সুধীর বাবু তাঁর মত প্রতিষ্ঠা করতে একটু উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলেন মনে হয়। নাহলে তাঁর জানার কথা, যে দাবী তিনি করেছেন, মানে, লালন আর কোন গানে ‘লালন ফকির’ লেখেন নি, এটা কিন্তু পুরোপুরি সত্যি নয়। কম লিখেছিলেন সেটা ঠিক, কিন্তু একেবারেই লেখেন নি সেটা ভুল –
“—আর বেদ বেদান্ত পড়বে যত বাড়বে তত লক্ষণ
আমি আমি কে বলে মন,
যে জানে তার চরণ শরণ লেনা
ফকির লালন বলে, বেদের গোলে হলাম চোখ থাকতে কানা”।
এটা উল্লেখিত আছে বেশ কিছু বইতেই। সময়ের হিসাবে ধরলে – ১) শ্রীমতি সরলা দেবী, ‘ফকির লালন ও গগন’ ভারতী, ভাদ্র ১৩১২; ২) উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ‘বাংলার বাউল ও বাউল গান, কলকাতা ১৩৬৪
এবার কেউ যদি বলেন এঁরা দুজনেও ছড়িয়েছিলেন, তাহলে আমার কিছু বলার নেই J
“বাংলার বাউল ও বাউল গান” বইটিতে সংগ্রীহিত আছেঃ
“--- বার মাস চব্বিশ পক্ষ, অধর ধরা তার সনে
স্বর্গ-চন্দ্র দেহ-চন্দ্র হয়।
তাতে ভিন্ন কিছু নয়;
এ চাঁদ ধরিলে সে চাঁদ মিলে, ফকির লালন কয় নির্জনে”।
সাঁই এর আলোচনাটা ঠিক ধরতে পারছি না – হয়ত আমার বোঝার ভুল এই ক্ষেত্রে। তবে আমার জানামতে লালন তো নিজেকে ‘সাঁই’ বলে উল্লেখ করেছেন কিছু গানে। একটা গান,
“ – নিরপেক্ষ নহে আছে পক্ষ,
বাদ-বাদী প্রতিবাদী আছে একসাথী
আমি যাব বলে ডানি
হাতে দেয় সে হানি,
সিতু বলে, লালন সাঁই যদি দেয় উপাধি”।
লালন নিজেকে ফকির বলেছেন এমন আরো গান,
“—গুরুর অঙ্কুর না বসিলে তাকে কেবা শিষ্য কয়
ফকির লালন বলেন, সাঁইয়ের বচন শিষ্য হওয়া বড় দায়
তিন মনকে এক মন করে ঐ চরণে সাধন-ভজন করতে হয়”।
“ - - ফোঁটা তিলক তসবি-মালা
তা জপো কি কারণে?
ফকির লালন বলে, তোমার দেহে আছে ছয়জন রিপু
বলি দাও গুরুর শ্রীচরণে”
“ - - ও ফুল রসিক ধইরাছে-প্রেম ডুরিতে
যে তারে কইছে ধরো,
খোদার ছোট, নবীর বড়
ফকির লালন বলে, নড়চড়
থাক সেই চরণ মিশে-প্রেম ডুরিতে”।
“ - - হাঁটতে মানা, আছে চরণ,
মুখ আছে তার, খাইতে বারণ।
ফকির লালন কয়, এ যে কঠিন মরণ,
তা কি পারবি তোরা”?
পরিশেষে বলা, সুধীর ববুর বাকি দাবী “হিন্দুমুসলমানখ্রীষ্টান সকলকে নিয়েই গানের শরীর গড়ে উঠেছে, ভাবা হয়নি যে লালনের সময়ে জাতিভাবনার এত বিস্তার ছিল না, অন্তত প্রত্যত গ্রামে”। এই সেই হিসেবে কনক্লুশন টানার চেষ্টা হয়েছে যে “এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে” গানটা লালন লিখতে পারেন না।
সুধীর বাবু এখানটাও তলিয়ে দেখেন নি। এই মুহুর্তে মূল লেখাটি হাতের কাছে নেই, কিন্তু ক্রশ রেফারেন্সটা দিই, লালনের মৃত্যু শত বার্ষিকী স্মারকগ্রন্থে তৃপ্তি ব্রক্ষ্মা নামে একজন এক প্রবন্ধ লিখেছিলেন, “ লালনের মনবতাবাদ ও অসাম্প্রদায়িক ভিত্তি” – তো সেখানে একটা লালনের গানের উদাহরণ আছে,
“আরবী ভাষায় বলে আল্লা
ফারসীতে হয় খোদা তালা
গড বলিছে যীশুর বেলা
ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভাবে
মনের ভাব প্রকাশিতে
-------------
--------------
আল্লা হরি ভজন পূজন
সকলি মানুষের সৃজন”
বা তার থেকেও স্পষ্ট পাওয়া যায় সরলা দেবীর “লালন ফকির ও গগন” বইটিতে সংগ্রীহিত লালনের এই গানটি
“জগন্নাথ দেখ রে যেয়ে
জাত কেমন রাখে বাঁচিয়ে
চন্ডালে আনিলে অন্ন ব্রাহ্মণে তাই খায় চেয়ে
জোলো ছিল কবীর দাস
তার তোড়নি বার মাস
উঠছে উথলিয়ে সেই তোড়নি খেয়ে
যে ধনী সেই আসে দর্শন পেয়ে
ধন্য প্রভু জগন্নাথ,
চায় না রে সে জাত-অজাত
ভক্তের অধীন সে, এবার জাত-বিরোধী দুরাচারী
যায় তারা সব দূর হয়ে
জাত না গেলে পাইনে হরি
কি ছার জাতের গরব করি
ছুঁসনে বলিয়ে
লালন কয়, জাত হাতে পেলে পোড়াতাম আগুন দিয়ে।“
লালনের মৃত্যু শত বার্ষিকী স্মারকগ্রন্থে উল্লিখিত আরো একটি গান
“বারো তাল উদয় হলো কলিকালে
কি করি কোন পথে যাই
পড়ে গোলমালে
কাশী কি গয়াতে যাই
ভেবে কিছু দিশে না পাই
ও কথা কারে শুধাই
মেলে কি মক্কাতে গেলে
পাপ-ক্ষয় গঙ্গা চানে,
খ্রিষ্টানেরা কয় জর্ডনে
একথা নেয় না মনে
আন্দাজে তীর্থ ঠেলে
যথা যাই মানুষ দেখি
মানুষ দেখে জুড়াই আঁখি
লালন বলে, আমি বা কি
না জেনে খুঁজি জঙ্গলে”।
তো যেটা বলার, লালনের অনেক গানেই ‘জাতিভাবনার’ পরিচয় আছে। সেই যুক্তি দিয়ে “এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে” গানটি লালনের লেখা নয় তা প্রমাণ করা যায় না।
দুদিন পর তিনি ঠিকই আবির্ভুত হবেন। লালন মারালেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।