ফ্লাইট বেশ গভীর রাতে। রাতে হোটেল থেকে চেকাউট করার সময় মনে হলো মেয়েটিকে জানিয়ে যাই। বিদায় নিতে গিয়ে দেখি ওর ঘরের দরজার বাইরে তালা ঝুলছে। রিসেপশনের ডিউটিতে তখন এক যুবক। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম ঐ মেয়েটির কথা, কোথায় গেল মেয়েটি?—কোন মেয়ে?
—নাম মনে হয় সীমা, মনে করতে পারছি না।
আমার সঙ্গে যখন ও কথা বলত, একেক সময় ওর একেকরকম নাম হয়ে যেত। সীমা নামটাও একবার নিজেকে দিয়েছিল ও। ওর আসল নকল কোনও নাম নিয়েই আমার আগ্রহ ছিল না। মজা ল্গেছিল যে, ও ক্ষণে নিজের নাম বদলে বদলে রাখে। যখন যেমন খুশি।
রিসেপশনের ছেলেটি বুঝে ফেলেছে সীমা নামটা বলতেই।
জানালো কিুক্ষণ আগেই মেয়েটি চেকাউট করে চলে গেছে।
আমি কৌতুহল সামলাতে না পেরে বললাম, কিন্তু ওর কাছে তো টাকা পয়সা কিছুই ছিল না, বিল চোকালো কেমন করে?
জানা গেল, কয়েকজন লোক এসে ওর বিল চুকিয়ে দিয়ে, ওকে নিয়ে গেছে। ফোনের বিলও দিয়েছে তারাই। মেয়েটা হরদম নানান ক্লায়েন্টকে ফোন করত। তাদেরই কেউ হবে। রিসেপশনের ছেলেটিকে মালিক ও ম্যানেজার খুব করে বকে দিয়েছে, ওরকম মেয়েদের যেন আর এই হোটেলে রুম না দেওয়া হয়। লোকগুলো গাড়ি এনেছিল, মেয়েটির যদিও লাগেজ বলতে কিছু ছিল না।
অজানার দিকে উড়তে উড়তে মেয়েটি কোথায় চলে গেল কে জানে।
আমি ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্টে চললাম।
রাতের এয়ারপোর্ট গমগম করছে। আয়েরোফ্লোতের কাউন্টারে মস্ত লাইন। অল্প পরে আমার চেক ইন এর পালা। লাগেজ হাতে নিয়ে জমা দেব বলে নীচু হয়েছি, কাউন্টারের লোকটি বলল, ওয় ওয়ে টিকিট, ওয়ান ওয়ে ভিসা আপনার, ইনকামট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স কই?
— সেটা কী?
— ওয়ান ওয়ে টিকিটে ইনকাম ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স লাগবে।
— সেটা কোথা থেকে আনব?
এর উত্তর লোকটির জানা নেই। সে আমাকে সাইড করে দিয়ে অন্য প্যাসেঞ্জারদের ডাকতে লাগল।
আমার তো মাথায় বাজ! এরকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলাম না। আমি আবার ঠেলেঠুলে কাউন্টারের লোকটিকে বললাম, তাহলে আমি এখন কী করব? আমি জুরিখ যাচ্ছি চাকরি নিয়ে, এরকম করলে আমি চাকরিতে জয়েন করব কী করে?
লোকটি আমার প্রশ্নের উতিতর জানে না, বলল, আমার হাতে কিছু নেই, আমি গ্রাউন্ড ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলুন।
— তিনি কোথায়?
লোকটি দেখিয়ে দিল, একজন মোটাসোটা লোক ভেতরের দিকে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
এখান থেকে তাকে ডাকা অসম্ভব। কোনও পথও নেই ঐদিকে যাবার। একটাই ফাঁক, যেখান দিয়ে মাল তুলে তুলে ওজন করে করে সোজা কনভেয়ার বেল্টের ওপর পড়ছে।
আর দেরি করা যাবে না। আমি সোজা ঐ ফাঁক দিয়ে লাফিয়ে উঠে কনভেয়ার বেল্টের ওপর দিয়ে ব্যালেন্স করে দৌড়ে কিছুটা গিয়ে ভেতরে গিয়ে আবার লাফ নিয়ে ওপাশে নেমে পড়লাম। হালকা হৈহৈ হলেও ব্যাপারটা কয়েক সেরেন্ডের মধ্যেই ঘটেছে। ম্যানেজারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। লোকটা রাশিয়ান! আমি আমার শেষ চেষ্টা করলাম। আর ইংরিজি নয়, সোজা রাশিয়ানে।
— দেখুন না, আমাকে যেতে দিচ্ছে না, আমার টিকিট ভিসা সব আছে। কীসব ক্লিয়ারেন্স চাইছে।
— অ্যাঁ?!
— ইনকাম ট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স চাচ্ছে।
ম্যানেজার ধাতস্থ হতে একটু সময় নিলেন।
— ওটা তো লাগবেই। ওটা না দিলে কেমন করে হবে?
— এত রাতে আমি কোত্থেকে পাব বলুন তো?
উনি চুপ করে গেলেন।
— আপনার কি আমাকে দেখে মনে হয় আমি আয়কর ফাঁকি দিয়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছি?
— নাহ। মনে হয় না। আসুন আমার সঙ্গে। টিকিট দেখি।
টিকিট দেখালাম।
— আপনি জুরিখ যাচ্ছেন? এত ভাল রাশিয়ান বলেন কেমন করে?
আমি বিনয় দেখালাম। ঐ আর কি অল্পস্বল্প... ও কিছু নয়..
ম্যানেজার কাউন্টারে দাঁড়িয়ে নিজে আমার চেক ইন করিয়ে দিলেন। সেই সঙ্গে একরাশ শুভেচ্ছা আমার নতুন চাকরির জন্যে।
কালবিলম্ব না করে, চুড়ান্ত দ্রুততায় ইমিগ্রেশন শেষ করে, গেট নাম্বার তিনের ওয়েটিং লাউঞ্জে ঢুকে তবে শান্তি।
এমনি সময় শুনি পাশ থেকে কে যেন বাংলায় বলছে, কী? এত ঝামেলা হচ্ছিল কেন? একসেস ব্যাগেজ নাকি?
দেখি আমারই সমবয়সী এক সুটেড বুটেড বাঙালি লোক আমাকেই এই প্রশ্নগুলো করে মিটমিটয়ে হাসছে।
এই লোককে আমি চিনি না, কস্মিনকালেও দেখেছি বলে মনে হয় না।