কাল গুঁতোগুঁতি করে ট্রেনে উঠে দেখি, জানলার ধারে জিলিপির আসর বসেছে। এক গ্রাম লোক কোলের উপর খবরের কাগজ পেতে তাস পেটাচ্ছে, সঙ্গে চলছে গরম গরম রসে ভেজা জিলিপি। মিষ্টি গন্ধে প্রাণ মাতোয়ারা, ঠেসাঠেসি করে দাঁঁড়িয়ে থাকা সমস্ত মানুষ অবিকল মাছির দৃষ্টিতে লোকগুলোর ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়া রসের দিকে চেয়ে আছে। জিলিপি গ্যাংয়ের অবশ্য তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই, কচরমচর মুখ চলছে, তোড়ে বেরোচ্ছে কথা। সেই কথার বহর কী! চোখে আবছা দেখবেন, রক্তচাপ বেড়ে যাবে। আমার মতো যদি রিসেন্টলি রুট ক্যানাল হয়ে থাকে, সাবধান! কানে আঙুল দিন। দাঁতের ক্যাপ খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
জানলার ধারে বসে আছে যে ঢ্যাঙা লোকটা, তার কোটার জিলিপি শেষ। চিবুকে মাস্ক নামিয়ে দাঁত খুঁটতে খুঁটতে এই মহাশয় ঘোষনা করলেন, "হেলিকপ্টার দুর্ঘটনা না কলা! সব চক্রান্ত! এর পিছনে আসলে আইএসআই আছে!"
এমন জব্বর রহস্যোন্মোচন শুনে আমার স্লিপ ডিস্কে ব্যাথা শুরু হয়ে যাওয়ার কথা, চোয়ালও ঝুলে যেত, কিন্তু আমি ওইসব কানে না নিয়ে জিলিপির ঠোঙার দিকে তাকিয়ে রইলাম। একজন বিশালবপু লোক বাঁটুলমার্কা থাবা সেখানে ঢুকিয়ে কৃষ্ণের চক্র তুলে এনে মুখে পুরেছেন, রস গড়াচ্ছে তার কবজি দিয়ে। লম্বা জিভে রস চেটে নিয়ে তিনি বললেন, "এদের ঠান্ডা করবে অজিত ডোভাল। ও এখন মোসাদকে ট্রেনিং দিতে ইজরায়েল গেছে, নাহলে এমন হয়!"
আমি আড়চোখে দেখলাম, ঠোঙায় আরো দুটো জিলিপি পড়ে আছে। গরম বলে ঠোঙা হাতবদল হচ্ছে, মিয়ানো হলে আমি পাত্তা দিতাম না। আমি মুহুর্তের মধ্যে প্ল্যান ছকে ফেললাম। সায় দিয়ে বললাম, "যা বলেছেন দাদা! মাস্টারমাইন্ড যদি বলে, ওই একজনই আছে। এই জন্যই তো ওই লোকটার উপর সঞ্জয় গান্ধির এত ভরসা ছিল। আমি তো পেপারে পড়লাম, সিআইএ, এমআই সিক্স আর সিনবেত থেকেও ওকে আসতে অনুরোধ জানিয়েছে। আপনি দেখছি সব খবর রাখেন।"
বাঁটুলদা তার যুক্তির পক্ষে একজনকে পেয়ে মহা আনন্দে বললেন, "নিন, জিলিপি খান!"
মন মে লাড্ডু... থুড়ি জিলিপি ফুটা! আমি অনিচ্ছা সহকারে বললাম, 'না না, এসব আবার কেন!"
"আরে নিন নিন। বসুন না! এই লাল্টুদা, একটু চেপে বসো তো। এনাকে বসতে দাও!"
মনে মনে খ্যাকখ্যাক করে হেসে বসে পড়লাম। আমার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছিলেন যে ভদ্রলোক, তিনি দেখি রক্তচক্ষুতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। গত কুড়ি মিনিটে বেচারি বহুবার সবাইকে চেপে বসে যায়গা করতে বলেছেন, সে সব গ্রাহ্য হয়নি। ব্যাগটাও সিটের উপর তুলে দেয়নি কেউই, শেষে সিটের তলায় ঢোকাতে হয়েছে লাথি মেরে। ইদিকে আমি আলবাল বকে অতিরিক্ত সুবিধা পাচ্ছি, খচা স্বাভাবিক। আমি অবশ্য বিশেষ পাত্তা দিলাম না। 'থ্রি বডি প্রবলেম' পড়ার পর আমি বুঝে গেছি, ইউনিভার্স ইজ আ ডার্ক প্লেস। সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট ছাড়া গতি নেই। থেবড়ে বসে পড়লাম বাঁটুলদার সামনে। তার বাড়ানো ঠোঙা থেকে জিলিপি বের করে দেখি, ভালোই গরম আছে। চোখ বুজে কামড় দিতেই ট্রেনের শব্দ কমে এল। মনে হল, সময় ভ্রমণ করছি ট্রেনে বসেই। অন্য একটা দুনিয়ার দ্বার খুলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
মানসচক্ষে দেখলাম, রাজদরবারে বসে আছি। হরেক রকম খাবার সাজানো আছে দস্তরখানে। রাজামশাইর ভ্রুযুগল কুঞ্চিত, সোনালি জড়িদার পোশাক পরে পাশবালিশে ঠেস দিয়ে দাড়িতে হাত বুলোচ্ছেন তিনি। রাজপরিষদ, অমাত্যরা জোড়হাতে অপেক্ষারত। আমি ভয়ে ভয়ে পাশে বসে থাকা কোটাল মশাইকে জিজ্ঞেস করলাম, "ব্যাপারখান কী স্যার!"
কোটাল মশাই তেড়িয়া ভঙ্গিতে বললেন, "কোন ভাষায় কথা বলছ হে ছোকরা? আন্দালুসিয়ায় বিজাতীয় ভাষায় মিনমিন করলে গর্দান যাবে?"
আমি ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে অঙ্গভঙ্গি করে জিজ্ঞেস করতে চাইলাম, "কে পাসো দাদা? সবার মুখ হাঁড়িখান ক্যান? কিসুই তো বুঝতাছি না।"
কোটাল মশাই মন্ত্রবলে আমার মনের ভাব আন্দাজ করে নিয়ে বললেন, "পাচকঠাকুরের উপর হুকুম হয়েছে নতুন এক মিষ্টান্ন তৈরি করার। সেই অপেক্ষায় বসে আছে সবাই। ভালো লাগলে উৎসব হবে, না ভালো লাগলে শুলে চড়ানো হবে।"
আমি ঢোক গিলে বললাম, "কাকে? বাবুর্চিকে?"
"ধুর!" কোটাল মশাই তিরিক্ষে মেজাজে বললেন, "ও ব্যাটা মরলে কী হবে? একজন মরলে কী রাগ যায়? কম করে শ পাঁচেক লোককে মরতে হবে। একগ্রাম ইহুদিকে তৈরি রেখেছি, চোর ছ্যাঁচড়ও আছে। ম্যানেজ হো যায়েগা। তবে কিনা সরকার বাহাদুরের ইচ্ছে বলে কথা! ইচ্ছে হলে আমাকে তোমাকেও শুলে চড়াতে পারেন!"
এমন সময় শোরগোল শুনে দেখি দু'জন লোক বিশাল এক থালা বয়ে নিয়ে আসছে। সে থালা এসে রাজামশাইয়ের সামনে রাখতেই তার চোখ গুলগুল হয়ে উঠল। থালা থেকে একটা মিষ্টি নিয়ে মুখে ঢোকাতেই তাঁর চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠল, দাঁত চলতে লাগল কচমচ। চোখ বন্ধ হল মুহুর্তের জন্য, তারপরেই চোখ খুলে তিনি বিজাতীয় ভাষায় চেঁচিয়ে উঠলেন। বুঝলাম, এ হল 'শুভানাল্লাহ' গোছের উল্লাস। থালা পাস হল হাতে হাতে, আমিও সোনালি রঙের রিং নিয়ে ক্যাবলার মতো বসে রইলাম। এদিকে অন্যদের মুখ চলছে কচমচ। দু মিনিটেই ম্যাজিক। দরবারিদের মুখে হাসি ফুটল, বাবুর্চিরা উদঘোষ করে উঠল। রাজামশাইয়ের প্লেট শেষ হতে না হতেই তিনি হুঁঙ্কার দিয়ে উঠলেন।
"অউর লাও। এক সে কেয়া হোগা বুরবক?"
আমি দুরুদুরু বুকে বললাম, "কী নাম দেওয়া যায় স্যার এই মিষ্টির?"
কথাটা কী করে যেন কানে চলে গেল কোটাল মশাইয়ের। তিনিও বলে উঠলেন, "সত্যিই তো! কী নাম বাবুর্চির এই রেসিপির? কী নাম এই দিব্য ব্যাঞ্জনের?"
এদিকে তখন বাবুর্চির অ্যাসিস্ট্যান্টরা ইয়া বড় থালা নিয়ে ছুটে আসছে। বাবুর্চি নানান কসরত করে মিষ্টি তইয়ার করছেন, সাপ্লাইয়ের কাজ সহকারীদের। রাজামশাইয়ের যা মেজাজ, দেরি হলে গর্দান যাবে। কিন্তু হায়! মেঝেতে পড়ে ছিল সেই নতুন মিষ্টির রস। সেই রসে পা পড়তেই এক ব্যাটার পা গেল পিছলে। ঘাবড়ে গিয়ে আহাম্মক অ্যাসিস্ট্যান্ট মাতৃভাষায় চেঁচিয়ে উঠল, "ইয়া রবি জেলেবিয়া, জেলেবিয়া, জেলেবিয়া!"
রাজামশাইয়ের কানে সে কথা শুনতেই তিনি মহা আনন্দে ঘোষণা করলেন, "জেলেবিয়া। দিজ ইজ জেলেবিয়া আমিগোজ। আই লাভ জেলেবিয়া। মুঝে জেলেবিয়া সে ইশক হ্যায়। তে আমো জেলেবিয়া..."
ওমনি উদঘোষ উঠল দরবারিদের মধ্যে।
"জেলেবিয়া, জেলেবিয়া, জেলেবিয়া..."
একমাত্র কোটাল মশাই ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়লেন। আমি নীচু স্বরে বললাম, "কেয়া হুয়া স্যারজি? এনিথিং রঙ?"
কোটাল বাবাজি নাক টেনে বললেন, "সব শালা বোকার হদ্দ। 'ইয়া রবি জেলেবিয়া' মানে 'খোদা পিছলে গেলাম পিছলে গেলাম!' আর এই ব্যাটারা ভাবল সেটা মিষ্টির নাম..."
আমি খ্যাকখ্যাক করে হেসে পৃথিবীর প্রথম তৈরি জিলিপিতে আরেক কামড় দিতে গিয়ে দেখলাম, আই অ্যাম ব্যাক টু ক্রাইসিস ইরা। বাঁটুলদা হাতে ধরে রাখা তিড়িটাই এক্কার ভঙ্গি করে ফেলছেন, যেন নিজেই অজিত ডোভাল। জিলিপিও শেষ, স্টেশনও আসতে বিশেষ দেরি নেই।
নির্দিষ্ট স্টেশনে নামলাম ঠিকই, কিন্তু জিলিপি আমার মাথা থেকে গেল না। আন্দালুসিয়ার 'ইয়া রবি জেলেবিয়ার'-র কিসসা পড়েছিলাম কোথায় যেন, যদিও প্রথম জিলিপির আত্মপ্রকাশ নিয়ে নানান কাহিনি প্রচলিত হয়েছে। বেনারসের দহি-জলেবী, ভোপালের দুধ-জলেবী আর ইন্দৌরের পোহা-জলেবীর সংস্কৃতি নিয়ে লেখালিখি কম হয়নি ঠিকই, কিন্তু সে সব পিওরলি নস্টালজিক লেখা। কিন্তু ভারতে জিলিপি এল কোত্থেকে? সুদূর স্পেনের আন্দালুসিয়া থেকে? হলেও হতেও পারে। শেষমেশ গুগল বাবার শরনাপন্ন হলাম। খোঁজ মিলল কিছু লেখাপত্তরের। তার বেশ কিছু পাবলিক ডোমেনেই আছে। সোশ্যাল মিডিয়াও কম যায় না। আমার এই হয়েছে এক মুশকিল। উঠল বাই তো কটক যাই! ঘণ্টা দশেকের মধ্যে জিলিপি নিয়ে একটা ক্র্যাশ কোর্স করা হয়ে গেল, যদিও বেশিরভাগ মাথার উপর দিয়েই গেল।
যা বুঝলুম, আন্দালুসিয়ার সঙ্গে সম্ভবত জিলিপির কিছু যোগাযোগ সত্যিই আছে। গল্প আছে আন্দালুসিয়ার এক গ্রামে এক নানবাই মানে রুটির বিক্রেতা থাকত। তার স্পেশালিটি ছিল চক্রাকার এক রুটি বানানোতে। তার বউ কিন্তু মাঝেমধ্যেই রান্নায় গোলমাল করে ফেলত। একবার সে একটা রুটি ভুল করে অন্য রান্নার জন্য তৈরি করে রাখা রসের পাত্রে ফেলে দেয়। আর যায় কোথায়, নানবাই আর্তনাদ করে ওঠে।
"হদি জল্লা বিয়া!"
অর্থাৎ সব নষ্ট হইয়া গেল। 'জল্লাবিয়া' আর 'জেলেবিয়া' সংক্রান্ত দু'টো গল্পই আন্দালুসিয়া থেকে এসেছে, এটা ঠিক সংয়োগ বলে মনে হচ্ছে না। কেউ কেউ আবার বলে হারুন অল রাশিদের দরবারে নিয়ুক্ত সংগীতশিল্পী অব্দুর্হেমান নাফা-জিরিয়াবই প্রথম জিলিপি রান্না করেছিলেন। এই ভদ্রলোক একটু ঠোঁটকাটা ছিলেন, ফলে তাকে স্যাটাস্যাট 'অ্যান্টি ন্যাশনাল' বলে নির্বাসন দেওয়া হয়। অব্দুর্হেমান স্যার বেরিয়ে পড়েন দেশ ছেড়ে, ঘুরতে ঘুরতে হাজির হন টিউনিসিয়ার বেদুইনদের কাছে। উদ্দেশ্য, তাদের গান বাজনা শিখবেন। সে সব শিখেছিলেন কি না জানি না, কিন্তু রান্না শিখেছিলেন ভালোই। সেখানে থাকার দরুন বেদুইন বাবুর্চিদের কাছে নতুম একটি রেসিপির হদিস পাওয়া যায়, সেই রেসিপি পার্সোনালাইজ করে ভদ্দরলোক আন্দালুসিয়া চলে আসেন। তৈরি হয়ে জেলেবিয়া। বাকিটা ইতিহাস।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আন্দালুসিয়া ইস ইন দ্য গেম ফ্রম বিগিনিং। হয়তো মুর সাম্রাজ্যের সূচনার পর সেখানে জিলিপির কাছাকাছি কিছু আবিষ্কার হয়েছিল। কিন্তু তার সূত্রপাত কোথায় হয়েছিল কে জানে? তবে আজ থেকে এগারোশো-বারোশো বছর আগে বাগদাদে যে এক ধরনের আটার বস্তু রাঁধা হত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
ইবন-অল-রুমি তো কবিতায় লিখে গিয়েছেন এই মিষ্টান্নের কথা। সেই কবিতা পড়ে অবশ্য প্রথমে সন্দেহ করা হয়েছিল, রুমি অ্যালকেমিস্টদের গোপন রহস্য ফাঁস করে গেছেন। কবিতায় বর্ণনা করা আছে আটার ঘন রূপোলি রসকে ভালো করে রাঁধার কথা, তাতে জিনিসটা একটা সোনালি রঙ পায়। তারপর মধুতে ফেললেই এই সোনালি রঙের রূপো খাঁটি সোনা হয়ে বেরিয়ে আসে। কয়েক দশক আগে বাগদাদের খাদ্য সংস্কৃতি সম্বন্ধে নতুন নতুন তথ্য জানা যায়, জিলিপিও ছিল সেই তালিকায়। নাহলে সোনা-রূপোর এই রহস্য ফাঁসও হত না।
আশ্চর্যের কথা হল, ভারতে এই মিষ্টির চলন আগে থেকে থাকার সম্ভাবনা থাকলেও তেমন কোনও নথিপত্র পাওয়া যায়নি। মুহাম্মদ বিন হাসান অল বাগদাদি হাজার বছর আগের শ্রেষ্ঠ রসুইকরদের একজন ছিলেন, তার লেখা 'কিতাব অল তবিহ' গ্রন্থে 'জুলুবিয়া'-র পাঁচপুরাণ লেখা আছে। পারস্য, ভারতবর্ষ, রোম... কোথায় না পাওয়া যায় এই জিনিস! সরকারি আর্কাইভে নথিভুক্ত না হলে কী হবে, জিনিসখান হয়তো আরো আগে থেকেই স্পেশাল ডেলিকেশি বলে রাঁধা হত। ষোড়শ আর সপ্তদশ শতাব্দীতে নানান জায়গায় জিলিপি নিয়ে লেখালিখি হয়েছে। খুঁজেপেতে দেখলাম, সংস্কৃতে 'গুণ্যগুণবোধিনী' আর 'ভোজনকূতুহলম'-এ একদম জিলিপির চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে দেওয়া হয়েছে, উইথ অল পসিবল রেসিপিস ইনক্লুডেড। সঞ্জীব কপুর থেকে সুদীপ্তার রান্নাঘর...সব আছে। ১৮৮৬ সাল থেকে হবসন-জবসন ডিকশিনারিতেও জিলিপি ঢুকে গেছে। সেখানে বলা হয়েছে আরব দেশেই কোথাও এই মিষ্টির সূচনা হয়েছে।
সে যাকগে! ইতিহাস চুলোয় যাক। জিলিপি নিয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতাও খুব কম নয়। তাই বলে আমি জিলিপি পাগল তা নয়! মোদ্দা কথা হল সারা ভারতে, বিশেষ করে সেন্ট্রাল নর্দার্ন বেল্টে জিলিপির মাহাত্ম্য এতটাই বেড়েছে যে ছোটবড় কোনও শহর-গ্রাম-মফস্বলে গেলেও জিলিপির একটা ফেমাস দোকান বেরিয়ে পড়ে। পুরোনো দিল্লির খাঁটি ঘিয়ে ভাজা জিলিপি খেয়ে প্রথমে মুগ্ধ হয়েছিলাম, হলদ্বানীর ভুখখন হালয়াইয়ের জিলিপির জবাব নেই। অলমোড়ার লোটিয়া জলেবী করা হয় 'লোটা'-র সাহায্য নিয়ে তো বেনারস সহ বহু জায়গায় দহি-জলেবির রমরমা। অল্মোড়ায় কেশবদত্ত জোশীর জিলিপি নিলে এই দই পাওয়া যাবে স্পেশাল গ্লাসে। ইন্দৌরে আবার পোহা-জলেবী না হলে কারো মন ভরে না। রাহত ইন্দৌরি জলেবী না খেলে শায়েরি লিখতে পারতেন না, ইন্দৌরে থাকলে জাকির খান স্ট্যান্ড কমেডির স্কিট লিখতে পোহা-জলেবী নিয়ে বসে। ভোপালের দুধ জলেবী খেলে নাকি আবার নানান রোগব্যাধি সেরে যায়, সেখানকার কবিরাজদের সঙ্গে জিলিপির দোকানের পার্টনারশিপ চলে। কোথাও লাল, কোথাও সোনালি, কোথাও কমলা, কোথাও ক্রম ইয়েল্লো। কত রঙ তার। চাশনীও তৈরি হয় বিভিন্নভাবে। আমার এক বন্ধুর মিষ্টির দোকান, তারা আবার চাশনী করে চিনির সঙ্গে কমলালেবুর খোসা দিয়ে। হিমাচলের এক জায়গায় দেখেছি, জিলিপি তৈরির উপকরণ শুদ্ধ করে ঠাকুরঘরে তুলে রাখা হয়, বজরঙ্গবলির সঙ্গে সেই 'করছি কড়াই'-কেও ধুপ দেখানো হয়, প্রসাদ চড়ানো হয়। জিলিপি খাওয়া নিয়েও কিসসা-কাহিনি কম নেই।
মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সের সময় দিন কুড়ি পর সমতলে নেমেছি, দেখি নিম ক্যাম্পাসের রাঁধুনিরা স্পেশাল জিলিপি করেছে। বিশ্বাস করবেন না, এই দৃশ্য দেখে তিন সপ্তাহ ধরে ট্রেক করা ছেলেমেয়েরা কেঁদে ভাসিয়ে দিল, আমার এক বন্ধু ক্যাম্পাসের ডিরেক্টর কর্নেল অজয় সিং কৌঠিয়ালকে জড়িয়ে ধরে চোখের জল ফেলতে লাগল। সে এক দৃশ্য!আরো আছে। জোধপুরের মেহরানগড় ফোর্টে জিলিপি খাব বলে সেবার আমরা উইদাউট টিকিটে ভরতপুর থেকে ট্রেনে উঠে পড়েছিলাম, সে অন্য গল্প। অন্যদিন হবে। গল্পের শেষ নেই। জলেব, জলেবা আর ইমারতির কথাও পেন্ডিং রইল।
মোদ্দা কথা, জিলিপি খুব ভালো জিনিস। দেখতে যতটা প্যাঁচালো, ভিতরে ততোটাই সরল। নরম, মিঠে, সতেজ। তাকে খেতেও হয় যত্ন করে, আদর করে। যদি খেয়াল করে দেখেন, দেখবেন প্রতিবার জিলিপিতে কামড় দিয়ে অন্যরকম ফিলিং হয়। মাইরি বলছি।
তাই বলছি, জিলিপি খান। শীতটা এতদিনে একটু পড়েছে। শীতের আদুরে রোদে পিঠ এলিয়ে প্রাণ ভরে জিলিপি খান। এক একটা জিলিপি তুলে তার সৌন্দর্য অ্যাপ্রিশিয়েট করুন, তার ইতিহাস নিয়ে ভাবুন। দেখবেন, দিব্যি সময় ভ্রমণ করে আসছেন ফিরিতেই। একসময় দেখবেন, জিলিপি শেষ। চিন্তা করবেন না, স্যাটাস্যাট আরেক প্লেট অর্ডার করে দিন। শীত বলে কথা! শীত অ্যান্ড জলেবী-- ডেডলি কম্বিনেশন। পতা নহি- কল হো না হো!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।