, যীশু খ্রিস্টের সঙ্গে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন তাদের মধ্যে ১৩ নম্বরে ছিলেন জুডাস। তাই ১৩ সংখ্যাটির সঙ্গে এই ১৩ সিঁড়ির কোনো যোগ থাকতে পারে বলে মনে করছেন প্যারানরমাল বিশেষজ্ঞরা। প্যারানরমাল বিষয়ক লেখক ডি. এস. ডুবি পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, একটি পারিবারিক কবরে কেন দরজা লাগানো সেটাই এক বিস্ময়কর ব্যাপার। এই ১৩টি সিঁড়ি বেয়ে নামলে মানুষের মনে এক অদ্ভুত হতাশা ভর করে। শরীর ক্রমশ হালকা অনুভব হতে থাকে। মনে হতে থাকে, এই পৃথিবীতে যেন আর কোনো প্রাণ নেই। চারদিকে শুধু মৃত মানুষের ভিড়। এই সিঁড়ি দিয়ে নেমে পেছনে তাকালেই নাকি দেখা যায় একটি ছোট্ট চেয়ার। কবরের ভেতরে কোথা থেকে চেয়ার আসল তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি ডুবি। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে যদি পেছনে কেউ তাকায় তাহলে সামনে ভেসে উঠে ‘নরকের ছবি’ কিংবা তারচেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু। এ বিষয়েও পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কেউ’।
“…
১
সিঁড়ির ওপরে সিঁড়ি
পা রাখি ধীরে, খুব ধীরে
শরীরের ধাপ, স্থির
অন্ধকারের স্রোত, উৎস, পেতে চাই
সারারাত
নারী, হে দেবী, চলি, চলি, দুই পাড়
চোখের স্তব্ধতা, রক্তের উৎসার
ঠোঁট রাখি পাতায়।
ফুল ফুটে উঠছে, সিঁড়ির ওপরে সিঁড়ি
সারারাত!
২
আমি ঠোঁটে আঙুল রেখেছি
দ্যাখো, এই যে এদিকে
সিঁড়ির ওপরে সিঁড়ি, তুমি উঠে গেলে
আর কিছু নয়
শুধু ধুলোয় রোদ্দুর, ঝরা পাতা
ওপরের দিকে যে নিশ্বাস, সে কি
স্বক্রিয় দেবান, তোমার শরীর
পথ জুড়ে মানুষ, ব্যস্ততা
এরই মধ্যে তুমি চলে যাও! - (সিঁড়ির ওপরে সিঁড়ি – রথীন্দ্র মজুমদার )
পামুক্কাল – তুরস্কের এক পর্যটন কেন্দ্র। একসময়ে এই পামুক্কালে ছিল ফ্রিজিয়া সাম্রাজ্যের এক বিখ্যাত শহর ‘হিয়েরাপোলিস’। গ্রিক ভাষায় যার অর্থ হল পবিত্র নগরী। ১৮৮৭ সালে এই অঞ্চলে খননকার্য চালাতে গিয়ে জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ কার্ল হুম্যান এই ঐতিহাসিক শহরটি আবিষ্কার করেছিলেন। এর পর, ১৯৫৭ সালে পাওলো ভারজোনের নেতৃত্বে ইতালীয় বিজ্ঞানীদের একটি দল নতুন করে খনন চালালে মাটির নীচে থেকে বেরিয়ে এসেছিল অত্যন্ত উন্নত এই শহর।
হিয়েরাপোলিস
‘হিয়েরাপোলিসকে ঘিরে ছিল অজস্র প্রাকৃতিক উষ্ণ প্রস্রবন। প্রস্রবনগুলির জলের ওষধি গুণ থাকায়, প্রাচীনকালে আরোগ্যনিকেতন হিসেবে সুখ্যাতি ছিল হিয়েরোপোলিসের। খননক্ষেত্রটি থেকে পাওয়া গিয়েছিল যুগের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকা বেশ কিছু ইমারত। যেমন, গরম ও ঠান্ডা জলের সুবিধাযুক্ত স্নানাগার, গ্রন্থাগার, ব্যায়ামাগার, ১২০০০ আসন বিশিষ্ট একটি আ্যম্ফিথিয়েটার ও সমাধিক্ষেত্র। অনুমান করা হয়, আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর আগে হিয়েরাপোলিস শহরটি স্থাপন করেছিলেন আনাতোলিয়ার অধিবাসীরা নয়ত পারস্যের অধিবাসীরা। পরবর্তীকালে গ্রীক ও তারপর রোমানরা শহরটির দখল নিয়েছিল।
১৯৬৫ সালে এই এলাকাটিতে আবার খননকার্য চালানো হলে আবিষ্কৃত হয়েছিল একটি মন্দির। তার নাম প্লুটোনিয়ন। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের শুরুতে এই মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। মাটির নীচে থাকা একটি গুহার ওপর তৈরি করা হয়েছিল এই প্লুটোনিয়ন মন্দির। ফ্রিজিয়াবাসীরা বিশ্বাস করতেন মন্দিরটির নীচে আছে পাতাল রাজ্যে যাওয়ার পথ। সত্যিই মন্দিরের নীচে আছে একটি রহস্যময় সুড়ঙ্গ। একজন মানুষ গলতে পারে এরকম একটি সংকীর্ণ গুহামুখ থেকে ধাপে ধাপে নীচে নেমেছে পাথুরে সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে নামা যায় গুহার ভেতরে। গুহার মেঝেতে আছে এক গভীর ফাটল। যার ভেতর আলো ফেললে দেখা যাবে, মেঝের নীচে দিয়ে দ্রুতবেগে বইছে ফুটন্ত জলের স্রোত।
হিয়েরাপোলিস থেকে পাওয়া বিভিন্ন পুঁথি থেকে জানা গিয়েছে, মন্দিরের পুরোহিতরা মন্দিরে আগত দর্শনার্থীদের বলতেন, এই ফুটন্ত জলের স্রোতের নীচেই আছে পাতাল। যেখানে বিরাজ করেন গ্রীক ও রোমানদের পাতালের দেবতা প্লুটো। এই গুহাপথ দিয়ে নাকি পৌঁছানো যায় বদরাগী দেবতা প্লুটোর কাছে। তবে সে পথ সাধারণের জন্য নয়। একমাত্র মন্দিরের পুরোহিতরাই পারেন দেবতা প্লুটোর কাছে পৌঁছতে।
এই সেই প্লুটোনিয়ন।
প্লুটোনিয়নের কথা পৃথিবী জানতে পেরেছিল, স্ট্রাবো, ক্যাসিয়াস ও দামাসসিয়াসের মত সুপ্রাচীন ইতিহাসবিদদের লেখা থেকে। ইতিহাসবিদ স্ট্রাবো লিখেছিলেন, “কোনও পশু বা পাখি প্লুটোনিয়নের ভেতরে গেলে তার মৃত্যু ঘটবেই। আমি কিছু চড়াই পাখি গুহার ভেতরে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম, সঙ্গে সঙ্গে তারা মারা গিয়েছিল।” পরবর্তীকালে প্লুটোনিয়নের গোপন কথা শুনে শিউরে উঠেছিল আধুনিক বিশ্ব। বিশ্ব জেনেছিল, এই রহস্যময় গুহার ভেতরে গিয়ে একমাত্র পুরোহিতরা ছাড়া, আর কেউ জীবিত অবস্থায় কখনও বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেননি। বহু মানুষ ও পশুপাখির মৃত্যু ঘটেছিল এই গুহার ভেতর। তাই হিয়েরাপোলিসের জনসাধারণ মন্দিরটিকে বলতেন ‘নরকের দ্বার’। গুহাটিকে বলতেন প্লুটোর গুহা।
হিয়েরোপোলিসের জনসাধারণ ভাবতেন, পাতাললোকে প্রবেশের চেষ্টা করলে দেবতা প্লুটো ক্রুদ্ধ হন। নিজের হাতে অবিশ্বাসীদের নির্মম মৃত্যু উপহার দেন গুহার ভেতর। দেবতা প্লুটোকে তুষ্ট করার জন্য পুরোহিতেরা পশুপাখিদের পায়ে দড়ি বেঁধে ছুঁড়ে দিতেন গুহার ভিতর। কয়েক মিনিটের মধ্যে ছটফট করতে করতে মারা যেত প্রাণীগুলি। মৃত্যুর পর দড়ি টেনে প্রাণীগুলির নিথর দেহ বাইরে বার করে নিয়ে আসা হত। তারপর সেগুলি পুড়িয়ে তাদের মাংস প্রসাদ হিসাবে দেওয়া হত উৎসর্গকারীর হাতে। এ সব দেখার পর, দূর্দমনীয় রোমানরাও প্লুটোর মন্দিরের ভেতরে ঢুকতে ভয় পেত’।
গালি পুরোহিতেরা জানতেন মন্দিরের ভেতরে ঘটা মৃত্যুগুলির পিছনে আছে নীচে থেকে উঠে আসা কোনও গ্যাস। তাঁরা বুঝেছিলেন গ্যাসটি ভারী হওয়ায়, গুহার মেঝের কাছাকাছি গ্যাসটির ঘনত্ব বেশী থাকে। তাঁরা জনগণকে দেখিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যেতেন গুহার ভেতরে। দম বন্ধ করা থাকতেন কয়েক মিনিটের জন্য। গুহার ভিতরে গিয়ে গালি পুরোহিতেরা দাঁড়িয়ে পড়তেন এবং দৌড়ে যেতেন গুহার ভেতর তাঁদের আবিষ্কার করা কিছু কিছু খোপের দিকে। যে খোপগুলিতে অক্সিজেন ঢুকতো কিছু সংকীর্ণ ফাটল দিয়ে। তাঁরা ছাড়া এই খোপগুলির কথা কেউ জানত না।
সেই খোপে কিছুক্ষণ কাটিয়ে, গালি পুরোহিতেরা আবার দম চেপে বাইরে আসতেন হামাগুড়ি দিয়ে। ‘গালি’ পুরোহিতদের দেখাদেখি অনেক সাধারণ মানুষ প্লুটোর করুণা পাওয়ার জন্য হামাগুড়ি দিয়ে গুহার ভেতরে এগিয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁরা পুরহিতদের বুজরুকিটা জানতেন না। ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেন। এইভাবে সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে ‘গালি’ পুরোহিতেরা প্রচুর সম্পত্তি করতেন।
গবেষকদের মতে খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত এই প্লুটোনিয়ন সক্রিয় ছিল। সক্রিয় ছিল গালি পুরোহিতদের বুজরুকিও। ষষ্ঠ শতকে খ্রিস্টানরা এই প্লুটোনিয়ন ভেঙে দিয়েছিল। পরবর্তীকালে ভূমিকম্পের ফলে একেবারে মাটির নীচে চলে গিয়েছিল অভিশপ্ত প্লুটোনিয়ন। তাঁকে নিয়ে গড়ে ওঠা বুজরুকির সমাধিটি, সেদিন হয়তো নিজের হাতেই খুঁড়েছিলেন পাতালের দেবতা প্লুটো’।
ধর্ম নিয়ে বুজরুকি যে সারা পৃথিবীতেই পরিব্যপ্ত এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আরেক সিঁড়ির গল্প আছে আমাদের পুরণে। সে এক শর্ত পূরণের গল্প। নরকের মাতা ভূমি দেবী বিষ্ণুর কাছে বর চেয়েছিলেন যেন তার পুত্র দীর্ঘ জীবন লাভ করে এবং সে শক্তিশালী হয়। বিষ্ণু এই বর পূরণ করেন। সঙ্গে বিষ্ণু নরকাসুরকে কামাখ্যা দেবীর পূজা করতে শেখান। প্রথম অবস্থায় ভালভাবে শাসন করা নরকাসুর শোণিতপুরের বাণাসুরের প্রভাবে পড়ে অত্যাচারী হয়ে ওঠে।
নরকাসুর কামাখ্যা দেবীকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। দেবীকে বলাতে দেবী শর্ত রাখেন যে, মোরগ বা কুক্কুট রাত পেরোনোর জানান দেওয়ার আগে যদি নরক নীলাচল পাহাড়ের তলা থেকে মন্দির পর্যন্ত এক রাতের মধ্যে সিঁড়ি নির্মাণ করতে পারেন তবে তিনি বিয়ে করতে রাজী হবেন। কামাখ্যা দেবী মোটেও আগ্রহী ছিলেন না এক অসুরের সাথে বিবাহ বন্ধনে জড়াতে। তাই এমন অবিশ্বাস্য শর্ত। নরকাসুর সেইমত সিঁড়ি নির্মাণ করে রাত পেরোনোর আগে শেষ করার উপক্রম করলেন। কাজের অগ্রগতি দেখে দেবী সত্যিই ভয় পেয়ে যান।তিনি তখন ছলনার আশ্রয় নেন। তিনি একটি মোরগকে চেপে ধরলে সেই মোরগ ভয়ে ডেকে ওঠে। মোরগের ডাক শুনে নরকও ভাবেন রাত বুঝি শেষ হল। নরকাসুর সিঁড়ি তৈরির কাজ অর্ধেক রেখেই ক্ষান্ত হলেন।কিন্তু পরে নরকাসুর আসল সত্যি জানতে পেরে কুক্কুটটিকে (মোরগ) প্রচণ্ড রাগে ধাওয়া করে হত্যা করেন।
এই কারণেই আসামের দরং জেলায় “কুকুরাকটা” নামে একটি স্থান আছে। নরকাসুরের অর্ধসমাপ্ত ঐ সিঁড়িটিকে “মেখেলা-উজোয়া পথ” বলা হয়। পৃথিবীর সকল রাজ্য জয় করার পর নরকাসুর স্বর্গ আক্রমণ করলে ইন্দ্র সহ দেবতারা স্বর্গ থেকে পালাতে বাধ্য হন। নরকাসুর প্রায় ১৬০০০ স্ত্রীকে অপহরণ করেন। ইন্দ্র, কামাখ্যা সহ সকল দেব দেবী বিষ্ণুর কাছে নরকাসুরকে হত্যার আবেদন জানালে বিষ্ণু কৃষ্ণ অবতারে নরকাসুরকে হত্যা করবেন বলে কথা দেন। পরবর্তীকালে কৃষ্ণর স্ত্রী সত্যভামা কৃষ্ণকে নরকাসুরকে হত্যার জন্য রাজি করান। কৃষ্ণ এবং সত্যভামা গরুড়ে চড়ে নরকাসুরের রাজ্য আক্রমণ করেন এবং সেখানে কৃষ্ণ নরকাসুরের সেনাপতি “মুর”কে বধ করেন। ”মুর”কে বধ করার জন্য কৃষ্ণ “মুরারী” নামেও পরিচিত। অবশেষে সুদর্শন চক্র দ্বারা কৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করেন এবং অদিতির সোনার কুণ্ডলের সঙ্গে ১৬০০০ জন স্ত্রীকে উদ্ধার করেন। প্রাগজ্যোতিষপুরের সিংহাসনে নরকাসুরের পুত্র ভগদত্তকে স্থাপন করা হয়।
উত্তর গুয়াহাটীতে “অশ্বক্রান্ত” (অর্থ – অশ্বের আরোহণ) নামে একটি মন্দির আছে। জনশ্রুতি প্রাগজ্যোতিষপুর আক্রমণ করার পূর্বে কৃষ্ণ এই স্থানে বিশ্রাাম নিয়েছিলেন এবং তাঁর ঘোড়াগুলি এখানে জল খেয়েছিল। নরকাসুর মৃত্যুর আগে সত্যভামাকে অনুরোধ করেন যে, বিশ্ববাসী যেন তাঁর মৃত্যু রঙিন আলোর সাথে উদ্যাপন করে। সেইজন্য এই দিনটি ‘নরক চতুর্দশী’ হিসেবে পালন করা হয়। বাংলায় যখন ভূত চতুর্দশী পালন করা হয় দক্ষিণ ভারতে বিশেষ করে গোয়া, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকে সেদিন নরক চতুর্দশী সাড়ম্বরে পালিত হয়। পুরাণ অনুসারে, এই বিশেষ তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ, সত্যভামা এবং দেবী কালিকা নরকাসুরকে বধ করেছিলেন।
“……….সে সবের বুক থেকে নিরুত্তেজ শব্দ নেমে গিয়ে
প্রশ্ন করে যেতেছিল সে সময়ে নাবিকের কাছে।
সিন্ধু ভেঙে কত দূর নরকের সিঁড়ি নেমে আছে?-
ততদূর সোপানের মত তুমি পাতালের প্রতিভা সেঁধিয়ে
অবারিতভাবে সাদা পাখির মতন সেই ঘুরুনো আধারে
নিজে প্রমাণিত হয়ে অনুভব করেছিলে শোচনার সীমা
মানুষের আমিষের ভীষণ ম্লানিমা,…………।” (- রবীন্দ্রনাথ – জীবনানন্দ দাশ।)
(৫)
“………
দাও তুমি দাও অপমান দাও
চাও বা না চাও নাও
পুড়ে খাঁটি সোনা নাও
আঁচলে বেঁধো না তাও
এতো তুচ্ছতা প্রাপ্য আমার?
সিঁড়ি খুঁজে চলি নরকে নামার।
অন্ধ ভ্রমর গেঁথেছে অমর
শব্দপুঞ্জ ডানায় তোমার
কী অর্থ তার বুঝবে কী আর!
সিঁড়ি খুঁজে চলি নরকে নামার।……” ( - ভালোবাসা – মঞ্জুষ দাশগুপ্ত)
বরানগর থেকে বহুবাজার বা বৌবাজার। ১৯৭৩ এ গোয়েঙ্কা কলেজে ঢুকেই সাপের পাঁচ পা দেখেছিলাম আমরা সব্বাই। দুচার মাস মন দিয়ে ক্লাস করার পরই শুরু হল আমাদের বিভিন্ন অভিযান। কোনোদিন দল বেঁধে এলিট গ্লোব বা নিউ এম্পায়ার এর পঁয়ষট্টি পয়সার সিনেমার লাইনে টেক্সাসের ছবি। আবার কোনোদিন নিউ মার্কেট ধর্মতলা চত্বর। এমন সব অপরিচিত অথচ নাম শোনা জায়গাগুলো নিজেরা চেখে দেখা। এই করেই দিন কাটছিল।
এমন সময় একদিন কে যেন বলে উঠল যে আমরা যাবো রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চলমান সিঁড়ি দেখতে। সে কেমন তখনো জানা নেই। এমনকি একটু আইডিয়া অব্দি নেই। তখন তো আর গুগুল মামা জন্মায় নি। তাই জানার জন্যে দৌড় ছিল পাড়ার লাইব্রেরি অব্দি। তাই এসক্যালেটর আমাদের সব্বার কাছেই এক অজানা শব্দ। কানে অব্দি শুনিনি, দেখা তো দূরের কথা।
তো একঢিলে দুই পাখি। কানে শোনা ড্যালহাউসি স্কোয়ার আর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চলমান সিঁড়ি। আমাদের কলেজের সামনের রাস্তাটাই বিপিন বিহারি গাঙ্গুলি স্ট্রিট, যার পুরোনো নাম বহুবাজার স্ট্রিট, সে রাস্তার এক মাথা শিয়ালদায় আর অন্য মাথা ড্যালহাউসির লালদিঘীতে। যার উত্তর পশ্চিম কোনেই ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কলেজের সামনে থেকে ট্রামে চেপে বসলেই এক্কেরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের উলটো পারেই নামা।
সদলবলে দুএকটা ক্লাস করার পরেই সোজা ১৪ নম্বর ট্রামের সেকেণ্ড ক্লাসে উঠে বসা। দুপুরের দিকে ১৯৭৩ সালে বেশ ফাঁকাই থাকত ট্রাম। ভাড়া চার কি পাঁচ পয়সা। ঠিক মনে নেই। লালদিঘিতে ঢোকার পরই গোটা ট্রাম ফাঁকা। যথাবিহিত জায়গায় নেমে নেতাজি সুভাষ রোড পেরোলেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বিশালকায় দরজা। দরজা বলতে কেমন বাধো বাধো লাগে আজও। সিংহদরজা বলাই ভাল। সেসময় দুটো বাজলেই বন্ধ হয়ে যেত সব ব্যাঙ্কেরই গেট। তাই একটু তাড়াহুড়ো আমাদের।
সামনের কয়েক ধাপ মার্বেলের সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই আমাদের চোখের সামনে দুখানা সিঁড়ি। চলছে দুটোই। বাঁদিকের সিঁড়ি খানা ধাপে ধাপে উঠছে আর ডানদিকের আরেকখানা সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে আসছে ওপর থেকে। অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা। সিঁড়ির ধাপগুলো কেমন ভাঁজ হয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে আবার খুলেও যাচ্ছে দরকার মতো। এবারে সিঁড়িতে ওঠার পালা আমাদের।
ডান পা'টা একটা ধাপে দিতেই বাঁ পা প্রায় নিজের থেকেই চলে গেল সিঁড়ির ওই ধাপে। হাতে ধরা রেলিং - সেও চলছে। শুধু ধরে থাকা। উঠে এলাম দোতলায়। সিঁড়ি থেকে নামার সময় অল্প ডিসব্যালেন্স সব্বাই। একদল ছেলে দুপুরবেলা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সিঁড়ি চাপছে এ দৃশ্য ওখানকার সিকিউরিটিদের কাছে এক অবাক ব্যাপার।
দোতলায় উঠেই নামতে যাবো সেসময় কে যেন জানিয়ে দিল আরেকটা সিঁড়ি উঠেছে ব্যাঙ্কের তিন তলায়। ব্যস চলো ভাইসব। আবার সেই দোতলার চলমান সিঁড়ি চেপে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তিনতলায়।
এবারে নামার পালা। তিন থেকে দুই। তারপরে দুই থেকে এক। ‘নামার সময় খুব সাবধানে’, জানালেন ব্যাঙ্কের কেউ। সেই একই প্রসেস। শুধু ধাপগুলো নামছে নিচের দিকে। বার চারেক এইভাবে ওঠানামা করে শেষ হ'ল সেদিনের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অভিযান। পুনরায় কলেজে ফেরা সেই চোদ্দো নম্বর ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণীতে।
নাথান এ্যামেস (Nathan Ames) বলে ম্যাসাচুসেটস এর একজন এটর্নি সেই ১৮৫৯ সালে এই "escalator" এর পেটেন্ট নিয়েছিলেন শুধুমাত্র নকশার ওপর ভিত্তি করেই। এমন কি একটা মডেল অব্দি তৈরি না করেই এই পেটেন্ট লাভ। তিনি ভেবেছিলেন কাঠের তৈরি করা এই সিঁড়ি অসুস্থদের সাহায্য করবে।
১৮৮৯। লেমন শেডার বলে আরেকজন এই রকম অনেকগুলো ধাপের সিরিজ এর ভাবনা ভাবলেন যাতে ধাপগুলো পরস্পরের সাথে যুক্ত থাকবে। পেটেন্ট নিলেন শেডার। এই পেটেন্টটারও মডেল বানানো হয় নি তবুও এই পেটেন্টটাকেই এই চলমান সিঁড়ির প্রথম পেটেন্ট বলা যেতে পারে।
১৫ মার্চ ১৮৯২ তে জেসে রেনো (Jesse W. Reno) পেটেন্ট নিলেন "Endless Conveyor or Elevator."। এর কয়েক মাস পরেই জর্জ এ হুইলার আবার তাঁর আইডিয়া বা ভাবনার ওপরে আবার পেটেন্ট নিলেন। তবে এইবারের ভাবনার সাথে চলমান ব্যাপারটা জড়িয়ে ছিল।
কেনাবেচার কত কি রাস্তা ! জর্জ হুইলার এর করা পেটেন্ট কিনে নিলেন চার্লস সিবার্গার (Charles Seeberger)। ১৮৯৯ সালে এই ভাবনার রূপায়ন ঘটাল ওটিস এলিভেটর কোম্পানি (Otis Elevator Company) যারা লিফট ব্যবসার সাথে যুক্ত এখনো।
লেহন ইউনিভার্সিটির স্নাতক, জেসে রেনো সর্বপ্রথম একটা কর্মক্ষম এসকেলেটর তৈরি ক’রে ("ঝুঁকির লিফট" নামে যা পরিচিত) সালে নিউ ইয়র্ক সিটির কোনি দ্বীপে ওল্ড আয়রন পাইয়ারের সাথে ইনস্টল করেছিলেন। এটি ২৫ ডিগ্রি এ্যাংগেলে চলতো। এর কয়েক মাস পরে, একই প্রোটোটাইপ একটা এস্ক্যালেটর ব্রুকলিন ব্রিজের ম্যানহাটনের পাশে এক মাস ব্যাপী ট্রায়াল পিরিয়ডের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল।রেনো অবশেষে ওটিস কোম্পানিতে যোগ দিয়েছিল এবং তার পেটেন্ট বিক্রি করে দিয়েওছিল।
১৮৯৫ সালের আশপাশে, চার্লস সিবার্গার ১৮৯২ সালে’র হুইলারের পেটেন্টযুক্ত এসকেলেটারের আকারে একটা নকশা নতুন ক’রে করতে শুরু করেন। এটি ছিল ফ্ল্যাট এস্ক্যালেটর যা আজ আমরা অনেক এয়ারপোর্টেই দেখে থাকি। ১৮৯৯ সালে ওটিসের সাথে সিবার্গার জুটি বেঁধেছিলেন এবং তাঁরা একসাথে প্রথম বাণিজ্যিক এসকেলেটর উত্পাদনের জনক বলা যায়। এই ছিল আজকের চলমান সিঁড়ি তোইরি’র ইতিহাস। পরবর্তীকালে বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে উন্নত হয়েছে। এখন স্পাইরাল এস্ক্যালেটর অব্দি এসে গেছে। এই জেসে রেনো’ই প্রথম স্পাইরাল এস্ক্যালেটর বসিয়েছিলেন লণ্ডনের হলোওয়ে রোড মেট্রো স্টেশনে ১৯০৬ সালে। যদিও পরে তা তুলে নেওয়া হয়েছিল।
“এস্ক্যালেটর” ("Escalator") এই নামটির পেটেন্ট কিন্তু প্রথম নিয়েছিলেন চার্লস সিবার্গার ১৯০০ সালে। আগেই বলেছি যে ল্যাটিন ভাষায় সিঁড়ি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত পরিভাষা হল “scala”। এটা কিন্তু একবচন শব্দ। এরই বহুবচন হ’ল "স্কালাই" ("scalae")।
“যেদিন বোধোদয় পড়াইবার উপলক্ষে পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, আকাশের ঐ নীল গোলকটি কোনো-একটা বাধামাত্রই নহে, তখন সেটা কী অসম্ভব আশ্চর্যই মনে হইয়াছিল। তিনি বলিলেন, "সিঁড়ির উপর সিঁড়ি লাগাইয়া উপরে উঠিয়া যাও-না, কোথাও মাথা ঠেকিবে না।" আমি ভাবিলাম, সিঁড়ি সম্বন্ধে বুঝি তিনি অনাবশ্যক কার্পণ্য করিতেছেন। আমি কেবলই সুর চড়াইয়া বলিতে লাগিলাম, আরো সিঁড়ি, আরো সিঁড়ি, আরো সিঁড়ি; শেষকালে যখন বুঝা গেল সিঁড়ির সংখ্যা বাড়াইয়া কোনো লাভ নাই তখন স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম এবং মনে করিলাম, এটা এমন একটা আশ্চর্য খবর যে পৃথিবীতে যাঁহারা মাস্টারমশায় তাঁহারাই কেবল এটা জানেন, আর কেহ নয়”। — (জীবনস্মৃতি – রবীন্দ্রনাথ)
এবারে আমার লেখা গুটোনোর পালা। তাই এক ভালবাসার গপ্পো দিয়েই শেষ হোক আমার এই সিঁড়ি।
প্রেমের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সম্রাট শাজাহান গড়েছিলেন তাজমহলের মতো এক অনুপম শৈল্পিক সৌধ। যা এখনো চিরায়ত রেখেছে প্রেমিক-যুগলকে। কিন্তু প্রেমের জন্য কেউ যদি সিঁড়ি বানিয়ে ফেলে তাকে কি বলা যায় ?
শুনুন তবে আর এক প্রেমের গল্প। হ্যাঁ, সিঁড়ি নিয়েই…
আজ থেকে সত্তর বছরেরও আগের এক ইতিহাস। দক্ষিণ-পূর্ব চীনের চোংপিং (Chongqing) অঞ্চলের জিয়াংজিন (Jiangjin) জেলার এক গণ্ডগ্রাম - গাউতাং (Gaotan)। ১৯৫১ সালের এক বৃষ্টিস্নাত দিনে ষোলো বছরের এক টগবগে যুবক লিউ গুজিয়াং (Liu Guojiang) এর প্রেমে পড়লেন ছাব্বিশ বছরের তন্বী - জু চাউকিং (Xu Chaoqing)। জু তখন বিধবা আর চার সন্তানের মা। খুব কষ্টের জীবনধারণ তাঁর। ভালবেসে থাকতে শুরু করলেন এই নতুন দম্পতি।
তখনো চীন ছিল বেশ রক্ষণশীল। নিজের চেয়ে বড় কোনো মহিলাকে বিয়ে করে ঘরসংসার করা তখনো অনাধুনিক চীনে। তাই গাউতাং গ্রামে শুরু হল তাঁদের নিয়ে টিটকিরি আর বিদ্রুপ। হঠাৎ করেই একদিন উধাও হলেন সব্বাই এই গ্রাম থেকে। সংসার পাতলেন এক পাহাড়ের গুহায়।
শুরু হ’ল এক রোম্যান্টিক জীবন। রোম্যান্টিকই বটে ! বিদ্যুৎহীন, জলহীন সে গুহার চারদিক। সবকিছুর ব্যবস্থা করতে হতো নীচে নেমে, পাহাড়ি ঢাল বেয়ে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা। বিরামহীন। খুব কষ্ট হতো লিউ-এর, যখন বৌ জু’কে এইভাবে নামাওঠা করতে দেখতেন রোজ। নিজে তো করতেনই সে সব কাজ। কিন্তু বৌ যে তাঁর চেয়ে বয়সে বড় - তায় মহিলা। সহ্যের সীমা পেরিয়ে যাচ্ছিল মনে মনে। অথচ নিরুপায় লিউ।
একদিন প্রতিজ্ঞা করেই ফেললেন লিউ। সিঁড়ি বানাবেন পাহাড় এর পাথর কেটে। নেমে পড়লেন কাজে। দেড় হাজার মিটার উঁচু পাহাড়ের গুহা থেকে নীচের পাদদেশ অব্দি সিঁড়ি তৈরির অদম্য ইচ্ছেয়। এক দিনও কামাই নেই। ১৯৫১ থেকে ২০০১। পঞ্চাশ বছর মানে ১৮২৫০ খানা দিন। বানিয়ে ফেললেন ছ-হাজার সিঁড়ির ধাপ। অগোচরে। অলক্ষ্যে।
তখন লিউ ৬৬ আর জু ৭৬। জু বুড়ি হয়ে গেছেন বেশ। চুলেও পাক। তাতে কি ? বুড়ো-বুড়ি হাত ধরাধরি করে ব্যবহার করতে থাকেন সেই ভালোবাসার সিঁড়ি। ইতিহাসের এক অপূর্ব অধ্যায় সৃষ্টি হয় পৃথিবীতে।
২০০১ সালেই একদল অভিযাত্রীর চোখে পড়ে এই সিঁড়ি। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরে তারা সন্ধান পায় লিউ আর জু এর সংসারের। তখন তাদের ছেলেপুলের সংখ্যা বেড়ে সাত।
২০০৬ এর ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে ‘চায়নিজ উইমেন উইকলি’ ঘটনাটি প্রথম প্রকাশ করে। বিশ্ববাসী জানতে পারে ‘এক দুজে কে লিয়ে’-র আরেক কাহিনী। সারা দুনিয়াজুড়ে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। চীনের সরকারও প্রতিশ্রুতি দেন যে তাঁরা ওই সিঁড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করবে। লিউ এর সেই গুহায় বিদ্যুৎ পৌঁছয়।
এক বছর পরে হঠাৎ একদিন বাড়ি ফিরে অসুস্থ হয়ে পড়েন লিউ। জু এর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন চিরতরে। পরে চীন সরকার ওই বাড়িটাকে একটা যাদুঘর বানিয়ে দেন। তৈরি করে দেন হাইওয়ে।
“একদিন বুদ্ধকে সে চেয়েছিলো ব’লে ভেবেছিলো।
একদিন ধূসর পাতায় যেই জ্ঞান থাকে— তাকে।
একদিন নগরীর ঘুরোনো সিঁড়ির পথ বেয়ে
বিজ্ঞানে প্রবীণ হ’য়ে— তবু— কেন অম্বাপালীকে
চেয়েছিলো প্রণয়ে নিবিড় হ’য়ে উঠে!
চেয়েছিলো—
পেয়েছিলো শ্রীমতীকে কম্প্র প্রাসাদে :
সেই সিঁড়ি ঘুরে প্রায় নীলিমার গায়ে গিয়ে লাগে;
সিঁড়ি উদ্ভাসিত ক’রে রোদ ;
সিঁড়ি ধ’রে ওপরে ওঠার পথে আরেক রকম
বাতাস ও আলোকের আসা-যাওয়া স্থির ক’রে কি অসাধারণ
প্রেমের প্রয়াণ ?............
নগরীর সিঁড়ি প্রায় নীলিমার গায়ে লেগে আাছে;
অথচ নগরী মৃত।
সে-সিঁড়ির আশ্চর্য নির্জন
দিগন্তরে এক মহীয়সী,
আর তার শিশু;
তবু কেউ নেই।....... - ( মানুষের মৃত্যু হ’লে - জীবনানন্দ দাশ )
(সমাপ্ত)
##
কৃতজ্ঞতা –
উইকিপিডিয়া
বাংলাপিডিয়া
মুগ্ধ করা অসাধারণ কিছু সিঁড়ির শিল্পকর্ম - অধিকার ডেস্ক – অধিকার নিউজ।
স্বর্গে যাবার সিঁড়ি – ইরাবতী ডট কম।
নরকের ১৩ সিঁড়ি - আমিনুল ইসলাম শান্ত - রাইজিংবিডি ডট কম
ভালোবাসার সিঁড়ি – আবুল হাসনাত - আরকাইভ ডট প্রথময়আলো ডট কম।
The History of Stairs – Stannah – এলিভ্স্টেয়ারস ডট কম।
This Man Carved 6,000 Steps - Akarsh Mehrotra – স্কুপহুপ ডট কম।
Ladder of Love destined to pass into posterity – চায়নাডেইলি ডট কম।
দিল্লির বাওলি - অমিতাভ রায় – দ্যওয়াল ডট ইন।
‘নরকের দ্বার’ – রূপাঞ্জন গোস্বামী - দ্যওয়াল ডট ইন।
নরক চতুর্দশী – সববাংলায় ডট কম।
ব্রিটানিকা ডট কম।
নির্বাচিত গদ্যাংশের জন্য –
ঘাটের কথা - রবীন্দ্রনাথ।
স্বর্ণ-মূর্তি – নীহাররঞ্জন গুপ্ত।
গোলকধাম রহস্য - সত্যজিৎ রায়।
জয়বাবা ফেলুনাথ - সত্যজিৎ রায়।
ক্ষুধিত পাষাণ - রবীন্দ্রনাথ।
জীবনস্মৃতি – রবীন্দ্রনাথ।
নির্বাচিত কবিতার অংশের জন্য –
রাজার বাড়ি – শিশু - রবীন্দ্রনাথ।
সিঁড়ি - সুকান্ত ভট্টাচার্য।
সিঁড়ি থেকে দূরে - শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়।
সিঁড়ি - কৃষ্ণকুসুম পাল।
সিঁড়ি - পূর্ণেন্দু পত্রী।
রাত্রির কোরাস - জীবনানন্দ দাশ।
সাপ-সিঁড়ি-লুডু - অনীশ আহমেদ।
ঈশ্বরগৃহ যাত্রা - কামরুল হাসান।
কাশী – ছড়ার ছবি – রবীন্দ্রনাথ।
সিঁড়ির ওপরে সিঁড়ি – রথীন্দ্র মজুমদার।
রবীন্দ্রনাথ – জীবনানন্দ দাশ।
ভালোবাসা – মঞ্জুষ দাশগুপ্ত।
মানুষের মৃত্যু হ’লে - জীবনানন্দ দাশ।
এছাড়া সমস্ত ছবি ও সন্ধানের জন্য অবশ্যই গুগুল।
#