এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নবদিগন্ত - ৩

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ ডিসেম্বর ২০২১ | ৬৪৮ বার পঠিত
  • (তৃতীয় ও শেষ পর্ব )

    প্রথম দুটো বল গুড লেংথে। আউট সুয়িং করাতে চেয়েছিল মনোজ বরাট। দেবু ডান পা বাড়িয়ে মাথা বলের ওপর নিয়ে গিয়ে ব্লক করল। বল ভাঙতে দিল না। তৃতীয় বলটা কম লেংথের। অফস্টাম্পের বাইরে থেকে ভেতরে আসছিল। দেবু ব্যাকফুটে গেল। তার ব্যাট ঝলসে উঠল দেড় দশক আগেকার ঔজ্জ্বল্যের একটা স্কোয়্যার কাটে। কভার পয়েন্ট ফিল্ডার নড়ার সুযোগ পেল না। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে কৌস্তভ ব্যাটতালি দিল। মাঠের বাইরে বসে সজল দাস বলল, ‘খুব রিস্ক নিল দেবু। মিট করতে না পারলে শিওর বোল্ড।’

    পার্থ কিছু উত্তর দিল না। মনে মনে ভাবল, ‘সেটা হলেই বোধহয় তুমি খুশি হতে।’ তারপর ভাবল — মাঠে এরকম কত সজল দাস ঘাপটি মেরে বসে আছে!

    ওভার শেষ হলে পিচের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেবু আর কৌস্তভ কথা বলে নিল। দেবু বলল, ‘এই সাদা বলের শাইন বেশিক্ষণ থাকবে না। আর ছ সাত ওভার। ততক্ষণ সিঙ্গল নিয়ে স্ট্রাইক ঘুরিয়ে যা। বরাটের বলটা দেখে খেল। কুড়ি ওভারের পর স্পিনার ওদের আনতেই হবে। তখন দেখা যাবে।’ কৌস্তভ বাধ্য ছাত্রের মতো মাথা নাড়ল।

    শীতের দুপুরে বিনা টিকিটের ক্রিকেট ম্যাচ দেখার জন্য থেকে থেকে লোক ঢুকতে লাগল। দেখতে দেখতে গ্যালারি ভরে গেল।

    পনের ওভারের পর তিন উইকেটে চৌষট্টি। আস্কিং রেট আট-এর ওপরে। দু একটা ডট বল খেললেই নয়-এর ওপরে চলে যাচ্ছে। আর একটা উইকেট পড়ে গেলেই নবদিগন্তে সূর্য অস্ত যাবার অবস্থা হবে। তবে কুড়ি ওভার খেলে দিতে পারবে মনে হচ্ছে।

    একটা বড় স্পনসর যোগাড় করতে পেরেছে প্রদ্যুৎ ঘোষেরা। আর ডোনরদের টাকা যোগ করলে মোটামুটি খারাপ টাকা উঠবে না। দেবুকে দেওয়ার পরও থাকবে কিছু।

    দেবু ব্যানার্জী শুধু একটা সাদা বল দেখতে পাচ্ছে। টাকা পয়সা অভাব অভিযোগ কিছু নেই স্নায়ুজালের মনপ্রবাহে। সব শূন্য, সব অদৃশ্য। জেগে আছে শুধু বোলারের হাত এবং একটা সাদা বল। আর শূন্যে দোদুল্যমান সুদীর্ঘকালের না পাওয়ার বেদনামাখা উদাসী বেলুন। গৌরীদেবী এতক্ষণে খাওয়া সেরে একটু রোদ্দুরে গিয়ে বসলেন। শীতের বেলা। রোদ পড়ে এসেছে। গৌরীদেবী বসে বসে ভাবতে লাগলেন ..... আলোমুখে না কালোমুখে ..... কিভাবে মাঠ থেকে খেলার শেষে বাড়ি ফিরবে দেবু।

    ড্রিঙ্কস ব্রেক হল আঠারো ওভারের পরে। রান তিন উইকেটে বাহাত্তর। বল পুরোন হয়ে গেছে অনেকটাই। তবে পিচে পড়ে বল এখনও নড়াচড়া করছে, ধীর গতিতে। মনোজ বরাটের ছ ওভার বল করা হয়ে গেছে। বদল করে আর একজন মিডিয়াম পেসার আনা হল। ইরাবান ঘটক। বাংলার ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতি। ব্যাটিংয়েও ঝড়ো চুয়ান্ন রান করেছে।

    ইরাবানের প্রথম বল। বল নড়ল না। বোধহয় ইয়র্ক করাতে চেয়েছিল। নীচু ফুলটস হয়ে গেল। দেবু ছবির মতো স্ট্রেট ড্রাইভ মারল। তীরের মতো বলটা বোলারের পিছনে বাউন্ডারীতে গেল। পরের বলটা শর্ট, লেগ স্টাম্পের ওপর শরীর লক্ষ্য করে। আস্কিং রেট ক্রমশ: বেড়ে যাচ্ছে। দেবু ঠিক করল এবার হিসেব করে ঝুঁকি নিতেই হবে। পেছনের পায়ে গিয়ে পুলশট মারল উঁচু করে। নিখুঁত টাইমিং। বল গিয়ে পড়ল স্কোয়্যার লেগের ওপর দিয়ে মাঠের বাইরে। মাঠ গরম হয়ে গেল ক্রিকেট প্রেমিক দর্শকদের তুমুল চিৎকারে। নিরীহ প্রদর্শনী চ্যারিটি ম্যাচ পেশাদার টুর্নামেন্টের হাড্ডাহাড্ডি উত্তেজক মেজাজে ঢুকে পড়ল সহসা। পরের বলে দেবু ফ্রন্টফুটে অনড্রাইভ মারল। লং অন থেকে ফিল্ডার পড়ি কি মরি ছুটে গিয়ে বাউন্ডারি বাঁচাল। তিন রান হল। স্লিপ পুরো খালি করে দেওয়া হল। একজন ডিপ কভারে আর একজন ডিপ স্কোয়্যার লেগে গিয়ে দাঁড়াল। শেষ বলে চোখ কান বুজে চালাল কৌস্তভ। উঁচু ক্যাচ। লং অফ ফিল্ডার সহজ ক্যাচ ফেলে দিল। ভাগ্য বোধহয় সাহসীর সহায়ক হয়। এরপর স্পিনার আনতেই হল। দেবু ভেবে নিল, ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া এ খেলা জেতার কোন সম্ভাবনা নেই। যতটা বেশি সম্ভব রান এই সময়েই তুলে নিতে হবে। একজন লেগস্পিনার বল করতে এল। বাংলা দলে নিয়মিত।

    পরপর দু বলে স্টেপ আউট করে মিড অনের ওপর দিয়ে দুটো ছয় মারল। বলটা যেখানে গিয়ে পড়ল সেখানেই বসে ছিল কান্তম আর তার মা। কান্তম বলটা কুড়িয়ে মাঠে ছুঁড়ে দিল। দুহাত তুলে শিশুর মতো লাফাতে লাগল।

    পঁয়ত্রিশ ওভারের মাথায় দুজনেই সত্তর পেরিয়ে গেল। রান তিন উইকেটে একশ একাত্তর। মাঠে লড়াইয়ের তাপ বেড়ে উঠেছে। ফিল্ডিং ক্যাপ্টেন সহ-খেলোয়াড়দের সঙ্গে দীর্ঘ শলাপরামর্শে ব্যস্ত থাকতে লাগল।

    কৌস্তভ আউট ... চল্লিশ ওভারের শেষ বলে। অফ স্পিনার আনোয়ার আলিকে তোলার জন্য স্টেপ আউট করল। বল বুঝতে পারে নি। স্পিন না করে সোজা টপস্পিন হয়ে গেল। পুরোপুরি লাইন মিস করল। বোল্ড! মিডল স্টাম্প। চার উইকেটে দুশো এগারো। জিততে গেলে শেষ দশ ওভারে করতে হবে বিরাশি রান। কৌস্তভ অমূল্য একানব্বই রান দিয়ে গেছে। দশ রানের জন্য দুশো রানের পার্টনারশিপ হল না। এরপর নামল সৌম্য সেন। বোলিং অলরাউন্ডার। চালিয়ে খেলে। ভয়ডর কম। ময়দানি পরিভাষায় ‘তাড়ু প্লেয়ার’। সময়বিশেষে এই তাড়ুরা খুব কাজে লেগে যায়, যদি ক্লিক করে যায়।

    পঁয়তাল্লিশ বছরের একটা বুড়ো পোড় খাওয়া বহু সংগ্রামের দাগ বয়ে বেড়ানো একটা ব্যাটসম্যান সৌম্যর উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দেবু সৌম্যকে কোন পরামর্শ দিতে গেল না। সম্পূর্ণভাবে তার ওপরই ছেড়ে দিল তার ব্যাটিং-এর ব্যাপার।

    মনোজ বরাটকে লাগিয়ে দেওয়া হল নতুন ব্যাটসম্যানকে তোলবার জন্য। প্রথম বল। সৌম্য দিগ্বিদিক ভুলে প্রায় মাঝপিচে নেমে গেল স্লগ করার জন্য। ব্যাটস্পীড এত বেশি ছিল যে, বল ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে উইকেটকিপারের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বাউন্ডারির বাইরে পড়ল। দেবু নিজে পঁচানব্বই রানে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবল এই সময়ে সৌম্য আউট হয়ে গেলে সে একার হাতে ম্যাচ বার করতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। দেবু সৌম্যর দিকে এগিয়ে কথা বলবার জন্য। দেবু বলল, ‘তোমাকে চালাতে বারণ করছি না। কিন্তু মনে রেখ ম্যাচটা আমাদের জিততেই হবে।’

    সৌম্য সমঝদারের মতো মাথা নাড়ল। কিন্তু তার উচ্ছ্বলতা থামায় কে। ক্রিজে ফিরে গিয়ে আবার নতুন করে গার্ড নিল। অবাক কান্ড লেগ স্টাম্প গার্ড নিল।

    মনোজ বরাটের বল। মিডল স্টাম্পের ওপর ইয়র্কার। সৌম্য চোখ কান বুজে হাঁকড়াল। ভাগ্যের জোরে বলটা ব্যাটের কানায় লাগল এবং স্লিপ যেখানে দাঁড়ায় সেখান দিয়ে ক্যাচ হয়ে বুলেটের গতিতে থার্ডম্যান বাউন্ডারিতে চলে গেল। মনোজ বরাট প্রবল হতাশায় দুহাতে মাথার চুল ছেঁড়ার ভঙ্গীতে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। দেবু আবার এগিয়ে গেল ওকে কিছু বলার মতো। সৌম্য আবার বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল। পরের বল স্লোয়ার, অফস্টাম্পের বাইরে। ছেড়ে দিলেই হত। কিন্তু সৌম্য ছাড়ার পাত্র নয়। লাফিয়ে উঠে হাতুড়ি চালাল। বল পয়েন্টের ওপর উঠে গিয়ে গাছ থেকে পড়া কমলালেবুর মতো নেমে আসতে লাগল। বাউন্ডারির ধারে দাঁড়ানো ফিল্ডার মরীয়া দৌড়তে লাগল ক্যাচটার নাগাল পাবার জন্য। শেষ মুহূর্তে কোন উপায় না দেখে শরীর ছুঁড়ল। বলটা হাতে প্রায় পেয়েই গিয়েছিল। কিন্তু পেল না। আঙুলে লেগে পিছলে গেল। দুটো রান হল। শেষ বল অফস্টাম্পের বাইরে সোজা বল গুড লেংথে। সৌম্য স্কোয়্যার কাট মারতে গেল। ব্যাটে লাগল না। ওভার শেষ। দেবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মাঠের বাইরে প্রদ্যুৎ ঘোষ উত্তেজনায় হাঁসফাঁস করতে লাগল। ঘনঘন সিগারেট ধরাতে লাগল।

    রান আটকাবার জন্য জলি শেখকে নিয়ে আসা হল। জলি পার্টটাইম বোলার কিন্তু খুব আঁটোসাঁটো বোলিং করে। ওর বলে স্ট্রোক করা মুশ্কিল। দেবু মিড অনের পাশ দিয়ে ঠেলে দু রান নিল। ও এখন সাতানব্বই। পরের বলে জোরাল ড্রাইভ। সোজা ডিপ মিড অফের কাছে গেল। রান হল না। পরের বলে সিঙ্গল নেওয়ার সুযোগ ছিল। দেবু সৌম্যকে হাত তুলে থামিয়ে দিল। পরের বল লেগস্টাম্পের ওপর। স্কোয়্যার লেগ এগিয়ে দাঁড়িয়েছে। দেবু দেখে রেখেছিল। তার পাশ দিয়ে ফ্লিক করল। ফিল্ডার ডাইভ মারল। বলে আঙুল লাগল কিন্তু বলটা থামাতে পারল না। মাটি থেকে উঠে পড়ি মরি করে ছুটল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। দেবু একশ এক! সারা মাঠ হাততালি দিতে লাগল। সজল দাশও সকলের দেখাদেখি তালি বাজাল। এখন আস্কিং রেট সাত দশমিক নয় পাঁচ ..... । মানে, প্রায় আট। শেষ বলে আটকে গেল দেবু। থার্ডম্যানে ঠেলে একটা সিঙ্গল নিতে চেয়েছিল। ব্যাটে লাগল না। কট বিহাইন্ড হতে হতে বেঁচে গেল। প্রদ্যুৎ ঘোষ শিউরে উঠল। ফের একটা সিগারেট ধরাল। কে জানত সাধারণ একটা প্রদর্শনী ম্যাচ এরকম হাড্ডাহাড্ডি উত্তেজক চেহারা নেবে। কান্তম তার মায়ের পাশে বসে দমবন্ধ করে বসে আছে।

    ছেচল্লিশ ওভার চলছে। পাঁচ ওভারে বিয়াল্লিশ রান করতে হবে।

    সৌমেনের স্ট্রাইক। ফিল্ডার সব দূরে ছড়ানো বাউন্ডারি আটকানোর জন্য। শুধু একটা শর্ট কভার দাঁড়িয়েছে। সেটাই কাল হল। উদভ্রান্তচিত্ত সৌমেন ফরোয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলেই সিঙ্গল নেওয়ার জন্য দৌড়তে শুরু করল। শর্ট কভার বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এসে বলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। উইকেটকিপার যখন বেল ফেলছে সৌমেন তখন মাঝ পিচে। দেবু ক্রিজের মধ্যে দাঁড়িয়ে কপাল চাপড়াল। পাঁচ উইকেটে দুশো একান্ন। এখনও বিয়াল্লিশ রান বাকি। হাতে আছে উনত্রিশ বল। পরের ব্যাটসম্যান অনিন্দ্য সোম নবদিগন্তের উইকেটকিপার। ব্যাট খুব খারাপ করে না। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে জবুথবু মেরে গেছে। দেবু ওর অবস্থাটা ভালরকম আন্দাজ করতে পারল। উইকেটে পৌঁছবার আগেই দেবু ওর দিকে এগিয়ে গেল। ওর কাঁধে হাত রেখে বুড়ো ব্যাটসম্যান দেবু ব্যানার্জী বলল, ‘ঘাবড়াবার কিছু নেই। তুমি শুধু একটা সিঙ্গল নেওয়ার চেষ্টা কর।'

    তা অনিন্দ্য সাবলীলভাবেই কাজটা করতে পারল। লংঅফে পুশ করে একটা সিঙ্গল পেল।

    হারজিৎ পুরোটাই এখন দেবুর হাতে। দেবু ভাবল ভীরুর মতো বেঁচে থেকে লাভ কি। ব্যাটিং ক্রিজের বাইরে স্ট্যান্স নিল। পরের বলটা এক পা এগিয়ে গিয়ে মিড অন আর মিড উইকেটের ওপর দিয়ে তুলল। বিশাল ছক্কা। প্রাক্তন ক্রিকেটারদের বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছে। পিকনিক করার মেজাজে খেলা দেখতে ঢুকে এমন মারকাটারি উত্তেজনার খোরাক পাবে মোটেই আশা করেন নি তারা। পরের বলের ড্রাইভটা মাটিতে থাকল। কিন্তু ঠিকমতো মিডলিং না হওয়ায় শাপে বর হল। বল ব্যাটের বাইরের দিকের অংশে লেগে দিগভ্রষ্ট হয়ে কভার আর পয়েন্টের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে গেল। মাঠ উত্তেজনায় কাঁপছে।

    শেষ বলে সিঙ্গল নিতে হল অনিন্দ্যকে ঢাকা দেওয়ার জন্য।

    অনিন্দ্য এখনও টিঁকে আছে। যে চারটে বল খেলতে হয়েছে ভালভাবেই সামলে দিয়েছে।

    এখন দু ওভারে করতে হবে বাইশ।

    হাতে যদিও পাঁচ উইকেট সেটা শুধু সংখ্যার হিসেবে। এরপর যারা আসবে তারা এই চাপ নিতে পারবে না।

    অফ অ্যান্ড মিডলে বল রাখল মনোজ বরাট, বলের ওপর আঙুল ঘুরিয়ে স্লো বাউন্সার। দেবু যাতে ব্যাটে না পায়। দেবু পেছনের পায়ে লেগস্টাম্পের বাইরে সরে গেল। একটু লাফিয়ে উঠে টেনিস শট মারল। একদম টাইমিং হল না। কিন্তু বলটা ধনুকের গতিপথে উঁচু হয়ে ঠিক ফাইন লেগ বাউন্ডারির বাইরে পড়ল। এই ওভারে দুটো দু রান আর শেষ বলে সিঙ্গল সমেত মোট এগারো রান হল।

    ইনিংসের শেষ ওভার করবে ইরাবান ঘটক। ব্যাট করবে দেবপ্রসাদ ব্যানার্জী। জেতার জন্য দরকার এগারো রান। বাংলা একাদশের ক্যাপ্টেন বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনীও দিতে রাজি হল না। সব ফিল্ডার বাউন্ডারি পাহারা দিতে লাগল। শুধু একটা শর্ট মিড উইকেট রইল। মিস টাইমড শর্ট তালুবন্দী করার জন্য। দেবু প্রথম বলে রান পেল না। চালাল এবং ফস্কাল। উইকেট কিপার বল ধরে দু হাত তুলে লাফিয়ে যেতে লাগল চিৎকার করতে করতে। আম্পায়ার নির্বিকার ভঙ্গীতে কোর্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিলেন। পাঁচ বলে এগারো চাই। পরের বলটা আর ফস্কাল না দেবু। এতক্ষণ ধরে বল দেখার পর বারবার বল ফস্কায় না কেউ। একদম ব্যাটের মাঝখানে এবং এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে ছয়।

    প্রদ্যুৎ ঘোষ স্ট্যান্ড থেকে নেমে বাউন্ডারি লাইনের ধারে এসে দাঁড়িয়ে রইল মাঠের দিকে চেয়ে। সে পোড় খাওয়া ক্রীড়া সংগঠক। সে জানে এরপর আর দেবুকে আটকাতে পারবে না ওরা। পারবে না আটকাতে নবদিগন্তকেও। অনেক অপমানের জবাব দেওয়া বাকি ছিল। দেবু তার হয়ে বদলাটা নিল।

    চার বলে পাঁচ রান। দেবু পরের বলে অফস্টাম্পের বাইরে শাফল করে মাথা পয়েন্টের দিকে হেলিয়ে ভয়ঙ্কর স্লগ করল লং অনের ওপর দিয়ে। এখনও তিনটে বল বাকি।

    স্থূলকায় প্রদ্যুৎ ঘোষ খলবল করতে করতে মাঠের মধ্যে ছুটতে আরম্ভ করল অতি দ্রুত দেবুর কাছে পৌঁছে তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরার জন্য।

    পিচের আড়াআড়ি দিশা থেকে কান্তমকেও দৌড়ে আসতে দেখা গেল।

    প্রদ্যুৎ দেবুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দেবু রে ...... তুই শুধু নিজেই জিতলি না, আমার আসল সন্তান নবদিগন্তকেও বাঁচালি।’

    কান্তম ততক্ষণে সেখানে পৌঁছেছে। সে বলল, ‘কাকু..... আমিও একদিন আপনার মতো খেলতে চাই।’

    দেবু টেন্টের দিকে হাঁটতে হাঁটতে প্রদ্যুৎকে বলল, ‘চিন্টু আমার একটা আর্জি আছে। এই ছেলেটাকে যদি নবদিগন্তে রিক্রুট করিস .... ’।

    প্রদ্যুৎ ঘোষ হাঁ করে তাকিয়ে রইল দেবুর মুখের দিকে। বলল, ‘শুধু এইটুকু ...... আর কিছু বলার নেই তোর?’

    — ‘ওর মা খুব দু:খী, আমার মার মতো।’

    প্রদ্যুৎ বলল, ‘তুই কোন চিন্তা করিস নি। কাল সকালেই পৌঁছব আমরা মায়েদের কাছে। আজ রাতটা পোয়াতে দে।’

    হিমেল হাওয়া লুটোপুটি খাচ্ছে শীতের গোধূলিবেলায়।

    (সমাপ্ত )
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:e9c0:7049:4a54:***:*** | ২৫ ডিসেম্বর ২০২১ ০১:৪৩502324
  • অঞ্জন, খেলা নিয়ে আপনার এই লেখাগুলো উপভোগ করছি।  মতি নন্দীর ক্লাসিক গুলোর কথা কিছুটা মনে করায় 
     
    আরও বড় আকারে লিখুন।  
  • রঞ্জন | 2405:201:4011:c808:d886:2745:a387:***:*** | ২৮ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:১৫502358
  • ফ্যান হয়ে গেছি। আগে কেন পড়িনি?
     
    অরণ্যের আবেদনে আমিও সই করলাম।
  • Anjan Banerjee | ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ ১৪:৫৫502361
  • আপনাদের জানাই অজস্র ধন্যবাদ। এরপর আর একটা গল্প দিচ্ছি - স্টপার
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন