অরণ্যদার বাড়ি কাবলিদার সঙ্গে আড্ডা, বেশ রাতে কাবলিদা গাড়ি চালিয়ে চলে এসেছিলেন, প্রবল ঝড়জল, ড্রাইভার সিট থেকে নামতে কাবলিদার অসুবিধেই হচ্ছিল। কিন্তু তুমুল আড্ডায় সেসব আর মনেই থাকেনি।
গুরুর হুজুগে সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল 'কাব্লিবুড়োর শার্দূলদর্শন'। আমার মনে হচ্ছিল ঐ লেখাটা বোধহয় সাইটেও আছে, কিন্তু খুঁজে পেলাম না। এখানে দিয়ে দিই, ছবি সহ।
~~~~
কাব্লিবুড়োর শার্দূলদর্শন
বাঙালীদের দু'টো বদব্বেস আছে, মানে আরও বেশী আছে, কিন্তু আপাততঃ এই দু'টোই থাক।
একটা হল বেড়ানো। কোথায় কোন রাজা তার রানীর নামে একটা বাড়ি বানিয়েছে, ছুটল সপরিবারে তাই দেখতে। তাও এমন বাড়ি তাতে একটা বাথরুমও নেই (এই বয়সে আমার কাছে অতিপ্রয়োজনীয়), এদিকে বাড়ির মধ্যেই নিজেদের কবর। দুস্!
অন্যটা হল, নিজেরাই ভুক্তভোগী হয়েই খুশি নয়, অন্যদেরও নিজেদের পাপের সঙ্গী করতে পীড়াপীড়ি করে। আমি একটু হুজুগে, তার ওপর অতি ভালোমানুষ (অন্ততঃ আমি তাই মনে করি) - এদের ফাঁদে তাই প্রায়ই পড়ি। শুদ্ধু বাংলায় যাকে বলে ""সাআআকার্র্র্''। বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে শুনুন।
কাল-পরশু দু'দিন কী গেল! ভালমানুষ হওয়ার এই জ্বালা। এক বন্ধুর গা-জোয়ারিতে কীসব জীবজন্তু দেখতে যেতে হলো সুন্দরবন - তবে কন্ডিশনালি, কোনো হাঁটাচলা করবো না আর অ্যাটাচ্ড বাথ ঘর চাই।
২৯ তারিখ ঘুমোতে ঘুমোতে ভোর সাড়ে সাতটায় বিবাদীবাগ (অনেকদিন ও'দিকে যাইনি - সন্দেহ হওয়ায় জিজ্ঞেস করে নিশ্চিন্ত হলুম যে এটাই সুন্দরবন নয়)। আমি আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমোতে পারি না (মানে এখন আর পারি না, ছোটবেলা পারতুম), ভেঙেই গেল - একটু চা-কফি চেয়ে পেলুম না, মানে ছিল, কিন্তু সাদা (এইজন্যেই আমার মতে সিপিএমের বিদেয় হওয়া উচিৎ, মমতা এসে এ'সব ভুল ঠিক করে দেবে)।
বাস ছাড়ার কথা আটটায়, এল সাড়ে আটটায়, ছাড়ল নটায়। বেশ যাচ্ছিল চার-পাঁচ মিনিট, তারপরেই কেলো, বাস দেখি পার্ক সার্কাস ফ্লাইওভারে উঠছে। আমি তো ড্রাইভার সাহেবের ঠিক কানের পেছনেই বসে (সিট নং ১/২), চিল্লাচিল্লি করে বোঝাতে চাইলুম, গঙ্গা পেছনে - তা কথা শোনেই না। আর বাকি প্যাসেঞ্জারেরাও বোধহয় কলকাতার বাইরের লোক, তাদেরও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার বন্ধুও হাত দিয়ে মুখ ঢাকা দিয়ে রয়েছে। যাই হোক, হাল ছেড়ে দিয়ে বসে গেলুম - তারপর ভাবলুম, হয়তো দমদম যাচ্ছে, প্লেনে করে বাঘ দেখাবে।
বাস বাঁদিক ঘুরে বাইপাসে উঠতে সন্দেহ দৃঢ় হল।
সারপ্রাইজ, সারপ্রাইজ! বাস হঠাৎ ডানদিকে ঘুরলো। আমি তো উল্লসিত। যাক্ অ্যাদ্দিনে এয়ারপোর্ট যাওয়ার একটা সর্টকাট - বড়রাস্তায় জ্যাম হলেই এটা নিতে হবে। নেক্সট টাইম শঙ্করকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্যে মন দিয়ে ল্যান্ডমার্কগুলো চিনে রাখতে শুরু করলুম - ঘটকপুর, বানতলা। কিন্তু, কিন্তু, কিন্তু - এর মধ্যে তো দমদম পৌঁছে যাওয়ার কথা। এদিকে আবার নেশাও চাগাড় দিয়ে উঠেছে টেনশনে। আমাদের সঙ্গে যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'ক্লাস মনিটর' ছিলেন, শ্রীভোলানাথ চক্রবর্তী, তাঁকে বলাতে উনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, একটা ব্রেক তো নিতেই হবে - অ্যানাউন্স করলেন, এবার বাস থামবে - ছেলেদের বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন হ'লে এখানে রাস্তার ধারে সেরে নিতে পারেন কিন্তু অতি দুঃখের সঙ্গে জানালেন যে মেয়েদের জন্যে অনেক ইচ্ছা থাকলেও সরকার এখনও কোনো ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। আমি নীচে নেমে একটি বিড়ি ধরিয়ে ওনাকে দমদম কখন পৌঁছবো জিগাতে উনি যেন কী যেন বলে, আকাশ থেকে পড়লেন। তারপর আসল ব্যাপারটা জানা গ্যালো - আমরা নৌকোতে যাবো সোনাখালি থেকে। আমি বললুম, সে কী? ওটা তো বাঁকুড়ায়, উল্টোদিক হয়ে যাচ্ছে না? ভোলাবাবু খুবই মাথাঠান্ডা লোক - বললেন ওটা 'মুখি', এটা 'খালি'। এই সোনাখালি বাসন্তিতে (বা বাসন্তির পরে) কী একটা নদী না খাল আছে, সেইখানে নৌকো আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। আরও অনেক তথ্য পেলুম - আমরা অলরেডি নাকি সুন্দরবনে - খুব ঘাবড়ে গিয়ে বললুম, কেলেঙ্কারি, আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে আছি, বাঘ এলে? বলেছি কি বলিনি, ভদ্রলোক আমার বুকে জোরে ধাক্কা দিয়ে নিজে পেছিয়ে গেলেন আর আমাদের মধ্যে দিয়ে বিশাল এক জন্তু হৈহৈ করে চলে গেলো। সামলে নিয়ে তাকিয়ে দেখলুম লম্বা লম্বা পাকানো শিঙওলা নন্দীবাবু - বোদহহয় আমার টকটকে লাল সোয়েটার ওনার পছন্দ হয়নি। যাই হোক, এই ট্রিপে এটাই আমার প্রথম জানোয়ার।
বাসে ফিরে বন্ধুর কাছে বকুনি খেলুম বেশী কথা বলার জন্যে - আমি উত্যক্ত করায় 'ভোলানাথ' রুষ্ট হয়ে নিজের বাহনকে দিয়ে শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। আমি জানি, ও মিথ্যে বলছে, তাও, ওই বলে না, সাবধানের মার নেই, আমি বাকি রাস্তা আর বেশী কথা বলি নি।
বেলা দু'টো, আমরা সোনাখালি ঘাটে। বাস অনেক দূরে দাঁড়িয়েছিল, বেশির ভাগ লোক ঘাটের দিকে হাঁটা দিলো, আমি একটা সাইকেল ভ্যান নিয়ে সকলের আগে পৌঁছে গেলুম, হাঁটিয়েদের ওয়েভ করতে করতে সেলিব্রেটিদের মতো। ধারে কাছে তিন চারটে নৌকো দেখছি, ওই দক্ষিণেশ্বর/বেলুড় মডেল। কিন্তু সন্দেহ হচ্ছে এগুলোতে কী করে যাবো - বেডরুম উইথ অ্যাটাচ্ড বাথ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। এদিকে বন্ধুর বকুনির ভয়ে জিগ্যেসও করতে পারছি না, পেট ফুলছে। মনের কষ্টে দু'টো কচি ডাব খেয়ে ফেল্লুম। মানে ডাবের জল আর কি। ইন দ্য মীন টাইম, দেখলুম কয়েকটা ছাগল আর ভেড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে - আমার জানোয়ার লিস্টে দু'টো যোগ হ'লো।
ভোলাবাবু ইতিমধ্যে সকলকে খেদিয়ে খেদিয়ে নিয়ে এলেন। আমি ভ্যানে এসেছি শুনে আমার বুদ্ধির খুব প্রশংসা কল্লেন - ভরসা পেয়ে চুপি চুপি জিগ্যেস কল্লুম - এত লোক, নিশ্চয়ই একটার বেশী নৌকো যাবে? উনি আবার থতোমতো খেয়ে বল্লেন, না না এতে কী করে সুন্দরবন যাবেন, বড় লঞ্চ, চিত্ররেখা, ব্রিজের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে, এখান থেকে এই নৌকো করে ওটাতে উঠবেন। শুনে সত্যিই শান্তি পেলুম, তবে বন্ধুকে বলিনি - আরো কিছুক্ষণ ভাবুক ব্যাটা!
সমস্যা হল নৌকোয় উঠতে - ঘাট থেকে জল অবধি যেতে প্রায় দুশোটা সিঁড়ি (অত না হলেও দশ-বারোটা তো হবেই)। তা নৌকোর একটি ছেলে এসে আমার ব্যাগ আর ব্যাকপ্যাক নিলো আর আর একজন আমায় বেশ যত্ন করে হাত ধরে নীচে নিয়ে এলো। ভোলাবাবুও ততক্ষণে ওখানে এসে গেছেন - ছেলেদু'টিকে ধমকে বল্লেন, ওরে ওনাকে নৌকোয় তুলিস না, উনি আমার সঙ্গে যাবেন। ঠিক বুঝলুম না কেন, খাতির করে, না ক্যাজুয়াল্টির ভয়ে। এনিওয়ে, উনি আমাকে ওনার সঙ্গে ওই লঞ্চেরই স্পীডবোটে তুলে নিয়ে গেলেন। সেই এক সিনারিও - স্লোমুভিং নৌকোর লোকগুলোকে ওয়েভ করতে করতে সকলের আগে এগিয়ে গেলুম লঞ্চের দিকে।
লঞ্চটা তিনতলা। একতলাটাকে বলে লোয়ার ডেক, ট্রেনের স্লীপার ক্লাসের মতো। দোতলা হল আপার ডেক আর তিনতলা ওপেন ডেক (তবে মাথার ওপর ছাউনি আছে), সেখানে খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি। আপার ডেকে একদম সামনে আমাদের ঘর আর একদম পেছনে দুটো চার বেডের কেবিন। মাঝখানটা একতলারই মতো তবে ফ্যান্সি। পেছনের কেবিনের কাছে এদিকে দুটো, ওদিকে দুটো বাথরুম - ঢুকতে হয় জলের ধারের বারুন্ডা দিয়ে (রাত দুটোয় কারুর যদি দরকার পড়ে, তার কথা ভেবে আমার এখনই কাঁপুনি লাগছে)। আমাদের ঘরে অবিশ্যি বাথরুম আছে, তবে আমার যদি আর দশ কিলো ওজন বেশি হত, তা হলে ওটায় ঢুকতে পারতুম কিনা সন্দেহ (এদিকে শাওয়ার আছে - মানে জাঙিয়ার বুকপকেট)।
মালপত্তর ইতিমধ্যে ঘরে এসে গ্যাছে। তবে বন্ধুর দেখা নাই। শার্ট, পেন্টুল ছেড়ে (সোয়েটার আগেই হাতে) পাজামা, পাঞ্জাবী পরে র্যাপার (চলতি ভাষায় যাকে শাল বলে) জড়িয়ে যেই একটু বসেছি, শুনি প্রবল আওয়াজ - কিনা নোঙর তুলছে (এদেশে দেখছি সবকিছুই বড্ড আওয়াজ করে করতে লোকে ভালোবাসে)। তা যাই হোক, নৌকো ভাসতে শুরু করল - মানে আগেও ভাসছিল, এবার ভাসতে ভাসতে চল্লো। আমি নৌকোর একটি ছেলেকে ডেকে ঘরের একটা চেয়ার ওই নোঙর-মেশিনের সামনের জায়গাটায় মানে নৌকোর ওই ছুঁচোলো মুখের (মানে আগেকার দিনে যেখানে একটা পরী মতো থাকতো) পেছনে নিজেকে অ্যাঙ্কর কল্লুম - পাশে পানজর্দার ডিবে , বিড়িদেশলাই আর এককপি নতুন গুরু।
ছেলেটিকে বল্লুম, বাবা, বাছাধন, একটু পুণ্যি করবে? এই বুড়ো বামুনটাকে একটা বড় গেলাসে করে কালো চা খাওয়াবে? ছেলেটি ঘাড় পুরো ৯০ ডিগ্রী বেঁকিয়ে দৌড়লো পেছনে চা আনতে। ও হ্যাঁ, আমার বন্ধু হাঁসফাঁস করতে করতে পৌঁছেচে আর এসেই আমায় খিস্তি ওর জন্যে দাঁড়াইনি বলে। বলি, কী করি বল, আমরা বামুন, উঁচু জাত, প্রিভিলেজড, আমরা এসব পেয়েই থাকি - তুই এজন্মে পুণ্যি কর, পরের জন্মে বামুন হয়ে জন্মালে তুইও পাবি। নেহাৎ ভোলাবাবু এসে পড়ায় প্রাণে বেঁচে গেলুম, নইলে এতক্ষণে কুমীরের ব্রেকফাস্ট।
এখন একটু সিনারি দেখি, অ্যাঁ।
বলতে ভুলে গেছি, বাসেই আমাদের এক প্যাকেট করে জলখাবার (দু'পিস পাঁউরুটি, এক পিস কেক, একটা করে আপেল, মজা জুস, সন্দেশ আর খোসা না ছাড়ানো ডিমসেদ্ধ), তার সঙ্গে এক লিটারের 'মিনারাল ওয়াটার'এর বোতল - ব্র্যান্ড AMUST (বাপের জন্মে নাম শুনিনি, অন্য প্যাসেঞ্জারেরা বল্লো এর ফ্যাক্টরি নাকি আলিমুদ্দিনের বেসমেন্টে)। মজার কথা, দেওয়ার সময় ভোলাবাবু বল্লেন, বোতলটি সাবধানে রাখবেন, সুন্দরবন প্লাস্টিক-ফ্রি জোন, ধরতে পারলে নাকি ১৫০০০ (নাকি ২০০০০) টাকা ফাইন। ব্যাপারটা কনফিউসিং লাগলো, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্গানাইজ্ড ট্যুরে ওদের দেওয়া বোতল ওই সরকার দেখতে পেলে ফাইন করবে - সবই সম্ভব, এই ভেবে ওটা ব্যাকপ্যাকে লুকিয়ে ফেল্লুম।
ব্যাক টু নৌকো। সাড়ে তিনটে নাগাদ স্পিকারে ঘোষণা, ল্যান্চ (sic) খেতে সকলে ওপরে ডেকে চলে আসুন। জানতে পাল্লুম এই খাবার-দাবারের দায়িত্ব ধর্মতলার 'বড়ুয়া কেটারার'এর (চার বেলা খেয়ে আমার মত -রান্না বেশ ভালো)। এই লাঞ্চে খেলুম ভাত, ডাল, ফুলকপির তরকারি, ভেটকি মাছের কালিয়া, চাটনি, পাঁপড় আর সন্দেশ। নিরামিশ পাব্লিকের জন্যে পালক-পনীর (বরাতক্রমে 'এটা একটু টেস্ট করে দেখুন না' রিকোয়েস্টে আমিও পেলুম এর সোয়াদ)। পেট পুরে খেয়ে আমি আবার নিজের জায়গায় - আমার বন্ধু বল্লো, তুই এখানে থাক, আমি একটু গড়িয়ে নিই। দুটো পান চিবিয়ে মৌজ করে বিড়ি ধরালুম। ওই খাওয়ার পর পিঠে রোদ্দুর, গায়ে ফুরফুরে হাওয়া - চোখটা কেমন যেন জড়িয়ে এলো।
ফ্ল্যাশব্যাক টু বাস। ভোলাবাবু জানালেন সুন্দরবনে ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে ঢুকলে ৩০০ টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট নিতে হবে। সার্টিফিকেট ছাড়া ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে ধরা পড়লে ১৫০০০ (নাকি ২০০০০) টাকা ফাইন। আমার সঙ্গে ক্যামেরাই নেই তো ভিডিও! সুতরাং।
সব দোষ কুমুদিনীর। কুঁড়ে মানুষকে রেস্ট নিতে বল্লে এই হয়। সত্যি কথা বলতে কি, এরপর তেমন কিছু লেখার নেই। তাও লিখি, শেষ পর্যন্ত যে বাড়ি ফিরেছি না লিখলে সকলে যদি ভাবে জলে ডুবেই গেছি!
'স্যার, চা' বলে ঘুম ভাঙালো শমীক। মানে ঘুমচোখে তাই মনে হ'লো। আমাদের গাইড, তরুণ বৈদ নিশ্চই শমীকের কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া ভাই। দেখতে যেমন, তেমন মিষ্টি গলার স্বর। বল্লো, এতক্ষণ লাউডস্পীকারে সুন্দরবনের ইতিহাস বলছিল, আমি যেহেতু শুনিনি, রাত্তিরে এসে শোনাবে। বল্লুম রাতে না, কাল সকালে। এখন নাকি আমরা 'সজনেখালি'তে থামব, রাতে নৌকো ওখানেই থাকবে। আমি ওসব নামা-টামার মধ্যে নেই শুনে অনেক চেষ্টা করল মোটিভেট করার, শেষে হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিল।
রাতে খাওয়ার ডাকে ওপরে গেলুম। আমি শুধু রুটি-মাংসেই খুশি, অন্য কিছু নিশ্চই ছিলো। পাব্লিকের কাছে জানতে পারলুম, সজনেখালির জঙ্গলে অ্যাটলিস্ট তিনটে বাঁদর আছে, তবে গাইড নাকি বলেছে আরো আছে এদিক ওদিক। বাঁদর দেখতে পয়সা খরচ করে কলকাতা থেকে সুন্দরবনে আসার কী কারণ কে জানে, আইদার পয়সা বেশী হয়েছে, নয়তো নোংরা মন, কলকাতার বাঁদরের প্যান্ট পরে, এখানের গুলো ন্যাংটো (সত্যি বলছি, পুরো ন্যাংটো, আমি জিগ্গেস করেছি)।
ও হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগে সানসেট দেখেছি, ভালোই তো, মানে যেমন হয় সেইরকমই! খেতে যাওয়ার আগে আমরা দু'জন এক ঢোঁক ভদকা-কমলাও মেরে দিয়েচি। খেয়ে দেয়ে ফিরে এসে রাতের পোষাক পরে হুইস্কি নিয়ে খাটে জমিয়ে বসে দু'জনে আড্ডা - বন্ধুর দুঃখ বউ আসতে রিফিউজ করেছে, তার এক বন্ধু নাকি পাটাতন থেকে পড়ে গিয়েছিলো, ও কোনো চান্স নিতে চায় না। বল্লো, দ্যাখ, ঐজন্যেই তোকে নিয়ে এলুম, তোকে তো ওরা সকলে চেনে, তুই যদি পারিস স্টিভেন হকিংও পারবে। আমার এ সব শোনা অব্বেস আছে, ইনছাল্ট গায়ে মাখলুম না। ভোলাবাবু একবার ঘুরে গেলেন, কিছুক্ষণ গপ্পোও করলেন, কিন্তু কিছুতেই জয়েন করলেন না - সরকারি লোক, ডিউটি ইত্যাদি।
এবার একটু ঘুমিয়ে নিই!
অদ্ভুত কান্ড! যে আমি দু'টোর আগে ঘুমোনোর কথা ভাবতেই পারি না, সেই আমি এগারোটার আগেই পুরো আউট! হয়তো ভাটিয়ালি নেই, তাই। নৌকোর দুলুনিতে বেশ সলিড ঘুম হলো।
তখনও বাইরে আলো ফোটেনি (পুরো গেস, চোখ খুলিনি), বেড টি হাজির। ব্যাটা মনে রেখেছে, কালো চা। ছেলেটাকে বল্লুম, ঘন্টাখানেক বাদে আর এক কাপ দিয়ে যাস্ বাপ, পুণ্যি হবে, সুন্দর দেখতে বউ হবে। ছেলেটি ধ্যাৎ স্যার, কী যে বলেন স্যার, বিয়ে হয়ে গেছে স্যার, বলে পালালো (আসলে চোখ খুলিনি, কে যে এসেছিলো চা নিয়ে না দেখেই ইত্যাদি)।
যাহা হউক, ইতঃপর ব্যস্তসমস্ত ভাবে প্রাতঃকৃত্য সমাপন করিয়া ভদ্রসমাজোপযোগী বেশ পরিধান করিয়া আপাদমস্তক র্যাপার (আমার বেশ কয়েকটি র্যাপার নূতন অবস্থায় আলমারিতে জমিয়া আছে, কতিপয় শ্রাদ্ধবাসরে ব্রাহ্মণবিদায়ে প্রাপ্তি) জড়াইয়া নৌকার নাসিকাগ্রে দাঁড়াইলাম সূর্যোদয় দর্শনের অভিপ্রায়। মনে করিতে চেষ্টা করিলাম গতকাল সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত কোন দিকে হইয়াছে। এই সূর্যোদয় দর্শন অতি প্রয়োজন - প্রতিজ্ঞা করিয়াছি জীবনে অন্ততঃ দশবার দেখিবো - আপাততঃ সাতটিতে আটকাইয়া আছে।
চা আসিলো। ইতিমধ্যে নৌকাও চলিতে শুরু করিলো। নূতন সমস্যা। নৌকা ঘুরিলে তার সাথে ঘাড়ও ঘুরাইতে হয় যাহাতে ওই অকালকুষ্মান্ডটি আমাকে ফাঁকি দিয়া তিড়িং করিয়া না উঠিয়া পড়ে। মনে হইতেছিলো আমি শিশুদের ন্যায় 'আনি মানি জানি না' খেলিতেছি।
অবশেষে দুঃসংবাদ। সূর্যোদয় হইয়া গিয়াছে কুয়াশার আড়ালে। হায়, এ যাত্রায় সাত আর আট হইল না। নৌকা থামিল। জনতা উধন্যখালি, নিধন্যখালি বা সুধন্যখালি (ঠিক মনে নাই) নামিল বনজপশুদের প্রাতঃকৃত্যে ব্যাঘাত ঘটাইতে। আমি সে পাপের ভাগী হইতে পারিব না বলিয়া নৌকাতেই রহিলাম। সকলে নৌকায় ফিরিতে জানিতে পারিলাম এই দ্বীপের প্রাণী আমারই মতো নিদ্রারসিক, কাহারও দর্শন পাওয়া যায় নাই। এত পরিশ্রমের পর ক্ষুধার তাড়নায় সকলেই উপরের ডেকে যাইতে ব্যস্ত - আমিও সেই দলে ভিড়িলাম।
ঠিক সেই মূহুর্তেই (ঠিক বানান কিনা জানি না, কিন্তু এটাই দেখতে সবচে' ভালো লাগছে) এই যাত্রার একমাত্র উল্লেখযোগ্য ঘটনার সূচনা। দোতলা থেকে তিনতলার সিঁড়িটি লোহার, বেশ খাড়া। সকলে লাইন দিয়ে উঠছি। হঠাৎ আমার সামনের ভদ্রমহিলা তাঁহার সুপুষ্ট নিতম্বটি পিছনে ঠেলে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ওটি সোজা আমার নাকে - আমিও প্রাণ বাঁচাতে (চোখের সামনে ভেসে উঠলো আবাপ'য় খবর "সুন্দরবনে পাছাঘাতে বৃদ্ধের মৃত্যু') পেছনে হেলতেই আমার পেছনে এক অতিবৃদ্ধ ভদ্রলোক হাঁউমাঁউ করে উল্টে পড়লেন তাঁর পেছনের সিঁড়ির নীচে দাঁড়ানো লোকটির ওপর। জানা গেলো সামনের মেয়েটির বাবাই আমার পেছনে - মেয়েটি থেমেছিলো বাবাকে সাবধানে ওঠার জন্যে বলতে।
ওপরে উঠে জানা গেলো জলখাবারে গর্মাগরম কচুরি আর আলুর দম - এখন ভাজা হচ্চে একটু পরেই আসবে (রান্না সব লোয়ার ডেকে হয়, সেখান থেকে ডাম্ব ওয়েটার দিয়ে ওপরে আসে)। কী করি, এদিক ওদিক করছি। তখনই, ওই বলে না, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধে হয়, গাইডবাবু আমায় পাকড়াও করলেন (দেক্লে, দেক্লে, কেমন কায়দা করে সুন্দরবনের গল্পে বাঘ এনে ফেল্লুম)। একটা বিরাট ম্যাপ খুলে কোথায় শুরু করেছি, কোন খাল, কোন নদী দিয়ে গেছি, যাচ্ছি, যাবো, সব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন আর আমি সঙ্গে সঙ্গে ভুলে গেলুম। তবে সব শুনে একটা প্রশ্ন করলুম, কেন আমরা সোজা রাস্তায় মানে বাবুঘাট থেকে রওনা দিইনি - সেটাও বুঝিয়ে দিলেন - মনঃপুত উত্তরও পেলুম ম্যাপের সাহায্যে। কথায় কথায় জানলুম ছেলেটি সজনেখালির পাশের দ্বীপে থাকে। এরা সরকারি কর্মচারী নয় - সরকারের কোন একটা স্কিমে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩৪টি ছেলে ট্রেনিং নিয়েছে - এখানে এরাই শুধু গাইডগিরি করতে পারে - ট্যুর কোম্পানিরা এদের ভাড়া করে নিয়ে আসে।
এরপর ছেলেটি বলতে শুরু করল সুন্দরবনের ইতিহাস (যার ভয়ে এতক্ষণ লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলুম)। একটি ছেলে এসে খাবারের প্লেট দিয়ে গেল (লাইন দিয়ে নেওয়ার কথা, কিন্তু এগুলো বুড়ো হওয়ার পার্ক্স)। খাওয়ার শেষে দেখলুম এখনও বোধহয় হাজার পাঁচেক বছর বাকি আছে ইতিহাসের - তাই বল্লুম, এত তো মনে থাকবে না, বরং তোমার ফোন নম্বর দাও, বাড়িতে গিয়ে তোমায় ফোন করে ধীরেসুস্থে শুনবো। পরে দেখলুম এমন মিথ্যের দরকার ছিল না, আমরা নেতিবামনি না না, নেতিধোপানির ঘাটে। লোকে খুব উৎসাহের সঙ্গে নাবলো - এখানে নাকি বাঘের চাষ হয়, গাছে গাছে বাঘ ঝুলে থাকে। আমি ওপর থেকে সকলকে বেস্ট অফ লাক বলে আবার নৌকোর ডগায় - এবার অন্য কিছুর সঙ্গে একটি কালো গুরু - দেখি কতটা পড়া যায়।
কিন্তু পড়ায় কি মন যায়! দেখি জলের ধারের বাঁধের ওপর a few pretty chicks । তারপরেই দেখা পেলুম এদের মাকে। কি সুন্দর! কেন যে লোকে কেটে খায় এদের!
আস্তে আস্তে পরাজিত সৈনিকের মতো ফিরে এলো হতভাগ্য টুরিস্টেরা। 'বাঘের দেখা নাই রে, বাঘের দেখা নাই' গেয়ে উঠতেই একটি দুব্লা পাত্লা মেয়ে, টীনএজার, চোখ কটোমটো করে বল্লো, "নিজে যায়নি, এখন খ্যা খ্যা করে হাসি হচ্ছে, ইচ্ছে করছে এক ঘুসিতে টাকটা ফা' পাশ থেকে মেয়েটির মা বোধহয়, "কী হচ্ছে কী, গুরুজন না?'।
ভোলাবাবু সবাইকে অশ্বাস দিলেন, রোদ্দুর উঠেছে, অনেক কুমীর দেখতে পাবেন চরায়। একটাও দেখা যায় নি, তবে কেউ ভোলাবাবুর কাছে কৈফিয়ৎ চেয়েছিলো কিনা জানি না।
এইবার আমরা মাতলা নদীতে, নেক্স্ট অ্যান্ড ফাইনাল স্টপ সোনাখালি। হিউজ নদী, ওই বলে না, দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি, সেই সব।
দুপুরের খাওয়ার ডাক পড়লো। ওই জলখাবারের পর পেটে আর জায়গা নেই, তাও গেলুম, ওই মেয়েটির সঙ্গে একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। খাবারও আমার অপছন্দের, বাঁধাকপি, চিকেন - কোনোটাই খাইনা। মেয়েটিকে খুঁজে পেলুম, বাঁহাতে খাবারের থালা, একটা বেগুনি ডানহাতে । এগিয়ে গেলুম একটু বকে দিয়ে আসবো বলে, কাছে যেতেই মেয়েটা বেগুনিটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, দাদু, বেগুনি খাবে? দারুণ। কি আর করি, যৌবনের কাছে জরার পরাজয়, বলি খাবো যদি তুই খাইয়ে দিস (হেব্বি লাগল ডায়ালগটা তৎক্ষণাৎ মনে পড়ায়, বয়সকালে কেনো যে পাত্তুম না)। দু'টো বেগুনি খেয়ে নাচতে নাচতে (মনে মনে) নীচে চলে এলুম ফেরার জন্যে জামা পালটাতে আর ব্যাগ গুছোতে।
তিনটে নাগাদ সোনাখালি, নৌকো থেকে ডিঙিতে ঘাট - তারপর দুটো বাস রওনা দিল কলকাতার দিকে। ভোলাবাবু বল্লেন, বাস সাইন্স সিটি, পার্ক সার্কাস মোড় আর ধর্মতলায় কেসিদাসের সামনে থামবে - আমরা যেখানে ইচ্ছে নেমে যেতে পারি - আমি সাইন্স সিটিতে নেমে বন্ধুকে অজয়নগরে ওর বাড়িতে নামিয়ে নিজের ডেরায়। ভালোই লাগল।
একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে এইটা লেখা। কোন এক হিরোইন যেমন "মরিয়া প্রমাণ করিলো যে সে মরে নাই', আমিও তেমন লিখিয়া প্রমাণ করিলাম যে আমি লিখিতে পারি না। এবার কেউ আর সাহস পাবে না আমায় লিখতে বলার।