এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • #হারানো_টুসুরা_ও #জাগরণের_মকরচান  

    Tanima Hazra লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ | ৪৫২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছোটবেলায় বাঁকুড়া শহরের যে পাড়ায় আমার বেড়ে ওঠা তার আশেপাশে গরাই, বাউরী, মালো, টুডু ইত্যাদি মানুষের জনবসতি। তাদের অধিকাংশের জীবিকা বিড়ি বাঁধা অথবা তেলকল বা ধানকলে শ্রম, কিংবা মাঠে দিনমজুর হিসেবে চাষ। 

    আমাদের উঁচু পাঁচিল ঘেরা দোতলা পাকা দালান, আমার গৌরবর্ণ সাহেবী পোশাক পরা দাদু ও বাবা, আমার চশমা আঁটা গম্ভীর স্কুলমিষ্ট্রেস মা সব মিলিয়ে তারা আমাদের বাড়িটিকে বলতো "বাবুদের ঘর"। 

    তখনো মিউনিসিপালিটির কলে সারাদিন জল পড়ে না, টাইম কল, সুতরাং আমাদের ইঁদারা থেকে জল নিতে আসতো পাড়ার মেয়েবউরা। 

    ঠাকুমার নির্দেশ ছিল, জল নিচ্ছো নাও কিন্তু কুয়োর উপরের লোহারফ্রেমের জাল ঠিকঠাক ঢাকা দিয়ে যেতে হবে আর চুপচাপ জল নিয়ে চলে যাবে, বাগানের ফুল বা ফলের গাছে হাত দেবে না, কুয়োপাড়ে দাঁড়িয়ে অকারণ হাহা হিহি গল্প জুড়বে না। 

    তবু সব প্রতিরক্ষা এড়িয়ে আমার সাথে তাদের ভাববিনিময় হতো,  তাদের জীবন, তাদের ভাষা ছোট্ট আমাকে ভারি আকর্ষণ করতো।

     নিস্তব্ধ দুপুরে জল নিতে এসে বাগানের শিউলি গাছের নীচে বসে  বড় বুনী আমার হাতে এঁকে দিতো মেহেন্দি পাতা বেটে আলপনা, কাজলি পাঁচিলের ফোকর গলিয়ে দিয়ে যেতো শিঁয়াকুল,
     কুসমি আমাকে যত্ন করে শেখাতো টিনের ফ্রেম আটকে বিড়িপাতা কাটা, লালসুতো দিয়ে মোড়ানো, তাতে তামাক পাতা ভরা, নরুণ দিয়ে চঙ মোড়ানো। 
     
     আমি উলি, থাকো, ফেলি, বুধনি, কুসমি কিংবা দুখনি কে দিতাম আমার পুরনো ক্লিপ, গালার চুড়ি, বইয়ের ভেতর রাখা রঙিন পালক, খড়িমাটির পুতুল, লাল নীল সবুজ হলুদ পপিন্স। 

    সারা পৌষমাস জুড়ে সন্ধ্যে হলেই তাদের বাড়ির অন্দর থেকে কানে আসতো টুসুগান। মাটির টুসুসরা বিক্রি হতো সেটা দেখতে এরকম যে তার মাঝখানে খোঁদল করে তাতে গাঁদাফুল  চারিদিকে প্রদীপ। 
    আমার মন ছটফট করতো সেই আসরের প্রতি। বহুকষ্টে বাড়ি থেকে অনুমতি মিলতো এক আধদিন সেখানে যাবার। 
     
    এখনো কানে বাজে সেই গান, 
     
    আমার টুসু মুড়ি ভাজে, 
    খোলা লড়বড় করে গো, 
    বিহা দিব কিসে টুসু 
    রাহাখরচ কুথা গো। 

    কিংবা, 

    বিড়ি বাঁধো বিড়ি বাঁধো 
    চঙ মুড়ে নরুণে, 
    ট্যাঁকে টাকা জমাও টুসু 
    কিনবে  মেলায় চিরুনি, 
    পায়ে লিব্যে রূপার মল গো, 
    গায়ে লিব্যে ছাবাশাড়ি, 
    আলতা পায়ে টুসুমনি 
    যাব্যেক যে তার সাঙাৎ বাড়ি, 
    সাঙাৎ ব্যাটা পানখেউকা 
    চাইছে সাইকিল বিহা'তে, 
    লারবে বাপে দিতে সাইকিল 
    বলো গিয়ে উয়াকে। 

    কিংবা, 

    টুসু আমার লখখী বিটি 
    সবুই কাজ সে পারে গো, 
    রাঁধবে টুসু, ঘুঁটা দিব্যে, 
    ধান ভাইনথে জানে গো, 
    তবু ক্যানে কালো বলে 
    কেউ লিল নাই ঘরে গো। 

    দেখতে দেখতে  বড়বুনীর বিয়ে হলো কেরানিবাঁধে, উলিকে পুড়িয়ে মারলো তার শ্বশুর বাড়ির লোকে, কাজলি মরলো টিবি হয়ে, থাকো সানবাঁধায় বরের সাথে চা পাঁউরুটির দোকান দিলো, ফেলির বিয়ে হয়ে গেল লোধাশুলিতে, দুখনি ভাতার খেয়ে বাপের ঘরে ফিরে এসেছিল এক'মাস যেতে না যেতে।তারপর সারাজীবন ভাই আর বোনেদের বাচ্চা মানুষ করতে করতে আর বিড়ির বাণ্ডিল বানাতে বানাতে সাদাচুল থুত্থুড়ি হতে লাগলো চোখের সামনে,  সে চুরি করে বরসুখ, শরীরমাখামাখি জেনেছিল শুনেছি  গোপনে শীটদের তেলকলের পিছনের ঝাড়ে, চুপচাপ পেট খসিয়ে এসেছিল বারদুয়েক গোবিন্দনগরে গিয়ে। 
    বুধনি কার সাথে যেন পীরিত করে পালালো, আর ফিরল না, কুসমি আয়া খাটত মানিক নন্দীর নার্সিংহোম এ। 

    আমিও চলে গেছি তার অনেকদিন বাদে অনেক  দূরে সংসার যাত্রাপালায় সঙ সেজে। 

    আজ ভোরে আবছা আলোয় ঘুম ভেঙে গিয়ে জানালা দিয়ে  সমুদ্র থেকে ছুটে আসা  হাওয়ার কাঁপন লেগে গায়ে ওদের কথা মনে করিয়ে কেমন যেন স্বজনবিরহে চোখের কোণে জল আনলো। 

    ইউটিউবে টুসু গান চালিয়ে শুনতে শুনতে খুঁজে পেলাম এই গানটিঃ-

    চল টুসুধন  ইস্কুলে যাবো, 
    আমরা লেখ্যাপড়া শিখিবো, 
    চল টুসুধন ইস্কুলে যাবো, 
    বইও পাবো, খাতাও পাবো, 
    আরও ইস্কুলড্রেস পাবো রে,
    লেখাপড়া হয়ে গেলে 
    মিড ডে মিলের ভাত খাবো, 
    চল টুসুধন ইস্কুলে যাবো। 
    বড় ইস্কুল চলে গেলে 
    আরও কত কী পাবো, 
    বছর বছর টাকা পাবো 
    সেই টাকাতে ঘড়ি লিব, 
    চল টুসুধন ইস্কুলে যাবো। 
    আমরা লেখাপড়া শিখিবো। 
    রাঁধাঘরে বইস্যে বইস্যে 
    চইখের জল নাই ফেলিবো, 
    রেল চালাবো, দেশ চালাবো, 
    আকাশে উইড়ে যাবো, 
    চল টুসুধন ইস্কুলে যাবো, 
    আমরা লেখাপড়া শিখিবো। 

    ক্রমে ভোর হয়ে এলো। আরব সাগরে উদয় দেখা যায় না। অস্ত দেখা যায়। মকর সংক্রান্তিতে প্রবিষ্ট সূর্যকে বল্লাম, 
    এ যুগের সব টুসুদের উড়বার জন্য উন্মুক্ত আকাশ দিও 
    হে মহাদ্যুতিম।

    এবার থেকে আমরা টুসু গাইবো কিন্তু ভাসান দেবো না আর। 

    আমি, বড় বুনী, কাজলি, উলি, থাকো, ফেলি, কুসমি, দুখনি, বুধনি সবাই সেই ছোট্টোবেলার মতো লাল নীল সবুজ কমলা হলুদ পপিন্স খেতে খেতে হেসে কুটিপাটি হয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলাম কুয়ো পাড়ের ভিজে ভুঁইয়ে। আমাদের সবার হাত ছাড়িয়ে  নানা রঙের পালক আকাশে দুলতে দুলতে উড়ে গেল। ঠাকুমা দেখল দূর থেকে চেয়ে চেয়ে। একটুও বারণ করলো না আমাকে ওদের সাথে খেলতে। 

     পুব দিকে ঘুম ভেঙে  মকরের সূর্য উঠলো।  হাত ধরে সব্বাই মিলে হাত ধরাধরি করে ঝাঁপ দিলাম দ্বারকেশ্বরের জলে। এজন্মে আমাদের জাত এক, গোত্র এক, লক্ষ্য এক। আমরা সব্বাই টুসু,পাশে ভেদাভেদের পদবি নাই।  আমাদের সব্বার উড়বার অধিকার চাই।। ।। ত নি মা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Supriya Debroy | ১৫ জানুয়ারি ২০২৩ ১৮:১৭515360
  • বেশ লাগল। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন