২০০৭ এর মিশর ভ্রমণের সময় আমি প্রথম হাতশেপসুতের নাম শুনি। সেবারে গাইড ছিল ভিভিয়ান নামের একটি মেয়ে। মিশরের এই ব্যতিক্রমী মহিলা ফারাওয়ের গল্প বলেছিল সে। রাজা-রানীদের গল্প আমরা ছোট থেকেই অনেক পড়ি। কিন্তু রাজ্য শাসন করছে এমন রানীর উপস্থিতি ইতিহাসের বইতে খুবই কম। রূপকথার গল্পে তো আরোই অমিল। আধুনিক যুগে বেশ কিছু মহিলা রাষ্ট্রাধিপতি আমরা পেয়েছি। প্রাচীন ও মধ্যযুগে মহিলা রাষ্ট্রাধিপতি একেবারেই নেই এমন নয়। কিন্তু সাধারণত তাদের দেখা পাওয়া যায় যখন পুরুষ রাজা কোনো সাবালক পুত্রসন্তান না রেখে মারা যায়।সেই সঙ্কটের মূহুর্তে মহিলা রাষ্ট্রাধিপতি হাল ধরে এবং হয় সে রাজ্যরক্ষায় ব্যর্থ হয় অথবা কিছুদিন পরে পুরুষ উত্তরাধিকারী সাবালক হয়ে রাজ্যভার গ্রহণ করে। অর্থাৎ সাধারণ ভাবে মহিলা রাষ্ট্রাধিপতির কাজ হল দুজন পুরুষ রাজার রাজত্বকালের মাঝের স্বল্পস্থায়ী শূন্যস্থান পূরণ করা। এখানেই হাতশেপসুত অনন্য৷ আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে এই মহিলাকে আমরা দেখছি একুশ বছর দক্ষতার সাথে রাজত্ব করতে। এই রাজত্বকাল প্রাচীন মিশরের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলা চলে। বিদেশে বাণিজ্য, অসংখ্য সৌধ নির্মাণ এবং খুব সম্ভবত দুটি যুদ্ধজয় হয়েছে এই সময়ে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে এর সাথে তুলনীয় আর কোনো মহিলা নেতৃত্ব আমার জানা নেই।
এবার দেখা যাক সারা পৃথিবী যে ভূমিকায় একজন পুরুষকে দেখতে অভ্যস্ত সেখানে হাতশেপসুতের ঠাঁই হল কিভাবে। হাতশেপসুতের বাবার নাম প্রথম থুথমোস। তিনি খুব বীর রাজা ছিলেন শোনা যায়। পাটরাণী আহমোসের সাথে তাঁর কয়েকটি সন্তান হয়েছিল। এদের মধ্যে দুটি পুত্রসন্তানও ছিল। কিন্তু তারা ছোটবেলায় মারা যায়। পড়ে রইল মেয়ে সন্তান হাতশেপসুত। কিন্তু তার তো সিংহাসন পাওয়ার নিয়ম নেই। থুথমোসের অন্য একজন রাণীর একটি ছেলে ছিল। তার সাথে হাতশেপসুতের বিয়ে দিয়ে সেই ছেলেকে রাজা করা হল। এর নাম হল দ্বিতীয় থুথমোস। দুঃখের বিষয় দ্বিতীয় থুথমোস আয়ুষ্কাল ছিল খুব কম। হাতশেপসুত ও দ্বিতীয় থুথমোসের নেফেরুরে নামে একটি মেয়ে হল। অন্য একজন রাণীর সাথে একটি পুত্রসন্তান হল। তার নাম দেওয়া হল তৃতীয় থুথমোস। এর পরেই দ্বিতীয় থুথমোস মারা গেলেন। এই অবস্থায় শিশু তৃতীয় থুথমোসের অভিভাবক ও সহরাষ্ট্রাধিপতি হিসেবে হাতশেপসুতকে প্রথম সিংহাসনে বসতে দেখা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত গল্পটা বেশ সাদামাটা। অনুরূপ পরিস্থিতিতে এর আগেও মহিলারা রাজ্যভার নিয়েছে, পরেও নেবে। রাজত্বের সপ্তম বছরে একটা ঘটনা ঘটল যা আগে ঘটেনি। এই বছরে পাওয়া একটা মূর্তিতে হাতশেপসুতকে দেখা যাচ্ছে পুরুষ ফারাও রূপে। মাথায় ফারাওয়ের মুকুট, স্তনাভাস নেই, এমনকি থুতনিতে নকল দাড়ি।
কিভাবে জানা যাচ্ছে এটা হাতশেপসুতের মূর্তি? এখানে মনে রাখতে হবে প্রাচীন মিশরীয়রা প্রতিটি কাজ করত পরকালের কথা ভেবে। জীবৎকালের প্রতিটি কীর্তির বর্ণনা তারা রেখে যেত ছবি বা ভাস্কর্যের মাধ্যমে। চিনতে যাতে অসুবিধে না হয় তাই মূর্তির গায়ে বা ছবির নিচে খোদাই করা থাকতো তাদের নাম। ক্যাপসুল আকৃতির এই নামের ফলকগুলোকে বলে কার্তুস। কথাটা কার্তুজ থেকেই এসেছে। প্রথম যুগের ইজিপ্টোলজিস্টদের মধ্যে কোনো ফরাসী ছিলেন। তিনি এই নামটা দিয়ে থাকবেন। মোদ্দা কথা হল মূর্তির গায়ের কার্তুস থেকে জানা গেছে রাজত্বের সপ্তম বছর বা তার আগে থেকে হাতশেপসুত পুরুষ ফারাওদের মত করে নিজের প্রতিকৃতি গড়াতে থাকেন। একক সার্বভৌম শাসকের উপযোগী উপাধিও নেন। তবে তিনি যে সর্বনামগুলো ব্যবহার করেছেন তা স্ত্রীলিঙ্গবাচক।
কি কারণে হাতশেপসুত রাণীর ভূমিকা ছেড়ে ফারাও হলেন তা সঠিক জানা যাচ্ছে না। হতে পারে ক্ষমতালোভী ছিলেন। তবে সৎ ছেলে তৃতীয় থুথমোসকে কিন্তু তিনি হত্যা করলেন না বা নির্বাসন দিলেন না। থুথমোস তখনও বেশ ছোট। বড় হয়ে উঠে সে একজন বড় যোদ্ধা হল। সেও তার সৎ মায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করল না। এভাবে প্রায় কুড়ি বছর কাটার পর মধ্য চল্লিশে হাতশেপসুতের মৃত্যু হয় এবং তারপর তৃতীয় থুথমোস ফারাও হলেন। হাতশেপসুতের মমি এখনো আবিষ্কার হয়নি। দেহ খুঁজে পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে, তবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল এমন কোনো ইঙ্গিত নেই।
হাতশেপসুতের রাজত্বকাল সফল বহির্বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত। সেকালের পুন্ট, বর্তমান ইরিট্রিয়া থেকে প্রচুর মূল্যবান জিনিসপত্র, পশুপাখী, মায় জিরাফ এসেছিল - এই ছবি রয়েছে হাতশেপসুতের তৈরি করা একটি মন্দিরের দেওয়ালে। আমরা সেই ছবি দেখলাম। ম্লান হয়ে এসেছে বলে ক্যামেরায় ওঠেনি, কিন্তু খালি চোখে বোঝা যায়। সূর্য দেবতা আমুন রা-এর উদ্দেশ্যে নিবেদিত বিশাল কার্ণাক মন্দিরে হাতশেপসুতের উৎসর্গ করা দুটি একশো ফুট উঁচু ওবেলিস্ক আছে। তার একটি ভেঙে গেছে। অন্যটি আমরা এবারে দেখে এলাম। নজর এড়ালো না সেই ওবেলিস্কের চারদিকে ভাঙা পাথরের দেওয়াল। ভিভিয়ান বলেছিল হাতশেপসুতের ওবেলিস্ক পাথর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। পরে কোনো ভূমিকম্পে সেই দেওয়াল ভেঙে পড়ে ভিতরের ওবেলিস্ক বেরিয়ে আসে। পুন্টের ছবি সমৃদ্ধ হাতশেপসুতের মন্দিরে দেখেছি হাতশেপসুতের নামের কার্তুস মুছে দেওয়া হয়েছে। ওই মন্দিরে তৃতীয় থুথমোসের ছবি আছে, কিন্তু হাতশেপসুতের কোনো ছবি নেই। যেখানে থাকার কথা সেই জায়গা ফাঁকা। হাতশেপসুতের বানানো অন্য একটি মন্দিরে শুনেছি হাতশেপসুতের ছবি মুছে অন্য এক ফারাও প্রথম সেতির ছবি আঁকা হয়েছে। সেই মন্দিরে আমরা যাইনি।
নাম মুছে দিলে কি করে জানা গেল এই মন্দিরগুলো হাতশেপসুতের? আসলে মোছার কাজটা খুব ভালো ভাবে করা হয়নি। মন্দিরের বাইরের দিকের ছবি বা কার্তুস মোছা হয়েছে। মূর্তি ভাঙা হয়েছে। কিন্তু ভিতরের দেওয়ালে মোছা হয়নি। অনেক সময় নাম মুছে কোনো পুরুষ ফারাওয়ের নাম লেখা হয়েছে, কিন্তু সর্বনাম রয়ে গেছে স্ত্রীলিঙ্গবাচক। রাণী অবস্থার কোনো চিহ্নই মোছা হয়নি। উনিশ শতকের ইজিপ্টোলজিতে হাতশেপসুত ছিল একটা ধাঁধা। আস্তে আস্তে তার রহস্য উন্মোচন হয়েছে। এখনো সবটা জানা যায় না।
কে করল এই কাজ? কেন করল? প্রথম দিকে ইজিপ্টোলজিস্টরা মনে করতেন সিংহাসন হারানোর জ্বালায় তৃতীয় থুথমোস এই কাজ করেছেন। কিন্তু এই কারণটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ হাতশেপসুতের রাজত্বকালের শেষদিকে থুথমোস প্রাপ্তবয়স্ক এবং কীর্তিমান যোদ্ধা। কিন্তু তিনি বিদ্রোহ করেছিলেন এমন খবর নেই। উপরন্তু এইসব ছবি/কার্তুস মোছা, মূর্তি ভাঙার ঘটনা ঘটেছে থুথমোসের রাজ্যলাভের কুড়ি বছরের মাথায়। যদি প্রতিহিংসার বশে ভাঙা হত তাহলে এতখানি অপেক্ষা করার মানে হয় না। তৃতীয় থুথমোসের রাজত্বের শেষদিকে যে সময়ে এই ভাঙাচোরা চলেছে তখন সহরাষ্ট্রাধিপতি যুবরাজ দ্বিতীয় আমেনহোতেপ। এই যুবরাজও পাটরাণীর সন্তান নন। অতএব সিংহাসনে এনার অবিসংবাদিত অধিকার নেই। ঠিক কি কারণে বাপ-ব্যাটায় হাতশেপসুতকে মুছে দিতে চাইলেন তা নিয়ে কিছু জল্পনা আছে।
কেউ কেউ বলেন তৃতীয় থুথমোস প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিলেন তিনি তাঁর বাবার থেকে সরাসরি উত্তরাধিকার পেয়েছেন। মাঝখানে কেউ ছিল না। এর ফলে নিশ্চিত করা যাবে যে হাতশেপসুতের মা আহমোসের বংশের কোনো অধিকার নেই সিংহাসনে। তবে আহমোসের দিক থেকে কোনো ভয় ছিল এমন প্রমাণিত নয়।
অন্য যে কারণটি এখন মোটামুটি মানা হয় সেটা হল স্রেফ মেয়ে বলেই হাতশেপসুতকে মুছে দেওয়া হয়েছিল। এর আগে যে মহিলা ফারাওদের নজির আছে তাঁরা সংকটকালে ফারাও হয়েছিলেন পুরুষ উত্তরাধিকারী পাওয়া যাচ্ছিল না বলে। সোবেকনেফেরু নামে এক মহিলা ফারাওএর নাম পাওয়া যাচ্ছে যিনি চারবছর ফারাও ছিলেন খুব টালমাটাল অবস্থায়। তাঁর শাসনকালেই সেই রাজবংশ শেষ হয়ে যায়। সোবেকনেফেরুকে তাই "আহা একা মেয়েমানুষ, পেরে ওঠে নি" বলে করুণা করা যায়। হাতশেপসুত কিন্তু অত্যন্ত সাফল্যের সাথে দীর্ঘ একুশ বছর দায়িত্ব সামলালেন। প্রমাণ হয়ে গেল মহিলা ফারাও দিয়েও কাজ চলতে পারে। ফলত সিংহাসনের দাবীদার বেড়ে গেল। সেই কারণেই খুব সম্ভব হাতশেপসুতের সব চিহ্ন মানুষের চোখের সামনে থেকে মুছে ফেলার প্রয়োজন পড়ল। এছাড়াও দেখা যাচ্ছে তৃতীয় থুথমোসের ছেলে এই দ্বিতীয় আমেনহোতেপ তার রাণীদের নাম কোথাও লিখতে দেয়নি যেটা মিশরের রাজপরিবারে একটা ব্যাতিক্রম বলা চলে। ফারাও না হতে পারলেও মিশরের রাজবধুরা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ছিল। তাদের উপাধি ছিল "আমুনের স্ত্রী"। দ্বিতীয় আমেনহোতেপ তার স্ত্রীকে এই উপাধি নিতে দেয়নি। এর থেকে মনে হয় দ্বিতীয় আমেনহোতেপ ক্ষমতাশালী মহিলাদের নিয়ে খুব একটা স্বস্তিতে ছিল না এবং হাতশেপসুতের উদাহরণ ছড়িয়ে পড়ুক এমনটা সে চায়নি।
এসব তো গেল ইতিহাসের কথা। এই একবিংশ শতকে এসে পনেরো বছরের ব্যবধানে আমি হাতশেপসুত নিয়ে নানারকমের মতামত শুনলাম। সংক্ষেপে সেই গল্প বলে লেখা শেষ করি। পনেরো বছর আগের ভিভিয়ান ছিল হাতশেপসুতের মুগ্ধ ভক্ত। ওর গল্প শুনেই হাতশেপসুত সম্পর্কে আমার আগ্রহ জন্মায়। এবারের মিশর ভ্রমণে আমরা এক একটা অংশে এক একজন গাইড পেয়েছি। হাতশেপসুতের মন্দির দেখার দিন গাইড ছিল ওয়েইস (অর্থঃ নিশাচর)। হাতশেপসুতের নাম মুছে ফেলা হয়েছে এই নিদর্শন সে আমাদের দেখালো। কিন্তু কে এই নাম মুছেছে তা নিয়ে কিছু বলতে রাজি হল না। খুব দৃঢ়তার সাথে জানালো তৃতীয় থুথমোস এ কাজ করতে পারে না। হয়ত অনেক পরের কোনো রাজার কাজ। তার মোটিভ কি? এ বিষয়ে ওয়েইস নীরব। ইজিপ্সিয়ান মিউজিয়াম দেখার দিন গাইড ছিল আব্দুল ওয়াহিব। সে বলল তৃতীয় থুথমোসই মুছেছে। তবে মুছবে না-ই বা কেন? হাতশেপসুত চক্রান্ত করে ভুলিয়ে ভালিয়ে সিংহাসনে বসেছিল। এমনটা হওয়াই তো স্বাভাবিক।
আমার ব্যক্তিগত মত তৃতীয় থুথমোস খারাপ লোক ছিল না। তার হাতে সামরিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও সে হাতশেপসুতকে ক্ষমতাচ্যুত করেনি। হাতশেপসুত মারা যাওয়ার পরের কুড়ি বছরেও সে কোনোরকম প্রতিহিংসাপরায়ণতা দেখিয়েছে এমন প্রমাণ নেই। সমস্যা হয়েছে তারপর। যখন থুথমোসের পাটরাণী এবং তার গর্ভজাত সাবালক পুত্রসন্তান দুজনেই মারা যায়। তখন যুবরাজ হল অন্য রাণীর সন্তান দ্বিতীয় আমেনহোতেপ। সিংহাসনে তার জন্মগত অধিকার নেই। যদিও তার কোনো উচ্চাকাঙ্খী বোনের খবর আমরা পাচ্ছি না, একথা অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে সে সিংহাসন সংক্রান্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিল। তাই হাতশেপসুতকে মুছে ফেলা। পৃথিবীর ইতিহাসে পরবর্তী সাড়ে তিন হাজার বছরে মহিলা রাষ্ট্রাধিপতি এল মূলত শূন্যস্থান পূরণ করতে। যদি হাতশেপসুতের নাম হারিয়ে না যেত, যদি তা আরও অনেক মেয়েকে অনুপ্রেরণা যোগাত একক নেতৃত্ব দেওয়ার, হয়ত পৃথিবীর ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো।
(এই পোস্টের ছবিটি ইজিপ্সিয়ান মিউজিয়ামে হাতশেপসুতের ভগ্নমূর্তি। নকল দাড়ি লক্ষ্যণীয়।
হাতশেপসুত সংক্রান্ত আরও কিছু ছবি একে একে আসবে)