শ্রীসদাশিবকৃত আদ্যা কালিকা স্তুতি:
সদাশিব বলিলেন -
হে দেবী! তুমি পরাপ্রকৃতি, সাক্ষাৎ পরব্রহ্ম, পরমাত্মা। সমুদয় জগৎ তোমা হতেই উৎপন্ন হয়েছে। হে শিবে! তুমিই সমুদয় জগতের জননী। তুমি গুণাতীত, তত্ত্বাতীত, তোমার থেকেই মহতত্ত্ব অবধি পরমাণু পর্যন্ত এবং স্থুল, সুক্ষ সমুদয় স্থাবর জঙ্ঘম স্বরূপ সমগ্ৰ জগৎ উৎপাদিত হয়েছে। এই সমুদয় জগৎ তোমারই অধীন। তুমিই সকলের আদ্যা বা আদিভূতা আদ্যা পরব্রহ্ম মহাশক্তি । সকল বিদ্যা ও ব্রহ্মা, মহাবিষ্ণু ও আমি(সদাশিব) তোমা হতেই উৎপন্ন হয়েছি। জগতের সকল বিষয় তোমার জ্ঞাত কিন্তু তোমায় কেহই জানিতে পারে না।
তুমিই কালী, তারা, দুর্গা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ধূমাবতী, তুমি বগলা, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, তুমি অন্নপূর্ণা, তুমিই বাগদেবী ও কমলা।
তুমিই সর্বশক্তিস্বরূপা ও সর্বদেবময়ী। তুমি সুক্ষা, স্থুলা, ব্যক্ত ও অব্যক্ত স্বরূপা। তুমি নিরাকারা হয়েও সাকারা ও সকলের অগম্যা।
উপাসকদিগের কার্যের নিমিত্তে, জগতের মঙ্গলের হেতু এবং দানবদিগের সংহারের হেতু তুমি সময়ে সময়ে নানাবিধ দেহ ধারণ করিয়া থাক। বিশ্বরক্ষার্থে তুমি কখন চতুর্ভুজা, দ্বিভুজা, ষড়ভুজা ও অষ্টভুজা হয়ে নানা রকম আয়ুধ সমূহ ধারণ করিয়া থাক। সমুদয় তন্ত্রশাস্ত্রে সেই নানাবিধ রূপভেদ, মন্ত্র, সাধন, যন্ত্রাদি বর্ণিত হয়েছে।
পশু, দিব্য ও বীর এই তিন প্রকার ভাব কথিত আছে। কলিতে পশুভাব নাই, দিব্যভাব দুর্লভ। কলিতে বীরসাধনই প্রত্যক্ষ ফলদায়ক। কলিতে কুলাচার ব্যাতিত সিদ্ধি নাই। ইহার দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান জন্মায়ে। যাঁর ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে সে নিঃসন্দেহে জীবন্মুক্ত। শাস্ত্রসম্ভুত জ্ঞান দ্বারা পবিত্র ও অপবিত্র বস্তুর ভেদ জন্মে। কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান হলে এই ভেদভাব আর থাকে না। সমুদয় জগৎকেই সে ব্রহ্মময় দেখে। সনাতনী ব্রহ্মময়ী সর্ব্বব্যাপী, কোন বস্তুই তার কাছে অপবিত্র নয়। তুমি সর্বস্বরূপিনী ও সংসার চক্র দ্বারা ক্রীড়া কর্ত্রী সকলের পরম জননী। তুমি পরিতুষ্টা হইলে সকলের পরিতোষ জন্মে। সৃষ্টির আদিতে একমাত্র তুমিই ছিলে। তোমার সেই রূপ বাক্য ও মনের অগোচর। তুমিই নির্গুণ পরব্রহ্ম তোমার সৃষ্টির ইচ্ছা হেতু তোমা হতেই সমগ্ৰ সৃষ্টির উৎপত্তি। মহৎতত্ত্ব অবধি মহাভূত পৃথিবী পর্যন্ত তোমা হতেই সৃষ্ট। তোমার নির্গুণ ব্রহ্মস্থিতি কারণস্বরূপ নিমিত্ত মাত্র। তুমি নির্গুণ পরব্রহ্ম রূপে সদা বাহ্যিক ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়েও কিন্তু অন্তরে স্পন্দনশীল, তুমি আদি অন্ত রহিত, অনাদিরও আদি, সত্যস্বরূপ, নির্লিপ্ত, সকল কার্যরহিত, অবস্থান রহিত ও বাক্য মনের অগোচর। তুমিই পরাৎপরা মহাযোগিনী। তুমি তাঁর ইচ্ছাকে নিমিত্ত করে জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার কর।
জগৎ সংহারক পরশিব মহাকাল তোমারই স্বরূপ। এই মহাকাল মহাসংহার সময়ে সমুদয় সৃষ্টিকে গ্ৰাস করবে। সকল প্রাণীকে কলন করেন বলেই তিনি মহাকাল নামে প্রকীর্ত্তিত। তুমি মহাকালকেও কলন বা গ্ৰাস করিয়া থাক, তাই তুমিই পরাৎপরা আদ্যা কালিকা। মহামৃত্যুরূপ কালকে গ্ৰাস কর, তাই তুমি কালী। তুমি সকলের এবং মহাকালেরও কাল স্বরূপা, এই হেতু জগৎ তোমায় আদ্যা কালী বলিয়া কীর্ত্তন করে। সর্ব্বসংহার প্রলয়কালে তুমি বাক্যের অতীত, মনের অগম্য, তুরীয়াবস্থায় আকৃতি বিহীন স্বরূপে অবস্থান কর। তুমি সাকারা হয়েও নিরাকারা। তুমিই নিজ মায়াশক্তি দ্বারা বহুরূপ অবলম্বন কর। তুমিই সকলের আদি, অনাদি, একমাত্র কর্ত্রী, হর্ত্রী ও পালিকা।