সুভাষ বসুর জন্মদিবসের প্রাক্কালে, দেখলাম, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আনন্দ পটবর্ধন দাবী করেছেন, সুভাষ বসুর সঙ্গে আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার আদর্শগত জোট ছিল। হয় সোজাসুজি, নয়তো মাঝে হিটলারকে রেখে। কোনটা, ইংরিজি ভাষার কারণে ঠিক স্পষ্ট নয়। তা, এতদিন আমরা জানতাম, কোনো কেন্দ্রীয় সরকারই সুভাষকে না পারে গিলতে, না পারে ওগরাতে। তারা একদিকে হইচই করে, ঢাকঢোল পিটিয়ে সুভাষের জন্মদিবস পালন করে, অন্যদিকে পুরোনো সোভিয়েতের রাশিয়ার কেজিবি আর্কাইভ খুলে গেলেও সুভাষের অন্তর্ধান নিয়ে অনুসন্ধান করতে সেদিকে উঁকি মেরে দেখারও প্রয়োজন মনে করেনা। আনন্দ পটবর্ধনের ফেসবুক পোস্টে সে ভুল ভেঙে গেল। উনি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন, সুভাষচন্দ্র বসুকে মোদি এবং আরএসএস আসলে খুব ভালবাসে। কারণ, ওই জোট।
উত্তর এবং পশ্চিম ভারতীয় এই 'প্রগতিশীল' হিন্দিভাষীদের নিয়ে সমস্যাটা হচ্ছে, তাঁরা বলেন প্রচুর, ইংরিজি আর হিন্দিতে গুছিয়ে লেখেন বা সিনেমা বানান, আর সারা ভারতের অ্যাকটিভিস্টরা এঁদের মাথায় তুলে নাচে বলে, ভূষিমাল বানিয়েও টের পাননা বস্তুটি কী হয়েছে। রবিশ কুমার কলকাতায় এসে জ্ঞানবাণী দিয়ে যান, বাঙালিদের ভুলটা কী, তাদের আরেসেসের বিরুদ্ধে কীকরে লড়তে হবে, কেউ প্রশ্নই করেনা, গোবলয়ে আপনারা তো হেরে ভূত হয়েছেন, এখন জ্ঞান দেন কোন আক্কেলে? তিস্তা শেতলবাদ এন-আর-সি নিয়ে লিখতে গিয়ে বাঙালি শব্দটা উচ্চারণ করতে ভুলে যান। এরপর এই আনন্দ পটবর্ধনের এই মহাবাণী। এই আনন্দবাবুরই একটি গগন-ফাটানো সিনেমা আছে, যার নাম 'রাম কে নাম'। সে খুবই উন্নতমানের সিনেমা বলে শোনা যায়, কিন্তু আজ পর্যন্ত এমন একটিও লোক পাওয়া যাবেনা, যে, সিনেমাটা হাই না তুলে পুরোটা দেখতে পেরেছে। বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচারে পাড়ার লোকজন জড়ো করে দেখাতে বসলে, গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়, আধ ঘন্টায় হল ফাঁকা হয়ে যাবে। সে অবশ্য খারাপ সিনেমা লোকে বানায়, সেটা কোনো অপরাধ না, কিন্তু সমস্যা হল, এগুলোকে ক্রমাগত 'কী করেছেন গুরু' বলে হাওয়া দিয়ে চললে এঁরা পরের ধাপে গিয়ে সীমানার বহুদূরে গিয়ে যা খুশি বলবেন, এবং তাতেও হাততালি পাবেন।
যা বলব, তাতেই তালিয়া, এই মোডে পৌঁছে না গিয়ে, আনন্দবাবু যদি বাণী দেবার আগে, অন্তত শ্যামাপ্রসাদের ডায়রিটা একটু পড়তেন, বিলক্ষণ টের পেতেন, যে জোট তো দূরস্থান, পদে-পদে সুভাষ এবং তাঁর গুরু চিত্তরঞ্জন মহাসভাকে বাঁশ দিয়ে গেছেন। সুভাষ তো লোক পাঠিয়ে সভা ভন্ডুল করেছেন। হুমকি দিয়েছেন। শ্যামাপ্রসাদ তো বস্তুত এঁদের বিরুদ্ধে যা বলেছেন, তা আজকের 'সেকু-মাকু' বলে গাল দেবার সঙ্গে তুলনীয়। আনন্দবাবু কষ্ট করে যদি পড়তে না পারেন, একটু কষ্ট করে বাংলাটা শিখে নিন, কদিন বাদে আমিই একটা সারসংক্ষেপ করে দেব। পড়লে টের পাবেন, সুভাষ অত সোজা বিষয় নয়। প্রচুর পরস্পরবিরোধিতা সত্ত্বেও, বিশেষ করে বাঙালি মননে সুভাষ যে জায়গায় ঢুকে আছেন, সেটা আপনার কল্পনারও অতীত। ভারতবর্ষের ইতিহাস মানে স্রেফ উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের ইতিহাস নয়। বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস। সুভাষের কেন্দ্রবিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাস। এবং অন্তর্ধানের ইতিহাস। এগুলো বাদ দিলে ভারতবর্ষের ইতিহাসে গোল্লা পেতে হয়। আরেসেসের বিরুদ্ধে লড়াই তো দূর অস্ত।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।