এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জীবন চক্র - দ্বিতীয় পর্ব (১)

    Himadrisekhar Datta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ৫৫৮ বার পঠিত
  • যদিও দ্বিতীয় পর্ব, কিন্তু খুঁটিয়ে দেখতে গেলে এখান থেকেই শুরু হল জীবনের যুগ অধ্যায়। এই পর্বে ফিরে যাব ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৯ সালের মধ্যবর্তী ১২ টি বছরে। 
    ভারতবর্ষ ইংরেজের মুঠো খুলে আলগা হয়ে বেরিয়ে আসে,স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ১৯৪৭ সালের ১৫-ই আগষ্ট। এর ঠিক ৯-বছর ৩-মাস আর ২৬-দিনের মাথায় এক ঠান্ডা হিমেল রাতে শিলিগুড়ির কাছে, নিতান্ত অখ্যাত এক চা-বাগান এলাকা, মাটিগাড়ায়, আমার জন্ম। আমি নিজে মাটিগাড়ার মাটি বা গাছপালা অথবা ঘর বাড়ি রাস্তাঘাট সম্বন্ধে কিছুই জানি না। আমার মাথার ভেতরে যে ধূসর বস্তুটি (gray matter)-র আকার আয়তন তখন কেবলই একটি বিন্দুবৎ ছিল,তার ভেতরে মজুত নিউওরনেরা ঠিক ঠাক কাজ করে থাকলেও, মেমরি ডিস্ক তখনও অ্যাক্টিভেটেড ছিল না। মা'য়ের কাছে শুণেছি আমার করোটির মধ্য ভাগ, জন্মের সময় পুরোপুরি ফিউসড ছিল না, ওপরে চামড়া (skin) যথাযথ লেগেছিল বলে, মাথাটি ছড়িয়ে যেতে পারে নি- কতকটা অর্দ্ধেক জরাসন্ধের মত জন্ম হয়েছিল আমার। তারপরে ডাক্তার আর নার্সদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, মাথার দুদিকে তুলোর প্যাড রেখে, মাথাটি ব্যান্ডেজ করে রাখা হয়েছিল প্রাথমিক ভাবে। যখন দেখা গেল মাঝখানে আর কেবল তুলতুলে চামড়া নেই, করোটিও অনুভব করা যাচ্ছে, তখন থেকে ক্রমশ সেই মমি মার্কা বাঁধনের আস্তে আস্তে অবশেষ ঘটে। সেটা ঠিক কতদিনে হয়েছিল, সেইটে জানা নেই। তবে পুরোন ফ্যামিলি অ্যালবামে আমার হাফ মমিকৃত সাদা কালো অনেক ছবি আছে। কি ভাগ্য,বাকি শরীরটা ঠিক ঠাক বেরিয়ে এসেছিল মাতৃ জঠর থেকে। নইলে, এ যুগে, মাটিগাড়ায় 'জরা' নামের সহৃদয়া রাক্ষসীকে কোথায় পেতাম? ডাক্তার এবং মাতা-পিতা ছাড়াও, যারা আমার জন্ম সূত্রে আত্মীয় ছিলেন সে সময়ে, তারা সকলেই এই অদ্ভুত শিশুর নিকট ভবিষ্যত নিয়ে নিশ্চয়ই চিন্তায় ছিলেন। আমার নিজের বিশ্বাস, এই সময়ই, আমার মাথার ভেতর থেকে, ম্যাথেমেটিক্স করতে পারার যে জন্মগত স্কিলটা ছিল, সেইটে, পাতলা চামড়া ভেদ করে ফুস হয়ে গিয়েছিল। আমার মত অগাণিতিক স্কিল নিয়ে খুব কমই বাচ্চা পৃথিবীতে আসে। এই গণিত ভীতি স্কুল কলেজে তো কাঁদিয়েই ছেড়েছে, তারপরেও আজ পর্যন্ত শয়নে স্বপনে মাঝে মাঝেই এক্সাম হলে অঙ্কের প্রশ্নপত্রের সামনে অসহায় ভাবে বসিয়ে দেয়। ঘন্টা পড়ে যেতে থাকে, উত্তরের খাতা সাদাই থেকে যায়, আমি ঘামতে থাকি, শেষ মেশ দুম করে চোখ খুলে যায়। চেনা বিছানায় উঠে বসে, দু ঢোঁক জল গলায় ঢালি। এই অঙ্কভীতির ধীরে ধীরে পর্দা উন্মোচিত হয়েছিল, স্কুল জীবনের সাথে সাথে। 
    মাটিগাড়ায় আমার জন্মের পরে কতটা সময় কেটেছে, তার একটা মোটামুটি আন্দাজ আছে, ব্যাক ক্যালকুলেশনের সাহায্যে। তবে যতটুকু সময়ই কেটে থাকুক না, তা ছিল, আমার দিক থেকে নির্বাক চলচিত্রের মত। পুঁচকে পাখী পাখী দেখতে ছানাটা ক্রমশ মানুষের মত হয়ে উঠতে থাকে। আদর আপ্যায়ন, মায়ের দুধ আর শিশুকালীন দরকারি সব কিছু পেয়ে। সে সময়ে, আম বাঙালির ঘরে, শিশুদের চোখে কাজল পরানোর রেওয়াজ ছিল। আর ছিল কপালের বাঁ-দিকে সেই কাজলের একটা টিপ দেওয়া। আমার ক্ষেত্রেও যে তার অন্যথা হয় নি, তিন ডজনের বেশি সাদা কালো ছবি, তা প্রমাণ করে। আমার পজিশন এবং মুদ্রা একই, শুধু কোল বদল ঘটেছে সেই ছবি গুলিতে। শুণেছিলাম,হাফ জরাসন্ধকে জন্ম দেবার পরে পরেই, আমার মাতৃদেবীর শরীরের বিশেষ অবনতি ঘটেছিল। সে সময় আমার দেখভাল, আমার মাসী, মায়ের ঠিক পরের ছোট বোন, বাবার একমাত্র ছোট শ্যালিকা, করেছিলেন। তাই তাকে ছোটমাসী না বলে, আমি 'ভালো-মা' বলে ডাকতাম। যখন মুখে সরস্বতীর আশীর্বাদে শব্দ ব্রক্ষ্ম সরব হয়েছিল। অবশ্যই এইভাবে ডাকতে আমায় মা-বাবা বা মাসী নিজেই হয়ত শিখিয়েছিলেন। তবে ছোটমাসী এখন আর আমার সাথে এই গ্রহে থাকেন না, চলে গেছেন অনেকদিন হল, কিন্তু আমার কাছে ভালোমা-ই থেকে গেছেন। শিলিগুড়ি পা্হাড়ি স্থান। বাবা কাস্টমস ইন্সপেক্টর, পোস্টিং মাটিগাড়াতে। আমার জন্ম সময় থেকে বাবা-মায়ের বিবাহের সময়কাল যদি ব্যাক ক্যালকুলেশনে বের করতে হয়, তাহলে সবচেয়ে কাছাকাছি সম্ভাব্য সময় হবে নভেম্বর-১৯৫৫ থেকে ফেব্রুয়ারি-১৯৫৬ এর মধ্যে কোন এক সময়। এটা একটা স্বাভাবিক মেডিকাল হাইপোথেসিস অবলম্বনে। এখন আমার জন্ম পরবর্ত্তী স্থিতি দেখে মনে হয় আমার, আমি একটু আগেই চলে এসেছি বোধহয়। সেটা স্বাভাবিক ভাবে না'কি সিজারিয়ান- সেইটে আজ জানার কোন সুযোগ নেই। যে ডাক্তারের হাতে আমার জন্ম, তাঁর নাম ছিল ডাঃ মাজি। মাটিগাড়া থেকে সেই যে জন্মের পরে সমতল ভূমিতে বাবার বদলির সুবাদে নেমে এসেছিলাম, আর কখনও সেখানে ফিরে যাওয়া হয় নি। সাদা কালো ছবিগুলি পরপর রেখে একটা আবছা ধারনা হয় - বাগানওলা, কাঠের লগের ওপরে দাঁড় করানো ছিল আমার সেই জন্মকালের বাড়িটি। বাবার হাতে করা বড় বড় ডালিয়ার বাগানে, ফুলের পাশে, আমাকে কোলে নিয়ে মা, বাবা নয়তো কাঞ্চা। সারা মুখ ভর্তি ফোকলা হাসি, চোখে ঢ্যাপসা করে কাজলের মোটা রেখা। মাথায় গুটি কয়েক চুল। সারা শরীর সোয়েটার টুপি আর আলোয়ানে ঢাকা। কাঞ্চা স্থানীয় ছেলে, নেপালী। তাদের নিজস্ব নাম থাকলেও, কাজের নেপালী ছেলে বা মেয়েকে কাঞ্চা বা কাঞ্চী বলেই ডাকা হত। প্রথামত তেল মালিশের জন্যই মনে হয় কাঞ্চাকে রাখা হয়েছিল। তা ছাড়া সংসারে তখন মায়ের শরীর খারাপের জন্যও একটা হেল্পিং হ্যান্ডের প্রয়োজন পড়েছিল নিশ্চয়ই। আমার বাবা যদিও সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের চাকুরে ছিলেন, কিন্তু তখনকার দিনে মাইনেপত্র খুব একটা বেশি ছিল না। বাবা মিতব্যায়ী ছিলেন এবং খুবই নিঁখুত ভাবে সংসার চালাতেন। একটা ছেলে যে নিজের উৎস থেকে এক সময়ে কেবলমাত্র নিজের পরিচয়ে বাঁচবেন বলে, সহায়ের কথা না ভেবেই, পরিচিত নিরাপদ গন্ডীর বাইরে পা রাখার সাহস দেখিয়ে ছিলেন, তার কাছে, নিজের পরিমিত আয়ে নিজের সংসার গুছিয়ে চালানোর আর্ট যে মজ্জাগত ভাবে অর্জিত হয়েছিল, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ পাই নি, সারা জীবন। কিন্তু মিতব্যায়ী হলেও, যখন যেটা করার কথা,সেইটে কোন খেদ বা খামতি না রেখেই পালন করতেন। এটা যদিও এক ধরনের বিশেষ হিউম্যান স্কিল, কিন্তু গণিত পুরো মাত্রায় গোচরে আসে। আর তাই, আমি বড় হয়ে বাবার তুলনায় অনেক বেশি মাইনেতে চাকরি করেও, তার মত সফল হতে পারি নি। 
    আমার মা, তখনকার দিনের আই এ পাশ ছিলেন৷ তিনি এবং তার ছোট ভাই এবং বোন,তার মায়ের সাথে, আমার দাদূর আগেই সিলেট ছেড়ে কলকাতা বাসী হয়ে গেছিলেন। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা পরবর্ত্তী সময়ে, জিন্নাহ শাসিত পাকিস্তানের, শাসন ব্যাবস্থা পূর্ব পাকিস্তানেও এক্সটেন্ডেড ছিল, যদিও সেখানে বেশির ভাগ লোকের ভাষা আরবি বা ঊর্দূ ছিল না। তারা বাঙলাতেই কথা বলত।
    র‍্যাডক্লিফ লাইন বা র‍্যাডক্লিফ রেখা হলো ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ ও বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিকে বিভাজন করে নবগঠিত ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণকারী রেখা। র‍্যাডক্লিফ লাইনের পরিকল্পনাকারী স্যার সাইরিল র‍্যাডক্লিফ (Cyril John Radcliffe)। এই রেখার নাম রাখা হয় পরিকল্পনাকারী স্যার সাইরিল র‍্যাডক্লিফ-এর নামে। (https://www.google.com/url?sa=t&source= web&rct=j&url=https://en.m.wikipedia.org/wiki/Radclif)
    রেডক্লিফ সাহেবের বিভাজনের রেখা, খুবই নির্বোধের মত টানা হয়েছিল, যদিও রেডক্লিফ সাহেবের কোন উপায় ছিল না। তাকে এত অল্প সময়ের মধ্যে মাউন্টব্যাটেন এই কাজ করতে বলেছিলেন, যে তার পক্ষে, ভৌগলিক, ভাষা বা ধর্মের বিচারে স্থান নির্দিষ্ট করে, বিভাজনের লাইন টানা, কলকাতায় বসে খুবই কষ্টসাধ্য কাজ ছিল। র‍্যাডক্লিফ ছিলেন ব্রিটিশ চেন্সারী বারের একজন প্রখ্যাত আইনজীবী । আইন পেশার বাহিরে তার বলার মত অন্য কোন কাজের অভিজ্ঞতা ছিল না । এর আগে তিনি একবার মাত্র ব্রিটিশ তথ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন। কিন্তু তাকেই ভারত ভাগ কমিশনের প্রধান করে মাউন্টব্যাটন নিয়ে আসেন। যদিও র‍্যাডক্লিফের ভারত সম্পর্কে কোন আগ্রহই ছিল না। ফলে বলা যায় যে তিনি বরাবরই এই কাজে উদাসীন ছিলেন এবং দায়সারা কাজ করতে থাকেন। সর্বশেষ তিনি অনেকটা দায়সারা ভাবেই ভারতবর্ষ বিভক্তির কাজ সম্পন্ন করেন এবং তিনি চলে যাবার সময় তার সকল নোট পুড়িয়ে দিয়ে যান। তিনি ব্রিটেনে ফিরে যাবার পর এই কাজ করার পুরষ্কারস্বরুপ তাকে নাইট উপাধি দেয়া হয়।
    (https://itibritto.com/radcliffe-line/)
    বিভাজনে মূল নায়ক মহম্মদ আলী জিন্নাহ এবং নেহেরু-গান্ধীজীরও ইনডাইরেক্ট চাপও ছিল। বড় শহরের সংখ্যা মোটামুটি সমান ভাবে দুজনকেই ভাগ করে দিতে হবে এমন একটা অলিখিত আইন পশ্চাদপটে রাজনৈতিক ভাবে রাখা হয়েছিল,খুবই সাটল (subtle) ভাবে। র‍্যাডক্লিফ লাইন দিয়ে ভারত পাকিস্তান কে ভাগ করা হয়েছে । কিন্তু কেন এই লাইন আর কেনইবা ভারত ভাগ ? হ্যাঁ এর পিছনে রয়েছে আরও ইতিহাস। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই সমগ্র ভারতবাসী তাদেরকে তাড়ানোর জন্য এক হয়ে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্তু তাতে ব্যর্থ হওয়ায় ভারতবাসীর মধ্যে একতা নষ্ট হয়ে যায়। এই কৌশলে ব্রিটিশরা ধনী হিন্দুদেরকে তাদের কাছে নিয়ে আসে। ফলে ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস গঠিত হলে হিন্দুদের স্বার্থ বেশী করে রক্ষিত হতে থাকে। তাদের বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে মুসলমানরা ১৯০৫ সালে মুসলিম-লীগ গঠন করে। ফলে এখান থেকেই হিন্দু-মুসলিমদের বিভাজন দৃশ্যমান হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে এই বিরোধ আরও চরমে উঠে। সর্বশেষ ১৯৪৯ সালে জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব উপস্থাপন করলে মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ন সামনে চলে আসে এবং মুসলিম-লীগ প্রচার প্রচারণা চালিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ম্যান্ডেট লাভ করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা ভারত ছাড়ার দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারত স্বাধীনতা আইন পাশ করে । হিন্দুদের দাবিকে পাশ কাটিয়ে মুসলমানদের কে প্রাধান্য দিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান নামে পৃথক দুইটি দেশকে স্বাধীনতা প্রদান করা হয়।
    (https://itibritto.com/radcliffe-line/)
    কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে তখন যে কেকের ভাগাভাগি চলছে, যা করছে এক বিদেশী বাঁদর। গল্পের বাঁদরের নিজের একটা উদ্দেশ্য ছিল, এইখানে বিদেশী বাঁদর কেবল, তার আকার আজ্ঞা পালন করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কর্মমুক্ত হতে চাইছিল। তাই তার কাছে বাটোয়ারার মূল উদ্দেশ্য কখনই যুক্তি তর্কের পাশ দিয়ে যায় নি। তা হয়েছে কিছুটা হুইমস আর বাকিটা চাপের মধ্যে পড়ে কোন রকমে কাজ খতম করার মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তানে স্থায়ী হিন্দুদের জন্য সবচেয়ে বেশি অসুবিধা সৃষ্টিকারী হয়ে উঠতে লাগলো জিন্নাহর শাসন ব্যবস্থা। গান্ধীজীর দেশেও সামগ্রিক কোনও সুশাসন এবং সুব্যাবস্থা তখনও ঠিক মত রূপ পায় নি। বল্লভভাই প্যাটেল দেশের প্রথম সরাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে, করদ রাজ্যগুলিকে রিপাবলিক ভারতের অধীনস্থ করার জন্য সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রাজা, বাদশা,নিজামদের সাথে দফায় দফায় আলোচনা করছেন। গান্ধীজী হঠাৎ করে, জনগণের থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়ে নিলেন। কেবল হিংস্রতা, রায়ট আর মৃত্যুর প্রতিবাদে, কখনও কলকাতায়, কখনও নোয়াখালিতে অনশনে বসতে লাগলেন। ইংরেজ চলে যাবার আগে, জাত আর ধর্মের এক বিষাক্ত বোমা রেডক্লিফ লাইন বরাবর ফাটিয়ে দিয়ে গেছিল, যার প্রভাব আজও কম হল না। 
     র‍্যাডক্লিফ লাইন আকার ফলাফল ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ তিনি অতি অল্প সময়ের মধ্যে কলমের দ্বারা রেখা টেনে একটি মানচিত্রকে ব্যাবচ্ছেদ করেন এবং সাথে সাথে ভাগ করেন ৪০ কোটি মানুষের পরিচয় কে। এতকাল যে সব মানুষ একসাথে পাশাপাশি বসবাস করে আসছিল তাদেরকে শুধু কলমের দ্বারা দাগ কাটার সাথে সাথে তাদেরকে আলাদা করে ফেলেন। এই কলমের নিচে সরাসরি বলি হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ।
    ১৯৪৭ সালের ১৭ আগস্ট র‍্যাডক্লিফ তার পূর্নাঙ্গ মানচিত্র প্রকাশ করেন এবং গেজেট প্রকাশ হবার সাথে সাথে পাঞ্জাব ও বাংলার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পরে দাঙ্গা কারণ যেসকল হিন্দু পাকিস্তানের ভূমিতে পরেছে তারা ভারতের অংশে চলে যেতে শুরু করে পাশাপাশি মুসলমানদের সাথে বিবাদেও জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে যেসব মুসলমান ভারতের অংশে পড়েছে তাদেরকেও পাকিস্তান অংশে চলে যেতে বাধ্য করা হয়। ফলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিবাধ চরম পর্যায়ে পৌঁছায়  এবং তাদের মধ্যে সরাসরি একে অপরের মধ্যে কচুকাটা হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। এতে প্রায় ৫ থেকে ১০ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান প্রাণ হারায়। এবং লাখ লাখ মানুষ তাদের পৈত্রিক ভিটা-বাড়ি ছেড়ে পাড়ি দিতে হয় অন্যত্র অচেনা /অপরিচিত জায়গায় যে চিত্র ছিল অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।
    তাছাড়া শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র শুরু হয় উভয়ের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ভেঙ্গে-ফেলা, প্রার্থনালয় জ্বালিয়ে দেয়া। নির্যাতিত হতে থাকে হাজারো নারী, ধারনা করা হয় শুধু ঐ সময়েই ৭০ হাজার নারী নির্যাতিত হয়েছিল এবং সীমান্ত অঞ্চল সমূহে নেমে আসে শরণার্থীদের ঢল। কেবলমাত্র ব্রিটিশ সাংবাদিকদের হিসাব অনুযায়ীই ৬০০ শরণার্থী শিবির গড়ে উঠে। কিন্তু এই সংখ্যা হাজার ছাড়িয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
    (https://itibritto.com/radcliffe-line/).
    এই রকম অশান্ত সময়ের চাপে, আমার দিদারা সকলে কলকাতা চলে আসে। মা তখন সেই পরিবারের চালিকা শক্তি ছিলেন। কলকাতায় স্বাস্থ্য বিভাগে, নিজের বিদ্যের জোরে কাজ জুটিয়ে ফেলেন। সিলেট ছাড়ার পরে, ভালোমা আর স্কুল বা কলেজের মুখ দেখেন নি, কিন্তু তার গানের গলাটি খুবই উচ্চ দরের ছিল। দিদি মানে আমার মা তার জন্যে হারমোনিয়াম কিনে দিলে, গানের মাস্টার রাখলে। মামা ভর্তি হলেন মেডিকেল কলেজে, ডাক্তার হবার অভিপ্রায়ে। এই সব কিছুই যদিও আমার জন্মের আগের ঘটনা - তবুও আমার বাবা-মা'র তখনকার অবস্থা বুঝে নিতে, এটুকু অতীতের সাহায্য নিতেই হল। আত্মীয় পরিজন সকলেই নতুন দেশ কাল সময়ে, নিজের পারিপার্শ্বিকতার সাথে তীব্র লড়াই করেই তখন টিঁকে থাকার লড়াইয়ে ব্যাস্ত। 
    (ক্রমশ....)
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Himadrisekhar Datta | ১০ জুলাই ২০২৩ ১২:৩৮521137
  • এই লেখাটি ১৯৪ বার পঠিত বলে দেখাচ্ছে। প্রায় দুশো মানুষের মধ্যে, একজনও একটি মতামত দিলেন না। এটা ভাববার বিষয় - লেখক হিসেবে। 
    নতুন কিছু লিখতে সংকোচ বোধ করছি। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন