এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বাকিসব  মোচ্ছব

  • আহিরণ নদীর বুক ফাটে, মুখ ফোটে নাঃ ৭ম পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    বাকিসব | মোচ্ছব | ২৬ অক্টোবর ২০২০ | ২১১৩ বার পঠিত
  • ৩) বর্ষশেষের দড়ি টানাটানি

    ক্রিসমাসের ছুটি আসছে। ছুরিগাঁয়ে কোন ক্রিশ্চান পরিবার নেই । তাই কিছু বোঝা যাচ্ছে না । কিন্তু কোরবা গেলেই অন্য ব্যাপার। আহিরণ নদীর এপারে একটি টিলার উপরে সর্বমঙ্গলা দেবীর মন্দির। আর ওপারে ক্রিশ্চান পাড়া, মূল শহরের বাইরে । মেননাইট চার্চ্ ও দুটো স্কুল; ইংলিশ ও হিন্দি মিডিয়াম। কোন কাজে ওখানে গেলেই চোখে পড়বে সাজো- সাজো রব। একমাস ধরে, বলতে গেলে দীপাবলীর পর থেকেই। অনেকগুলো বাড়ি থেকে ঝুলছে বেথেলহেমের পাঁচমুখো তারার আলোকমালা।

    তাতে ব্যাংকওলাদের কী? ৩১ তারিখে বর্ষশেষ, ব্যাংকের সার্বজনিক অবকাশের দিন। দুটোই সময়মত নোটিস বোর্ডে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যার সারকথা হলঃ

    এতদ্বারা সর্বসাধারণকে এবং সমস্ত গ্রাহকগণকে সূচিত করা যাইতেছে যে ২৫শে ডিসেম্বর ক্রিসমাস এবং ৩১শে ডিসেম্বর ব্যাংকের বার্ষিক লেখাবন্দীর নিমিত্ত নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্টের অন্তর্গত সমস্ত লেনদেন বন্ধ থাকিবে।

    ডিসেম্বরের গোড়ায় একজন ফিল্ড অফিসার ও একজন ট্রেনি অফিসার এই শাখায় জয়েন করেছে। দুজনেই বিলাসপুরের বাসিন্দে; পোস্ট গ্র্যাজুয়েট।

    একজন মারাঠি ব্রাহ্মণ , শ্রীরাম চিত্তাওয়ার। আর একজন দলিত, বিপুল ডোঙ্গরে। একজন থাকে চাটাপাড়া, ট্র্যাডিশনাল মারাঠি ব্রাহ্মণদের পাড়া । অন্যজন রেলস্টেশনের কাছে।

    রূপেশ চারজনকেই একসাথে মেস করে থাকতে বলেছিল। কিন্তু শ্রীরাম রাজি হয় নি । ওর পক্ষে দলিতের সঙ্গে একছাতের নিচে থাকা, একই পায়খানা ব্যবহার করা অসম্ভব।

    রূপেশ নির্বিকার। বলল –ঠিক আছে, তোমার অসুবিধে হচ্ছে তো তুমি আলাদা থাক, স্বপাকে খাও। ওটা তোমার সমস্যা। শ্রীরামের মুখ কালো হয়ে গেল। কিন্তু দু’একদিনের মধ্যেই দেখা গেল ওর অন্য অসুবিধে। বাড়ির আদুরে ছেলে, নিজে হাতে রান্না করেনি কখনও। শেষে ও মোড়ের মাথায় জুগনুর দোকানে কথা বলে ওখানেই দু’বেলা পাত পাড়ার বন্দোবস্ত করে নিল। রূপেশ জানে যে এরা দু’জন হল ‘দো দিনকা মেহমান!’ দু’মাস ওরিয়েন্টেশনের পর অন্য কোন ব্রাঞ্চে পোস্টিং হয়ে যাবে। কিন্তু সাতদিন পরে বিপুল নিজে সতনামী পাড়ায় ঘর ভাড়া করে উঠে গেল। রূপেশ জানতে চাওয়ায় দাঁত বের করে বলল- বস, জ্যাদা টেনশন নহীঁ লেনে কা। আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না । ওখানে ওরা বাড়িভাড়া নিচ্ছে না , শুধু দু’বেলা ভাত খাওয়ার জন্যে পঞ্চাশ টাকা নিচ্ছে। কেন জানেন? কারণ, এই গাঁয়ের দলিতসমাজে আমিই একমাত্র ব্যাংকের সাহাব। ওরা আমাকে নিয়ে গর্বিত।

    রাত্তিরে ওরা তিনজন খেতে বসলে শ্রীরাম বলল-- দেখলেন তো বস, আপনি খামোখা রেগে যাচ্ছিলেন। ওরও এখানে আমাদের মধ্যে অস্বস্তি হচ্ছিল। এখন স্বজনদের মধ্যে আনন্দে আছে।

    রাজন কোন কথা না বলে রূপেশের দিকে তাকিয়ে রইল।

    রূপেশ বলল—একটা কথা; একই ভগবান কি তোকে আমাকে ডোঙ্গরেকে বানায় নি? একই পরমপিতা?

    --বানিয়েছে, তবে এক জায়গা থেকে নয়।

    --মানে?

    --এই দেখুন না , আমরা সবাই মায়ের পেট থেকে জন্মেছি; কিন্তু একই জায়গা থেকে কি? কেউ নর্মাল, কেউ ফরসেপ, কেউ সিজারিয়ান।

    রূপেশের গলায় ভাত আটকে গেল। আমরা নর্মাল, আর ডোঙ্গরে সিজারিয়ান? তুই কী করে জানলি?

    -শাস্ত্রে আছে। ঋগবেদের পুরুষসূক্ত দেখুন। শূ্দ্র জন্মেছে সৃষ্টিকর্তার পা থেকে, ব্রাহ্মণ মাথা থেকে।

    --ঠিক আছে। আমিও তো শূদ্র, কাল থেকে তুই আর আমি একজায়গায় খাব না ।

    -- না বস, আপনি কী করে শূদ্র হবেন?

    --- আমার পৈতে হয় নি, আমি দ্বিজ নই, তাই শূদ্র।

    শ্রীরাম হেসে বিগলিত হয়ে বলতে থাকে—আরে না না বস; আপনি কোটা থেকে চাকরিতে আসেন নি; মেরিটে এসেছেন। ও তো দলিত কোটায় চাকরি পেয়েছে।

    রূপেশের ভিতরে কী একটা ঘটে যায়। প্রায় গর্জন করে ওঠে— বেশি বস্ বস্ করবে না বলছি।

    ওরা দুজনেই চমকে ওঠে। রাজন ও শ্রীরাম, দুজনের চোখেই প্রশ্ন? কিছু ভুল বলেছি? অ্যাতো রেগে গেলেন কেন?

    রূপেশ লজ্জা পায়। একটু পরে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে খানিকটা আত্মগত ভাবে বলতে থাকে—আসলে আমার বড়বৌদি আমাকে মজা করে বস বলত, বাবা কড়া করে বারণ করে দিয়েছিলেন।

    কেন?

    পরে আমাকে আলাদা করে বুঝিয়েছিলেন যে ওটা আমেরিকান ফ্যাক্টরি স্ল্যাং; একটু যৌনগন্ধী ।

    ওরা দুজন হতভম্ব। কী করে?

    বাবা ছিলেন ভিলাই প্ল্যান্টের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়র। উনি বলেছিলেন যে ফ্যাক্টরিতে বা ওয়ার্কপ্লেসে নাট বল্টুকে মেল ও ফিমেল বলা হয়। তেমনি বস এসেছে এমবসিং থেকে। অর্থাৎ মার্কিন মজদুর কী নজরিয়া মেঁ ম্যানেজার মজদুরোঁ কা বজাতে হ্যাঁয় , তাই। আমিও বস্ কথাটা সহ্য করতে পারি না ।

    বাবা রিটায়ার করে সেক্টর সিক্সের মার্কেটে বই ও স্টেশনারির দোকান খুলেছিলেন। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য ছিল দিনভর মজে সে কিতাব পড়না। ওহি উনকী প্যাশন থী।

    --আংকল এখনও দোকানে বসেন?

    -- না , অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

    ওরা প্রত্যেক শনিবারে ব্যাংক বন্ধ হওয়ার বেশ আগে বাস ধরে বেরিয়ে যায়। রাজন পারে না । ওর কাজ ক্যাশ মিলিয়ে ক্যাশবুক লিখে তবে শেষ হয়। অথচ ওরা যাবে বিলাসপুর, আর রাজন যাবে ভিলাই। আরও তিনঘন্টার জার্নি।

    তবু শনিবার হলেই ওরা দুজন ছটফট করতে থাকে।

    ইস,বন্দে মাতরম বাসটা চলে গেল। আরে, আলি আহমেদ ট্রান্সপোর্টও গেল। অ্যাই রাজন, এখনও ক্যাশ ক্লোজ করিস নি? তুই বড্ড স্লো, এরপর এম পি ট্রান্সপোর্ট ও ফসকাবে।

    প্রত্যেক শনিবারে সন্ধ্যের মুখে বিলাসপুরে নিজের নিজের মহল্লায় গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঠেক না করলে ওদের রাত্তিরের খাওয়া হজম হবে না । তারপর রোববার সকালে ক্রিকেট খেলা!

    প্রথম মাস, রূপেশ কি ওদেরএকটু বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছে?

    এক শনিবারে রিজার্ভ ব্যাংকে পাঠানোর উইকলি স্টেটমেন্ট তৈরি করতে গিয়ে লেগে গেল ফস্কা গেরো! ট্রায়াল ব্যালান্স মিলছে না । কিছুতেই না । রূপেশের কপালে অনেকগুলো ভাঁজ, এরকম হওয়ার কথা তো নয়! ব্যাপারটা কী?

    ও রাজনকে বলল তুমি যাও, আমি দেখছি।

    একবছরের বেশি একসঙ্গে কাজ করে ওদের সম্পর্কে একটা অন্যরকম দোমাটি লেগেছে। রাজন বলল যে ও যাবে না , লফরা নিপটানে মেঁ হাথ বটায়েঙ্গে।

    --আরে একঘন্টা পরে শেষ বাসটাও বেরিয়ে যাবে।

    --যাকগে, এবার নাই গেলাম। পরের শনিবারে যাবো। শুক্কুরবারে ক্রিসমাসের ছুটি, ওর সঙ্গে মিলিয়ে একসাথে নেব। তাহলে তিনদিন পাওয়া যাবে।

    --পরের সপ্তাহে কাউকে ছুটি দেওয়া যাবে না । অ্যানুয়াল ক্লোজিং! সমস্ত ডিপোজিট ও লোন অ্যাকাউন্টে ইন্টারেস্ট অ্যাপ্লাই করে লম্বা জাবদা খাতায় জটিং করে টোটাল করতে হবে । ব্যালান্স করতে হবে। তারপর ইনকাম ও এক্সপেন্ডিচার হেডের, সমস্ত এন্ট্রি পাস করে জেনারেল লেজারে সব হেডে ৩১ তারিখে ক্লোজিং এন্ট্রি ও নতুন বছরের ১ জানুয়ারির তারিখে ওপেনিং এন্ট্রি । এর পরে আছে প্রফিট এন্ড লস স্টেটমেন্ট, ওপেনিং ও ক্লোজিং স্টেটমেন্ট আর ব্যালান্স শীট বানানো।

    --- আরে ব্যস ব্যস! থাম্বা, থাম্বা! আপনি যে মুম্বাই মেইল চালিয়ে দিলেন। গতবছর আমার প্রথম ক্লোজিং ছিল , আপনিই রাত জেগে সব করেছিলেন, আমি খালি ইন্টারেস্ট লাগিয়েছিলাম। সে ঠিক আছে, এবার না হয় জান লড়িয়ে দেব। কিন্তু ওই দুজন অফিসার! ওদের বাড়ি যেতে দেবেন?

    --বোকার মত কথা বলিস না । এবার কাজ আরও বেশি। ব্যাড লোনের প্রভিশন করে এন্ট্রি পাস করতে হবে । যত ডকুমেন্ট টাইমবার হতে যাচ্ছে সবগুলোর রি-নিউয়াল চাই। আমার আগামী বছর ট্রান্সফার হবে । তাই একটা অ্যাকাউন্টের ডকুমেন্টও তামাদি হতে দেব না । এগুলো ওরা দুজন ঘরে ঘরে গিয়ে করিয়ে আনবে। এছাড়া আছে প্রত্যেকটি ডিপোজিট ও লোন অ্যাকাউন্টের লেজারে ‘টু ব্যালান্স , বাই ব্যালান্স’ এন্ট্রি করে সামারি টোটাল নিয়ে চেক করা। সোমবার ওরা আসলে একটা স্টাফ মিটিং করে সবাইকে দায়িত্ব ভাগ করে ডায়েরিতে নোট করিয়ে দেব।

    কিন্তু যতটা ভেবেছিল ততটা সহজ হল না । ক্রিসমাস এবং শঅ্যানুয়াল ক্লোজিং ও সঙ্গের রোববারের ছুটি স্টাফের জন্যে নয়, এটা নতুন ছেলে দুটো মেনে নিতে পারল না ।

    এর মানে আম পাবলিক ক্রিসমাসে মস্তি করবে, কেক খাবে , আমরা ছুরিতে বসে বুড়ো আঙুল চুষবো।! ৩১শে ডিসেম্বর রাতে বিলাসপুরের ছেলেরা মাল খাবে বাইকে করে রাস্তায় ঘুরবে আর আমরা? আহিরণ নদীতে সাঁতার কাটবো? একেই তো ব্যাংকে ছুটি কম, স্টেট গরমেন্টের থেকে অনেক কম। তারপর ওই দুটো ছুটি আর দুটো রোববার? ছুরির চুতিয়া পাবলিক এনজয় করবে, আর আমরা!

    --বেশ, কাজের ফিরিস্তি দিয়ে দিয়েছি। এগুলো করবে কে?

    --সেটা আপনার প্রবলেম! আপ হমারে সাথ জ্যাদতী কর রহে হ্যাঁয় ।

    -- কালকেই হেড অফিসে যাও, অন্ততঃ তোমাদের একজন। ভয়ের কিছু নেই । আমি চিঠি দিয়ে দেব। গিয়ে জেনে এস আমি কতটা মনমানী করছি। আর ঘটে বুদ্ধি থাকলে পাড়ার ব্যাঙ্কে যারা কাজ করে তাদের থেকেও জেনে এস।

    সন্নাটা! সন্নাটা!

    রূপেশের খারাপ লাগে।

    বলে এখন কাজ শেখার সময়, এমন করলে চলে! তোমরা যদি এখন থেকে রোজ রাত্তিরে খেয়ে দেয়ে আমার সঙ্গে বসে কাজ এগিয়ে নাও, আর তিরিশ তারিখে সারারাত্তির জেগে ভোর নাগাদ ব্যাল্যান্সিং করে ৩১শে সকাল সকাল এন্ট্রি পাস করিয়ে দিতে পার তাহলে তোমাদের ছুটি। বাকি স্টেটমেন্ট আমি আর রাজন বানিয়ে নিয়ে হেড অফিসে বিকেল নাগাদ জমা করতে যাব।

    আর ২৬শে জানুয়ারী ‘ঝন্ডা উত্তোলন’কে বাদ আহিরণকে উসপার ঝোরা-সিরকি গাঁও মেঁ পিকনিক। মূর্গা কে খর্চা হম দেঙ্গে।

    ওরা অবাক চোখে রুপেশকে দেখে, তারপর হেসে ফেলে।

    এসে গেল তিরিশ তারিখ! টেনশন! টেনশন! আনলিস্টেড কাজগুলো অনেক বেশি। যেসব লোনে অন্ততঃ একটা কিস্তি বাকি, তাদের নোটিস সার্ভ করে কার্বন কপি ডকুমেন্টে লাগাও। ডাউটফুল অ্যাসেটগুলোর ক্লাসিফিকেশন করে ব্যাড ডেট প্রভিশন কর। লোন ডকুমেন্টে কোথাও ম্যানেজারের সিগনেচার মিস হয়েছে কি? স্টক স্টেটমেন্ট? বীমা? ব্যাঙ্কের ওভারহেড এর খরচের ক্লাসিফিকেশন? ডেডস্টক রেজিস্টার? সোনার ও রূপোর গয়না বন্ধক রেখে যে লোন দেওয়া হয়েছে তার হাল-হকিকত? স্টাফ মুভমেন্ট রেজিস্টার? ডাকবুক ও পেটিক্যাশ এর ব্যালান্স ও এন্ট্রি? গত অডিট রিপোর্টের কমপ্লায়েন্স?

    জানুয়ারির গোড়াতেই এসে যাবে অডিট ফার্ম আর এমন সন্দেহের চোখে সব দেখবে , বাঁকা বাঁকা কথা বলবে যেন আমরা ক্রিমিনাল আর ওরা সি আই ডি?

    নতুন ছেলেদুটোর খানিকটা ভ্যাবাচাকা ভাব; এতসব আজ সারারাত জেগেও হবে তো? ম্যানেজার আমাদের বোকা বানাচ্ছেন না তো?

    ওদের জন্যে আরও সারপ্রাইজ ছিল। সন্ধ্যের মুখে হাজির হল কুড়ি কিলোমিটার দূরের গেওরা রোড ব্র্যাঞ্চ থেকে দুই শ্রীমান। রাজদূত মোটরবাইক থেকে নেমে সঙ্গের ঝোলা থেকে একটা বড় টিফিন ক্যারিয়ার বের করে চাপরাশি ঠুল্লুকে বলল যে দুটো বাটিতে মুরগীর মাংস , কেটে পরিষ্কার করে ধোয়া। ও যেন ওর বাবার হোটেল থেকে যত্ন করে রান্না করিয়ে আনে। আর দুটো বাটিতে আছে ওদের ওখানের স্পেশাল শুকনো মিষ্টি—খজুর ও বড় বড় গুজিয়া।

    কী ব্যাপার?

    আসলে ওদের শাখাটি মাত্র তিন সপ্তাহ আগে খোলা হয়েছে; ওই এলাকায় নতুন ওপেন কাস্ট কয়লাখনি শুরু হচ্ছে। টাকা হাওয়ায় উড়বে, সেগুলো ধরবার জন্যে। সামান্য ডিপোজিট আছে, কোন লোন নেই । দুজন অভিজ্ঞ স্টাফের কাছে এর ক্লোজিং কয়েক ঘন্টার ব্যাপার। তাই রূপেশ স্যার অনুরোধ করেছেন নিজেদের কাজ পুরো হলে সব রিটার্ন ও স্টেটমেন্ট নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে ছুরিতে এসে মাংসভাত খেয়ে মস্তি কে সাথ এদের অ্যানুয়াল ক্লোজিং মেঁ থোড়া ‘জোর লগাকে হেঁইসা’ করে দিতে। তারপর ব্যাংকের টেবিলে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে সবাই একসঙ্গে ৩১ তারিখ হেড অফিস বিলাসপুর যাবে খ’ন। তবে নাথিং অফিসিয়াল অ্যাবাউট ইট!

    ওরা দুজন চেঁচিয়ে উঠল – রূপেশ বস জিন্দাবাদ!

    আবার বস!

    পরদিন সকাল আটটায় সবাই রওনা দিচ্ছিল; শুধু রূপেশ তখনও টেবিলে কিছু স্টেটমেন্টের থার্ড কপি সাইন করতে ব্যস্ত। ডোঙ্গরে বলল, দশ মিনিটে বন্দে মাতরম বাস আসছে, চলুন।

    রূপেশ মাথা না তুলেই বলে তোমরা যাও, আমি বিকেল নাগাদ যাব। এখন স্নান করে একটু ঘুমিয়ে নেব।

    শ্রীরাম অবাক হয়। সেকী , তাহলে ভিলাই কখন যাবেন?

    রাজন ওদের জানিয়ে দেয় যে স্যার শুধু বছরে একবার বাড়ি যান, দীপাবলীতে।

    কেন?

    ছোড়িয়ে, ইয়ে সব বাতেঁ, জলদি চলিয়েঁ, টাইম হো রহা।

    ৪ আহিরণের পারে পিকনিক

    ২৬ জানুয়ারি, রিপাবলিক ডে। আগের দিন চাপরাশি ঠুল্লুকে দিয়ে ওর রসেলু পটেলের দোকানে বলা হয়ে গিয়েছে যে কুড়ি টাকার জলেবি সামোসা ও সকাল বেলা বানিয়ে রাখতে। হাঁ জী, বাসি নহীঁ, তাজা হোনা চাহিয়ে। আর ঠুল্লু স্টোর থেকে বের করে ধুয়ে পরিষ্কার করেছে ঝাণ্ডার লৌহদণ্ড, যার মাথায় ছোট্ট পুলি ; ধুয়ে ইস্তিরি করিয়ে রেখেছে ত্রিবর্ণ পতাকা। কিছু ফুল দরকার। ঠুল্লু বলল কিনতে হবে না , ওদের বাগান থেকে তুলে আনবে। আর পাঁচটাকায় একটু চিনি, গুঁড়ো দুধ ও চা পাতা যা হবে তাতে ও দশকাপ চা বানিয়ে দেবে।

    ব্যস, হয়ে গেল রিপাবলিক ডে উদযাপনের জন্যে হেড অফিসের বরাদ্দ করা ২৫ টাকার হিসেব। ব্যাংকের চাকরিতে রূপেশের এটা তৃতীয় রিপাবলিক ডে; এদিকে বলে গণতন্ত্র দিবস। স্বাধীনতা দিবসকে বলা হয় স্বতন্ত্রতা দিবস। সেদিন রূপেশ মকানমালিক কলেশরামকে ও প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারকে ডাকে। প্রধান অতিথি হিসেবে হেডমাস্টারজীকে বলা হয় পতাকা উত্তোলন করতে, তারপর সরু মোটা সুরে ‘জন-গণ-মন’ গেয়ে সবাইকে জলেবি, সামোসা ও চা খাইয়ে ইতি করা হয়। কিন্তু রিপাবলিক ডে’র দিন ও কাউকে ডাকে না । পৌনে আটটা নাগাদ ব্যাংকের স্টাফের সামনে নিজে দড়ি টেনে ‘ঝান্ডা উত্তোলন’ করে তারপর সদলবলে স্থানীয় হাই স্কুলের প্রোগ্রামে হাজির হয়। সেখানে ছাত্র-শিক্ষক- স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ‘ভাষণ’ ও গান শেষ হলে ছাত্র ও মাস্টারমশাইদের প্রীতি ক্রিকেটম্যাচে মা’সাবদের দলের হয়ে খেলে ঘেমেটেমে ঘরে ফেরে। আর দিনের সেরা খিলাড়িদের প্রাইজ দেওয়ার ফান্ডে কিছু কন্ট্রিবিউট করে আসে।

    কিন্তু গতবার মামলা থোড়া গড়বড়া সা গয়া থা!

    পতাকার মধ্যে ফুল গুঁজে ওটিকে বেঁধে কায়দা করে এমন ভাবে দড়িতে গিঁট দেওয়া হয় যাতে একটি মুড়ো ধরে টানলে পতাকা উপরে উঠবে আর অন্যটি ধরে টানলে পতাকা খুলে ফুলের পাপড়ি হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়বে। রূপেশ ভুল ভাবে দড়ি টানায় না ফুল ছড়িয়ে গেল, না পতাকা উপরে উঠল। মাঝপথে মুখ ভেটকে গোঁসা করে ঝুলে রইল; শেষে ঠুল্লু হাত লাগিয়ে পতাকার সম্মান বাঁচালো। তারপর স্কুলের প্রোগ্রামে ওকে বলার সুযোগ দিতেই ও বলল যে একটা কথা বলা দরকার। প্রতি বছর সমস্ত বক্তা এই দিবসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা না করে আজাদী কী লড়াইয়ের গল্প ফেঁদে বসেন। ফলে ছাত্রছাত্রীরা ১৫ই অগাস্ট ও ২৬শে জানুয়ারির মধ্যে কোন ফারাক দেখতে পায় না । এছাড়া রিপাবলিক ডে কে গণতন্ত্র দিবস বললে কিছুই বলা হয় না । ভারত গণতান্ত্রিক দেশ মানে, শাসককে জনতা ভোট দিয়ে ঠিক করে । কিন্তু রিপাবলিক ডে মানে আইনের চোখে সরপঞ্চ , পঞ্চায়েতের চাপরাশি, আমি ও ঠুল্লু সবাই সমান। আমাদের সমান অধিকার। ইংরেজ আমলে রায়বাহাদুর খেতাব পাওয়া ভদ্রলোক-- যিনি পাঁচ বছর বিলাসপুরে ওঁর কোঠিতে থাকেন -- এখান থেকে ভোটে দাঁড়ান। উনি আমাদের পিতামহের বয়েসী, সম্মাননীয়। তবে দেশটা রিপাবলিক হওয়ায় ভবিষ্যতে যে কেউ এমনকি চাপরাশি ঠুল্লুরামও ভোটে দাঁড়াতে পারে । মানে, আমি ওকে দাঁড়াতে বলছি না, তবে ওর ইচ্ছে হলে নিয়মে আটকাবে না ।

    সবাই থম মেরে গেল, তারপর এখানে ওখানে খুক খুক করে হাসি শুরু হল। হেডমাস্টার এক ধমক দিয়ে ‘রাষ্ট্রগান’ শুরু করিয়ে দিলেন। তারপর চা-জলখাবারের সময় ইংরেজির স্যার উপাধ্যায়জি উঁচু গলায় বললেন – ম্যানেজার সাব আজ বড়িয়া জোক মারা—ঠুল্লু বনেগা অপনা বিধায়ক? রায়বাহাদুর কো হরায়েগা?

    হাসির হররা।

    রূপেশ বলল—ম্যায় সির্ফ স্বতন্ত্রতা দিবস অউর গণতন্ত্র দিবস কা অন্তর বতানা চাহতা থা। ইয়ে তো এক উদাহরণ ভর থা।

    হ্যা-হ্যা-হ্যা!

    এমন উদাহরণ! কহাঁ রাজা ভোজ অউর কহাঁ গঙ্গু তেলি!

    রূপেশ ভেবেছিল যে ব্যাপারটা ওখানেই চুকেবুকে গেছে।

    কিন্তু খবর গেল বিলাসপুরে রায়বাহাদুরের কাছে। উনি গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানকে ফোন করে বললেন যে ম্যানেজারকে রাজনীতিতে নাক না গলিয়ে ব্যাংকের কাজ মন দিয়ে করতে নির্দেশ দেওয়া হোক, ওয়ার্না---!

    তাই রূপেশ ঠিক করেছে এবার স্কুলে না গিয়ে ব্যাংকে পতাকা তুলে সবাই মিলে আহিরণের ওপারে ঝোরা –সিরকি গ্রাম পেরিয়ে পাহাড়ের কোলে নদীর চরে সবাই মিলে পিকনিক করবে। নতুন ছেলে দুটো খুব খুশি। বস, ইঁহা ইতনা কাম, ইতনা কাম কি হম টেবিল সে সর উঠাকে কুছ দেখ নহীঁ সকে। অব নদিয়া কে পার জায়েঙ্গে? মজা আ জায়েগা।

    কিন্তু এবারেও গোলমাল বেঁধে গেল। বাঁধল নিজেদের মধ্যে । সকাল পৌনে আটটায় সবাই স্নান করে হি-হি কাঁপতে কাঁপতে ব্যাংকের ছাদে উঠেছে। শ্রীরাম ঘড়ি দেখে বলল টাইম হো গিস, অব শ্রীগণেশ করেঁ?

    রূপেশ মাপা পায়ে ঝান্ডার কাছে গিয়ে ঠুল্লুকে ইশারায় ডেকে নিয়ে বলল আজ আমাদের ব্যাংকের ধ্বজারোহণ করবেন শ্রীমান ঠুল্লুরাম পটেল, ব্যাংকের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারি। সবাই হতবাক। ঠুল্লু ভয়ে দু’পা পেছিয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলতে থাকে—নাহি সাহেব, নাহি সাহেব; এইসন মজাক ঝন করিহ; মোলা পাপ লগ যাহি।

    রাজন বলে হোয়াটস আপ?

    শ্রীরাম বলে এইসব পাগলামি করে আপনি রাষ্ট্রীয় ধ্বজ কী ইনসাল্ট কর রহে হ্যাঁয় স্যার!

    ডোঙ্গরে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না ।

    রূপেশ একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেয় যার নিগলিতার্থ হল যদি ঠুল্লুকে পতাকা তোলার সম্মান না দেওয়া হয়, যদি তাতে পতাকার অপমান হয় তাহলে রিপাবলিক ডে’র মানে কি!

    হতাশ শ্রীরাম মাথা নাড়ে, ঠিক হ্যাঁয় স্যার, আপ ইঁহাকে বস হো, আপ জো করে ও কম হী হ্যাঁয়।

    রূপেশ অবিচলিত। এবার ডোঙ্গরে মুখ খোলে—ভইগে ভইগে! হয়েছে হয়েছে। স্যার যেমন বলছেন কর তারপর পিকনিক। ই সব বহসবাজি মে আজ কা মজা কিরকিরা ঝন করিহ। ফালতু তক্কাতক্কি করে আজকের দিনটা মাটি ক’র না ।

    বেলা এগারোটা নাগাদ গোটা দলটা পৌঁছে গেছে ছুরিকলাঁ গাঁয়ের সরহদ পার করে শেষ মাথায় কালো পাথরের টিলায়। এখান থেকে পায়ে চলার একটি সর্পিল পথ এঁকেবেকে ক্রমশ নীচে নেমে গেছে আহিরণের কিনারায়। শীতের শেষ, জল কম পায়ের গোছ ছাড়িয়ে উপরে উঠবে না । আর টিলার গায়ে কালো পাথরের মধ্যে চিকচিক করছে অভ্রের কুচি । বিলাসপুরের দুই ট্রেনি দাঁড়িয়ে পরে। মুগ্ধ হয়ে চারদিকে তাকায়। ওদের কোন ধারণা ছিল না যে জায়গাটা এত সুন্দর। নদীর পারে বালি, তারপরে ঝোরা-সিরকি গাঁয়ের ধানের ক্ষেত, খুব সামান্য এলাকায়। এখনও কিছু পাকা ধান কাটা হয় নি। এর পরে ঘন বন। আর বনের পেছন থেকে একপাল আদিম প্রাগৈতিহাসিক হাতির মত চলেছে নীলপাহাড়ের সারি, যেন আকাশে মিশে গেছে।

    ওরা কোন কথা বলে না , শুধু চলতে থাকে। ওদের প্রাথমিক মুগ্ধতা এখনও কাটেনি।

    ঠুল্লু ব্যাংকের সাইকেল ঠেলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। ওর ক্যারিয়ার আর হাতল থেকে ঝোলা থলিগুলোতে রয়েছে খাবার , আনাজপাতি, চা-চিনি, মশলা।

    হাতে চটি নিয়ে ওরা জলে নামে, কী ঠান্ডা জল! এবার সবার মুখে কথা ফোটে।

    হাসিমুখে শ্রীরাম বলে কিছু মনে করবেন না স্যার! আমাদের দু’মাস হতে চলল। মানে এ’মাসটাই শেষ। আপনি যদি আমাদের আরও একমাস এখানে রেখে দেন তাহলে ভাল হয়। কথা দিচ্ছি চারটে উইক এন্ডের দুটোতে বিলাসপুর না গিয়ে এখানে থাকব, ফিল্ডে যাব। আর শীত চলে যাওয়ার আগে এখানে এই আহিরণের চরে আরও দুটো পিকনিক করব।

    রূপেশ হাসে। ফলে সবটা আমার হাতে নেই , ডেপুটেশন হেড অফিস ঠিক করে। ঠিক আছে, দেখব’খন। এখন চটপট কাজে লাগা যাক।

    ঝোলা খালি করে জিনিসপত্র নামিয়ে প্রথমে ভিজে বালুর উপর একটা প্লাস্টিকের শিট বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা হল। গ্ল্যাক্সো বিস্কিট আর চানাচুরের প্যাকেট খোলা হল; এর সঙ্গে থার্মস থেকে গরম চা। রূপেশ সতর্ক করে, কেউ যেন সেলোফেন বা কাগজের ছেঁড়া প্যাকেট এখানে না ফ্যালে। একটা ঝোলায় সবগুলো জমা করা হবে, মায় পাতলা প্লাস্টিকের কাপ ও কাগজের প্লেট।

    খানিকক্ষণ পরে কথা হল রান্না শুরু করা যাক। রূপেশ চেয়েছিল মাংসভাত পটেল হোটেলে রান্না করিয়ে সসপ্যানে মুখ বেঁধে সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসিয়ে আনা হবে। কিন্তু শ্রীরামের আবদার যে এখানে রান্নাকরা হবে, পুরোদস্তুর বনভোজন। কালকেই বলেছিল যে কিস্যু ভাবতে হবে না । জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে উনুন ধরাতে ও ভালই পারে । অনেক এনসিসি এন এস এস ক্যাম্প করা আছে।

    ডোঙ্গরে ঝকঝকে দাঁতে একগাল হেসে বলল মাংসভাত আমিই রাঁধব। রূপেশ হাসি চেপে গম্ভীর মুখে বলে—রান্নার এক্সপেরিয়েন্স?

    --স্কুলে পড়ার সময় থেকে। আসলে আমাদের সিরিগিট্টি পাড়ায় একটা গ্যাং তৈরি করেছিলাম। চরতে থাকা মুরগী ও ছাগল চুরি করে রেললাইনের ওপারে ক্ষেতের মধ্যে রান্না করে হাড়গোড় মাটিতে পুঁতে ফেলে চম্পট! অনেকবার আমাদের বিরুদ্ধে পঞ্চায়েতে শিকায়েত হয়েছে কিন্তু কখনও কেউ প্রমাণ করতে পারে নি ।

    একবার তো উপ-সরপঞ্চের মুরগী কেটে ওকেই খাইয়ে দিলাম, টের পায় নি ।

    টেরচা চোখে তাকায় শ্রীরাম, বলে আচ্ছা ফেক রহে ইয়ার! হম লপেট রহে। গুল মারার জায়গা পাস নি!

    রাজন জানতে চায় পাঁঠা কী করে চুরি করা হয়? ও তো ব্যা-ব্যা করে ডেকে সবাইকে জাগিয়ে দেবে।

    রহস্যটা হল পাঁঠার কানের মধ্যে গোটা ছয় সরষে দানা ঢুকিয়ে দিন। ব্যস, ও চুপ করে যাবে, একেবারে রা’ কাড়বে না ।

    ইতিমধ্যে ঠুল্লু থার্মস থেকে ছোট ছোট প্লাস্টিকের কাপে চা ঢেলে সবাইকে হাতে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে গ্ল্যাক্সো বিস্কুট ও গাঠিয়া ভাজা।

    শ্রীরাম ওর ঝোলা থেকে বের করে একটা ক্যাডবেরির প্যাকেটের মত লম্বা হটশট ক্যামেরা। ফটাফট নদী- ক্ষেত- জঙ্গল –পাহাড়ের দিকে তাক করে ফ্ল্যাশ চমকিয়ে বলল এবার একটা গ্রুপ ফোটো হয়ে যাক। আমি আগামী সপ্তাহে বিলাসপুরে আমার বন্ধুর স্টুডিও থেকে ওয়াশ করিয়ে সবাই একটা সেট দেব, খরচা আমার।

    রূপেশ বলে যে আগে রান্না খাওয়াদাওয়া ও এখানে একটু বেড়ানো হোক, অন্ততঃ আলো থাকতে থাকতে পাহাড়ের কোলে জঙ্গলে ঘোরা যাক। এইসময় মহুয়ার ফুল, তেন্দু ফল পাওয়া যেতে পারে । তোমাদের মন্দ লাগবে না, একটা এক্সপেরিয়েন্স হবে।

    রূপেশ জিনিসপত্তর আগলে ওখানেই বসে রইল, ওরা চারজন শ্রীরামের নেতৃত্বে গেল শুকনো কাঠকুটো কুড়িয়ে আনতে। প্রায় আধঘন্টা কেটে গেলে ওরা ফিরল এক এক আঁটি শুকনো ডাল নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে। ঠুল্লুর ছোট একটা কাটারি দিয়ে শ্রীরামের নির্দেশ মাফিক ওগুলো আরও ছোট ছোট টুকরো করা হল। একটু পরে আগুন জ্বলে উঠল । দেখা গেল শ্রীরাম বাড়িয়ে বলে নি। ও হাওয়ার গতি দেখে সে দিকটা একটা টিন ও প্যাকেটের পিসবোর্ড দিয়ে আড়াল মত করে কাঠ সাজিয়ে চমৎকার আগুন জ্বালিয়েছে। ঠুল্লু নদীর জলে ধুয়ে ফেলেছে চাল, আর ডোঙ্গরে রসুন, পেঁয়াজ কুচি হলুদ, জিরে, ধনে তেজপাতা ও গরম মশলা একটা প্লেটে সাজাচ্ছে, মাংস চড়াবে।

    কিন্তু ঠুল্লু প্রাণপণে হাতড়ে চলেছে একের পর এক থলে আর প্যাকেট। একটু পরে রাজন ব্যাপারটা দেখে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে? কিন্তু জবাবে ও খালি মাথা নাড়ে এর বলে –কুছ নহীঁ।

    একটু পরে ও উঠে রাজনকে এক পাশে নিয়ে গিয়ে উত্তেজিত ভাবে কিছু বলছিল। শেষে সেই শলাপরামর্শে ওরা চারজনই যুক্ত হল, রূপেশকে এড়িয়ে। এদিকে আগুনের তাপে কড়াই গরম হয়ে ধোঁয়া উঠছে। এবার রূপেশের নজর গেল সেদিকে।

    সবাই এদিকে এস, কড়াই পুড়ে যাচ্ছে যে!

    রাজন জানালো—নুনের প্যাকেট আসে নি। তেলের শিশি এসেছে, সঙ্গেই নুনের প্যাকেট কাগজে মুড়ে রাখা ছিল, কিন্তু এখানে এসে চোখে পড়ছে না। এখন উপায়!

    খিঁচিয়ে ওঠে শ্রীরাম—সব ঠুল্লুর দোষ, ওই যাক ফিরে ছুরির ব্যাংকে। নিয়ে আসুক ফেলে আসা নুনের প্যাকেট।

    মুখ কালো করে উঠে পড়ে ঠুল্লু, সাইকেলের দিকে এগিয়ে যায়। হাত তোলে রূপেশ।

    ওর মতে এটা কোন সল্যুশন হল না । ওর যেতে আসতে পাক্কা একঘন্টার বেশি সময় লাগবে। তার চেয়ে কাছের ঝোরা সিরকি গাঁ থেকে কারও কাছ থেকে পয়সা দিয়ে কিনে আনুক। ঠুল্লুর সঙ্গে কেউ যাক। ডোঙ্গরে সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝোলা নিয়ে ঠুল্লুর সাথে বেরিয়ে গেল।

    ওরা তিনজন বসে শীতের দুপুরে সদ্য জ্বালানো আগুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বিশ মিনিট কেটে গেছে। রাজন ও শ্রীরামের ঘড়ির দিকে তাকানো দেখে রূপেশ আশ্বস্ত করল যে আর একটু, ব্যস –ওরা ফিরল বলে!

    ছুরিগাঁয়ে এইসময়টা কোন শীতটিত নেই, মকরসংক্রান্তির পর থেকেই ঠান্ডা কমতে থাকে। সন্ধ্যের দিকে গুলাবি জাড়া বা মিঠে শীত টের পাওয়া যায়। কিন্তু এখন এই নদীর পারে জঙ্গলের দিক থেকে হু হু করে হাওয়া এসে কাঁপুনি ধরাচ্ছে। ওরা একটু আগুনের দিকে ঘেঁসে এল।

    শ্রীরাম রাজনের সঙ্গে চোখে চোখে ইশারা করে উঠে গিয়ে একটা থলের থেকে হাতড়ে টাতড়ে একটা চ্যাপ্টা ছোট বোতল নিয়ে এল। রূপেশের চোখ কুঁচকে গেল। এসব কী?

    --প্লীজ আজকে রাগ করবেন না । এই নদীর পাড়, এই নীলচে পাহাড় , হাওয়ার কাঁপন, চিকেন রান্না হচ্ছে, এখন একটু ইয়ে না হলে চলে? আমরা তো ছুরিগাঁয়ের বাইরে, জঙ্গলের ধারে। কেউ আপনাকে দেখবে না । কেউ জানতে পারবে না ।

    -- জিনিসটা কী?

    -- শুদ্ধ মহুয়া। লাইনপাড়ার পীলা যাদবের হাতে তৈরি। একেবারে হ্যান্ডলুম মাল। এতে মৌরি মেশানো আছে।

    -- কার বুদ্ধি?

    ওকে অবাক করে উত্তর আসে ক্লার্ক রাজনের থেকে।

    --আমাদের সবার। দেখুন, আপনাকে জানি, এটা কোন ব্যাঙ্কের বরোয়ারের থেকে পাওয়া ফোকটিয়া মাল নয়। পীলারাম যাদব আমাদের ক্লায়েন্ট নয়। দস্তুরমত পয়সা দিয়ে এনেছি। ইসমে কোই মিলাবট নহী হ্যাঁয়, কোঈ খতরা নহী।

    --স্যার, আজকের পিকনিকের সব খরচা তো আপনি দিচ্ছেন, কিন্তু এইটুকু আমাদের। মনে করুন এটা আসলে আমাদের ফেয়ারওয়েল পার্টি। আসলে আমাদের আপনাকে ভাল লেগেছে। আপনি কোন লন্দফন্দে নেই , কারও থেকে কোন ফেবার নেন না ; জুয়ো খেলেন না । এমনকি, ছুটিতেও ভিলাইয়ে বাড়িতে যান না । সংসারে এই বয়সেই কেমন বৈরাগ্য এসে গেছে ভাব।

    রূপেশ একটু অবাক হয়েছে, কিন্তু মুখে কিছু বলছে না । ওরা তিনটে প্লাস্টিকের গ্লাসে মেপে ঢালে, তারপর বলে আপনার তো এই প্রথম, একটু জল মিশিয়ে দিই?

    ওরা গ্লাসে গ্লাস ঠেকিয়ে শুরু করে। রূপেশের ঠোঁটে মহুয়ার ঝাঁঝালো কষটে স্বাদ। ওরা চানাচুরের প্যাকেট এগিয়ে দেয় ।

    খানিকক্ষণ পরে শ্রীরাম একটা সিগ্রেটের প্যাকেট বের করে। স্যার, যদি অনুমতি করেন!

    রূপেশের মুখ থেকে বেরিয়ে আসে—আমাকেও একটা দাও।

    ওরা চমকে ওঠে, চেহারায় খুশির ঝলক। শস্তা ব্র্যান্ড স্যার, পানামা। এখানে অন্য কিছু পাওয়া যায় না ।

    নদীর দিক থেকে আসা দামাল হাওয়ার প্রকোপ বেড়ে গেছে। শ্রীরামের হাত কাঁপে, দেশলাইয়ের কাঠি বার বার নিভে যায়। রূপেশ অভ্যস্ত হাতে হাত গোল করে আগুনের শিখা আড়াল করে। তারপর শ্রীরাম ও রাজনের সিগ্রেট ধরিয়ে দিয়ে যেই নিজেরটা ধরাতে যাবে, অমনি শ্রীরাম ঝাঁপিয়ে পড়ে হাতের ঝাপটায় কাঠিটা নিভিয়ে দেয় ।

    রূপেশের বিরক্ত বিস্মিত চেহারা দেখে সাফাই দেয় । এক কাঠিতে তিনজন ধরাতে নেই ।

    -- তৃতীয় ব্যক্তি মারা যাবে এই তো? যত বাজে কথা, বহুবার করে দেখেছি। বেড়ালের রাস্তা পার, সকালে মাকুন্দ অথবা কাণোয়া দর্শন, এসবে কিছু হয় না । ফালতু গপবাজি!

    -- আপনি না মানতে পারেন , আমি মানি। আমি কিছুতেই আপনাকে তিসরা আদমি হতে দেব না।

    রূপেশ হাল ছেড়ে হাত উলটে দেয় ।

    একঘন্টা হয়ে গেছে। ওরা যে গেছে এখনও কোন খবর নেই ।

    এদিকে সিগ্রেট ও মহুয়া দুটোই দু’রাউন্ড হয়ে গেছে। রাজন বলে স্যার, ওই জঙ্গলের দিকে কোন খতরা নেই তো? মানে ওরা—

    --আরে না না , বাঘ-ভালুক সব মানুষের উৎপাতে আরও গভীরে চলে গেছে। হ্যাঁ, রাতের বেলা হলে কথা ছিল। আর ঠুল্লু রাস্তা চেনে, পথ হারাবে না । গেছে জঙ্গলের এপাশে একটা গোটা কুড়ি পরিবার ঝোপড়া বানিয়ে থাকে, সেদিকে।

    ধীরে ধীরে সবার গলার স্বর ভারি হয়ে আসছে, ক্রমশঃ একটু মোটা হয়ে খাদের দিকে নামছে। রূপেশের হাতে ধরা সিগ্রেট পুড়তে পুড়তে আঙুলে ছ্যাঁকা লাগার অবস্থায়। শ্রীরাম আর একটা বাড়িয়ে দেয় , কিন্তু রূপেশ মাথা নেড়ে গ্লাসের দিকে ইঙ্গিত করে।

    অবাক হয়ে শ্রীরাম জিজ্ঞেস করে আগে কখনও মহুয়া খাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে কি না ? নইলে এবার থামা উচিত। উত্তরে রূপেশের ঠোঁটে একটি মৃদু হাসি খেলা করতে থাকে। ওরা অপেক্ষায় আছে দেখে প্রায় বিড়বিড় করে বলে হ্যাঁ, গ্রামীণ ব্যাংকের চাকরিতে এসে, ছ’মাস আগে। এখানে? না , এখানে নয়; ট্রেনিং পিরিয়ডে।

    ওরা সোল্লাসে প্রায় চেঁচায়—ইয়ে কিসসা জরুর সুননে কা লায়ক হোগী। বতাইয়ে না!

    আমার প্রোবেশন পিরিয়ড। প্রথম পোস্টিং। বলোদা বলে একটি ব্র্যাঞ্চে, দু’মাসের জন্যে। কাজ শেখাবেন স্টেট ব্যাংক থেকে ডেপুটেশনে আসা সিঙ্ঘানিয়া সাহেব । তা’ সেখানে গিয়ে প্রথম রাত্তিরে ভূত দেখলাম আর দশ দিনের মাথায় মহুয়ার নেশা।

    --ক্যা বাৎ! স্টেট ব্যাংকের অফিসার আপনাকে প্রেতসাধনা ও পঞ্চমকারে দীক্ষা দিলেন! উনি কি ভূতসিদ্ধ ? নাকি তান্ত্রিক?

    রূপেশ মাছি তাড়ানোর মতন করে হাত নাড়ে, মাথা নাড়ে ।

    রাজন বিরক্ত হয়ে বলে—আঃ, স্যারের মুখ থেকেই শোন না !

    গেলাস আবার ভর্তি। ও চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত করে একটু হাসে তারপর ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে শুরু করে।

    ৫) ভূত –পেত্নী-দত্যি-দানো

    ভিলাইয়ে সিভিক সেন্টারের পাশের মাঠে সেবার রঞ্জি ট্রফির ম্যাচ হচ্ছিল ইউ পি বনাম এম পি। উত্তর প্রদেশ বনাম মধ্যপ্রদেশ। কোনও টিকিটের বালাই নেই । এম পি দলের পক্ষে বিলাসপুরের থেকে সিলেক্ট হওয়া একটি নতুন ছেলে ভাল ব্যাট করছে । মন দিয়ে দেখছি এমন সময় পিঠে হাত, আমার লংগোটিয়া ইয়ার পানিগ্রাহী , খুব উত্তেজিত। এখনই বাড়িতে যেতে হবে, বড়ে ভাইয়া ডেকেছেন। বড়ে ভাইয়া স্টিল প্ল্যান্টে জেনারেল ফোরম্যান। আজ শনিবার বটে , কিন্তু এ’সময় বাড়িতে কেন? মার শরীর খারাপ হল নাকি? প্রেশারের রুগী।

    বন্ধু বলল সেসব কিছু না , ভালো খবর । তোর চাকরি হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকে। পোস্টিং বলোদা বলে একটা গেঁয়ো ব্লক হেড কোয়ার্টারে। তুই তো বাড়ির ঠিকানা না দিয়ে আমার ঠিকানা দিয়েছিলি। আজ চিঠি আসতেই আমি তোদের বাড়ি দিয়ে এসেছি। মা মুঁহ মিঠা করিয়েছেন, ফোন পেয়ে বড়ে ভাইয়া প্ল্যান্ট থেকে চলে এসে তোকে ডাকতে পাঠিয়েছেন।

    আমার মাথার ভেতরে দিওয়ালির হাজার লড়ি চড়বড় করে ফাটতে থাকে। অন্ধ রাগে আমি পানিগ্রাহীর কলার ধরে ঝাঁকাতে থাকি। কেন? কেন তুই চিঠি আমার বাড়িতে দিতে গেলি? কেন আমার হাতে দিলি না ? এইজন্যেই কি করেস্পন্ডেন্স এর জন্যে তোর ঠিকানা দিয়েছিলাম!

    ও ভয় পায়। অতিকষ্টে আমার হাত ছাড়ায়। আমার চারদিকে ভীড় জমতে থাকে। আমি লজ্জা পাই। পাবলিককে বলি সব ঠিক ঠাক হ্যাঁয়। তারপর ওর হাত ধরে একপাশে সরে আসি। ও হাঁপায়, তারপর বলে—দু’হাজার টাকা সিকিউরিটি দিতে হবে যে! তাই তোর বাড়িতে গেলাম। বড়ে ভাইয়া টাকা তুলে এনেছেন।

    আমার গা চিড়বিড় করে । ও বলে কুছ ভী হো ইয়ার, তেরে অপনে বাপ-মা, খুদ কে ভাইয়া, কোই গ্যর থোড়ি। পুরানী বাতে ভুল জা, গুসসা থুক দে। অব তেরী নয়ী জিন্দগী শুরু হোগী।

    যদি ভুলে যাওয়া যেত!

    বাড়িতে ঢুকতেই বড়ী ভাবী হৈ হৈ করে উঠল। এসেছেন এসেছেন; তিনি এসে গেছেন। বাইরের ঘরে সবাই হাজির। ভাবী ইশারা করছিল – প্যার ছুঁও; কম সে কম বাবুজি অউর মাজী কে।

    যন্ত্রের মত ভাবীর আদেশ পালন করলাম। ভাইয়া এসে একটা খাম দিয়ে বললেন—তিন হাজার আছে। সিকিউরিটি দু’হাজার আর তোর প্রথম মাসের খাইখরচা বাবদ আরও এক হাজার। কাল রোববার দিনের বেলা রওনা হয়ে বিকেল নাগাদ হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে যা। সোমবার থেকে ডিউটি জয়েন করবি; নতুন ব্যাংক, প্রথম ব্যাচ, সিনিয়রিটি মার না খায়!

    --আমি আপনার টাকা নেব না ।

    ঘরের মধ্যে বাজ পড়ল। ভাইয়া যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না ।

    - কী বললি?

    - ঠিকই শুনেছেন, নেব না ।

    বাবা আস্তে আস্তে নীচু গলায় বললেন—সিকিউরিটি ডিপোজিটের টাকা কোথায় পাবে?

    --এখানে চেনাজানা লোকজনের থেকে ধার নেব।

    ভাইয়া এসে ঠাস করে এক চড় কষালেন।

    --ধার নিবি? আর চেনাজানা সবাই যখন আমাদের নামে ছি-ছি করবে? তাতে তোর কিছু আসে যায় না ? খালি নিজের জিদ!

    আমার আনন্দ হচ্ছে। চড়ের জ্বালা টের পাচ্ছি না । এই তো বদলা নেওয়ার শুরু!

    আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল—আর যেদিন চেনাজানা সবাই আমার নামে ছি-ছি করছিল সেদিন আপনারা কোথায় ছিলেন? ভুলে গেলেন!

    বড়ে ভাইয়া খামটা বাবার হাতে দিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। বাবা আমাকে ডেকে বললেন –টাকাটা আমি দিচ্ছি। তোমার যখন এতই আপত্তি তো ধার হিসেবেই নাও। মাসে মাসে শোধ দিও, যেমন পার।

    যাহোক, পরের দিন রোববার। সকাল দশটায় একটা কালো চামড়ার স্যুটকেস, একটা এয়ারব্যাগ ও হোল্ডঅল নিয়ে ছত্রিশগড় এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। বাকি জনতা স্টোভ ,মগ, বালতি অকুস্থলে গিয়ে দেখা যাবে। জীবনে গাঁয়ে থাকি নি। কলেজে পড়ার সময় এন এস এস এর ক্যাম্পে গেছি বটে, তবে সেসব গ্রামসমাজের বাইরে ক’দিনের জন্যে পিকনিক। সঙ্গে বন্ধুবান্ধব , স্যারেরা।

    ট্রেন লেট ছিল , বিলাসপুরে নামলাম বিকেল সাড়ে তিনটে। তারপর সারদা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির বাস ছাড়ল চারটে আর কয়েক জায়গায় রোববারের বাজার হাটের সামনে গড়িমসি করে ঢিকিস ঢিকিস করে রওনা দিতে দিতে যখন শেষ স্টপ বলোদায় নামলাম তখন শীতের কুয়াশা ঘন হয়েছে। বাস থেকে নামতেই ঝপ করে আলো নিভে গেল। দেখলাম এটা বলোদার শনিচরি বাজার। পাওয়ার কাট নিয়মিত হয়, আলো কখন আসবে , আজ রাতে আদৌ আসবে কি না কেউ জানে না।

    নতুন খুলেছে গ্রামীণ ব্যাংক, দেখা গেল অনেকেই চেনে না । শেষে জানা গেল ওটা এক কিলোমিটার দূরে বুধবারি বাজারে দুর্গাবাড়ির সামনে। একটাকা মেহনতানার বদলে একজন রাউত বাঁকে করে আমার লাগেজ বয়ে নিয়ে চলল, পেছন পেছন আমি।

    কিছু কিছু ঘরে টেমি জ্বলছে, কোথাও হ্যারিকেন, কোথাও মোমবাতি। অধিকাংশ ঘরে কিছু জ্বলছে না । তল্পিবাহক জানাল যে বেশির ভাগ লোক এই রুটিনে অভ্যস্ত, খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

    একটা একতলা পাকা বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে বলল –এটাই ব্যাংক।

    ভেতরে গিয়ে একটু দমে গেলাম। ব্যাংক বলতে যেমন কাউন্টার, কাঁচের আড়াল, সফিস্টিকেটেড পোশাক আশাক মনে হয়। তেমন কিছুই নেই । গোটা কয়েক কাঠের র‍্যাক, দুটো স্টিলের আলমারি, একটা তেজারতি কারবারিদের সিন্দুকের মত, তার ওপরে একটা সোনার দোকানের মত ছোট্ট দাঁড়িপাল্লা।

    বুঝলাম , বতক বা হাঁস যেমন পাখি নয়, গ্রামীণ ব্যাংকও তেমনি ব্যাংক নয়।

    তিন জোড়া চেয়ার টেবিল। তাতে হ্যাজাক বাতির সামনে একজন গুরুজি বা স্থানীয় মাস্টারমশাই একটি বছর নয়ের ছেলেকে ১৫ কে পহাড়া রটা রহে থে। উলটো দিকে পাজামা ও গেঞ্জি পরা এক ভদ্রলোক কোলে একটি বাচ্চাকে নিয়ে আদর করছেন। আমি ম্যানেজার সিংঘানিয়া সা’বের খোঁজ করায় উনি নিজের পরিচয় দিয়ে হ্যান্ডশেক করে বললেন আগেই আপনার পোস্টিং বিষয়ক চিঠি এসে গেছে। কাল সাড়ে দশটায় ব্যাংক খুলবে। এখন কিছু খেতে চাইলে পাশে মল্লু ভাঁচার (মল্লু ভাগনের) হোটেলে ভাত ডাল পেয়ে যাবেন। আমি বললাম আজ রাতের মত খাওয়া হয়ে গেছে। ওঁর ইশারায় একটি ছেলে এগিয়ে এল। এখানকার চাপরাশি গোরেলাল আদিত্য। বললেন ফিল্ড অফিসার অনিল উইক এন্ডে ওর ঘর রায়পুরে গেছে। গোরের কাছে চাবি। আপাততঃ ওখানে শুয়ে পড়ুন। কাল ঘরের ব্যবস্থা পাকাপাকি করব। আর হ্যাঁ, মোমবাতি ও দেশলাই নিয়ে যান। আমার কাছে টর্চ ছিল , তবু প্রথমদিনেই গুরুজনের অবাধ্য হব না ভেবে নিয়ে নিলাম।

    ঘর ছোট , দেয়ালের কুলুঙ্গিতে আধপোড়া মোমবাতি ও কোন দেবতার ছোট্ট ফটো। একটা নীচু তক্তপোষ, গোরে তাতে হোল্ড অল খুলে দিয়ে বলল –শুয়ে পড়ুন, সকাল সাতটায় আপনাকে ডেকে চা খাইয়ে পুকুরপাড়ে নিয়ে যাব, প্রাতঃকৃত্য মুখারি সব করে একেবারে স্নান সেরে ঘরে ফিরবেন। আর মাঝরাতে সু-সু পেলে দরজা খুলে বারান্দা থেকে নীচে নেমে রাস্তার ধূলোর ওপর সেরে নেবেন । এখানে সবাই তাই করে।

    দরজা বন্ধ করে আধপোড়া মোমবাতি জ্বালিয়ে ব্যাগ খুলে দেখি মায়ের হাতে তৈরি বেসনের লাড্ডু আর সুজির পুর দেয়া গুজিয়া কিছু বেঁচে আছে। খেয়ে নিলাম। তারপর মোমবাতি নিভিয়ে রজাই মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

    গাঢ় ঘুমের মধ্যে কোথাও একটা পেরেক ঠোকার মত আওয়াজ মাথার মধ্যে অনবরত ঠোকাঠুকি করতে লাগল । চোখ যেন আঠা দিয়ে সাঁটা , কিন্তু আওয়াজ চলছে। ধীরে ধীরে চোখ খুললাম, এ কোথায় শুয়ে আছি? এইসা ঘুপ অন্ধেরা তো মেরে ঘর মেঁ কভি নহী হোতী? কিন্তু একটা আওয়াজ যে আসছিল? থেমে গেছে? না , ওই শুরু হল। ইঁদুর ? আরশোলা ? উঁহু, শব্দটা আসছে বাইরে থেকে কেউ যেন দরজায় টরে টক্কা গোছের একটা তালে তালে টোকা দিচ্ছে। আর ফিসফিস ফিসফিস ! শহরের ছেলে, ভূতের ভয় নেই , কিন্তু এই অচেনা জায়গায়? এমন রাতে? কে হতে পারে ? ঘুমের ঘোরে টর্চের কথা ভুলে গেলাম। বিছানা থেকে নেমে হালকা হাতে দরজা খুলতেই এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ঘরের ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। আর একজোড়া কনকনে ঠান্ডা হাত আমার গলায় ফাঁস হয়ে জড়িয়ে গেল। একটা হিসহিসে স্বর কানের কাছে বলে চলেছেঃ

    উঃ, কতক্ষণ ধরে ডাকছি, ঘোড়া বেচে ঘুমুচ্ছিলে? আমি যে শীতে জমে গেলাম।

    ভয়ে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। কোনরকমে হাতের বাঁধন খুলে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম—কৌন, কৌন হো আপ?

    দু’সেকেন্ড; চমকে উঠে সেই স্বর বলে উঠলঃ হায় দাইয়া!

    আর আমি খালি ঘরে কাঁপতে কাঁপতে ভাবছিলাম? স্বপ্ন দেখছিলাম কি? কিন্তু দরজা বন্ধ করার পর অনেকক্ষণ ঘরের মধ্যে ভাসছিল এক গেঁয়ো নেবুতেলের গন্ধ।

    এক মিনিট সবাই চুপ। রূপেশ নিজের শূন্য গ্লাসের দিকে তাকিয়ে। রাজন ইশারায় বোঝাল আর নেই । তারপর শ্রীরাম মুচকি হেসে বলল – ক্যা কিসমত লেকর আয়ে হ্যাঁয় স্যার! নৌকরি কে পহেলা দিন হী ভূতনী সে মূলাকাত? পর আপ ছোড় দিয়ে কিউঁ? আমি হলে জাপটে ধরতাম পেত্নীকে, টর্চের আলোয় দেখে নিতাম ওর চেহারা।

    রূপেশ লজ্জা পেয়ে বলে ধ্যেৎ!

    রাজন বলে তারপর? সিংঘানিয়া সা’ব কো বতায়েথে? কহাঁ মরনে কে লিয়ে ভেজ দিয়ে থে আপ কো? আখির ও স্পিরিট কে হাত আপ কে গর্দন তক --!

    ও কথা শেষ করতে না পেরে দুদিকে মাথা নাড়তে থাকে।

    না , ম্যানেজার সা’বকে নয়; সকালে স্নানে যাবার সময় চাপরাশি গোরেলালকে বলেছিলাম । ও একচোট হেসে নিল। তারপর বলল যে কাউকে এ নিয়ে কিছু বলার দরকার নেই । আর আপনি তো আজ থেকে অন্য ঘর পেয়ে যাবেন। আজ অনিল এসে যাবে। ওটা ওর ব্যাপার, ও বুঝবে।

    খাসা গল্প; এবার জীবনে প্রথম মহুয়া খাওয়ার কিসসাটাও হয়ে যাক। রূপেশ মুচকি হেসে চুপ করে । এত কথা এদের বলে ফেলে কেমন ক্লান্ত লাগছে, আর একটু অস্বস্তি।

    শ্রীরাম চেঁচিয়ে ওঠে—আরে , আমাদের স্কাউটের দল ফিরে আসছে। বেওকুফলোগ নমক লানে কে লিয়ে ডান্ডি মার্চ করকে আ রহে শায়দ।

    তারপর নীচুগলায় বলে—দেখিয়ে সাব, এক ভূতনীকো ভী সাথ লা রহে হ্যাঁয়।

    সামনের দুটো কোসম গাছের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে আসছে ডোঙ্গরে ও টুল্লু। হাতে একটা বড় ব্যাগ, কিন্তু সঙ্গে একটি মেয়ে, মুখে সলজ্জ হাসি। কাছে এলে চোখে পড়ল কপালে একটা তেরছা কাটা দাগ। সেভিংস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার ১/১০; দ্রুপতী বাঈ।

    দলটা এসে হাতের ঝোলা নামিয়ে ধপ করে ঘাসের উপর বসে পড়ে । সবার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওদের দেখে ভুলে থাকা খিদে যেন নতুন করে চাগিয়ে উঠল।

    তোদের ব্যাপারটা কী? আজ কি চায় – নাস্তার পিকনিক?

    ডোঙ্গরে ঢক ঢক করে জল খায় , তারপর জানায় যে আচ্ছা চক্করে ফেঁসে গেছল। ওই পাড়াটা অত কাছে নয়; রাস্তাও তথৈবচ । তারচেয়ে বড় ব্যাপার হল গাঁয়ে কোন মুদি দোকান নেই । ওদের কিরানা সামান ছুরিকলাঁ গাঁ থেকেই আসে। আর কোন পরিবার ঘরের নুন বেচবে না ; বলে এমনি নিয়ে যাও। যত বলি আমাদের সা’ব মিনি মাগনা কিছু নেন না ওরা মাথা নাড়ে। কিন্তু নুন না নিয়ে ফেরত আসি কী করে ?

    শেষে জঙ্গলের পথে এই মেয়েছেলেটার সঙ্গে দেখা; ঠুল্লু চেনে, বলল ও নাকি আমাদের কাস্টমার। মেয়েটা সব শুনে নিজের ঘর থেকে নুন তেল আরও কিছু নিয়ে এল । বলল অনেক বেলা হয়ে গেছে আমাদের সঙ্গে এসে মাংস রেঁধে দেবে।

    রূপেশ অস্বস্তি বোধ করে । তারপর দ্রুপতীকে ধন্যবাদ দিয়ে বলে যে রান্নাটা ডোঙ্গরে সাহাব করবে, আগে থেকে ঠিক হয়ে আছে।

    দ্রুপতী হার মানবার পাত্র নয়। গলা চড়িয়ে বলে –তা ডোঙ্গরে সা’ব এতক্ষণ কী করছিল? দুটো বেজে গেছে। শীতের দুপুর। চারটের পর সূর্য পাহাড়ের আড়ালে চলে গেলে এখানে তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসবে। আপনারা ঘরে ফিরবেন না ?

    শ্রীরামের মাত্রাটা বোধহয় একটু বেশি হয়ে গেছল। একটা কৃত্রিম চেরা আওয়াজে বলে – না হয় নাই ফিরলাম, তোর ঘরে মেহমান হই যদি? থাকতে দিবি তো?

    রূপেশের চোয়াল শক্ত হয়। দ্রুপতী শ্রীরামের অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রূপেশকে বলে যদি ওর হাতে খেতে সাহাবের আপত্তি না থাকে তো জিদ না করে ওর কথাটা মেনে নেওয়া হোক। ওর অনেক গুরুজির বাড়িতে রান্না করে অভ্যেস আছে। এইসব নৌসিখিয়াদের উপর ভরসা করলে সারাদিন উপোস করে থাকতে হবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • swati ray | 117.194.***.*** | ২৬ অক্টোবর ২০২০ ২৩:৫৭733073
  • পড়ছি .

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন