আজ মঙ্গলবার, আঠারোই জুন উনিশশো ছিয়ানব্বই সাল। ভোরের দিকে ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছিল একটু, তারপরেই গুমোট শুরু হয়েছে। গরম বলেই এবং আমার ঘরে সিলিং ফ্যান নেই বলেই আমি বিশেষ ঘুমোতে পারি না রাতে। এরকম করেই চলছে, সিলিং ফ্যান ভাড়া পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে ঘরভাড়া বেড়ে যাবে মাসে আরও একশ টাকা, তার ওপরে ফ্যানের ভাড়াও গুণতে হবে। শুনেছি ভাড়ার ফ্যান নাকি নিয়মিত খারাপ হয়ে যায়, তখন দোকানে খবর দাও রে, মিস্তিরি কখন আসবে তার ঠিক ঠিকানা নেই, এই সমস্ত ঝামেলায় আমি যেতে চাই না। সর্বোপরি ফ্যানের দোকান যখন খোলা থাকে তখন তো আমি ঘরেই থাকি না। আমার ঘরে ফিরতে ফিরতে কম করে রাত নটা বেজে যায়। তারপরে রান্না করে খেয়ে বাসন মেজে ঘুমোতে যাই। অপেক্ষা আর একটা নতুন দিনের, যে দিনগুলোয় অবশ্যম্ভাবী ভালো সময় আমার অপেক্ষায় থাকবে বলে আশায় আশায় থাকি। কদিন আগে একটা নতুন জামা উপহার পেয়েছি, সেটা অফিসেই রাখা আছে, ওটা পরে এই বস্তি থেকে বের হলে লোকে কী ভাববে কে জানে!
লোকে কী ভাববে, লোকে কী বলবে, এসবের তোয়াক্কা না করাই উচিৎ, কিন্তু ভাবা আর বলার বাইরে থাকে করা নামক ক্রিয়াপদ। লোকে ভাববে, বলবে এবং ফাইনালি করবে। কী করবে সেটা আমার জানা নেই। এত কম সামাজিক ক্ষমতা এবং আর্থিক সঙ্গতি নিয়ে লোকের ভাবা বলা করার তোয়াক্কা না করাটা মূর্খামি। তাই আমি গুড গার্ল সেজে শাড়ি পরলাম, খুব পুরোনো একটা তাঁতের শাড়ি। পুরোনো কিন্তু যত্নে রাখা, সোনালী সুতোর চওড়া পাড় এবং লাল কালো চেক চেক খোলের শাড়ি। খড়মড়িয়ে সিঙাড়ার মত ফুলে আছে শাড়িটা, কিন্তু তাতে কিচ্ছু এসে যাবে না, অফিসে গিয়েই এটা বদলে আকাশি নীল কটনের ফ্রকের মধ্যে ঢুকে যাব।
আঠারোর-বি বাসে কয়েকজন নিত্যযাত্রীর মুখ চেনা হয়ে গেছে। আজ একটা মেয়ে যেচে কথা বলল। নমিতা। আমার পাশেই বসেছে সে লেডিস সীটে। আমার মতই বয়স, এখনও বিয়ে হয়নি। চাকরি করে সুকিয়াস স্ট্রীটে একটা কারখানায়, সেখানে রবারের গ্লাভস তৈরি হয়, বিশেষ করে সার্জিকাল গ্লাভস। বহুদূরে ওর কাজের জায়গা। আমার ডবল ডিসট্যান্স ওকে রোজ যেতে হয় কাজ করার জন্য। এই সরশুনা থেকে সুকিয়াস স্ট্রীট মেয়েটি দুবার না তিনবার যেন বাস বদল করে করে যেত, এখন এই নতুন বাস হওয়ায় সুবিধে হয়েছে কিছুটা, আর আমি কি না বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড অবধি যেতেই কাতর হয়ে যাচ্ছি। আজ সম্ভবত বৃষ্টি হবে, অন্তত হবার সম্ভাবনা আছে। সেই আশাতেই মেয়েটি সঙ্গে এনেছে নতুন একটা লাল ফোল্ডিং ছাতা, মহেন্দ্রলাল দত্তর দোকান থেকে কেনা। দামি জিনিস, দেড়শ টাকা দাম, বারবার করে বলছে।
মেয়েটি বড্ড বেশি বকবক করছে, একটু পরে মনে হল হয়ত মাথায় একটু ছিট টিট আছে, নইলে সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের সঙ্গে প্রথম আলাপেই কেউ গড়গড়িয়ে এত কথা বলে যায়? টিফিনে রুটি তরকারি নিয়ে যায় রোজ সেটা পর্যন্ত বলতে বাকি রাখে নি। আমার মতই আর কোনও একটা বস্তিতে থাকে আশেপাশে, মা বাবা আছে, ছোট ভাই বোন আছে, ওর ঘর ভাড়াও আমারই মত সাতশো টাকা হবে কম করে, একটার বেশি ঘর থাকলে আরও বেশি হতে বাধ্য, তার ওপরে ভাড়ায় যদি সিলিং ফ্যান নেয়, ... ভাড়ায় হয়ত নেবে না, হয়ত কেনা ফ্যানই আছে, তাহলে তো ইলেকট্রিকের খরচ বাবদ ভাড়া আরও বাড়বে, সব খরচ এই মেয়েটির একার ঘাড়ে, কত আয় করে ও মাসে মাসে? আড়াই হাজার? তিন হাজার? ম্যাক্সিমাম সাড়ে তিন, না না সাড়ে তিন দেবে না ওকে সুকিয়াস স্ট্রীটের সার্জিকাল গ্লাভস ফ্যাক্টরি। এই এত কম আয় সত্ত্বেও দেড়শো টাকার লাল ছাতা কিনে ফেলাটা ওর কাছে চুড়ান্ত বিলাসিতার নিদর্শন, তাই অতবার করে ছাতাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছিল, প্রশংসা আশা করছিল আমার কাছ থেকে। সেরকম বাড়াবাড়ি কিছু প্রশংসা করি নি যদিও, মনে হল মেয়েটি একটু মনে কষ্ট পেয়েছে, যেচে আগ বাড়িয়ে ঐ ছাতাটার প্রসঙ্গ তুলে একটু প্রশংসা করে দেব কিনা ভাবতে ভাবতেই তারাতলা ছাড়িয়ে গেল, আমাদের লেডিস সীটে তখন চারজনের জায়গায় চেপে চেপে পাঁচজন বসেছে, সামনে প্রচুর লেডিস দাঁড়িয়ে, সবাই ওৎ পেতে রয়েছে কখন সীট খালি হবে সেই আশায়। নমিতাও এখন নামবে না, আমিও না, ভেবে নিই কাল বাসে দেখা হলে ওর ছাতাটার অনেক প্রশংসা করব, রং, কাপড়ের কোয়ালিটি, আরও যা যা সম্ভব সব কিছুর।
চক্রবেড়িয়া থেকে হেঁটে দশ মিনিট আমার অফিস। সোনালী পাড় পায়ে জড়িয়ে জড়িয়ে যায়, কী একটা টিভি চ্যানেলের অফিস পড়ে ডান হাতে, প্রচুর প্রাইভেট টিভি চ্যানেল তৈরি হয়েছে গত ক বছরে। দূরদর্শনের আধিপত্য করবার যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে, সবাই «কেবল» লাগাচ্ছে, ঐ নমিতা মেয়েটির ঘরেও হয়ত কেবল আছে, বা হয়ত নেই। এই যে টিভি চ্যানেলের অফিসের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি তারা একটা ইংরিজি সিরিয়াল বানায়, নামটা শুনেছি, A mouthful of sky না কী যেন, রাহুল বোস অ্যাকটিং করে, কোথায় দেখলাম যেন সিরিয়ালের নামটা, টিভি তো দেখি না, কোথায় দেখলাম? মনে করতে পারছি না। অনেক কিছুই মনে করতে পারি না আজকাল। অফিসের কাজের চাপে এসব হচ্ছে হয়ত। সেদিন বড়সাহেবের সেক্রেটারি কাম গার্লফ্রেন্ড আমায় শিখিয়ে দিয়েছিল কী করে কোনও কাগজের এপিঠ ওপিঠ ফোটোকপি করা যায় অটোম্যাটিকালি। শেখালো, তখন পারলামও, কিন্তু তার পরে ভুলে গেছি। ইদানীং মেয়েকে ফোন করা হচ্ছে না, রোজ ভুলে যাই এটা, আজ ফোন করব। দুপুরে পাবো না জানি, সন্ধেবেলায় ফোন করব, সাড়ে ছটা কি সাতটা নাগাদ। সন্ধেবেলায় ফোন করা যাবে না এমন তো কোনও মাথার দিব্যি নেই।
সারাটা দিন অফিসে কেমন একটা থমথমে ভাব। বেনারস থেকে ফিরে আসবার পরে সাশা ক্রমশ একটু গম্ভীর স্বতন্ত্র টাইপ হয়ে গেছে। ইদানীং এক নতুন লোক যিনি জয়েন করেছেন তিনিও বিশেষ কথা টথা বলেন না। ইনি এককালে অধ্যাপক ছিলেন মস্কোর কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা ইন্সটিটিউটে, মেটালার্জির অধ্যাপক। রিটায়ার করে এই কোম্পানীতে জয়েন করেছেন কিছু বেশি রোজগারের আশায়। প্রোফেসর ফ্রালোভ― ইয়ুরি আন্দ্রেইভিচ ফ্রালোভ। ইনি সারাক্ষণ খশখশ করে নানান ফর্মুলা লিখছেন কাগজে, কাটাকুটি করছেন, ফের কীসব ভেবে নিয়ে লিখছেন, তারপরে কয়েক পাতা টেক্সট, ফের ফর্মুলা, ফের টেক্সট, এবং অবশেষে সেটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেন কম্পিউটারে টাইপ করে দাও। অসম্ভব খারাপ হাতের লেখা ওঁর, কিচ্ছু পড়তে পারি না, আন্দাজে টাইপ করি। কোনও দিনও টাইপিং শিখি নি, এক আঙুলে টাইপ করি। দেরি হয়ে গেলে ফ্রালোভ আমার পেছনে এসে দেখতে চান কতদূর এগোলো কাজটা, সেই দেখতে গিয়ে বানানের ভুল ধরা পড়ে যায়, উনি ধৈর্য ধরতে পারেন না, আমায় উঠে যেতে বলেন সীট থেকে, নিজেই শুরু করে দেন টাইপিং, উনিও আমারই মত প্রায়, আমি এক আঙুলে টাইপ করি তো উনি দু আঙুলে টাইপ করেন।
ফ্রালোভ যতক্ষণ টাইপ করবে ততক্ষণ আমি অন্য কিছু করতে পারি, সন্ধে হয়ে গিয়েছে, আমি মেয়েকে ফোন করলাম। সে তখন বাড়িতে একা রয়েছে, ইস্কুলে যায় নি সেদিন। সেকী! ইস্কুলে যাস নি কেন? মেয়ে বলে দেয়, আজ মাসীকে নিয়ে দিদিমা নার্সিং হোম চলে গেল, মাসীকে নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছে।
আমার বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস, নার্সিং হোম কেন?
―মাসীর বেবি হবে তো, সেইজন্য।
কোন নার্সিং হোম গড়গড় করে বলে দেয় মেয়ে।
ফ্রালোভ নিজের হাতের লেখা নিজেই পড়তে পারছে না, আলোর সামনে ধরে এগিয়ে পিছিয়ে নানানরকম করে কাগজটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল, তারপরে নিজেই খশখশিয়ে কেটেকুটে অন্য কীসব লিখল। ফের ভাবতে বসল। তারপরে রণে ভঙ্গ দিয়ে বলল, ওহো তুমি এখনও দাঁড়িয়ে আছো? বোসো বোসো, এটা কালকে ভালো করে লিখব, আজ অফিস ছুটি হতে চলেছে।
ফ্রালোভ আলিপুরে থাকে না, থাকে গোর্কি সদনে, এই অফিস থেকে বেশ কাছে। ফ্রালোভকে ঝপ করে পৌঁছিয়ে দিয়ে গাড়ি ফিরে আসবে অফিসে, নানান সায়েব নানান জায়গায় যাবে, কেউই সরাসরি বাড়ি ফিরতে চায় না। ঝপাঝপ পোশাক বদলে খড়মড়ে শাড়িতে নীচে নেমে ড্রাইভারদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা বলতে পারেন প্রেসিডেন্সী নার্সিং হোমটা কোনদিকে?
―একদম সিধে রাস্তা ম্যাডাম। হাজরার মোড়েই প্রায় বলতে পারেন, ল কলেজটা চেনেন তো? আচ্ছা চিনবার দরকার নেই। এক কাজ করুন, এই রাস্তাটা ধরে সোজা বালিগঞ্জ ফাঁড়ি অবধি চলে যান, মোড়ের মাথায় ডানদিকে ফার্স্ট যে রাস্তাটা ঘুরেছে, ওটায় ঢুকেই বাঁহাতে দুতিনটে বাড়ি ছেড়েই আপনার ঐ নার্সিং হোম। চলুন, পৌঁছে দিয়ে আসছি একখুনি।
―আরে না না, গাড়ি লাগবে না।
ড্রাইভারেরা কথা শুনতে চায় না, সায়েবদের সবার নেমে আসতে আসতে গাড়ি আমায় পৌঁছিয়ে ফিরে আসবে সে গ্যারান্টি তারা দিচ্ছে। দামি গাড়ি নার্সিং হোমের সামনে নামিয়ে দিয়ে গেল। ভিজিটিং আওয়ার প্রায় শেষ হতে চলেছে। কী অদ্ভুত ব্যাপার, আমি যে মাসী হতে চলেছি এটা কেউ আমায় জানালো না পর্যন্ত! এমন কি বাইরে থেকে চেহারা দেখেও কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। অবশ্য বুঝবই বা কেমন করে, লাস্ট দেখেছি তিরিশে জানুয়ারি, সাড়ে চারমাস আগে, তখন দেখে বোঝা সম্ভব ছিল না। তাও, কেউ কিছু বলেনি আমায়, কখন ডেলিভারি হবে? ডাক্তার কে? নর্ম্যাল ডেলিভারি, নাকি সেজারিয়ান সেকশান? এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে নার্সিং হোমের ভেতরে ঢুকে পড়ি।
আকাশটা লাল হয়ে আছে, প্রচণ্ড গুমোট, ভিজিটররা সব বেরিয়ে গেছে মনে হয়, আমায় আটকে দেয় রিসেপশনে। আমি পেশেন্টের নাম বলি, তারা বলে এখনও লেবার শুরু হয় নি, ঠিক আছে যান আপনি দেখা করে আসুন। একতলার ঘর, দেখা করে নিই। লেবার শুরু করবার জন্য ফ্লুইড চলছে, আমি কি চলে যাব? নাকি থাকব? একটু পরে যদি লেবার শুরু হয়ে যায়? যদি রাত বাড়তে থাকে, ডাক্তার কি এখানেই আছে, নাকি তাকে ডেকে আনতে হবে? প্রথম লেবার, আমায় কি আবার ঢুকতে দেবে এরা একবার বেরিয়ে গেলে? ভিজিটরেরা চলে গেছে। আমি পেশেন্টের পায়ের দিকে দেখি একটা মস্ত জানলা, তার পাল্লাগুলো কাঁচের শার্সি দেওয়া। নার্সিংহোমের ভেতরে যে ছোট বাগান সহ খোলা জায়গাটা রয়েছে সেটা জানলার ঠিক বাইরে। একটা অল্টারনেটিভ উপায় রইল পেশেন্টকে দেখতে পাবার। রিসেপশানে গিয়ে জানলাম ডক্টর বোস বেরিয়ে গেছেন, লেবার বাড়লে নার্সিং হোম থেকে ওরা ফোন করবে।
তবু মনের ভেতরে খচ খচ করে, যদি খুব রাতে লেবার বাড়ে? গভীর রাতে কিংবা শেষ রাতে? তখন কোথায় থাকবে আয়া বা নার্সেরা? এখনই যা দেখছি ওরা দূরে একটা জায়গায় গল্পে আড্ডায় মশগুল। বোনের বর কোথায়? আসবে জানিয়েছে একটু পরে, অফিসে কাজের চাপ চলছে, তবে এসে যাবে। আর ডাক্তারবাবু? ওঁর ফোন নম্বরটা আমার দরকার, রিসেপশানে একটু রিকোয়েস্ট করতেই নম্বর দিয়ে দিল। আমি বাইরে খোলা জায়গায় বাগানে দাঁড়িয়ে পায়ের আঙুলের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম পেশেন্টকে দেখা যায় কিনা। যায় না। এক ফুট মত উঁচু হলে ভাল হত। মানে গোটা তিন চার বড় ইট পরপর চাপালেই চলবে। ফুলের কেয়ারির পাশে আড়াআড়ি কিছু ইট দিয়ে লাইন করা আছে। শুকনো ইট। গোটা চার পাঁচ তুলে এনে একটা দাঁড়াবার জায়গা মত বানিয়ে ফেললাম। ইটের ওপরে দাঁড়ালে ঘরের ভেতরটা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে লেবার শুরু হয়েছে। এখন আমার কর্তব্য ডাক্তারবাবুকে একটা ফোন করে রাখা। গেটের দিকে দেখলাম বোনের বর আসছে। বোনের বরকে সঙ্গে নিয়ে টেলিফোন বুথে গিয়ে নম্বর ঘোরাই ডাক্তারের, অনেকক্ষণ ধরে বাজে, শেষে ডাক্তারবাবুই ধরেন, গলাটা কি একটু ভারি ভারি শোনালো? বোনের বরকে দিই কথা বলতে, সে খুব নম্রতার সঙ্গে বলছে, ডাক্তারবাবু যেন রেডি থাকেন আর কিছুক্ষণ পরে আবার ফোন করা হবে। আমি ছিনিয়ে নিই ফোন তার হাত থেকে হুবহু প্রিটি ওম্যান সিনেমায় জুলিয়া রবার্টসের বান্ধবী যেভাবে নামী হোটেলের রিসেপশনিস্টের হাত থেকে ফোন প্রায় কেড়ে নিয়েছিল সেই ভঙ্গিমায়। শুনুন ডক্টর বোস, আপনি চলে আসুন লক্ষ্মীটি, প্লীজ প্লীজ প্লীজ―
―এখনও তো দেরি আছে, সময় লাগবে।
গলাটা একটু জড়ানো জড়ানো শোনালো না কি? শুনেছি উনি নিয়মিত সন্ধেবেলা মদ্যপান করেন। সেরেছে! এখন শুরু করে দিলে তো ঘন্টা দুয়েক পরে ডাক্তার বেহুঁশ হয়ে যাবে!
―না না, তেমন সময় আর কোথায় লাগবে? মানে সেরকম বেশি সময় লাগবে বলে আমার মনে হচ্ছে না, আমারও তো এক্সপিরিয়েন্স আছে, চলে আসুন প্লীজ, এখানে এসে বসবেন, আমি থাকব আপনার সঙ্গে যতক্ষণ ওয়েট করতে হবে।
―ওকে, আই অ্যাম কামিং ইন হাফ অ্যান আওয়ার।
যাক বাবা, বাঁচা গেল। ডাক্তারবাবুকে রাজি করানো গেছে, ইংরিজিতে যেভাবে বললেন তাতে পরিষ্কার যে উনি তখুনি বেরিয়ে পড়বেন। কটা বাজে এখন? সাড়ে আটটা, নাকি নটা?
টিপ টিপ করে ছোটো ছোটো দু এক ফোঁটা জল গায়ে পড়ছে। এর নাম বৃষ্টি নয়। বৃষ্টি আজ সারাটা দিনে পড়েনি, নমিতাও তার নতুন ছাতা ব্যবহার করবার সুযোগ পেল না আজ। কেমন বারবার করে বলছিল, দেড়শো টাকা নিয়েছে, ফিক্সড প্রাইস।
এখন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলে বাগানে দাঁড়ানো যাবে না। ডক্টর বোস এসে পড়লে ওঁর কাছাকাছি থাকতে হবে, যত রাতই হোক না কেন, জাগিয়ে রাখতে হবে ডাক্তারকে।
নতুন শিশু ভূমিষ্ঠ হতে হতে রাত প্রায় শেষ, ভোরই বলা চলে, সাড়ে তিনটে বেজে গেছে। এখন শিশুর রক্ত পরীক্ষা করা হবে, তার ব্লাডগ্রুপ যদি পজিটিভ হয়, তবে তার মায়ের জীবন সংকট হতে পারে। মায়ের রক্তের গ্রুপ নেগেটিভ, জীবনদায়ী ইনজেকশন দরকার হবে মায়ের। কিন্তু এসবে এরা আমায় থাকতে দেবে না, আমায় এখন ফিরতে হবে, সেই সরশুনা পেরিয়ে ষষ্ঠির মোড়। ভোরের বাস এখনও চালু হয় নি, বোনের বরের স্কুটারের পেছনে বসি আমি, প্রায় যানবাহনহীন কলকাতার রাস্তা দিয়ে হুহু করে সে আমায় পৌঁছে দেয় আমার ডেরায়। আর তো ঘুমিয়ে কোনও লাভ নেই। একটু জিরিয়ে, পোশাক বদলে ফের আমায় বেরোতে হবে অফিসে। আশেপাশের ঘর থেকে উঁকি মারে কৌতুহলী মুখ।
―তুমি এই ফিরলে বুঝি? কাল রাতে ফেরো নি? তাই দেখছি ঘর বন্ধ, ভাবছি গেল কোথায়, কোনও বিপদ আপদ...
―নাহ, কোনও বিপদ আপদ নয়।
পায়খানার বাইরে লাইন পড়েছে। এক এক করে সকলে আমায় দেখে যাচ্ছে পায়খানার দিকে যাবার সময়। আজ একটু আগে আগেই যাই বরং অফিসে। বস্তির প্রতিবেশীরা জেনেছে যে কাল সারারাত আমি বস্তির ঘরে ফিরিনি, ভোরের দিকে একজন লোক বাইকে করে আমায় পৌঁছে দিয়ে গেছে। "ভাল" মেয়েরা রাত্রিবেলায় ঘরের বাইরে কাটায় না। এরা আমাকে নিয়ে অবশ্যই কিছু ভেবে রেখেছে। ভেবেছে বলেই তো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করছিল কোথায় ছিলাম আমি জানবার কৌতুহলে। এখন আমার ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা আপাতত জানা নেই।
(চলবে)