শনি ও রবিবারে আমার অবস্থা "দিন কাটেনা, রাত কাটেনা"। শনিবারে ক্লাস নেই, রবিবারেও কিচ্ছুটি করবার নেই। ওদিকে এরিকা প্রচুর বাজার করে এনেছে, ক্রিসমাসের দিন রান্না হবে। এমনিতে সে কিছু রাঁধে টাঁধে না। অত বড়ো রান্নার জায়গাতে আমি একাই রাঁধি প্রত্যেক দিন। আমার রান্না অতীব সিম্পল, চিকেন ভাত। এরিকা ও তার বয়ফ্রেণ্ড যখন একত্রে খায়, প্রচুর ঘাসপাতার স্যালাদ, সালামি, রুটি, এইসব খায়। আমি ওদিকটায় তখন যাই না।
মঙ্গলবারে যেহেতু ক্রিসমাস, বয়ফ্রেণ্ড তার বাচ্চা ছেলেমেয়েদের তাদের মায়ের কাছ থেকে নিয়ে আসবে, তাছাড়া এরিকার মেয়ে ও জামাই, ছেলে ও কার গার্লফ্রেণ্ড, বিশাল বাহিনির ক্রিসমাস পার্টি হবে। একটা জ্যান্ত ক্রিসমাস ট্রি ও আনা হয়েছে। সেটাকে গোল গোল বল দিয়ে সাজিয়েছে সে নিজেই। গাছের পাতায় পাতায় রামতায় মোড়া চকোলেট ঝুলছে, সবই ষ্প্রুংলির চকোলেট। গাছের পাদদেশে প্রচুর প্রেজেন্ট চকমকে প্যাকেটে শোভা পাচ্ছে। এবং এই ক্রিসমাসের ডিনারে আমাকেও নেমন্তন্ন করে বসেছে এরিকা।
একটা টার্কি, একটা হরিণ ছালছাড়ানো অবস্থায় ফ্রিজের মধ্যে। এরিকা মগ্ন হয়ে কুকিং রেসিপির মস্ত একটা বইয়ের পাতায় মগ্ন। তার দুই আঙুলের ফাঁকে সিগার জ্বলে জ্বলে নিবে গেছে। এমনিতে টিভিতে ডিটেকটিব নাটক কলম্বো দেখবার সময়েই তাকে সিগার হাতে দেখা যায়, কিন্তু এখন সে মহাব্যস্ত আসন্ন উৎসবে রোস্টেড হরিণ ও টার্কির উপযুক্ত রেসিপি খুঁজতে।
আমি ছুটির দিনে টিভিতে সিএনএন দেখে থাকি। নাইন ইলেভেনের টাইমে যেসব বন্দীদের গুয়ান্টানামো বে তে কারাগারে রাখা হয়েছে, তাদের মধ্যে মহম্মদ আতা র ছবিটা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে খাঁচার বাইরে থেকে ছবি তোলে সাংবাদিকেরা, কমলা পোশাক পরা বন্দীদের, কেও আবার স্ট্রেচারে। আফগানিস্তানে দুম দুম করে বোমা ফেলে আমেরিকা। রাতের দিকের বোমা ফেললে বেশি ভালো এফেক্ট হয় ফোটোগ্রাফির দিক দিয়ে। কন্ট্রাস্ট। অন্ধকারের মধ্যে আতসবাজির মতো আলো। টিভি সিরিয়ালেও এত বেশি মন দেয় না লোকে, যতটা দেয় এইসব আসল যুদ্ধের খবরে। মাঝে মধ্যে দেখা যেত আগে দাড়িওলা তালিবান নেতাদের। যুদ্ধ শুরু হবার পর তারা কোথায় পালিয়েছে কে জানে।
সোমবার চব্বিশে ডিসেম্বর যে ছুটির দিন, তা আমাকে কেও বলে দেয় নি। শেরীও জানত না। সেদিন বোকার মত অফিসে গিয়েছি আমরা দুজন। শুধুই আমরা। কাফেটেরিয়া বন্ধ। সব আলো নেবানো। চারতলার বিশাল সেই ওয়ার্কস্পেসে আমরা জমিয়ে গল্প করছি। এক্কেবারে ইস্কুল কলেজের দিনে বন্ধুরা যেমন গল্প করে সেইরকম।
শেরী সাত বছরেরো বেশি আছে এদেশে। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছিলো চীনের এক মফঃস্বল থেকে। এদেশেই প্রেম, বিয়ে। বিয়ের পাঁচ বছর পরে নাগরিকত্ব অ্যাপ্লাই করেছিল। হালফিল সে একজন সুইস সিটিজেন। কিন্তু এ বিয়ে টিকবে না। বরের সঙ্গে বনে না। বর এখন সিঙ্গাপুরে কর্মসূত্রে। শেরী আলাদা থাকে, যেখানে গেছলাম গত শুক্রবার। সুন্দর অ্যাপার্টমেন্ট। ও এখন ডিভোর্সের জন্য অ্যাপ্লাই করবে। যেদিন ডিভোর্সের জন্য খোঁজ নিতে যাবে, আমি যেন ওর সঙ্গে যাই।
কথায় কথায় দিন গড়িয়ে দুপুর হতে চলেছে। আমি কম্পিউটার অন করে একটা বিশেষ অ্যাপ্লিকেশন খুলে বসেছি। এটার নাম টুইক্সটেল। টেলিফোন ডিরেক্টরি। সব শহরের জন্য আছে। পোস্টকোড দিয়ে, পদবী দিয়ে দিয়ে সার্চ করা যায়। আমি আমার বাড়ি ও কাছাকাছি পোস্টকোড দিয়ে বাঙালি পদবী সার্চ করে চলেছি। কিচ্ছু নেই। হ্যাঁ পাওয়া গেছে ব্যানার্জি। দেবাঞ্জন ব্যানার্জি।
ফোন করলাম। পেয়েছি। কল ধরেছে। আমি নিজের পরিচয় দিই বাংলায়। দেখা করতে চাইবার আগে তিনি নিজেই দেখা করতে চাইলেন, পয়লা জানুয়ারি সকালে রেলওয়ে কাফেতে।
এবার আরেকজন পেলাম, ভটচায্যি। ফেন করতেই পেয়ে গেলাম। ইনি বললেন, আপনি এখনই চলে আসুন। আমার এখানে আরও একজন বাঙালি এসেছে ফ্রান্স থেকে। বারোটায় আসুন। ঠিকানা তো আছেই। অফিসের পাশেই স্টেশন, এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে একটা স্টপ।
আমি তড়াক করে উঠে পড়ি।
শেরী, আমার দেশের লোক খুঁজে পেয়েছি রে! যেতে বলছে এখনই।
—আমিও যাব তোর সঙ্গে।
— তার বাড়িতে আরও গেস্ট আছে। ফ্রান্স থেরে এসেছে।
— ফ্রান্স থেকে! কত বয়স? হ্যান্ডসাম?
শেরী তখনই ব্যাগ খুলে লিপস্টিক বের করে ফেলেছে।
— দাঁড়া বাবা। চিনি না জানি না, ওরকম হুট করে তোকে নিয়ে যেতে পারি না আমি।
— তা কেন? তা কেন? ওরা দুজন ছেলে, আমরা দুজন মেয়ে! ভালোই হবে।
— না। পরে নিয়ে যাব। পরে। কথা দিচ্ছি।
শেরী মুষড়ে পড়ে।
অফিস থেকে বেরিয়ে আমাদের দুজনের ট্রেন একেবারে বিপরীত মুখে। উল্টোদিকের প্ল্যাটফর্মে শেরী। ওর ট্রেন ঢোকার আগেই আমার ট্রেন ঢুকছে। ওর দিকে চেয়ে হাত নাড়ি আমি।
সেই মুহূর্ত থেকেই সম্ভবত আমার জীবন অন্য পথে চলতে শুরু করে দেয়।