প্রসূন আচার্য লিখেছেন দেখলাম। অনেকাংশেই একমত।
মাথা হেঁট করে দেওয়া সন্দেশখালি প্রভাব ফেলবে লোকসভা ভোটেও।
--- প্রসূন আচার্য
সন্দেশখালির ঘটনা বাংলার লজ্জা। বাঙালির লজ্জা।
সন্দেশখালি কোনও মাওবাদী মুক্তাঞ্চল নয়। যেখানে পুলিশ প্রশাসন যেতে পারে না। মূলত তফসিলি, আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের বাস এই সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় গত দেড় মাস ধরে যা হচ্ছে, এবং স্থানীয় মানুষ বিশেষ করে মহিলারা প্রকাশ্যে দীর্ঘ দিনের অত্যাচারের যে ধরনের অভিযোগ করছেন, তাতে সত্যি লজ্জা লাগে, আমরা কোন রাজ্য, কোন সমাজে বাস করছি! পুলিশ প্রশাসন এত দিন ধরে কী করত?
এক শিশুর ভিডিও দেখলাম। কী ভাবে ধানের জমিতে জোর করে জল ঢুকিয়ে, ধান কাটতে না দিয়েই মাছের চাষ করেছে শাজাহান বাহিনী, তারই বিবরণ দিচ্ছে সেই ছয় সাত বছরের শিশু!
লুম্পেন ক্রিমিনাল শাজাহান বাহিনী নির্বাচিত তৃণমূলের জন প্রতিনিধির সিলমোহর নিয়ে দিনের পর দিন যে ধরনের অত্যাচার চালিয়েছে, তার শাকরেদ উত্তম সর্দার শিবু হাজরারা যে অন্ধকারের রাজত্ব কায়েম করেছে, তার কোনও খবর কালীঘাট, ক্যামাক স্ট্রিটের শান্তিনিকেতন বিল্ডিং বা নবান্নের কাছে ছিল না, এটা হতে পারে না।
কিন্তু একদিকে বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডলের মত দাপটের সঙ্গে কোটি কোটি টাকা অবৈধ রোজগার, পার্টি নেতৃত্বের একাংশকে সেই টাকার ভাগ দেওয়া, অন্য দিকে রাজনৈতিক পেশী শক্তির জোরে ভোট নিয়ন্ত্রণ, এই দুই কারণেই রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান এবং তৃণমূল নেতৃত্ব চোখ বন্ধ করে ছিল। হ্যাঁ, বড় বড় কথা বলা ডায়মন্ড ভাইপো অব্দি!
বিক্ষোভরত মহিলারা বলছেন, তাঁদের রাতে ডাক আসত। ভোর বেলায় ফিরতে হতো। দেখলাম, রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গাঙ্গুলি (যিনি মূলত সিনেমা সিরিয়ালের স্ক্রুপট লিখিয়ে এবং এই যোগ্যতায় তিনি ওই পদে আছেন) বলেছেন, "ধর্ষণ এর কোনও অভিযোগ পাইনি। রাতে নিয়ে গিয়ে মহিলাদের দিয়ে কাজ করানো হতো!"
How strange! আরে দূর্যোধনও তো দ্রৌপদীকে ধর্ষণ করেনি! শুধু বস্ত্র হরণ করেছিল মাত্র। আপনার মন্তব্য এটাই প্রমাণ করে আপনি নারী নির্যাতনকে এত ভালো ক্লাসিফিকেশন করেন বলেই বলেই এই পদে বসেছেন! ধন্য আপনার মহিলার কমিশন।
ভাবতে আরও লজ্জা লাগে এই কারণে যে, একদা অগ্নিকন্যা মমতা ব্যানার্জি শুধু এই অভাগা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নন, দেশের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রী! কিন্তু এখনও অব্দি সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে মমতাকে এমন কোনো কড়া প্রতিক্রিয়া দিতে দেখিনি বা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখিনি, যেটা রাজধর্ম পালনের প্রাথমিক শর্ত।
আর ফেরার ক্রিমিনাল শাজাহান? তাকে যে ইচ্ছে করলেই ধরা যায়, নিয়মিত আদালতে তার আইনজীবীর পেশ করা বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার। এখন তার নতুন আবদার, তাকে গ্রেফতার করা না হলে সে আদালতে হাজিরা দেবে ! ভাবুন একবার! তৃণমূল নেতৃত্ব বা রাজ্য পুলিশ জানে না, শাজাহান কোথায় আছে এটা হতে পারে না।
সরকার যে সাধারণ মানুষ থেকে আরম্ভ করে সাংবাদিক বা সংবাদ মাধ্যম কারও অভিযোগকেই পাত্তা দেয় না, এতটাই দম্ভ আর অহংকারের চূড়ায় বসে আছে, তার প্রমাণ এক সন্দেশখালিতে ED রেইডের দিন সাংবাদিক নিগ্রহের ব্যাপারে কলকাতা প্রেস ক্লাবের সামনে প্রতিবাদ সভার পরে দোষীদের শাস্তি সহ একাধিক দাবিতে চিঠি দেওয়া হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর মন্ত্রক ( CMO ) , রাজ্যের চিফ সেক্রেটারি এবং ডিজিকে। কিন্তু সেই চিঠির প্রাপ্তি টুকু এক মাসের মধ্যে স্বীকার করা হল না। সাংবাদিক নিগ্রহের ব্যাপারে দোষীদের শাস্তি তো অনেক দূরের কথা!
একটা কথা ক্ষমতাসীন হলেই সবাই ভুলে যান। "চির দিন কাহারো সমান নাহি যায়।" এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। আজ মমতা যদি বিরোধী নেত্রী হতেন, সন্দেশখালিতে মা বোনদের অপমানের বিরুদ্ধে, নারীর সন্মান ভূলুণ্ঠিত হওয়ার অভিযোগে, রাজ্যে আগুন জ্বলতো, বাংলা বনধ হত। কোনোটাই হয়নি।
তার কারণ, বিজেপি এই সুযোগে ভোট ভাগের লক্ষে হিন্দু মুসলিম বিভাজনের কার্ড খেলছে। তাদের একটাই কথা, শাজাহান বাহিনী আদিবাসী মহিলাদের নির্যাতন করত। অর্থাৎ মুসলিমদের হাতে হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা। আর সিপিএম পথে নেমে প্রতিবাদ জানালেও তারা আজ বড়ই দুর্বল। এবং ৩৪ বছরের শাসনে তাদের বিরুদ্ধে এত রকমের অভিযোগ এখনও মানুষের মনের মধ্যে ভেসে ওঠে যে তাদের পক্ষে জনমত গঠন বা জোরদার রাজনৈতিক লড়াই করা খুবই কঠিন।
তবু ভীত প্রশাসন দৃষ্টি ঘোরাতে ১০০ কিমি দূরে বাঁশদ্রনী থেকে প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক নিরাপদ সর্দারকে গ্রেফতার করেছে! সবাই বুঝতে পারছে , আন্দোলনরত মহিলাদের মুখ বন্ধ করতে, তাদের ভয় দেখাতেই প্রশাসন এই পদক্ষেপ নিয়েছে। বিনাশ কলে বিপরীত বুদ্ধির মতই এই ঘটনা।
সব শেষে একটা কথাই বলবো। মানুষ ভোট দেয় পারসেপশান অনুযায়ী। সিঙ্গুরে টাটাদের গাড়ি কারখানা হলে ভালো হতো কিনা, শিল্প এলে কর্মসংস্থান কতটা হতো , সেই বিতর্কে না গিয়ে মানুষের মধ্যে পারসেপশান বা ধারণা গড়ে উঠেছিল, সিপিএম জোর করে কৃষকদের জমি নিয়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে মুসলিমদের। নন্দীগ্রামের পরে সেই ধারণা আরও জোরদার হয়। ফল কী সবাই জানেন।
সন্দেশখালির ঘটনা সাধারণ গরীব মধ্যবিত্ত মানুষ, বিশেষ করে মহিলাদের মনে একটাই ধারণার জন্ম দিল, শাজাহান বাহিনীর মত গ্রামের তৃণমূল নেতাদের হাতে মহিলাদের লাঞ্ছনা আর কালীঘাটকে কাঁদায় না। বরং প্রকারান্তরে নানা চক্রান্তের তত্ত্ব উপস্থাপনা করে এই শাজাহান বাহিনীর পাশেই দাঁড়ায় কালীঘাট।
লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা ২০০ টাকা বাড়িয়ে বা দ্বিগুণ করে এই পারসেপশন বা ধারণার মোকাবিলা করা যাবে তো ?
তৃণমূল নেতৃত্ব এই কথাটা ভালো করে ভাবুন।
লোকসভার ভোট আর তিন সপ্তাহের মধ্যেই ঘোষণা হবে।
সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের ফায়দা যেমন মমতা পেয়েছিলেন, তেমনি সন্দেশখালির ফায়দা বিজেপি পাবে না তো ?
C@ প্রসূন আচার্য