এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • পরাণ বাগ্দী - ১ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ জুন ২০২২ | ৮৬৭ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (৪ জন)
  • লোয়ার কোর্টে পরাণ বাগ্দীর যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা ঘোষিত হল প্রায় তিন বছর ধরে মামলাটা চলার পর। সাক্ষ্যপ্রমাণ সব পরাণের বিরুদ্ধে গেল। মানে, পরাণের পক্ষে দেবার মতো সাক্ষী পাওয়া গেল না। দেবমাল্য সরকার উকিল হিসেবে পরাণের জন্য প্রচুর লড়েছিল। কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে পরাণকে নির্দোষ প্রমাণ করা গেল না। সেসান জজ সুহৃৎ মিত্র নিজেও বোধহয় জানেন যে পরাণ পুরোপুরি নিরপরাধ। কিন্তু তার কিছু করার ছিল না। আমাদের বিচার ব্যবস্থা নিয়মকানুনের ফাঁসে বাঁধা। সেই ফাঁস কেটে বেরিয়ে আসা সহায় সম্বলহীন গরীব মানুষের পক্ষে অনেক সময়েই অসম্ভব কাজ হয়ে যায়। পরাণের যেমন হল। গ্রাম প্রধান অনন্ত মন্ডলের খুনের ঘটনায় সে ফেঁসে গেল। আর বেরোতে পারল না।

    দেবমাল্য বারাসাত কোর্টের বাইরে এসে দাঁড়াল বিমর্ষ মনে। বেলা আড়াইটে বাজল। পরাণের বৌ সুজাতা আর ছেলেমেয়ে দুটো তার কাছে এসে দাঁড়াল। সুজাতা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ছেলেমেয়ে দুটোও কাঁদতে লাগল।  
    ------ ' আমি ছেলেমেয়েকে দুটোকে নিয়ে কোথায় যাব বাবু ..... তবু তো একজন ছিল আমাদের .... '
    ----- ' কেঁদ না .... কেঁদ না। এখনও রাস্তা আছে আমাদের ..... হাল ছাড়লে চলবে না .... হাইকোর্টে অ্যপিল করব .... কেস দাঁড় করাবোই..... ভেব না তুমি ..... এতবড় অন্যায় কক্ষণো মেনে নেব না ..... '  

    দেবমাল্য বাড়ি ফিরে ভাবতে বসল ....... 

    অনন্তর মৃতদেহ পড়ে ছিল তার বাড়ির পিছনের বাগানে। বাগান না বলে ক্ষেত বলাই ভাল। নানা সব্জীর চাষ হয় ওখানে। বিশেষ করে বেগুন আর ঝিঙে। তাছাড়া ক্ষেতি জমি কিছু কম নেই অনন্তর। দুটো গাড়ি করে ফেলেছে এ ক'বছরের মধ্যে। একটায় মাঝে মাঝে নিজে চড়ে বারাসাত বসিরহাট টাকি যায়, আর একটা ভাড়া খাটে। আরও অনেকরকম কারবার আছে অনন্তর। ঝাঁ চকচকে পেল্লায় কোঠা তুলেছে। রাস্তায় যেতে যেতে লোকে তাকিয়ে দেখে। বাড়ির পিছনের সব্জী বাগানটা দেখভাল করার জন্য অনন্ত পরাণ বাগ্দীকে রেখেছিল। ক্ষেতমজুরের কাজ আর কি। অনন্ত নিজেও একসময়ে ক্ষেতমজুর ছিল। তারপরে কি করে যে কি হয়ে গেল ভেবে অবাক লাগে পরাণের। অনন্তর ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকল বনবন করে। পরাণ যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে গেল .... অনন্তর ক্ষেতে ক্ষেতমজুর।

    সেদিন ভোরবেলায় পরাণ অনন্তর বাড়ির পিছনের বাগানে ঢুকেছিল কাজ করতে যেমন রোজ ঢোকে। ঢুকে বাগানের মাঝামাঝি ঝিঙে চাষের জায়গাটায় পৌঁছতেই পরাণের চোখ কপালে উঠে গেল। বুকের ভিতর ধকধক করে ইঞ্জিন ছুটতে লাগল। রক্তে মাখামাখি হয়ে  চিৎ হয়ে পড়ে আছে অনন্ত। গলার নলি কেউ দু ফাঁক করে দিয়ে গেছে। অনন্তর চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। পরাণ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। দু:স্বপ্নগ্রস্ত মানুষের মতো সেখানে পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।  

    দু মিনিটের মধ্যে সেখানে হঠাৎ এসে হাজির হয়ে গেল অনন্তর এক ভাইপো বসন্ত মন্ডল। সে এসেই আচমকা হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিল। অথচ বসন্ত কোনদিন বেলা নটার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। 

    ' আরে .... একি .... খুন ... খুন ... ' , বলে  দাপাদাপি শুরু করল। চেঁচামেচি শুনে দু চারজন ছুটে এল এদিক ওদিক থেকে। ভ্যাবাচ্যাকা মেরে যাওয়া পরাণকে জাপটে ধরল দু তিনজনে মিলে।    
    ----- ' নিয়ে চল ..... নিয়ে চল শালাকে ..... কাকাকে মার্ডার করেছে ..... ও: .... চিন্তা করা যায় না ....  নেমকহারাম ..... ', বসন্ত চেঁচাতে আরম্ভ করল।  

    বসন্তই খুনের মামলা রুজু করল পরাণের নামে।  পুলিশ চাক্ষুষ এবং আপাতসিদ্ধ প্রমাণের ভিত্তিতে পরাণকে হেফাজতে নিল। 
         
    শুনানির জন্য প্রথম যেদিন কোর্টে তোলা হল পরাণকে, কোর্টের বাইরে উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়াচ্ছিল সুজাতা। ছেলেমেয়ে দুটো সামনের চায়ের দোকানে বসে কোন অজানা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে কাঁদছিল। দোকানদার স্নেহপরবশ হয়ে দুটো করে বিস্কুট খেতে দিল তাদের। কোর্টের গেটের মুখে আচমকা দেবমাল্যর মুখোমুখি পড়ে গেল পরাণের বৌ সুজাতা। বেশ ক'বছর ধরে এ লাইনে কাজ করার অভিজ্ঞতায় উদভ্রান্ত ও বিধ্বস্ত সুজাতাকে দেখে মূল ব্যাপারটা খুব তাড়াতাড়ি আন্দাজ করে নিল দেবমাল্য। 
    ----- ' দাঁড়ান ... দাঁড়ান।  কি হয়েছে ? ' দেবমাল্য সুজাতার সামনাসামনি হয়। 
    ------ ' আমার স্বামীকে আজ কোর্টে তুলবে .... '
    ------ ' উকিল নেই ? '
    ------ ' না  .... বাবু '  
    ----- ' বুঝতে পেরেছি। আমার সঙ্গে আসুন .... '
    ----- ' আমার কাছে টাকা নেই বাবু .....'
    ----- ' আমি কি টাকার কথা বলেছি কিছু ? আমার সঙ্গে আসুন .... '
    ----- ' একটু দাঁড়ান বাবু ..... ছেলেমেয়ে দুটোকে ডেকে আনি .... '
    ------ ' নিয়ে আসুন .... আমি এখানে আছি .... '

    তারপর দেবমাল্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছে নিরাপরাধ পরাণের মামলাটা সঠিক রাস্তায় নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু বিরুদ্ধ পক্ষ এত তীব্র বিষময়,  চতুর এবং ক্ষমতাসম্পন্ন ছিল যে মামলাটার মোড় ঘোরান গেল না। আজ নিম্ন আদালতের রায় বেরিয়ে গেল। 

    দেবমাল্য সাময়িকভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিল কিন্তু দুমড়ে গেল না। বরং তার চোয়াল শক্ত হয়ে  উঠল। এই ম্লান গোধূলিবেলায়  সে একাকী তার চেম্বারে বসে দৃঢ় শপথ নিল যে এত বড় অন্যায় সে মেনে নেবে না। কিন্তু দেবমাল্য এটাও গভীরভাবে অনুভব করতে পারছে যে, একজন ধারালো মস্তিষ্কসম্পন্ন কারো পরামর্শ নেওয়া দরকার যাতে মামলার ছিদ্রগুলো মেরামত করে নেওয়া যায়। আইনি রাস্তাতেই প্রতিপক্ষের অনৈতিক চালগুলো নস্যাৎ করা যায়। সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করার পথ বন্ধ করে দিয়েছে ওরা ছলে বলে কৌশলে। ফরেন্সিক রিপোর্ট থেকেও পরাণের অনুকূলে কিছু নিশ্চিত করা গেল না। সেখানেও নিশ্চয়ই কিছু কারচুপি করা হয়েছে। শুধু প্রাইমা ফেসি ইভিডেন্স .... ব্যস ....এই ভিত্তিতে মামলাটা এগিয়ে গেল !  আর দেবমাল্য উদারহৃদয় বটে কিন্তু তার অভিজ্ঞতা কম। কিন্তু হার মানতে সে রাজি নয়। এ অন্যায় সে মুখ বুজে মেনে নেবে না। হায়ার কোর্টে কালই  অ্যপিল করবে। কিন্তু একজন সঠিক এবং উপযুক্ত কারো পরামর্শ অবশ্যই চাই তার। 

    কিন্তু সে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল ব্যাপারটা নিয়ে। সে কার কাছে যেতে পারে পরামর্শ চাইতে। শুধু বুদ্ধিমান হলেই তো হবে না। হৃদয়বানও হওয়া চাই। 

    দেবমাল্য স্মৃতির সুড়ঙ্গে টর্চ ফেলে অনুসন্ধান চালাতে লাগল একাগ্রচিত্ত হয়ে। প্রায় দশ মিনিট পর মস্তিষ্ক সুড়ঙ্গের আর এক প্রান্তে সহসা ভেসে উঠল উজ্জ্বল আলোকবিন্দুর মতো একটা নাম ----- কলতান গুপ্ত। 

    তার বন্ধু আশিস ভট্টাচার্য নেতাজিনগরে একটা গয়না চুরির সমস্যায় কলতান গুপ্তর সাহায্য নিয়েছিল বলে মনে পড়ছে। কলতানের ফোন নম্বরটা নিশ্চয়ই ওর কাছে পাওয়া যাবে। সে তক্ষুণি ডায়াল করল আশিসকে।

    ( ক্রমশঃ ) 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন