একজন নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর মত সংবাদ সব সমাজেই মুখরোচক আলোচনার সম্ভাবনা তৈরি করে। সেই নারীর যদি কোনও দুর্ঘটনাময় অতীত থাকে, যদি মৃত্যুর পূর্ব অবধি তার অ্যাফেয়ার থাকে কোনও বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে, তাহলে তো কথাই নেই। শব্দের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে সেই সংবাদ।
(নাম পরিবর্তিত)
— অর্চনার মৃত্যু কি সুইসাইড? নাকি খুন?
— সুইসাইড যদি হয়, সে কি প্রেগন্যান্ট ছিল?
— খুনও হতে পারে, তাকে প্রেগন্যান্ট করে দিয়ে ঐ বদমাশ লম্পটটা মার্ডার করে দিয়েছে নির্ঘাৎ!
এরকম হাজারো আলোচনা ও বিচারসভা বসে যায় নেট দুনিয়ায়, টেলিফোনে এবং বাংলাদেশিদের নানান মজলিশে। সে সব মজলিশে নানান মতামত, লোকটির স্ত্রীর জন্য অনুকম্পা, এবং সর্বোপরি ঐ সোকটিকে কেমন করে খুনি সাব্যস্ত করে তার অ্যাসাইলাম খারিজ করিয়ে, জেলবাস করিয়ে, বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো যায় — এ নিয়ে বাঙালিরা চিন্তায় চিন্তায় অস্থির।
সামাজিক এবং আইনত পলিগ্যামি সিদ্ধ এমন দেশ থেকে আগত, বা পলিগ্যামিস্বীকৃত বাংলাদেশ থেকেও এই লোকটিকে কেমন করে সাজা দিয়ে পিষে মেরে শেষ করা যায় তার উপায় বের করতে জনতার ঘুম নেই।
বেঁচে থাকতে যারা অর্চনার খোঁজ নেয় নি, মেয়েটা গণধর্ষনের পর বিচার পায় নি যখন, তখন কেও সাহায্য করে নি। বিদেশে বিভূঁইয়ে একা একটা বিজাতীয় ভিন্ন ভাষার সমাজে মেয়েটা কেমন আছে, কী করছে, তার অসুখ বিসুখের খোঁজ কেও নেয় নি। দিনকে দিন সে পাতের মত রোগা হয়ে যাচ্ছে জেনেও কেও তার কাছে সাহায্যের হাত বাড়ায় নি।
বরং সে ছিল ঘৃণার পাত্রী। বিবাহিত পুরুষকে ভালোবেসেছিল, শারিরীক সম্পর্কও ছিল। কেও তার সঙ্গে জীবদ্দশায় মেশে নি।
সারাটা দিন ধরে মেয়েটা জারমান ভাষার ক্লাসে পড়াশোনা করত, সংস্থার মাসিক বৃত্তির টাকার সিংহভাগ পাঠাত দেশে বাবার কাছে মেজবোনের উচ্চশিক্ষার খরচ, তাদের সাধ আহ্লাদের খরচ সব মিটিয়ে, প্রেমিকের পাবলিক ট্রান্সপোর্টের মাসিক টিকিটের খরচও সে ভালোবেসে মেটাতো। পরিশেষে নিজের জন্য কিছুই থাকত না। মেয়েটা প্রায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছিল। তার মেজাজ খারাপ হচ্ছিল রুগ্নতার কারনে, মানসিক চিন্তার কারনে।
সে খুব চাইত ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে ভাল ডিগ্রি পেয়ে স্বাধীন জীবন যাপন করতে।
প্রেমিককে বিয়ে করা বা তার বিয়ে ভেঙে দেবার প্রস্তাব সে বারে বারে প্রত্যাখ্যান করেছে। জারমানিতে পলিগ্যামি চলে না। চললেও সে রাজি হতো না।
এ সবই জেনেছি তার মৃত্যুর আগে পরে মিলিয়ে সেই লোকটির কথায়।
ঐ এক ঝলক অর্চনাকে দেখেও সেরকমই মনে হয়েছিল। জেদি মেয়ে, অনেক ঝড়ের মধ্যে দিয়ে গিয়ে সে ক্লান্ত, তবে তার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটা প্ল্যান আছে, তার ওপর ভরসা করে আছে তার বাবা মা বোনেরা। মেজবোন আশা করে আছে দিদি তাকে জারমানিতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবে।
এই মেয়ে আত্মহত্যা করতে পারে কি?
পারে না। কোনও যুক্তিই তার আত্মহত্যার স্বপক্ষে খাটে না।
সে প্রেগন্যান্ট হলেও মরবে না, ইয়োরোপে এরকম ছেঁদো কারনে কেউ মরে না, সমাজ মুক্ত॥ সেতো এননিতেই কারোকে পরোয়া করে নি, ম্যাচিওর্ড ভাবনা চিন্তা দেখা গেছে তার লেখাপত্রে। ইমোশনাল হয়ত ছিল, কিন্তু নাহ্, হঠকারিতা করবার মত মেয়ে সে নয়।
এদিকে পুলিশ নিয়ে গেছে দেহ। যে দেহ সাত কিংবা দশদিনের মৃতদেহ। বারোই ডিসেম্বরে মৃত্যু হয়েছে ধরে নিলে আরও পুরোন সেই লাশ।
ময়না তদন্ত এবং ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের ল্যাবরেটরি টেস্টের পরেই জানা যাবে এ মৃত্যুর রহস্য।
তার মৃতদেহ পাওয়া গেছল বাথটাবে। সেই বাথটাব নভেম্বরের গোড়ায় আমরা দেখে এসেছি। বাথটাবে জল ছিল, সেই জলেই পাওয়া গেছে তাকে। সেজন্যই লোকটি চিৎকার করে বলেছিল — এত পানি কেন দিদি? এত পানি এল কোথা থেকে!