সাভারকরকে নিয়ে এখানে দুটো কথা বলার লোভ সামলাতে পারলাম না।
এক, গান্ধী ও সাভারকর চললেন বিপরীত মুখে। গান্ধী ১৯২০-২২ নাগাদ নিজেকে মোস্ট ওবিডিয়েন্ট সাবজেক্ট অফ বৃটিশ এম্পায়ার লিখতেন, কিন্তু একের পর এক ঘটনায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে বদলাতে তাদের এ ডেভিল'স এম্পায়ার বলতে লাগলেন।
সাভারকর শুরু করেছিলেন বৃটিশ খেদাতে ব্যক্তিগত ইংরেজ রাজপুরুষ হত্যার রাস্তায়। অনেকটা ক্ষুদিরাম প্রফুল্ল চাকী স্টাইলে। কিন্তু নিজে কখনও কাউকে গুলি করেন নি। লডনে এডিকং হত্যায় মদনলাল ধিংড়া এবং পুণেতে জ্যাকসন হত্যায় অনন্ত কানহারে --সবাইকে পিস্তল সাপ্লাই করা এবং হত্যার জন্যে উদ্দীপ্ত করে শপথ গেলানো--সবই করেছেন।
লডনে ওকালত পড়ার সময় সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম আখ্যাদিয়ে বই লিখলেন--ইংরেজি এবং মারাঠিতে।
কিন্তু লাইফ টার্ম শাস্তি পেয়ে কালাপানি যাওয়ার কয়েক মাস পরে শুরু হল --মাফ চেয়ে মুক্তির আবেদন লেখা।
মোট ছ'খানি চিঠি লিখেছেন।
তাতে বলছেন বীরই উদার হৃদয় হয়ে ক্ষমা করতে পারে। প্রডিগাল সন যদি ভুল বুঝতে পেরে বিকেলে বাড়ি ফিরে আসে তবে কি পিতৃগৃহে তাঁকে ঠাঁই দেওয়া হবে না?
আরও বললেন --মহামূর্খ ছাড়া কেউ আর বিপ্লবের রাস্তায় হাঁটার কথা ভাবে না। এটাও বললেন যে তাঁকে দেখে যারা বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিল তাদের তিনি বুঝিয়ে সুজিয়ে বিপ্লবের পথ থেকে সরিয়ে আনবেন। কিন্তু তার জন্যে তাঁকে আগে মুক্তি দিতে হবে।
এটাও বললেন যে ছাড়া পেলে আজীবন বৃটিশ সরকার যেভাবে তাঁকে দিয়ে যে কাজ করাতে হুকুম করবে তিনি তাই করবেন।
এভাবে একজনের আদ্দেক ভরা গ্লাস খালি হয়ে গেল। আর অন্যজনের আদ্দেক খালি গ্লাস পুরো ভরে উঠল।
দুই,
আমি পাশাপাশি দাঁড় করাচ্ছি দু'জনকে -- পুণের সাভারকর এবং বেনারসের শচীন্দ্রনাথ সান্যাল।
সাভারকর কতদিন আন্দামানে ছিলেন? ১০ বছর। (১৯১১-২১)।
শচীন্দ্র সান্যাল? ১৪ বছর। দু'দফায় ( ৫ এবং ৯ বছর)।
শচীন্দ্র সান্যাল একমাত্র বিপ্লবী যিনি দু'দুবার আন্দামানে গেছেন। ইতিহাসে এর নজির নেই।
প্রথমবার আন্দামান থেকে ফেরার পর সাভারকর কী আন্দোলন করলেন?
চিঠিতে যা লিখেছিলেন তাই করেছিলেন। বাকি জীবন কোন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন করেন নি। হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানোয় ব্যস্ত ছিলেন। হিন্দুত্বের তত্ত্ব দাঁড় করাতে লেখালেখি করলেন। এমনকি বুড়ো বয়সে ' দ্য সিক্স গোল্ডেন ইপোক্স অফ হিস্ট্রি'তে লিখলেন যে সাপ মারার সময় যেমন মেয়ে না বাচ্চা সাপ সেসব দেখা হয় না। মুসলিম হত্যার সময়েও তাই করতে হবে।
শচীন সান্যাল? আন্দামানে দুদফায় ১৪ বছর ছাড়াও নানা আন্দোলনে মোট তিরিশ বছরের মত জেলে গেছেন। এমনকি ৪২শের আন্দোলনের সময়ও ওনাকে গ্রেফতার করে প্রথমে দেউলি , পরে টিবি হওয়ায় ঘরের কাছে গোরখপুরের জেলে পাঠানো হয়। উনি জেলেই অসুস্থ অবস্থায় মারা যান।
সাভারকররা এবং বারীন ঘোষেরা (উপেন বন্দ্যো প্রভৃতি) দু'বছরের মাথায় গুড কন্ডাক্ট দেখিয়ে বন্দীদের উপর খবরদারি করার এবং নিজেদের লপসি ছেড়ে পছন্দমত আলাদা রান্না করার অধিকার পেলেন। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শচীন সান্যাল এবং ত্রৈলোক্য মহারাজ।
এঁরা দুজনেই আন্দামানে সাভারকরদের সঙ্গে পাঁচ বছর কাটিয়েছেন, কোন আপোষ করেন নি। অত্যাচার সহ্য করেছেন।
পাঁচ বছর পর বারীন জেলের প্রিন্টিং এর চার্জ পেলেন আর সাভারকর হলেন তেলঘানির ফোরম্যান। এটা ভক্তেরা চেপে যায় ।
কিন্তু দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকে থাকা ঐতিহাসিক আর সি মজুমদার এ নিয়ে তিক্ত খেদ প্রকাশ করেছেন।
দেখুনঃ ভারত সরকার দ্বারা ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত এবং ওনার সম্পাদিত " পেনাল সেটলমেন্টস অফ আন্দামান অ্যান্ড নিকোবর" (১৯৭৫)।
তাহলে সেলুলার জেলের বা পোর্ট ব্লেয়ার এয়ারপোর্টের নাম কাদের নামে হওয়া উচিত?
গুণগত এবং পরিমাণগত --দুই হিসেবেই সাভারকরের থেকে শচীন এবং মহারাজ অনেক এগিয়ে। আমরা বাঙালীরা নিজের গৌরবময় ইতিহাস ভুলে চুপ করে সব মেনে নিচ্ছি। ঈশান এবং গর্গ চ্যাটার্জিরা এ নিয়ে লিখুন, বাঙালীরা সত্যিটা জানুক।
সংসদে কার ছবি টাঙানো উচিত?
ইতিহাস বইয়ে শচীন সান্যাল এবং মহারাজের নাম নেই কেন?
দুঃখের বিষয়, বইটি কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি পিডিএফ নামাতে পারলাম না। অনেক আগে কেউ দিয়েছিলেন, হারিয়ে গেছে।
কেউ যদি এর পিডিএফ নামাতে সাহায্য করেন কৃতজ্ঞ থাকব।