হুতো এবং কেকে আমার কথার পিঠে দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। চোখ এড়িয়ে গেছল।
প্রথমে হুতোঃ
"আমি আসলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কী সেই নিঘিন্নে জিনিস যাকে ঘেঁটি ধরে টেনে এনে খামোখা গাল না দিলে একটা অসম্পর্কিত ভালো জিনিসের প্রশংসা পূর্ণ হয় না"।
---সত্যি কথা। কোনো 'অসম্পর্কিত ভালো জিনিসের প্রশংসা পূর্ণ' করার জন্যে কোনো 'নিঘিন্নে জিনিস' কে 'ঘেঁটি ধরে টেনে এনে খামোখা গাল' দেয়ার দরকার নেই। একেবারে অদরকারী। তাহলে লিখলাম কেন?
এটা @ শ্রীমল্লারকে লেখা। উনি অল্পদিন আগে ভাটপাতায় আমাকে নাম করে লিখেছিলেন আমি যেন তাকে ওই রকম শস্তায় হাততালি পাওয়ার চেষ্টা করা কবি না মনে করি।
তাই এখানে লিখলাম যে এই কবিতা পড়ার পর কেউ আপনাকে অমন হালকা কবি ভাববে না। ব্যস্ এই টুকুই।
@ কেকে,
;প্রথমেই একটা ক্যাভিয়েট দিয়ে রাখিঃ আমি কবিতার বোদ্ধা বা কোন হনু নই। নেহাত পাতি পদ্য পড়া পাবলিক। কাজেই যা বলব সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বোধ। কারও সঙ্গে মতে মেলার আশা কম।
এক, কবিতা একান্ত ব্যক্তিগত অনুভবের জিনিস। এই মাধ্যমে কবি পাঠকের সঙ্গে ওয়ান -টুঁ -ওয়ান কথা বলেন। (এটা নতুন কিছু বলছি না)।
তাই ভাল কবিতা/মন্দ কবিতা নিয়ে দুই পাঠকের মধ্যে অমিল হতেই পারে।
তবু যুগের বা কালের প্রভাবে একটা জনরুচি তৈরি হয়। কবিতার অলংকার, ছন্দ, শব্দ প্রতিমা নির্মাণ নিয়ে একটা কমন ডিনোমিনেটর তৈরি হয়।
যেমন আজকাল কোন কবিই অনুপ্রাসের শব্দ ঝংকার নিয়ে মাথা ঘামান না। পয়ার বা ত্রিপদী ছন্দে কবিতা চোখে পড়ে না। সনেট বোধহয় শক্তি ও আরও দুয়েকজনের পর কেউ লেখেন না।
তবু এই বৃত্ত বা ইউনিভার্সাল সেটের ভেতরে ভিন্ন পছদের আরও সাব সেট থাকতে পারে।
যেমন কয়েক মাস আগে ভাটপাতায় জানা গেল হুতোর বেশ পছন্দ কবিশেখর কালিদাস রায়ের কবিতা। "নন্দপুরচন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার। বহেনা আর মলয়ানিল বহিয়া বনগন্ধভার" বা "ছাত্রধারা" ইত্যাদি।
আমার চোখে ওনার কবিতা করুণানিধান ও মোহিতলাল স্কুলের মধ্যে বি গ্রেড, অনুপ্রাসের বাড়াবাড়িতে দেখনদারি বা চমকে দেয়ার চেষ্টা প্রকট, কবির নিজস্ব আকুতি, অনুভব বা 'অ্যাংগস্ট' টের পাই নি।
তারমানে এই নয় যে আমার ভাল লাগেনি বলে উনি খারাপ কবি। রুচির তারতম্য বলাই ঠিক।
দুই, কোন কবিতা হাততালি পেয়েছে মানে সে খারাপ কবিতা --এমন নয়। পেলেই ভাল এমনও নয়।
আবার হাততালি না পেলেই ভাল কবিতা--এমনও নয়। না পেলে খারাপ, এমনও নয়।
অর্থাৎ কবিতার কাব্যগুণের সঙ্গে জনরুচির বা জনপ্রিয়তার ডায়রেক্ট কোরিলেশন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
মায়াকোভস্কি তাঁর ফিউচারিস্ট কবিতার দিনে অবশ্য লিখেছিলেন "জনতার রুচির গালে এক থাপ্পড়"। কিনতু পরে উপেক্ষা করতে পারেন নি।
তিন অনেক ভ্যান্তারা হল।
কিন্তু কী সেই বিশেষ গুণ যা একটি কবিতাকে ---জনপ্রিয় হোক না হোক-- ভাল কবিতা বলে চিহ্নিত করবে, ফরমায়েশি বা বাজারি বলে অশ্রদ্ধা করবে না? রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের মত কবিতা না লিখলে গাল খেতে হবে? কিস্যু হয় নি বলতে হবে? একেবারেই নয়।
আমার মতে সেই "বিশেষ গুণ হোল যা পাঠকের মনে এই প্রতীতি এনে দেয় যে কবিতাটি কবির একান্ত অনুভুতি/অনুভব/ অস্তিত্বের যন্ত্রণার ফসল। আজকাল পাবলিক কী খাচ্ছে, কেমন কবিতা দেশ বা অন্য বড় হাউসে ছাপা হচ্ছে --এসব না ভেবে কবি তাঁর সেই যন্ত্রণা থেকে আত্মপ্রকাশের জন্য কবিতাটি লিখেছেন--- তাতে যদি জনপ্রিয়তা আসে, পহাকড়ি আসে তো ভাল। কিন্তু সেই আশায় লেখেন নি, বা সেই আশা পূরণ না হলে কবিতা লেহা ছেড়ে দেবেন এমনও নয়।
উদাহরণঃ বাঙ্গালী কবিদের কথা আগ বাড়িয়ে বলে ক্যাল খেতে চাই না। আমাকে কোল্কাতায় থাকতে হবে।
ধরুণ টেনিসন আর ম্যাথু আর্নল্ড।
টেনিসন রাজকবি, অর্থ যশ জনপ্রিয়তা সবই বেঁচে থাকালীনই পেয়েছেন' আজ তাঁকে বি--গ্রেড কবি ধরা হয়। তাঁর ছন্দের হাত চমৎকার। দেশপ্রেম আর ভিক্টোরিয়ার সাম্রাজ্যবিস্তারএর প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ। ছন্দের হাত খুব ভাল। কিন্তু কবিতা পড়লেই বোধ হয়, ক্রাফটের দিক মজবুত, অনুভূতি কোথায়?
'ক্যাননস, টু দ্য রাইট অফ দেম, ক্যানন্স্ টু দ্য লেফট অফ দেম'?
একেবারে রাজদরবারের ভাট!
বলা হয় জীবনে একবারই ভাল কবিতা লিখেছিলেন যখন তাঁর প্রিয়তম বন্ধু জাহাজ থেকে পড়ে সমুদ্রে ডুবে গেল। রচিত হয় দীর্ঘ কবিতা 'ইন মেমোরিয়াম'-যা নিজের অন্তর্লীন যন্ত্রণার প্রকাশ।
ম্যাথু আর্নল্ড রাজকবি নন। কিন্তু যখন 'ডোভার বীচ' কবিতায় লেখেন ' And ignorant armies clash by night', তখন কবিতাটির আবেদন বৃটেনের সময় ও সমাজ ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বের মানুষের আত্মিক সংকটকে তুলে ধরে। ওই একটি লাইনে আমার মত সাধারণ পাঠক ভারত উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, উক্রেইন --সব দেখতে পায়। অথচ আমার জন্মের এক শতাব্দী আগে লেখা।
৪ একটু সাহস বেড়েছে। মায়াকোভস্কি এবং সুভাষ মুখুজ্জের কথা বলি।
বাল্টিক নৌবাহিনীর মার্চ দেখে যখন তিনি লেখেন "বাঁয়ে কদম" মনে হয় সময়ের চাপে বা তাগিদে লেখা। আবার যখন 'পাৎলুন পড়া মেঘ" লেখেন মনে হয়--এটা কিছু হয়েছে।
সুভাষ যখন লেখেন "জাপ পুষ্পকে জলে ক্যান্টন, জলে হ্যাংচাও।
কমরেড আজ ব্জ্রকঠিন বন্ধুতা চাও?
লাল নিশানের নীচে উল্লাসী মুক্তির ডাক,
রাইফেল আজ শত্রুপাতের সম্মান পাক"।
ফরমায়েসি বা সময়ের দাবিতে লেখা চটজলদি কবিতা ছাড়া কিছু মনে হয় না। কিন্তু উনিই যখন লেখেন "ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত" --তখন আমরা স্তব্ধ হয়ে কবিতার সৌন্দর্য উপভোগ করি।
অথচ ভালো রাজনৈতিক কবিতাও লিখেছেন। ধরুন "রাম! রাম!
কুকুরের মাংস কুকুরে খায় না"।
অথবা " মুখুজ্জের সঙ্গে আলাপ",।
নকশাল আন্দোলনের সময়ে লিখলেন একটি অসাধারণ কবিতা --"ছেলে গেছে বনে"। বলতে চাইছি, কবিতা রাজনৈতিক হয়েও ভাল কবিতা হতে পারে যদি তা দলীয় স্লোগানের সীমা ছাড়িয়ে নিজের যন্ত্রণার প্রকাশ হয়।
প্রতিষ্ঠিতদের মধ্যে জয় গোস্বামীর "মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়" আমার চোখে একেবারে ভিনি! ভিডি! ভিসি!
"আমার পরে যে বোন ছিল চোরাপথের বাঁকে,
মিলিয়ে গেছে, জানিনা আজ কার সঙ্গে থাকে"।
আমাদের চোখে দেখা অবক্ষয় আর্থিক দুর্গতি সব ভেসে ওঠে।
দেখুন, তারপরে আবার কিছুদিন অন্ত্যমিল দিয়ে কবিতা লেখার ঝোঁক এল। এখন সেই ঝোঁক প্রায় অস্ত্যমিত।
গুরুর পাতার কথা যদি বলা হয় তাহলে বলব ফরিদার কথা। ওনার কবিতায় জীবনের মানে খোঁজার যন্ত্রণা চোখে পড়ে। বড় পত্রিকায় বেরোল কিনা, হাততালি পেল কিনা --সে প্রশ্ন অবান্তর।
শ্রীমল্লারের লেখায় সেই আন্তরিকতা।
মনে হয় সময়ের সঙ্গে আরও পরিণত হবে।
-