দুর্গাপুজো নিয়ে কিছু লিখিনি। ইপ্সিতা যথারীতি অনুরোধ পাঠিয়েছিল, তবুও লিখিনি। সময় পাইনি বা অন্য অজুহাত দেবার কথা ওঠে না - লিখতে স্রেফ ইচ্ছেটাই হয়নি। দুর্গাপুজোর ক'টা দিন নিজেকে নিরন্তর বিচ্ছিন্ন মনে হতে থাকে। লিখিনি, কারণ এখন আর পুজো বিষয়ে আমার কোনো অবস্থান নেই - পক্ষে বা বিপক্ষে। দুর্গাপুজো আমার পুজো নয়, আমার উৎসবও নয়। বাঙালির "শ্রেষ্ঠ" উৎসবও নয়, সে নিয়ে আর তর্কে যাবার অর্থ দেখি না - তবে এটা একটা কার্নিভালের মত। তার বিরোধিতা করাটাও এখন সময় নষ্ট মনে হয় - যখন আমার পিতার লাশের বুকের ওপর উঠে রাষ্ট্র নৃত্য করছে, আমার ভাইয়ের শরীরের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনের কনভয়, আমার রাজ্যের অধিকাংশ শহর চলে যাচ্ছে মিলিটারি শাসনের ভয়াবহতায়, মাথার ওপর শকুনের মত উড়ে বেড়াচ্ছে এন আর সি, সি এ এ, এন পি আর এর আশঙ্কা, তখন দুর্গাপুজো ভাল না খারাপ ভাবার মত সময় নষ্টের বিলাসিতা করি না।
আগে লিখতাম। তখনো কি এইসব ছিল না? খুবই ছিল। তবুও লিখেছি - সিঁদুর খেলা নিয়ে, বাজীপুজো নিয়ে, পুজোর অর্থনীতি নিয়ে, দূষণ নিয়ে। সেসবও পয়েন্টলেস ছিল - তা যে একেবারে বুঝতাম না, তেমনও নয় - তবুও লিখেছি। তাহলে আজ আর লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না কেন?
একটা প্রধান কারণ সম্ভবতঃ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। বিষয়টা আমার অজান্তেই ছিল, "আমাদের" উৎসবে "ওদের" প্রতি অবিচার। এই "ওদের" বলতে যেমন ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং বিশেষ করে মুসলিমরা ছিলেন, তেমনি সামাজিক "পশ্চাৎপদ" - বিশেষ করে দলিতেরা, অচ্ছুতেরা ছিলেন। উল্টোদিকে "আমরা" অর্থাৎ হিন্দু উচ্চবর্ণ ভদ্রলোকেরা। এই বাইনারি ধারণা থেকেই পুজোর পক্ষে বা বিপক্ষে যাওয়া। পক্ষে মানে "আমাদের" পক্ষে, বিপক্ষে মানে "আমাদের" বিপক্ষে। অথচ কাগজে-কলমে, সরকারিভাবে আমি হিন্দুত্ব ত্যাগ করেছি অনেকদিন আগেই। আমার পাসপোর্টে রাষ্ট্র লিখে দিয়েছে "অ্যাথেইস্ট" (যদিও আমি সেটাও কি না, সন্দেহ আছে), আমার বিভিন্ন ডকুমেন্টে, এমন কি আমার পুত্রের স্কুল রেজিস্ট্রারেও "নো রিলিজিয়ন" লেখা - সমাজমাধ্যমে বা অন্যত্র আমি নিজেকে ধর্মহীন বলেই দাবী করে থাকি - তবু যেন হঠাৎই প্রত্যয় হল যে লেখার সময়ে আমি সেই "আমাদের" ই প্রতিনিধিত্ব করি - "আমাদের" বিপক্ষে লিখি। অথচ এই "আমাদের" কোনো অস্তিত্ব আমি রাখতে চাইনি বহুদিন। কিন্তু রেফারেন্স ফ্রেমের মায়া ত্যাগ করাও অত সহজ নয়।
কিন্তু এখন, যখন লিখতে বসেও আমার অবস্থান আর ভদ্রলোকীয় নেই, হিন্দু তো নেইই, তখন আর এইসব হিন্দু কার্নিভালের ভালোমন্দ নিয়ে আমি কেনই বা লিখব, ভেবে উঠতে পারিনা। আমি একজন অহিন্দু হয়ে হিন্দুদের ভালোমন্দ নিয়ে ভাবিত হলে সেটা আমার কানেই সাম্প্রদায়িক শোনাবে। শোনাচ্ছে। তোমাদের ভালোমন্দ জ্ঞান দেবার আমি কে হে! থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বর হিসাবে তোমাদের উৎসবের শুভেচ্ছা রইল।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।