এর অনেক অনেক পরে আমার মেয়ে যখন ইস্কুলে পড়াকালীন ছোট্টো একটা ফিল্ম তৈরি করেছিল, তখন সেও দেখেছিল এই সিনেমাটা।
তার সেই ইস্কুলের গল্প তখন সে সে লিখেও ফেলেছিল একটি ওয়েবজিনে। সেইটে এখানে তুলে দিচ্ছি।
একেই বলে শুটিং
পারিজাত, সুইটজারল্যান্ড
৮.২.২০০৭
হলিউড-বলিউডের সঙ্গে কোনো তুলনা চলে না। সোলোথুর্ন পুঁচকে শহর, সুইটজারল্যান্ডের ফিল্মসিটি। কজন লোক নাম শুনেছে সোলোথুর্নের? আর কটা সুইস ফিল্মের নাম আমরা জানি? খুব ভেবে চিন্তে বললে বলব "হাইডি', "শোয়াইৎসারমাখার' (এষং ঢ়ষ থনদষলন ত জংভড়ড়?), "এস্কেপ্ টু প্যারাডাইস্', আর আর আর মনে পড়ছে না, ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, গতবছর বেরোলো, "গ্রাউন্ডিং'। এরা সিনেমা কম বানায়, কিন্তু ভালো করে বানায়। সেরকম হাই বাজেট সিনেমা বানায় না, এগুলো সবই লো বাজেট ফিল্ম, কিন্তু যত্ন করে বানানো।
তো আমাদের মনে খুব ইচ্ছে হয়েছিল আমরাও সব সিনেমা বানাব। ষোলো বছর বয়েসে এরকম ইচ্ছে হলে কেউ পাগল বলে না, বলে ওটা পিউবার্টির দোষ। অতএব আমরা ইস্কুলে আবদার করলাম, আমরাও ফিল্মমেকার হব। সেপ্টেম্বরে শরৎকালের ছুটি থাকে এক সপ্তাহ, সোম থেকে শুক্রের মধ্যে এত কিছু করে ফেলতে পারি আর একটা সামান্য সিনেমা বানাতে পারব না? কী এমন হাইফাই ফান্ডা লাগে সিনেমা বানাতে? স্টোরি? আছে। মানে নেই, কিন্তু এক্ষুনি বানিয়ে দিচ্ছি। বানালাম গল্প। গল্পের একটা স্টাইলিশ নাম দিলাম হেভি কায়দা মেরে - "দেজাভু'। ফ্রেঞ্চ নাম। শুধু নাম দেখিয়ে হাউসফুল করে দেব। আর কী লাগে? ভিডিও ক্যামেরা। সে হয়ে যাবে, কোনও বড়লোক ক্লাসমেটের কাছ থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ম্যানেজ করে নেব, ঘুষ হিসেবে তাকে সিনেমায় একটা রোল পাইয়ে দেব। অ্যাকটর অ্যাক্ট্রেস অনেক আছে, কত চাই? ডিরেক্টর কাম ক্যামেরাম্যান আমি নিজে। ওটাই মোস্ট দায়িত্বফুল কাজ। আর চাই, আর চাই, মুভিমেকার সফ্টওয়্যার আর বেশ ভালো হার্ড ডিস্কওয়ালা একটা ল্যাপটপ। ব্যাস, আমরা রেডি। অ্যাক্শান!
আমাদের ক্লাস টিচার ফ্রাউ স্টুকি, যাঁকে আমাদের ইংলিশের টিচার হের ফিশার আড়ালে "মিসেস্ স্টাকি" বলে থাকেন, সেই স্টুকি আমার বানানো গল্পটা শুনলেন। এবং যা ভয় পেয়েছিলাম, তাইই হল, স্টুকি এই গল্পে নিজস্ব মতামত দিতে গিয়ে গল্পটার সাড়ে বারোটা বাজিয়ে ছাড়লেন। আমার গল্পটা ছিল এইরকম :- একটা লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন একটা হকার তার হাতে একটা ফ্রি নিউজপেপার ধরিয়ে দিল। লোকটা কাগজটায় অল্প চোখ বুলিয়ে একদম তাজ্জব। সে তখন হকারটাকে খুঁজতে গিয়ে আর তাকে দেখতে পেল না। এমন সময়ে একটা লোক ছুটতে ছুটতে এসে এই লোকটার হাত থেকে ওই খবরের কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়। লোকটার হঠাৎ খেয়াল হল যে, ওই হকারই খবরের কাগজ ছিনিয়ে নিয়ে গেল। তখন লোকটাও ওই হকারের পেছনে দৌড় লাগাল, অনেকক্ষণ দৌড়নোর পরে এক সময়ে সে দেখল হকারটা আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেছে। তারপরে আবার কোনও একটা দেয়ালের পেছন থেকে হকারটা বেরিয়ে এসে লোকটার সঙ্গে একটু কথা বলেই লোকটাকে গুলি করে মেরে ফেলল। এই কথা বলার সময়ে বোঝা গেছিল যে ওই হকারটা লোকটাকে চেনে। খুন টুন করে, হকার শান্ত ভাবে খবরের কাগজটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল, আর বিড়বিড় করে বলল, "উ: যত রাজ্যের রাবিশ খবর এরা কাগজে ছাপে'। এবার ক্যামেরা জুম করল ডাস্টবিনে, আর সেখানে দেখা যাবে যে লোকটা এইমাত্র খুন হল, তার খুনের খবর উইথ ফোটো অলরেডি ফার্স্ট পেজের হেডলাইন, আর কাগজের নাম "দেজাভু'।
তিনমিনিটের সিনেমার জন্যে এর থেকে বড় আর ইন্টারেস্টিং গল্প আমার মাথায় খেলেনি। স্টুকির গাইডেন্সে, হকার বনে গেল "শয়তান'। সেই শয়তানের সঙ্গে ওই লোকটা একটা কন্ট্র্যাক্ট সই করল, আল্টিমেটলি সেই খুন ই হল। কিন্তু আমার গল্পের সব চার্ম মরে গেল। কী করব? স্টুকি আমার জার্মানের টিচার, তার হাতেই ক্ষমতা, সোলোথুর্নে গিয়ে শুটিং করার অনুমতি তিনিই দেবেন। কাজেই কম্প্রোমাইজ করলাম। এবার আরও অনেক কিছুর সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করা শুরু হল। আসল নায়ক যে হবে, তেমন কোনও ছেলে পাওয়া গেল না, কেউ লড়াই না করে খুন হতে রাজি নয়। কিন্তু এ সিনেমায় ফাইটিং সিকোয়েন্সের স্কোপ নেই। তাই লোকের জায়গায় মেয়ে এল। নাম সারা। সে বেশ নায়িকা নায়িকা দেখতে, অনেক দামি দামি জামাকাপড় আছে তার, ফিগার ভালো, শুধু অ্যাকটিংটা সে পারে না। দেড় লাইন ডায়ালগ সারা ফিল্মে, সেটা বলতে সে পনেরোবার হাসে, তার মধ্যে বারোবার হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে যায়। তাকে বেশি বকে ধমকে দিলে সে কেঁদে ফেলতে পারে, তখন তাকে তোয়াজ করে আবার শান্ত করতে হয়। ডিরেক্টরদের অনেক ঝামেলা সহ্য করতে হয়। বলতে এক্কেবারে ভুলে গেছি। আমরা কিন্তু সেই ছুটির সপ্তাহের সোমবারে ট্রেনে চেপে সোলোথুর্ন পৌঁছে গেছি। স্টুকি আমাদের সঙ্গ নিয়েছেন, আর আছেন ভুগোলের টিচার হের্ স্টাউফার। (হের্ মানে মিস্টার, ফ্রাউ মানে মিসেস্ - যারা জার্মান জানেন না তাঁদের জন্যে।) হের্ স্টাউফার ভালো লোক, যাকে বলে "কুল' লোক। আগবাড়িয়ে কোনও ঝামেলা করেন না। আমরা রইলাম ইউথ হস্টেলে।
এদিকে মার্টিন, আমাদের ক্লাসমেট, সেও রোল চায়। সিনেমায়। তখন আমি একবার ভেবেছিলাম, ওকে "এগ্রোল' দিলে কেমন হয়। কিন্তু "এগ্রোল' কী জিনিস, কেমন খেতে সেসব সুইস্রা জানে না, তাই এসব আর বলিনি। অনেক ভেবে চিন্তে মার্টিনের জন্যে একটা মাতালের রোল ঠিক করা হল, সে পথের ধারে মদের বোতল নিয়ে হা`ফ বেহুঁশ হয়ে বসে আছে। মার্টিন তাতেই খুশি। ওকে দশ সেকেন্ডের মতো স্ক্রিনে দেখা যাবে। তিন মিনিটের সিনেমায় দশ সেকেন্ড মানে প্রচুর। ইয়ার্কি নাকি! আমরা সিনেমাটা রিয়্যালিস্টিক করব, জালি জিনিস চলবে না, মার্টিনের মদের বোতলে আসল খাঁটি ভোদ্কা-ত্রো`ইকা থাকবে, লাল রঙের। শুটিং শেষ হলে, সিনেমা রিলিজ করবে কি করবে না, কিন্তু বোতলটা খালি করবার কোনও অসুবিধা হবে না। আমাদের গ্রুপের ছেলে এডি, দুবার ফেল করে তার বয়েস আঠারো, তাই সে গিয়ে বীরের মতো ভোদ্কা কিনে নিয়ে এল। আমরা বাচ্চা বলে আমাদের কেউ মদ বেচবে না।
মোটকথা আমরা রেডি। অ্যাকশন বললেই শুটিং এ ঝাঁপিয়ে পড়ব। সোমবার এসব গোছাতে গোছাতেই কখন সূর্য ডুবে গেল। মঙ্গলবার আমাদের ক্লাস নিতে এলেন, নিনো জাকুসো। বিখ্যাত সুইস্ ডিরেক্টর। সোলোথুর্নের একটা বিশেষ সিনেমা হলে বসে দেখলাম তাঁর বানানো ফিল্ম "এস্কেপ্ টু প্যারাডাইস্'। যা তা অসহ্য ভালো সিনেমা। একটা টার্কিশ রিফিউজি পরিবারের গল্প, কীভাবে তারা এই দেশে অ্যাসাইলাম পেল তার ডিটেল। গল্পটাও নিনো-র নিজের লেখা। সিনেমাটা চলেনি। এত ভালো ফিল্ম চলল না? নিনো বললেন, চলেনি কারণ খুব ভুল একটা দিনে এই সিনেমা রিলিজ করেছিল। ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১, ঠিক সেই দিনে দুনিয়ায় আরেকটা ব্লক বাস্টার রিলিজ করে, জলজ্যান্ত। সবাই সেসময়ে শুধু টিভি দেখত, কেউ সিনেমা হলে ঢুকত না। নিনোর কাছে ফিল্ম বানানোর কিছু টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি নিয়ে হাতে খড়ি হল আমাদের। কিন্তু তর সইছে না, কখন শুটিং শুরু করব? কখন?
সোলোথুর্নের রাস্তায় রাস্তায় শুরু হল শুটিং, পুরোটাই আউটডোর। কখনও ক্যামেরা নিয়ে দৌড়চ্ছি, ট্রলি নেই, আমরা গরীব স্টুডেন্ট। একটাই ক্যামেরা, কাজেই এক অ্যাঙ্গেল থেকেই একেকটা সিন নিতে হচ্ছে, শুটিং চলছে, সামনে দিয়ে লোকজন হেঁটে গেল। কাট! সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে এডিটিং, ল্যাপটপে মেমরি কম, ল্যাপ্টপ হ্যাং করে যাচ্ছে, তবু দমছি না আমরা। বাকিরা সন্ধেবেলা "আরে' নদীর ধারে আনন্দ করছে, আর আমরা কয়েকজন তখন বুঝতে পারছি সাউন্ড ডাবিং না করলে এ সিনেমার দেড়খানা ডায়ালগের আধখানাও কেউ বুঝতে পারবে না। এই করতে করতে বুধ শেষ হল, বেস্পতিবারও প্রায় শেষ। শুটিং শেষ। এডিটিং শেষ। ডাবিং এর কোনও চান্স নেই, তাই আমরা ওটাকে সায়লেন্ট মুভি বানিয়ে ফেললাম। উইথ সাবটাইটেল। সাবটাইটেলের ভাষা নির্ভেজাল সুইস্ জার্মান। ভাষা নয় ডায়ালেক্ট। আরেকটু আর্টিস্টিক টাচ দেবার জন্যে সিনেমাটাকে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট করে দেওয়া হল। রং নেবো ও না, রং দেবো ও না। শুধু নামটাই একটু ঘেঁটে গেল। সেটা স্টুকির দোষ। দেজাভু-র বদলে "শয়তানের দেজাভু'। এত খারাপ নাম লোকের মাথায় কীকরে আসে? সিনেমাকে ডিভিডিতে বার্ণ করে নেওয়া হল।
শুক্রবার আমরা ফিরছি দুপুরের ট্রেন জুরিখের দিকে। অতএব বেষ্পতিবার রাতে একটু বেশিক্ষণ বাইরে থাকার অনুমতি পাওয়া গেল। খুব বেশি নয়, জাস্ট রাত বারোটা অবধি। আর আমাদের পায় কে? আমরা হুল্লোড় করে বেড়াচ্ছি সোলোথুর্ন শহরে। রেস্টুরেন্টে যাবার পয়সা যাদের কাছে নেই, যেমন আমি, তারা নদী টদি দেখে , গান গল্প করে বেজায় ক্লান্ত হয়ে গেলাম, এমন সময়ে খবর এল, আমাদের নায়িকা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সারা। যিনি খুন হলেন সিনেমায়। সেই বোতল, যেটা সিনেমায় দেখা গেছিল সেটা তো শেষ হয়েইছে, এডি-র সাহায্যে এরকম আরও কিছু পানীয় এসেছে এবং শেষ হয়েছে। মোট পাঁচজন এইসব কীর্তি করেছে, কিন্তু সারা নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রায় অজ্ঞান। অ্যাম্বুলেন্স এল। সারাকে নিয়ে ফ্রাউ স্টুকি হাসপাতালে গেলেন। গোটা ইউথ হস্টেলে থম্থমে ভাব। সারা বাঁচবে তো? বিষক্রিয়া? সেই পাঁচজনের মধ্যে চারজনকে (কারণ সারা বাদ, সে হাসপাতালে) জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে, কিন্তু তারা সব চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুম। কিন্তু শুক্রবার সকাল হতেই পাঁচজনকে ভোরের ট্রেনে জুরিখ পাঠিয়ে দেওয়া হল। সারাও তাদের সঙ্গে। ও তখনও অসুস্থ, স্টুকি ওকে ভোরবেলাই হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন। ওদের বলে দেওয়া হল, সোজা ইস্কুলে যাবে আর রেক্টরের সঙ্গে দেখা করবে! এদিকে ওদের প্রত্যেকের বাড়িতে ফোন করে করে বাবা-মাকে জানানো হয়েছে, আপনার ছেলে বা মেয়ে এই কীর্তি করেছে। সবচেয়ে বেশি ভয় হয়েছিলো আমার। আমিই তো ডিরেক্টর, ওই রিয়্যালিস্টিক কান্ডকারখানর জন্যে রিয়েল অ্যাল্কোহলের পার্মিশান তো আমি দিয়েছিলাম। ওরা আমাকে এক ফোঁটাও দেয়নি, আমি চাইওনি, তবুও আমারও যদি শাস্তি হয়? যদি ওরা বলে, মদ কে এনেছিল, কেন এনেছিল, এসব বুদ্ধি কে দিয়েছিল?
খুব ভয়ে ভয়ে সোমবার ইস্কুল গেলাম। কিচ্ছু হয়নি। আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন ভুগোলের টিচার। উ:, কী ভালো লোক। সারা যেহেতু হাসপাতাল অবধি যাবার মতো অবস্থায় নিজেকে নিয়ে গেছল, তাই ওকে একটা ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছে, আর ওদের পাঁচজনকে ইস্কুল বাড়ি পরিষ্কার করতে হবে। শাস্তি। এই সব ঝামেলায় সিনেমার ব্যাপারটাই সবাই ভুলে গেল। সেদিন দেখছিলাম ডিভিডিটা। আমার নিজের বানানো প্রথম সিনেমা। দ্বিতীয়টা এখনো বানানো হয়নি যদিও। আর লিখেই ফেললাম এই প্রবাসীর পত্র যতক্ষণ প্রবাসী আছি।