৬)
ছুরিকলাঁ হল মুখ্যতঃ তাঁতিদের গ্রাম, কিন্তু জাতপাতের ভিত্তিতে আলাদা আলাদা পাড়া গড়ে উঠেছে। যেমন কোষ্টাপাড়া (তাঁতিপাড়া), রাউতপাড়া (গয়লা), লুহারপাড়া (কামার), কুমহারপাড়া( কুমোর), বড়ইপাড়া (ছুতোর)। এরপর ছোটখাট সম্প্রদায়গুলোর বস্তি হল মুহল্লা। যেমন পাঠান(মুসলমান) মুহল্লা, ছিপিয়া(যারা চুলের ফিতে আলতা এসব বিক্রি করে), সতনামী মুহল্লা ও সহিস (চামড়ার ঢোল তবলা মাদল বানায়) মুহল্লা।
তবে মূলবস্তি শেষ হয় রাজওয়াড়া মানে রাজবাড়িতে গিয়ে। মেটে রঙের বিশাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা রাজবাড়ি। প্রধান দ্বারের উপর রয়েছে এদের কোট অফ আর্মস, খোদাই করা। আজ চোখ কুঁচকে দেখলে অতিকষ্টে একটি ছোটখাট সিংহ ও ১৮৩৭ সাল চোখে পড়বে। ভেতরে যুবরাজ, মঝলা, সঝলা ও ছোটে কুমারদের আলাদা আলাদা মহল। এককোণে একটি জীর্ণ জীপগাড়ি ও ভ্যান বুড়ো কর্মচারির মত নম্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। এরা প্রত্যেকেই বেশ কালোকোলো এবং নিজেদের ক্ষত্রিয় বললেও চেহারায় স্থানীয় আদিবাসীদের ছাপ স্পষ্ট। রাজবাড়ির মূল অংশের বাইরে আর একটি ছোটখাট বাড়ি। সেটা বড়ে বাবুসাব ও ছোটে বাবুসাবএর ডেরা। এরা হলেন রাজার প্রাক্তন মন্ত্রী বা নায়েবের দুই ছেলে। আজ দুই জনেই কিছু করেন না , তবে পৈতৃক সূত্রে যা চাষের জমি ও আহিরণের দুই তীরে জঙ্গলের মধ্যে পড়ত জমি পেয়েছেন ,সেগুলোর ফসল ও জমির টুকরো বেচে বেচে এদের দিন চলে।
এর পরেই পাকদন্ডী পথে নেমে গিয়েছে আহিরণের পাড় অবধি। তারপর নদীর ওপারে ঝোরা-সিরকি জোড়া গ্রাম। এর জমিদারি অথবা মালগুজারি দুই বাবুসায়েবের নামে।
গাঁয়ের আরএকপ্রান্তে নদীর ধার ঘেঁষে আছে বিঁঝওয়ার -মঝওয়ার মুহল্লা(ব্যাকওয়ার্ড ট্রাইব)। তারপরে গাঁড়ামুহল্লা। এরা অন্ত্যজ। এরা নগাড়া বাজায়, নাচে। অথচ এদের এই গাঁড়াবাজা না হলে সবর্ণ হিন্দুর বিয়ে, ছট্টী(নবজাতকের ছয়ষেটেরা) ও দাহসংস্কার পুরো হয় না ।
এরপরে ক্ষেত-খার (মানে চাষের ও পড়তি জমি) পেরিয়ে নদীর আরেক পাশে রয়েছে কিছু নীচু নীচু মাটির ঘর, মাথা নীচু করে ঢুকতে হয়। এদের বলা হয় সুকবাসী। এরা যাযাবর অন্ত্যজ গরীব মানুষ। এদের মূল গাঁয়ের লোক সন্দেহের চোখে দেখে। এদের নাকি হাতটান খুব, আর মেয়েরা জড়িবুটি বিক্কিরি করে। এরা সবাই খুব খাটতে পারে । ধানকাটার সময় অথবা পঞ্চায়েতের টেন্ডারে ও ওয়ার্ক অর্ডারে রাস্তা বানানো, পুকুর কাটা এসবের জন্যে এদের ডাক পড়ে । এরা মাথা নীচু করে আসে। আটঘন্টার জায়গায় দশঘন্টা খাটে। যা বনিভূতি বা মজুরি দেওয়া হয় মুখবুজে কৃতজ্ঞ চোখে মেনে নেয়। মিনিমাম ওয়েজ অ্যাক্ট ও ওয়েজ পেমেন্ট অ্যাক্টের নাম এরা শোনে নি। তবু মালিকদের শিকায়ত ফুরোয় না ।
এদের গায়ে বুনো গন্ধ; এক একেকজন প্রায় দু’জনের মত ভাত খায় যে! তবে এরা ক্ষেতে পায়খানা করলে মাটি নাকি উর্বরা হয়।
ওরা শীতকালে ধানকাটার পর ভিনগাঁয়ে সপরিবারে চলে যায়; মাঠে তাঁবু খাটিয়ে থাকে। খালি মাঠে চরতে আসা পাখিদের ফাঁদ পেতে ধরে বিক্রি করে। তবে এরা যে বেঁচে আছে এটাই গাঁয়ের লোকজনের চোখে পড়ে না।
ছুরিগাঁয়ের জীবন বয়ে চলেছে আহিরণ নদীর মত –সেই একই খাতে। আদ্যিকাল থেকে যেমন চলে আসছে।
কবে থেকে? তা রামনিবাস জানে না । খালি এটুকু বলতে পারে যে ওর ঠাকুমা বিয়ে হয়ে এসেছিল এই গাঁয়ে। ঠাকুর্দাকে ও দেখে নি। ঠাকুমা বলত যে ওরা আসলে সিঙ্ঘানিয়া। পদবি আগরওয়াল, রাজস্থানের মারওয়ার থেকে এসেছে। সেখানের কোন গ্রামে ওদের ঠাকুমার বাবার পেশা ছিল মীনার কাজ; নাম হয়েছিল । দশ গাঁয়ের লোকে চিনত ।
তারপর কিছু একটা ঘটে; কোন এক ঘটনা, যার ফলে ওর ঠাকুর্দা ঠাকুমাকে নিয়ে পালিয়ে আসে। মারওয়ার থেকে দিল্লি, সেখান থেকে ভোপাল। তারপর বছর খানেকের মাথায় ওই দম্পতিকে দক্ষিণ পূর্ব মধ্যপ্রদেশের ছত্তিশগড় এলাকার আহিরণ নদীর তীরে ছুরি গাঁয়ে নিয়ে আসে মনসুখনারায়ণ জোশী। জোশী হলেন মাড়োয়ারি সমাজের পূজারি ব্রাহ্মণ। ঠাকুর্দা ঠাকুমার বিয়ে দিয়েছিলেন, আর ওদের প্রাণ বাঁচাতে গোপনে অন্য লোকের হাতে টাকাপয়সা দিয়ে দম্পতিকে ভোপালে পৌঁছে দেন। কিন্তু সেখানে দুশমন খবর পেয়ে যায়। রামনিবাসের বাবা বনওয়ারি তখন ওর ঠাকুমার পেটে। নিরুপায় হয়ে ওরা আবার জোশীজির কাছেই হাতজোড় করে।
শেষে উনি বললেন তাহলে ছুরিকলাঁ গাঁয়ে চল, আহিরণ নদীর ধারে। রাজপরিবার সিধে সাদা। গ্রাম পঞ্চায়েত আমার কথায় মানা করবে না । আমি রেভিনিউ রেকর্ড দেখে আবাদী জমিন থেকে তোদের পাঁচ ডেসিমেল জমিন ঘরতোলার জন্যে পাইয়ে দেব। আগে ঘর তুলে নিবি, ইঁটের দেওয়াল ,চূণসুরকির গাঁথনি আর খাপরার ছাদ। তারপর ছ’মাস বাদে পাটোয়ারিকে দিয়ে আমিই রেভিনিউ অফিসে তোদের বিরুদ্ধে বেজাকব্জা ও সরকারি আবাদী জমিনে বিনা পারমিশনে ঘর তোলার নালিশ করে কেস খাওয়াব। দেওয়ানি মামলা। তহসিলদারের কোর্টে বিচার হবে। কোন উকিল লাগাবি না । হাতজোড় করে বলবি হজুর মাঈবাপ! ভুল হয়ে গেছে, মাপ করে দিন। মাথার উপরের ছাদ কেড়ে নেবেন না । ব্যস, সামান্য জরিমানা হবে; জমা করে দিবি।
কেল্লা ফতে। দুমাস পরে তহসিল অফিস থেকে পাকা রেভেনিউ বুক ও রেজিস্ট্রির কাগজপত্তর এসে যাবে। সামান্য খাজনা ধার্য হবে, বাৎসরিক। তোরা ওই জমিনের মালিক হবি। সব একনম্বরের কাগজপত্তর। বুঝলি, যদি আগে থেকে অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে নকশা পাস করিয়ে ঘর তুলতে যেতি, তো ‘অনাপত্তি প্রমাণ পত্র, ডাইভার্সন সার্টিফিকেট এসব পেতে ছ’মাস লাগত। ততদিন থাকবি কোথায়!
এই দুনিয়ায় আইন মেনে কাজ করলে সময় বেশি লাগে, গাঁটের কড়ি খসে বেশি। আইন না মেনে কাজ করে আইনের কাছে শরণাগত হও, কমপয়সায় তাড়াতাড়ি কাজ। এটাই ভগবানের বিধান।
ঠাকুর্দা শুধিয়েছিলেন—মহারাজ, শেষ প্রসঙ্গটি বুঝি নি। আমি মুখ্যু মানুষ, যদি একটু খুলাসা করে বলেন।
শোন তবে। বৈকুন্ঠে বিষ্ণুভগবান দুপুরে খেয়েদেয়ে লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে একটু ভাতঘুম দিচ্ছিলেন। এমন সময় অষ্টাবক্র মুনি এসে হাজির। জরুরি কাজ। বিষ্ণু যেন একখুনি হাজির হন। দ্বারী জয়-বিজয় দুই ভাই কিছুতেই ঢুকতে দেবে না । অমন ভিখমাঙ্গা বৈরাগিঠাকুর ঢের ঢের দেখা আছে। অসময়ে ভগবানের ঘুম ভাঙানো যাবে না । কাঁচাখেকো মুনি অগ্নিশর্মা! শাপ দিলেন ওদের বৈকুন্ঠের চাকরি উনি খেয়ে নেবেন। ওদের মানুষের পৃথিবীতে যেতে হবে।
বিষ্ণু ঘুম ভাঙলে উঠে এসে নিজের দারোয়ানদের জন্যে অনেক কাকুতিমিনতি করলেন। কিন্তু হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না । মুনিঋষির অপমান। কান ধরে ক্ষমা চেয়েও রেহাই নেই । জয়-বিজয় মালিককে বললে হজৌর, যা করেছি আপনার হুকুমে। এখন আপনি যদি না দেখেন!
তখন অপ্রস্তুত বিষ্ণু আমতা আমতা করে বললেন যে তোরা বেছে নে ; যদি ধরতীতে গিয়ে আমার শত্রু রূপে থাকিস, তো তিন জন্মে খালাস। নতুন ট্রান্সফার অর্ডার নিয়ে বৈকুন্ঠে ফেরত, পুরনো ডিউটিতে জয়েন করবি। আর যদি ভক্ত হয়ে জন্ম নিতে চাস তবে ফিরে আসতে সাত জন্ম লাগবে। এখন তোরা যা চাইবি।
ওরা বলল, --মালিক, আমরা চাই শত্রুরূপে জন্ম নিয়ে আপনার হাতে মরে তিনবারে সাজা কেটে মুক্ত হয়ে ফিরে আসব।
উনি বললেন তথাস্তু!
তাই ওরা দু’ভাই সত্যযুগে হিরণ্যাক্ষ- হিরণ্যকশিপু , ত্রেতাযুগে রাবণ-কুম্ভকর্ণ এবং দ্বাপরে শিশুপাল-দন্তাবক্র হয়ে জন্মাল। তারপর বিষ্ণূভগবানেরই তিন অবতাররূপ নরসিং ভগবান, রাম ভগবান ও কৃষ্ণভগবানের হাতে বধ হয়ে মুক্তি পেল। তাই বলছি এসব শাস্ত্রমতে ঈশ্বরের বিধান।
এভাবেই ছুরি গাঁয়ে সাতঘর মারওয়ারি পরিবার গত আশি বছরে ঠাঁই পেল। এরা সবাই ধানচাল কেনা বেচা করে আর মুদি দোকান চালায়। ছুরিকলাঁ এখন বর্ধিষ্ণু গ্রাম, জনসংখ্যা দশহাজার ছাড়িয়েছে। আর তাদের উকিল, অভিভাবক, রক্ষাকর্তা হলেন জোশী মহারাজ। সবাই দেখা হলে বলে প্যার লাগুঁ। পায়ে পড়ি গো মহারাজ।
তবে রামনিবাসের ঠাকুমা নাতিকে বলত ওই বিটলে বামুন থেকে শতহস্ত দূরে থাকবি।
কেন ঠাকুমা, উনিই তো তোমাদের এই গাঁয়ে এনে বসিয়েছেন। কত দয়ার শরীর! পরোপকারী।
চুপ কর! তুই সেদিনের ছোঁড়া , কতটুকু দেখেছিস? আমার সোনার মাকড়ি আর রূপোর নাকছাবি ওকে দিতে হয়েছিল। এছাড়া ওর চলে সুদের কারবার। মাসে তিনটাকা হারে।
সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে আহিরণের পারে, ঘাসের উপর বসে অন্যমনস্ক ব্যাংক ম্যানেজার রূপেশ বর্মা একটা শিস ছিঁড়ে চিবুচ্ছিল। রামনিবাসকে বলল এবার উঠলে হয় না ?
-বিলকুল সাহাব। এক আখরি সিজার পিলাইয়ে।
রূপেশ পকেট থেকে পানামা সিগ্রেটের প্যাকেট থেকে দুটো বের করে একটা রামনিবাসকে দিয়ে একটা নিজে ধরায়। রামনিবাস একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে খোসামুদে সুরে বলে—আপকে সংগ দিনভর ঘুম রহা হুঁ। তো সিজার পী রহা হুঁ, নহি তো বিড়ি !
রূপেশ গত ছ’মাসে বহুবার দেখেছে যে ছুরির কয়েকজন সিগ্রেটকে সিজার বলে কেমন গর্বিত ভাবে তাকায়। আর জুটে গেছে রামনিবাস। সকাল আটটা বাজলেই এসে বেল টিপবে। ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে মন দিয়ে খবরের কাগজ পড়বে। ঠুল্লু এসে চা ও জলখাবার দিয়ে যাবে। নিঃসংকোচে সেগুলো সাঁটিয়ে ও সেদিনের চারপাশে কী কী ঘটছে এবং কী কী ঘটবে তার ফিরিস্তি ম্যানেজারকে শোনাবে। রূপেশ সেসব আদ্দেক কান দিয়ে শুনতে শুনতে আগের দিনের বকেয়া কাজ, যেমন ভাউচার চেকিং বা লেজার চেকিং করতে থাকবে। এরপর ও উঠবে স্নান করে ব্যাংক খোলার জন্যে। রামনিবাসও বাড়ি যাবে।
কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার আগেই ও আবার ব্যাংকে হাজির। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে এককোণে বসে বসে সকালে পড়া খবরের কাগজ ওল্টাতে ওল্টাতে ও সবাইকে মন দিয়ে দেখে, সবার কথা কান পেতে শোনে। শেষে ব্যাংক বন্ধ হবার সময় ও ম্যানেজারকে ওর সামারি ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট দেয়। ধীরে ধীরে ও রূপেশের কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। রূপেশের অধিকাংশ ‘দোউরা’ বা ফিল্ড ভিজিট/সার্ভের সময় সঙ্গে থাকে রামনিবাস। ওর দুটো গুণ—ভাল মোটরসাইকেল চালায়, বিশেষ করে পুকুরের পাড় এবং ক্ষেতের আল দিয়ে চালাতে হলে। তখন রূপেশ ওর পেছনে বসে , কখনও কখনও চোখ বুজে ফেলে। আর প্রায় প্রত্যেক গ্রামে রামনিবাসের কোন না কোন কুটুম রয়েছে। ফলে চায়-নাস্তা ও ভেতরের খবর সহজেই পাওয়া যায়।
সফল ভাবে রাজত্ব চালাতে কিংবা ব্যবসাবাণিজ্য করতে হলে গুপ্তচর খুব জরুরি। কৌটিল্য বলে গেছেন। এছাড়া এখানে ও কাউকে চেনে না, আবার হেড অফিস থেকে নির্দেশ এসেছে। দশটা গাঁয়ের প্রোফাইল তৈরি করতে । যাতে সেখানকার জমি, লোকজন, চাষ ও ব্যাংকের ডিপোজিট ও লোন বিজনেসের সম্ভাবনার স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে। আগামী মাসে যে কোন দিন হেড অফিসের অফিসার এসে ইন্সপেকশন করবেন । তখন যেন এই ডায়েরিটা কমপ্লিট থাকে; নইলে—
ফলে ও রামনিবাসকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে। মনে মনে সংকল্প নেয়। অন্ততঃ একজন ক্লার্ক পোস্ট হলেই ও আর রামনিবাসকে নিয়ে ফিল্ড ভিজিটে যাবে না । আর রামনিবাস তো কোন কমিশন বা সার্ভিস চার্জ চাইছে না । ও শুধু ওদের গেঁয়ো আড্ডায় ব্যাংক সাহাব যে ওকে ছাড়া চলতে পারেন না , ও যে সে লোক নয়-এটা বলে ঘ্যাম নেয়। সে যাকগে!
আজকে ওরা ফিরছে ঝোরা –সিরকি গ্রাম থেকে। এখন শীত আসি- ভাই আসি-ভাই করছে। তবু সারাদিনের হ্যাপা আর গাঁয়ের মধ্যে ঘরে ঘরে গিয়ে দরজায় টোকা দেওয়া। কেউ খুললে আলাপ পরিচয় করে তাকে খানিকটা ‘ইমোশনাল অত্যাচার’ করে সেভিংস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলানো—এসবের একটা ক্লান্তি আছে বইকি!
পাঁচ টাকা দিয়ে খাতা খোলা। তবু অধিকাংশ লোক বলে ওদের কাছে এখন টাকা নেই । আস্তে আস্তে ও বুঝতে পারে এই সব নদীপারের গাঁয়ে নগদের কারবার কম। কাজেই ওদের কাছে পাঁচটাকা নগদ না থাকা অস্বাভাবিক নয়। কয়েকবার ও নিজের পকেট থেকে পাঁচটাকা বের করে দিয়েছে। বলেছে যেদিন ব্যাংকে আসবে সেদিন মনে করে আমাকে ফেরত দিও।
রামনিবাস হাঁ-হাঁ করে উঠেছে। সাহেব, এমন ভুলটি করবেন না । নিজের পকেট থেকে টাকা না খসলে মানুষ ওর ব্যাংক অ্যাকাউন্টকে নিজের মনে করে না, সরকারি কারবার ভাবে। সরকার কা মাল , দরিয়া মেঁ ডাল। আর এভাবে দান-খয়রাত করতে থাকলে আপনার মাসের মাইনের পুরো টাকাটা ওদের পেটে যাবে। আমাকে কথা বলতে দিন। ফির আপ মেরা জাদু দেখনা।
রামনিবাস সত্যিই ম্যাজিক দেখাল। যেই কেউ বলে টাকা নেই ও হো-হো করে হেসে ওঠে। বলে সে কী! এতবড় গৌটিয়া, দশগাঁয়ে নামডাক। তার ঘরে পাঁচটা টাকা নেই , লোকে শুনলে বলবে কী! আর এই কথা যদি অমুক গ্রামে তোর সমধি-সমধিনের (বেয়াই-বেয়ানের) কানে পৌঁছে যায় তাহলে ওরা কী ভাববে? হাভাতে পরিবারে মেয়ে দিয়েছি? শোন, চালের বাতায় হাতড়ে দেখ, ঠিক পেয়ে যাবি। নয় তো তোর গিন্নিকে শুধিয়ে দেখ। আর নইলে পাশের বাড়ি থেকে ধার নে । আরে আমরা খালি হাতে ফিরে যাব? ব্যাংক ম্যানেজারকে ফিরিয়ে দিবি? এ তো মালক্ষ্মী কে বিদেয় করা! দেখিস নি, শেঠেদের গদ্দিতে তিজৌরির (সিন্দুকের) পাশের দেয়ালে বড় বড় করে লেখা থাকে ‘কুবের মহারাজকে ভান্ডার সদা ভরা পুরা রহে!’ আর তুই স্বয়ং কুবেরমহারাজকে তোর দ্বার থেকে শূন্য হাতে বিদেয় করবি? ধর্মে সইবে? ভেবে দ্যাখ ।
এর পরে আর কাউকেই খুব বেশি ভাবতে হয় না ।
একদিনে জমাখাতা খোলা অভিযানের সাকসেস রেট খুব খারাপ নয়। কৃতজ্ঞ রূপেশ শীতের সন্ধ্যেয় ঘনিয়ে আসা বিষণ্ণ অন্ধকারে মোটর সাইকেল স্টার্ট করতে করতে রামনিবাসকে শুধোয় কালকে ও জোশী মহারাজের গদ্দিতে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতে পারবে কি না ।
৭)
জোশী মহারাজের সঙ্গে দেখা করা যে এত কঠিন হবে তা রূপেশ বর্মা ভাবতে পারেনি। ব্যাংকের বারান্দায় মন্ত্রীজির পাশে দাঁড়িয়ে তোলা ছবি যা স্থানীয় হিন্দি পত্রিকায় পরের দিন ছেপে বেরোল তা নিঃসন্দেহে শ্রীমান ব্যাংক ম্যানেজারের লোকের চোখে ‘ভাও’ বাড়িয়ে দিয়েছিল। গত কয়েকমাস ধরে ছুরি গাঁয়ের পথেঘাটে চলাফেরার সময় লোকজন রাস্তায় চিনতে পারে; বয়স্ক মানুষেরা হাত তুলে নমস্কার করে। ‘জয় রাম সাহেব’ শুনতে শুনতে ওর কান পচে গেছে। আগে ও লজ্জা পেত, হাত তুলে প্রতি নমস্কার করত। তারপরে হাত ওঠা বন্ধ হয়ে গিয়ে একটু মাথা ঝোঁকানো শুরু হল। ইদানীং তা ও হয় না , বিশেষ করে বাইক চালানোর সময়।
জোশী মহারাজের বাড়িতে সামনের বড় হলঘরে একটি মুদি দোকান চলে, তাতে গদিতে বসে তাঁর ছেলে গিরীশ। রোগা পটকা পানচিবোনো মুখে একগাল হাসি গিরীশ অধিকাংশ সময় লুঙ্গি আর হাতকাটা গেঞ্জি পরেই দোকানে বসে। এই দোকানে শুধু মুদি বা ‘কিরানা সামান’ নয়, শুকনো ডুমুর ফল থেকে তৈরি ‘অঞ্জির’ বলে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করার ভেষজ, ত্রিফলা, আনন্দকর ট্যাবলেট সবই পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশ জিনিসপত্তর আঢাকা টিনের ড্রামে রাখা। মাকড়সার জাল ও টিকটিকি কাছের দেওয়ালে শিকার ধরায় ব্যস্ত।
মহারাজের আসল পেশা হল গুরুগিরি, পুরুতগিরি এবং বিভিন্ন আর্থিক সমস্যার নিদান হেঁকে প্রণামী নেওয়া। প্রথমবার যাওয়া মাত্র গিরীশ দেঁতো হেসে বলল পিতাশ্রী তো অমুক গাঁয়ে শিষ্যবাড়ি গেছেন। ঘন্টা দুই পরে আসতে। এবার ব্যাংকের ‘লাঞ্চ আওয়ারে’ ফুর্সত পেয়ে রূপেশ ধাওয়া করল যাতে আজই ওঁর সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলা যায়। ও এখন প্রবেশনে আছে। তাই একটা ডেইলি পজিশন মেমো ওকে রোজ সন্ধ্যেবেলা ডাকে ফেলতে হয় যাতে বিভিন্ন হেডের ডিপোজিট অ্যকাউন্টএর সংখ্যা ও অ্যামাউন্ট হেড অফিস জানতে পারে ।
গাঁয়ের লোকজন প্রথম থেকেই লোন পাওয়ার জন্যে চাপাচাপি করছে ; কিন্তু ওর চেয়ারম্যানের সেই এক কথা। আগে ভাল করে ‘জনসম্পর্ক’ কর, জমা খাতা খোল, কে কী কেমন এইসব খোঁজ নাও, তারপর তোমাকে লোন দেওয়ার পাওয়ার দেওয়া হবে। ও জানে প্রত্যেক নতুন শাখা ও নতুন ম্যানেজারের জন্যে উনি আলাদা আলাদা ডিপজিট গ্রোথ রেট ও বেঞ্চমার্ক ঠিক করে দিয়েছেন। সেটা ছোঁয়ার পর এক-দুদিনের ওয়ার্কশপ করে তবে কর্জা দেওয়ার অনুমতি পাবে।
এবার গিয়ে শুনল উনি পূজোয় বসেছেন। ম্যানেজারকে একটু বসতে বলেছেন। ওকে খাতির করে গিরীশ একটা কাঠের চেয়ারে বসায়। রামনিবাস সাদা চাদরে ঢাকা গদ্দিতে গিরীশের পাশে বসে খোশগল্পে মেতে ওঠে।
রূপেশ এদিক ওদিক মন দিয়ে দেখে; সাদা চাদর ও গিরীশের তাকিয়ার কভার বেশ ময়লা। গিরীশের কাঁধের পাশ দিয়ে উঁকি মারা পৈতেরও একই হাল। একটু পরে চা এল, কাপের আসল রঙ কবেই ফিকে হয়ে গেছে। বড্ড চিনি। ওর মুখের ভাব দেখে গিরীশ আশ্বস্ত করে যে এটা পাউডার মিল্কে বানানো নয়, ওদের ঘরের কালো গরুর দুধ দিয়ে তৈরি।
দোকানের বারান্দায় জনাচারেক মহিলা বসে কুলো দিয়ে চাল গম থেকে কাঁকর বেছে আলাদা করে রাখছে। রূপেশ অন্যমনস্ক ভাবে ওদের চাল গম বাছাই দেখছিল, হটাৎ টের পেল যে ওরাও টের পেয়েছে। দু’জন মাথায় ঘোমটা টানতে টানতে নীচু গলায় অন্যদের কিছু বলল। এবার ওরা একটু পাশ ফিরে বসে নিজেদের কাজ করতে লাগল।
একটা স্টিলের থালায় করে এল মৌরি, লবংগ আর ছোটা ইলাইচি। অতিথি সৎকার সুসম্পন্ন । এবার ও উসখুস করছে। ব্যাংকে যদি অন্য গ্রাহকেরা এসে বসে থাকে? ও চাপরাশিকে বলে এসেছে যে আধঘন্টার বেশি লাগবে না । এ তো প্রায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেল। ও উঠে পড়ে , বলে নাহয় কাল একবার আসবে।
এমন সময় একটা চড়া সুরে শোনা গেল—আরে এত অধৈর্য হলে চলে? তাহলেই হয়েছে। একজন দীর্ঘদেহী প্রৌঢ় ভেতর বাড়ি থেকে একটু ঝুঁকে ঢুকছেন। খালি গা, ধুতি পরা, যজ্ঞোপবীত যত্ন করে মাজা, পায়ে কাঠের খড়ম। বাঁকা ঈগল নাকের নীচে সাদা ঝোলা গোঁফ, আর ঠোঁটে ব্যঙ্গের হাসি। কিন্তু ঈষৎ পিঙ্গল যে চোখজোড়া ওকে দেখছে তাতে কোন প্রসন্নতা নেই ।
ম্যানেজার এ্যাদ্দিনে এখানকার কায়দা-কানুন শিখে গেছে। একটু ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে পা ছোঁয়ার ভঙ্গিটুকু করল , খানিকটা কুস্তির আখড়ায় চ্যালা যে ভাবে গুরুকে অভিবাদন করে। কিন্তু পা ছুঁল না । জোশীজি বললেন –শুনুন সাহেব, বয়স কম। তাই এত ছটফটানি; আপনারা হলেন সরকারি নৌকর। রাগ করবেন না , যে নোকরি করে সেই নৌকর, সে কলেক্টরই হোক কি ব্যাংক ম্যানেজার। কিন্তু আপনাদের কাজ প্রশাসন চালানো নয়, ব্যবসা করা। অধৈর্য হলে ইতোনষ্টঃ ততোভ্রষ্টঃ।
ব্যবসায়ীর কাজ জাল পেতে পাখি ধরা; অনেক ধৈর্য দরকার। যেমন আপনি আজকে অনেক আশা নিয়ে এসেছেন যে আমার বচত খাতা খুলবেন। কিন্তু আমি অত সহজে ধরা দেব না। ব্যাংকের কাজ কী? না , লোকের সঞ্চিত পয়সা জমা নিয়ে সুদ দেওয়া আর সেই পয়সা জরুরতমন্দ লোককে সুদে কর্জ দেওয়া। তো আপনারা এখনও খালি জমা নিচ্ছেন, কাউকেই লোন দিচ্ছেন না । বলি, জমাদাতাদের সুদ কী আপনার পকেট থেকে দেবেন? ব্যাংকের বাড়িভাড়া? বিজলি বিল? আপনাদের মাইনে? এটা কী ব্যাংক না চিটফান্ড?
রূপেশের আত্মবিশ্বাস টলে যায়। মিনমিন করে বলে—কী বলছেন? আমরা সরকারি ব্যাংক, ইন্দিরা গান্ধীর তৈরি। আমাদের চেয়ারম্যান স্টেট ব্যাংকের।
জোশীজি হাত তুলেছেন।
দিল্লি থেকে মন্ত্রীজি এসে উদঘাটন করেছেন, নইলে সন্দেহ থেকেই যেত। অত ঘাবড়ালে চলে? বসুন, জলটল খান। আরও কথা আছে।
ও সবিনয়ে জানায় যে চা জলটল সব হয়ে গেছে। এখন ওকে ব্যাংকে যেতে অনুমতি দেওয়া হোক। হয়ত গ্রাহক বসে আছে।
জোশীজি আবার হাত তুলে রামনিবাসকে বললেন—তুম যাও বেটা! ব্যাংক জাকে বৈঠে রহো –ম্যানেজার সাহাব লৌটনে তক। গ্রাহকদের বলবে অপেক্ষা করতে , সাহেব মহারাজের সঙ্গে জরুরি আলোচনায় ব্যস্ত।
চলে যেতেই ছেলে গিরীশকে বললেন ক্যাশবাক্স থেকে একটা একশ টাকার নোট আর একটাকার সিক্কা দিয়ে ওর দোকানের নামে খাতা খুলতে। অবাক রূপেশ কোন কথা না বলে ব্রিফকেস থেকে ফর্ম ও ডিপোজিট স্লিপ বের করে ফিল আপ করা শুরু করে।
উনি বললেন—এই দিয়ে শুরু হল, বুঝলে ম্যানেজার; একশ এক টাকা। এর পরে আমার নামেও খুলব। কিন্তু এখন নয়, আগে তুমি লোন দেওয়া শুরু কর, তারপর।
আর শোন, রামনিবাসকে ইচ্ছে করে সরিয়ে দিলাম। তুমি ব্যাংকে গেলে ও জিজ্ঞেস করবে মহারাজ কত টাকা দিয়ে খাতা খুলেছেন? বলবে না । যদি দোস্তি ইয়ারির খাতিরে বলে ফেল তবে আমি তোমার হেড অফিসে নালিশ করব। গ্রাহকের খাতার মন্ত্রগুপ্তি ফাঁস করার অপরাধে তুমি বরখাস্ত হবে; প্রবেশনে আছ তো।
রূপেশের হাড়পিত্তি জ্বলে যায়। একবার ভাবে টাকাটা ফেরত দিয়ে উঠে আসে। কিন্তু অনেক আগেই শিখে গেছে যে রাগের মাথায় কিছু করতে নেই । রাগের গ্যাসটাকে কবজা করে ভেতরে বেঁধে রাখলে সেটা বেলুনের মত ওপরে ওঠার শক্তি দেয়। আগেই সেটা বের করে দিলে শক্তি নেতিয়ে পড়ে , ঠিক চুপসে যাওয়া গ্যাস বেলুনের মত।
ও ফ্যাকাশে হেসে বলে যে মন্ত্রগুপ্তি ফাঁস হবে না ।
এবার ও উঠতে যাচ্ছিল, উনি হাত ধরে বসিয়ে দিয়ে গিরীশকে ইশারা করেন। ও ভেতর থেকে একটা বড় কাঁসার জামবাটি ভরে পায়েসের মত কিছু নিয়ে আসে। উনি সেটা রূপেশকে ধরিয়ে দিয়ে সস্নেহে বলেন—খান, লজ্জা করবেন না । মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি যে দুপুরের খাওয়া হয় নি।
ওর ইতস্ততঃ করা দেখে বুঝিয়ে বললেন—এটা হল পীযূষ। আমাদের একটা গরু আজ প্রথম দুধ দিয়েছে। কোন মায়ের সন্তানের জন্যে প্রথমবার যে দুধ বের হয় সেটা একটু গাঢ় থাকে। এটা তাই; আর সন্তানের জন্যে সেই দুধ হল অমৃত। সুরভির মত সমস্ত গাভীই আমাদের মাতা। গীতামাহাত্ম্যে ব্যাসদেব বলেছেন ‘সর্বোপনিষদো গাবো দোগ্ধা গোপালনন্দনঃ’। তাই এটাকে আমরা পীযূষ বা অমৃত বলি। খেয়ে নিন।
রূপেশ চামচ দিয়ে একটু একটু করে বাটি খালি করল। এমনসময় চাপরাশি ঠুল্লু দৌড়তে দৌড়তে হাজির। সায়েব চলুন, সরপঞ্চ কুমারসায়েব এসেছেন।
ধমকে উঠলেন জোশীজি। কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন যে সরকারের ব্যাংক কার ভরসায় ছেড়ে ও এখানে এসেছে। ও আমতা আমতা করে বলল যে কুমারসায়েব আর রামনিবাস ওখানে বসে আছে, কুমারসায়েব ম্যানেজারকে ডেকে আনতে বললেন, জরুরি কাজ আছে তাই ও এসেছে।
জোশীজি হাত নেড়ে ওকে প্রায় তাড়িয়ে দিয়ে বললেন যে কুমারসায়েবকে একটু বসতে বল। ম্যানেজার আসছে।
তারপর বললেন রামনিবাসের সঙ্গে আহিরণ নদীর পাড়ে বসে সূর্যাস্ত দেখেছে বটে, কিন্তু আহিরণ নদী আর কোসগাই পাহাড়ের পুরাণকথা ও জানে কি না । আর রামনিবাসের নারীঘটিত দুর্বলতার কথা ম্যানেজার সায়েবের জানা আছে কি না । ওর হতভম্ব ভাব দেখে বললেন যে কারও সঙ্গে দশ পা চলার আগে ভাল করে খোঁজ খবর নেওয়া উচিত। যেমন রামনিবাসদের বাড়িতে গমপেষানোর কল অর্থাৎ ‘আটা চাক্কি’ আছে বটে, কিন্তু ঘরে খাওয়ার লোক কম নয়। ওর বাবা আর ওর বিয়ে- সব আমিই করিয়েছি। ভাল ঘরের সুন্দরী গোরী চিট্টি পদ্মিনী মেয়ে, কিন্তু রামনিবাসকে জাদুটোনা করেছে এই গ্রামের কালিন্দী; স্বভাবে নগরবধূ।
-- হাঁ করে আছ ম্যানেজার, বিয়ে কর নি, স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম কী জানবে? তবে শোন নর্মদা নদীর দুঃখের কথা। অমরকন্টক গিয়েছ? নর্মদার উদগম স্থল? এখান থেকে কাঠঘোরা মহকুমা সদরে গিয়ে বাসস্ট্যান্ড থেকে পেন্ড্রার বাসে চাপবে। সাড়ে তিন ঘন্টা; সেখান থেকে বাস বদলে আরও আধঘন্টা গেলে অমরকন্টক, সেখানে সোনগুঢ়ার পাশে দেখবে ছোট্ট একটি কুন্ড আর জলধারা। সেই হল শিশু নর্মদা। এর জন্মদাতা মহাকাল পর্বত, আমরা বলি মহারাজ ‘মৈকাল’। একবার হল কি, রাজকুমার সোন নদ সুন্দরী নর্মদার প্রেমে পড়ল । প্রেম প্রগাঢ় হল। বিবাহবন্ধনে বাঁধা পড়তে রাজকুমারের আপত্তি নেই । নিজেই প্রস্তাব নিয়ে গেল নর্মদার পিতা মৈকাল মহারাজের কাছে। মৈকাল গম্ভীর হলেন; একমাত্র মেয়ে নর্মদা ,ছোটবেলা থেকেই মাতৃহারা। বড় মায়া। মেয়েকে ডেকে বললেন পুরুষের মন চঞ্চল, একমুখী নয়। আর রাজকুমারেরা বহুপত্নীক। তোর ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমি দোটানায় পড়েছি ।
নর্মদা বাবার গলা জড়িয়ে বলল এত ভেব না । ও খুব ভাল, আমায় কথা দিয়েছে।
মৈকাল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল।
বিকেল হতে চলল। এতক্ষণে রাজকুমার সোন নদের অমরকন্টকের ছোট পাহাড়ির কাছে পৌঁছে যাবার কথা। রাজকুমারী নর্মদা সেজেগুজে অপেক্ষায় অধীর। সখী চম্বল নদীকে বললেন—যাও সখি; একটু এগিয়ে দেখ, ও বোধহয় এসে গেছে। তাহলে ওকে বরণ করে নিয়ে এস।
চম্বল অপাঙ্গে তাকিয়ে বলল—দেখ সখি; আমার রাজকুমারের সামনে যাওয়ার মত বস্ত্র-আভরণ কিছুই নেই । এমন বেশে তোমার প্রতিনিধি হয়ে গেলে তোমারই বদনাম হবে। এখন তুমি যা ভাল বোঝ।
নর্মদা যত্ন করে নিজের বহুমূল্য বস্ত্রালংকারে চম্বলকে সাজিয়ে দিলেন।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অমরকণ্টকের আগে ছোট পাহাড়ি পাকদন্ডী পথে রাজকুমার সোন আর ছলাকলাপটিয়সী চম্বল নদীর দেখা হল। সেই আধো অন্ধকারে রাজকুমার চম্বলকে নর্মদা ভেবে ভুল করে বসলেন। চম্বল ও সোনের এই অশুভ মিলনে ঘনিয়ে এল মেঘ; বিদ্যুৎএর ঝলকানি আর বাজের আগুনে আকাশ চিরে চিরে গেল।
এদিকে অপেক্ষা করতে করতে ব্যাকুল হয়েছে নর্মদা আর মৈকাল পর্বতের কপালে ভ্রূকুটি। না রাজকুমার সোন না চম্বল নদী, কারও দেখা নেই , কোন খবর নেই।
শেষে দুজনে মিলে খুঁজতে বেরোলেন। পেয়ে গেলেন দুই অপরাধীকে; ভুল বুঝতে পেরে অনুতপ্ত রাজকুমার আর চম্বলের চেহারায় বিজয়িনীর হাসি।
নর্মদা শাপ দিলেন সখী চম্বলকে—যে প্রতারণা তুমি আমার সঙ্গে করেছ একদিন তোমার স্বামী তোমাকে এমন করেই ঠকাবে। আর রাজকুমার, তোমার বুকের মধ্যে ভালবাসা শুকিয়ে জেগে উঠেছে বল্গাহীন কাম। শাপ দিলাম, তোমার বুকের জল শুকনো বালিতে ভরে যাবে। মর্মাহত রাজকুমার সোন বললেন—আমি নিজে প্রতারিত হয়েছি, তোমার বসন ভূষণ দেখে। তুমি অবিচার করলে। আমিও বলছি তুমি আজীবন কুমারী থাকবে।
এবার সরপঞ্চ নিজে এসে হাজির হয়েছেন জোশী মহারাজের ডেরায়। পঞ্চায়েতের অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। নতুন সরকারি নিয়মে পুকুরের ঠিকা , মাছমারা ও বিজলি কনেকশন, সাপ্তাহিক বাজারের খাজনা ও ঘরছাড়া গরুমোষ কাঞ্জিহাউসে বাঁধা রাখা ইত্যাদি থেকে পঞ্চায়েতের যত আমদানি হয়, সব কোন না কোন ব্যাংকে খাতা খুলে জমা করতে হবে, তার অডিট হবে। কাজেই ম্যানেজার সায়েবকে এবার গা তুলতে হয়।
ব্যাংক বন্ধ করার ফাঁকে রামনিবাস ফিসফিস করে জানতে চাইল মহারাজ কত টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন?
অন্য পর্বগুলোর লিন্ক ওপরে পাওয়া যাবে না, না?
নীচে রয়েছে অবশ্য ...
অপূর্ব!
প্রশংসা করে শেষ করা যাবে না। জীবনের জলছবি, লোককথা, পুরাণ, লোকায়ত ইতিহাস কি না মিশেছে!
একজন মানুষের কতটা গভীর জীবনবোধ হলে তবে এই লেখা বেরোয়!
আভূমি কুর্ণিশ রঞ্জনবাবু!
খুব ভাল লাগছে . একটা অচেনা জগৎ দেখতে পাচ্ছি .
এটা এতো দিন পড়িনি কেন !!!!!!!
চারটি কিস্তি একসঙ্গে পড়লুম। মনে হচ্ছে 'ছত্তিশগড়ের চালচিত্র' পর্ব দুইয়ের প্রস্তুতি চলেছে।
চরৈবেতি ....