এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মিউনিখ 

    Tirtho Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৪ জুলাই ২০২৪ | ২৮৩ বার পঠিত
  • শিন্ডলার্স লিস্ট যতটাই যুদ্ধ বিরোধী, ফ্যাসিজম বিরোধী মানবতার মূর্ত চিত্র হিসেবে সমালোচক ও বক্সঅফিস দুদিকেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল, মিউনিখ ততটাই মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ২০০৫ এ মুক্তি পায় স্পিলবার্গের এই ছবিটি, যে সময়ে জর্জ ডাব্লিউ বুশের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ জোর কদমে চলছে, ২০০১ এর টুইন টাওয়ার বিস্ফোরণের ঘা দগদগে। সেই সময় প্রথম টেলিভিশনে লাইভ যুদ্ধ দেখার নেশায় মশগুল আমেরিকার সাধারণ দর্শক। মিউনিখ তাদের কাছে ইসলামী সন্ত্রাসবাদী হত্যার থ্রিলারের প্রতিশ্রুতি জাগিয়ে ও ব্যর্থ হয়। উল্টে প্রেস ও বিদগ্ধ সমালোচকরা টেরোরিসমের আপলোজি বলে ছবিটিকে দাগিয়ে দেয়।

    ইতিহাস ও ঐতিহাসিক ঘটনার অভিঘাত ও তাকে অনুধাবন যুগের সাথে বদলে যায়। নতুন প্রজন্ম নিজেদের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বিনির্মাণ ঘটায়। নতুন ভাবে বুঝতে চায়। তাই ইতিহাসের তথ্য না বদলালেও তার থেকে প্রাপ্ত সত্যের বদল হয়। আমি বহুদিন আগে, মানে ওই কালান্তক অক্টবর ৭’ এর অনেক অনেক দিন আগে ছবিটা দেখেছিলাম। আরো পাঁচটা স্পাই থ্রিলারের মতো। আমার মনেই ছিল না। গতকাল তাই আবার দেখলাম। স্তব্ধ হয়ে দেখলাম। শুরু থেকে শেষ। না শুধু সিনেমাটাই দেখলাম না, তার সাথে গত দশ মাসের পাশবিকতা ও গণহত্যা কে ও দেখলাম আবার করে।

    মিউনিখ অলিম্পিকের ঘটনাটি অনেকেরেই জানা। যাদের জানা নেই বা ভালো মনে নেই তাদের জন্যে সংক্ষেপে বলি, ১৯৭২ এ ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর গ্ৰুপের ৮ জন পালেস্তিনীয় উগ্রপন্থী মিউনিখে অলিম্পিক ভিলেজে ইসরায়েলি অলিম্পিক টিমের বাসস্থান আক্রমণ করে দু জনকে হত্যা করে ও ৯ জনকে অপহরণ করে। তাদের দাবি ছিল ২০০-র উপর পালেস্তিনীয় কে ইসরায়েলি জেল থেকে মুক্তি দেয়া। তারা অনেকটাই সফল হয়েছিল এবং এয়ারপোর্টে যখন প্লেনের মধ্যে অপেক্ষা করছিলো তখন পশ্চিম-জার্মান পুলিশ ইসরায়েলি দের উদ্ধার করতে আক্রমণ করে কিন্তু উভয়ের গোলাগুলিতে ৯ জন ইজররায়েলিই মারা যান ৫ জন উগ্রপন্থীর সাথে। অলিম্পিকের ইতিহাসে সবচেয়ে মর্মান্তিক এই ঘটনা মিউনিখ ম্যাসাকার নামে কুখ্যাত। দুটো ইন্টারেষ্টিং তথ্য হলো, এই অভিযানের ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করেছিল পশ্চিম-জার্মান নিও-নাজি দের দল। আবার উগ্রপন্থিদের আরেকটি দাবি ছিল পশ্চিম জার্মানির জেলে বন্দি রেড আর্মি ফ্যাকশান (RAF) বা Baader–Meinhof Group এর স্থপতিদের মুক্তি। ইতিহাস বেশ মজার, তাই না ?

    মিউনিখ ছবিটি ১৯৮৪ তে লেখা জর্জ জোনাসের Vengeance বইটি অবলম্বনে তৈরী। এর মূল প্রতিপাদ্য হলো কিভাবে মোসাদের কাউন্টার-টেরোরিজম ইউনিট এই ঘটনার মূল চক্রী দের খুঁজে খুঁজে খুন করবে বিভিন্ন দেশে ঘুরে। ছবির নায়ক এভনার একজন জার্মান-ইহুদি এবং তার সঙ্গী আরো চারজন ইহুদি যারা প্রত্যেকেই আস্কেনজাই বা ইউরোপীয় ইহুদি। কিন্তু এই ছবি আর পাঁচটা হলিউডি স্পাই-থ্রিলারের মতন ব্যাড গাই, ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই নয়। এই শত্রুকে খুঁজে মারতে মারতে যেতে গিয়ে তারা এক সময় আবিষ্কার করে তারা নিজেদেরকেই হারিয়ে ফেলছে , নিজেদেরকেই মেরে ফেলছে তিলে তিলে। এই হত্যা, আবারো হত্যা, এই চক্রের শেষ কোথায় ?

    এভনারের দলের একজন বলে আমরা তো ইহুদি। এই হত্যা তো আমাদের ধর্ম আমাদের শেখায় না। আমরা তো নিজেদের পরিচিতি হারিয়ে ফেলছি। কি হবে এই যুদ্ধে জিতে? স্পিলবার্গ ধরার চেষ্টা করেছেন কিভাবে এই দুই জাতিগোষ্ঠীর পারস্পরিক নিধন যজ্ঞের ভার সমষ্টিগত চেতনা থেকে ব্যক্তিগত স্তরে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঢুকছে। একটা সময় আসে যখন এভনারের দলকে খুঁজতে পিএলও ও অন্যান্য শত্রু শিবির ও পেছনে পড়ে যায়। অনুসরণকারী কখন যেন পলাতক হয়ে যায়, নকশাল আন্দোলনের সময় লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত ছোট গল্পটার মতন। এভনার ইজরায়েল ফিরতে পারে না। সে আমেরিকাতে থেকে যায়।

    কিছু চিরন্তন প্রশ্ন থাকে যার উত্তর নতুন করে খুঁজতে হয়। সিনেমাটা দেখতে দেখতে এটাই মনে হচ্ছিল, যে ১৯৭২ এ যে প্রশ্নের উত্তর ইজরায়েলি ও প্যালেস্তিনীয়রা খুঁজছিল, ২০২৪ এসেও একইভাবে সেই প্রশ্ন কে দেখছে। হয়তো এই প্রশ্ন গুলোর কোনো উত্তর নেই। দুদলের কাছেই এটা অস্তিত্বের যুদ্ধ। সেই রোমান গ্লাডিয়েটরদের মতো। আর আমরা বাকি পৃথিবীর লোক যেন এই কোলোসিয়ামের দর্শক। পপকর্ন খেতে খেতে খেতে মৃত শিশুর লাশ দেখছি। ইহুদিরা এক অভিশাপগ্রস্ত জাতি। তারা যেন সেই অভিশাপের ভার তুলে দিয়েছে প্যালেস্টাইনের কাঁধে। দুদলই নিজেদের জমি খুঁজে যাচ্ছে যে জমি হারিয়ে গেছে।

    সিনেমাটায় একটা দৃশ্য আছে যেখানে এভনার তার প্রতিপক্ষ পিএলও-এর এক উগ্রপন্থী আলীর সাথে সিগেরেট খেতে খেতে কথা বলছে। যদিও আলী জানেনা এভনার কে। এভনার বোঝার ও বোঝানোর চেষ্টা করছে আলীকে কেন প্যালেস্টাইন পারবে না আর আলী জোর দিয়ে বলছে ১০০০ বছর পরে হলেও তারা পারবে। ইজরায়েল তৈরী হতে কতদিন লেগেছিলো? বা জার্মানি? আলী আরো বলে, এভনার ইউরোপীয় তাই জানবেনা ঘর হারানোর দুঃখ কী ? তারা বিশ্ব বিপ্লব চায়না, শুধু চায় নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে। ওদের কথাগুলো শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল এভনার ও আলী নয়, বেঞ্জামিন নেত্যানাহু ও ইয়াহ্যা সিনওয়ার কথা বলছে। …

    Avner: You people have nothing to bargain with. You’ll never get the land back. You’ll all die old men in refugee camps, waiting for Palestine.
    Ali: We have a lot of children. They’ll have children. So we can wait forever. And if we need to, we can make the whole planet unsafe for Jews.
    Avner: You kill Jews, and the world feels bad for them and thinks you animals.
    Ali: Yes. But then the world will see how they’ve made us into animals.
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Guru | 157.4.***.*** | ২৪ জুলাই ২০২৪ ০৬:৪৪535230
  • @তীর্থ  ,                                                                              অনেক ধন্যবাদ l খুবই প্রাসঙ্গিক কথা খুবই সহজ করে বলেছেন l ইউরোপে ইহুদী বা ইস্রায়েল বলতে যেটি বোঝানো হয় সেটা আসলে আদতে একটা আশেখেনাজি প্রোজেক্ট l এই নিয়েও লিখুন l
  • Tirtho Dasgupta | ২৫ জুলাই ২০২৪ ১৩:৩৩535301
  • @গুরু
     
    অনেক ধন্যবাদ । নিশ্চই লিখব ।
  • kk | 172.58.***.*** | ২৫ জুলাই ২০২৪ ১৮:৩২535316
  • বেশ ভালো লাগলো লেখাটা। এই সিনেমাটা আমি দেখেছি। এরিক বানা ছিলেন না?
  • Tirtho Dasgupta | ২৭ জুলাই ২০২৪ ১৫:৩৮535426
  • @কক ধন্যবাদ । হ্যাঁ লিড চরিত্রটা এরিক বানা । এছাড়া ড্যানিয়েল ক্রেগ ও ছিল ওর সহযোগী চরিত্র হিসেবে ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন