কালীসায়রের পাশের রাস্তা দিয়ে গিয়ে বড় মাঠ পেরিয়ে, বাঁঁ দিকে ঘুরে ডিপার্টমেন্ট। সামনেই মাঘ মেলার মাঠ। ডিপার্টমেন্টের দোতলার করিডরে দাঁড়ালে দূরের সবুজের হাতছানি। নীচে, অ্যাকাউন্ট সেকশনের পাশে, কাঞ্চন গাছটা ফুলে ফুলে সাদা। অডিও ভিস্যুয়াল ইউনিটের বাইরে, চালতার কুঁড়ির উঁকিঝুঁকি। এসব পেরিয়ে লাইব্রেরীর পথ ধরলো কলি। ছোট্ট লাইব্রেরী। এই বইভূমিতে বেশ লাগে কলির। রিডিং রুমের জানলার বাইরে রঙীন প্রজাপতি আর পাখিদের আলাপন। আত্মশাসন করেও দৃষ্টিকে স্ব-বশে রাখতে পারেনা কলি। প্রায় ফাঁকা রিডিং রুমে বইয়ের পাতায় নিঃশব্দ পাশ ফেরা আর বাইরে পাখিদের কলতানে আচ্ছন্ন কলির মন।
সেদিন, লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে, হোস্টেলের পথ ধরতেই, দিগন্ত সহেলী হেমন্তদের সাথে দেখা হয়ে গেল। ওদের জোরাজুরিতে হোস্টেলে ফেরা হলোনা কলির। সাইকেল নিয়ে দল বেঁধে চললো সোনাঝুরির পথে। যেতে যেতে অরণ্য গান ধরলো, "আজি বরিষণমুখরিত শ্রাবনরাতি".. সবাই হই হই করে উঠলো, 'কি ব্যাপার ভাই, সবে ফাগুন বনে ফুল ফোটাচ্ছে, আর তুই কিনা এখনই শ্রাবণ বন্দনা শুরু করলি। এ এ এ ভাই, ফাগুনের গান ধর'।
ক্যানাল পাড়ে এসে অরণ্য সাইকেল থামাতেই, সবাই থেমে গেল। অরণ্য আড়চোখে দেখে নিল কলি আসছে কিনা। শান্তিনিকেতনে এসেই সাইকেল শিখেছে কলি। তাই, ওদের থেকে ধীর গতি।
কলি এসে পড়তেই, অরণ্য গেয়ে উঠলো, 'সে কি আমায় নেবে চিনে..এই নব ফাল্গুনের দিনে'।
সদলবলে এগিয়ে চললো ওরা সোনাঝুরির পথে।
ওদের সাইকেলগুলো রাখা থাকলো নন্দী কাকুর সাইকেল সারাইয়ের দোকানে।
ঋজু চেহারায়, ঝিরি ঝিরি পাতার হিল্লোলে সোনাঝুরি বন, ফাগুনের নবীন আনন্দে মেতে উঠেছে।
তরু দা-অরুণিমা, দিগন্ত-মহুয়া, সহেলী-হেমন্ত যে যার পথে এগিয়ে গেল।
এই সোনাঝুরি বনের, মনের নানা কোণে, ওরা নিজেদেরকে ছড়িয়ে দিল।
অরণ্য আর কলি, খোয়াই বনের অন্য হাট পেরিয়ে এগিয়ে চললো আরো।
কলি, ভালো নাম কৃষ্ণকলি। এম.এস.সি ফার্স্ট ইয়ার এ্যনথ্রোপলজি, আর অরণ্য শিক্ষাভবন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। কলি জানে না কোন সাবজেক্ট।
ওদের নিঃশব্দ এগিয়ে চলার মাঝে, ফাগুনী হওয়ায় শুধু খস খস পাতাদের ঝরে পড়া। দূরে পলাশের ডালে ডালে কুঁড়ির পথ চাওয়া। কিছুদিনের মধ্যেই সেজে উঠবে তারা।
শিমুলের রক্তিম ফুলে পাতায় মনকেমনের বাসন্তিক হাওয়া।
অরণ্যই নৈঃশব্দ ভাঙলো.. 'তোমার হবি কি'..
কথার আগল খুলতেই, আপাত শান্ত চেহারার কলি বলল, 'গান, শোনা আর গাওয়া দুটোই '।
উফফ, কথা বলতে পেরে কলি যেন বাঁচলো। না হলে কতক্ষণ যে এভাবেই শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনী মনের মাঝে বেজে চলতো কে জানে।
'একটা গান গাও না অরণ্য দা'
খুব জোরে হেসে উঠলো অরণ্য.., 'নিশ্চয়ই, গানে আমার কোনো না নেই। বলো, কি শুনতে চাও।'
উত্তরের অপেক্ষা না করেই অরণ্য গেয়ে উঠলো, 'আমার বনে বনে ধরলো মুকুল'।..
গানে গানে, মনে, অনুরণনে কলির হৃদয় জুড়িয়ে গেল। ভীষণ এক ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল ওর সমস্ত সত্ত্বা।
কলির আয়ত চোখের উদাস দৃষ্টি, সোনাঝুরি বন পেরিয়ে সেই শান্ত শালী নদীটির মতো ভালোলাগায় ভালোবাসায় বইতে লাগলো।
অরণ্য কখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, কলি বুঝতে পারেনি। কলির চিবুক স্পর্শ করে অরণ্য বললো, 'তুমি খুব সুন্দর, কলি। তোমার এই সজীব প্রাণবন্ত মনের সঙ্গী করবে আমাকে' ।
অরণ্যর হাতের পাতায় কলির উদাস চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। তার নিমীলিত চোখে নীরব সমর্থন।
সোনাঝুরি বনকে সাক্ষী রেখে, ওদের জীবনে আজ ভালোবাসার উদযাপন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।