এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • উমাদেবীর আমন্ত্রণ, শৈশবের চোখে দেখা আমাদের বাড়ির দুর্গাপূজা

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১১ অক্টোবর ২০২১ | ১০৯৯ বার পঠিত
  • “অধিবাসের কুলো মাথায় আমাদের পুত্রবধূ নেহা-র প্রবেশ যখন মন্দিরে দেবীর আমন্ত্রণের জন্য পূজারীর দ্বারা, উপলব্ধি করতে পারছিলাম - আমার দাদুভাই, ঠাম্মা, বাবা, মা, কাকুমণির আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে ওনাদের বংশের নববধূর উপর অকাতরে।” - লিখছেন সুপ্রিয় দেবরায়



    “ইয়া দেবী সর্বভুতেষু, মাতৃরূপেন সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ”

    ( হে মা মহামায়া আমাদের সকলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অসুর শক্তির বিনাশ করে, শুভ শক্তির সঞ্চার করুন )

    মহালয়ার ভোরে ঘুম জড়ানো চোখে কানে আসতো জনপ্রিয় 'চণ্ডীপাঠ' এর সূচনার শ্লোক। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের আকর্ষণীয় ব্যারিটোন কণ্ঠ শাস্ত্রীয় গায়কদের সুরের মধ্য দিয়ে বিদ্ধ করে আবৃত্তি শুরু - দেবী দুর্গা এবং অসুর রাজা মহিষাসুরের মধ্যে মহাকাব্য যুদ্ধের বর্ণনা। এইভাবেই শুরু হতো আমার শৈশবের দুর্গাপূজা।

    বড় হয়ে জানতে পারি, ৮৯ মিনিটের দীর্ঘ অডিও অনুষ্টানটি প্রথম ১৯৩১ সালে একটি লাইভ-পারফরম্যান্স হিসাবে শুরু হয়েছিল, একটি অর্কেস্ট্রা এবং কোরাসের সাথে। ১৯৬৬ সাল থেকে, AIR মহালয়াতে প্রতিবছর শো-এর প্রাক-রেকর্ডকৃত সংস্করণ সম্প্রচার করে আসছে।

    বাণী কুমারের স্ক্রিপ্টেড এবং পঙ্কজ মল্লিকের সুরে সংগীত, অনুষ্ঠানটি ভক্তিমূলক গান, ধ্রুপদী সঙ্গীত, অ্যাকোস্টিক মেলোড্রামা, ঐতিহ্যবাহী যন্ত্র এবং সংস্কৃত শ্লোকের সংমিশ্রণ।

    ৯০ বছর পরও, এই সংস্করণটিই পুরনো এবং নতুন, ধর্মীয়, আধ্যাত্মিক বা অন্যভাবে দর্শকদের মোহিত করতে সক্ষম হয়েছে।

    শৈশব আমার কেটেছে আমাদের বসতবাড়ি বারাসাতে দাদুভাইয়ের সাথে। আজও মনে পড়ে দাদুভাই বলতেন, “ওঠ, পলাশ। মহালয়া শুরু হয়ে গেছে।” খানিকক্ষণ বিছানায় ঘুম ঘুম চোখে গায়ে কাঁথা মুড়ে শুনতাম এক হৃদয়স্পর্শী গলার অসাধারণ বর্ণনায় দেবীর আহ্বান । রেডিও থেকে ভেসে আসতে থাকত তাঁর স্বর্গীয় কণ্ঠধ্বনি। মাঝে মাঝে গান হত। ছোটবেলায় সেরকম বোঝার মতো মানসিকতা তৈরী হয়নি বলে সব কিছু বুঝতাম না, কিন্তু মহালয়ার আনন্দে মেতে ওঠার উৎসাহ ছিল অনেক। কারণ এটা জানতাম মহালয়া মানে আর ক’দিন পরেই দুর্গা পূজা।

    বাঙালিদের জন্য, দুর্গাপূজা উদযাপন মূলত "মহালয়া" থেকে শুরু হয়। শুধু বাঙালিরা নয়, অন্যরাও যারা তাদের জন্য নবরাত্রি চলাকালীন মা দুর্গার পূজা করেন তাদের জন্যও এই দিনটি দেবীপক্ষের সূচনা করে। মহালয়া থেকে শুরু হয়ে সপ্তাহব্যাপী উদযাপন, চলবে দশেরা বা দশমী পর্যন্ত।

    প্রায় দেড়'ঘন্টা ধরে চলতো "মহালয়া"-র সম্প্রচার। এরপর দাদুভাই আমাদের বাড়ির পুকুরে বুকজলে দাঁড়িয়ে তর্পণ করতেন। তর্পণ কী জিজ্ঞেস করতে দাদুভাই বলতেন, মহালয়ার দিন প্রাতঃ সকালে হিন্দুরা গঙ্গাতে পূর্বপুরুষদের কাছে তর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানান তাঁদের উত্তরসূরীদের আশীর্বাদ করার জন্য। আর দাদুভাইয়ের কাছে আমাদের বাড়ির পুকুরই ছিল যেন গঙ্গা।

    দাদুভাই আরও বলতেন, একটি বিশ্বাস আছে যে পূর্বপুরুষদের অসন্তুষ্ট আত্মারা পৃথিবী থেকে মুক্ত হয় না যদি তাদের তর্পণ দেওয়া না হয়।

    দাদুভাই আমাকে বোঝাতেন, দেবীপক্ষ শুরু হয় মহালয়ার দিন। মহালয়ার প্রাতঃসকালে তর্পণের মাধ্যমে দেবীপক্ষকে আমন্ত্রণ জানানো হয় আমাদের শুভদিনের জন্য। দেবী দুর্গামা ওনার যাত্রা কৈলাশ থেকে শুরু করেন মহালয়ার দিন ওনার পরিবারকে নিয়ে পিতৃগৃহ পৃথিবীর উদ্দেশে।

    যদিও দাদুভাইয়ের কথা তখন পরিষ্কার করে বোধগম্য হতো না, কিন্তু দেখতে এবং শুনতে ভালো লাগতো দাদুভাইয়ের তর্পণ সংস্কৃত মন্ত্রের উচ্চারণের সাথে পুকুরের বুকজলে দাঁড়িয়ে।

    পরে বড় হয়ে জানতে পারি, আশ্বিন মাসে কৃষ্ণ পক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনায় যে অমাবস্যাকে আমরা মহালয়া হিসেবে চিহ্নিত করি সেই দিনটি পিতৃ পূজা ও মাতৃ পূজার সন্ধিক্ষণ। অসুর শক্তির বিনাশে অনুভূত হওয়া এক মহাশক্তির নাম দেবী দুর্গা। দেবীর আরাধনা সূচিত হয় মহালয়ার মাধ্যমে। মহালয়ার ষষ্ঠদিন ষষ্ঠী পূজার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা হয় ৫ দিনব্যাপী দুর্গোৎসবের।

    প্রতিবছর মা আসেন মর্ত্যে, ভক্তের পুজো নিয়ে আবার ফিরেও যান কৈলাসে। মায়ের আগমনে সন্তানের আনন্দ। মায়ের কাছে সন্তানের অধিকার সমান। কারণ, তিনি বিশ্ব জননী। সনাতন ধর্মশাস্ত্রে দুর্গা নামটির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, উ-কার বিঘ্ননাশক, রেফ রোগনাশক, গ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয় শত্রুনাশক। তার মানেই দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয় শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই শ্রীদুর্গা। অন্যদিকে শ্রীশ্রী চণ্ডী অনুসারে এই দেবীই দুর্গা ‘নিঃশেষদেবগণশক্তি সমূহমূর্ত্যাঃ’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি। তিনি আমাদের দুর্গতি থেকে ত্রাণ করেন বলেই দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা।

    আমার শৈশবে মহালয়া দিয়ে দুর্গাপুজোর আনন্দপর্ব শুরু হত, সমাপ্তি হতো দেবী বিসর্জনে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম শরতের সাদা মেঘের ভেলা আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, যেন মায়ের আসার আগমনী বার্তা নিয়ে এসেছে। শিউলিতলায় ঝরে পড়া শিউলি ফুলের সুবাস চারিদিকে। আমাদের পুকুরের ঘাটের দু'পাশে ছিল শিউলি গাছ, আঙিনা ভরে থাকতো সাদা শিউলিফুলে - সাথে মাদকতা ভরা মিষ্টি গন্ধ। হয়ে যেত মন শরীর সজীব তাজা শিউলিফুলের আঘ্রাণে। চারিদিকে আকাশে বাতাসে বেজে উঠেছে ঢাকের বাদ্দি, সঙ্গে শঙ্খধ্বনি উলুধ্বনি কাঁসর ঘন্টা।

    আমাদের বসতবাড়ি বারাসাতের বাড়িতে দুর্গাপূজা আমার দাদুভাই শুরু করেন ১৯৫৪ সালে, দুর্গামায়ের স্বপ্নাদেশে। আজও পালিত হয় এই দুর্গাপূজা আমাদের বাড়িতে। ঘটনাচক্রে আমার মায়ের-ও প্রবেশ ঘটে আমাদের বংশে ১৯৫৪ সালে, আমার দাদুভাইয়ের বড় পুত্রবধূ হিসেবে।

    শৈশব থেকেই সবার মুখে শুনে এসেছি, বারাসাতে আমাদের বাড়ির পূজা 'দারোগাবাড়ি'-র দুর্গাপূজা নামেই পরিচিত। আমাদের ন'পাড়ায় আরো চারটে দুর্গাপূজা হতো তখন - 'চন্ডী বাড়ি', 'কবিরাজ বাড়ি', 'কিরীটি বাড়ি' আর 'সারদা বাড়ি'। এরমধ্যে 'চন্ডি বাড়ি'-র পূজা সবচেয়ে পুরানো, যতদূর মনে আছে ১৯৫২ সালে শুরু হয়েছিল। এখন 'সারদা বাড়ি'-র পূজা আর হয় না।

    শৈশবে দেখতাম সাধারণত দুর্গাপূজা শুরুর ৩/৪ দিন আগে, ঠাম্মার সাথে আমার মা কাকিমারা আর পিসিরা মিলে নারকেল নারু, সন্দেশ, মোদক, তিলের নারু, চিড়ের এবং মুড়ির মোয়া তৈরি করতেন। সকালে প্রথমে স্নান করে, একটি নতুন শাড়ি পরে তাঁরা দুর্গা পূজার জন্য নির্দিষ্ট চুলা এবং বাসনগুলিতে এই জিনিসগুলি প্রস্তুত করতেন। সেই সময় আমাদের সেই ঘরে ঢুকতে দেওয়া হতো না।

    সে সময় আমাদের বাসায় বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাদের সব আত্মীয়-স্বজনরা আসতেন। একটা মহামিলন নিজেদের মধ্যে, যেটা আজও বজায় আছে।

    ষষ্ঠীতে নবপত্রিকা প্রতিস্থাপন করে সূচনা করা হতো দুর্গাপূজার। ষষ্ঠীর দিনে, কল্পারম্ভের অনুষ্ঠানটি ভোরবেলা করা হয়। দুর্গা মণ্ডপের এক কোণে ঘট (জল ভরা তামার পাত্র) স্থাপন করে সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি মেনে সঠিকভাবে পূজা করার জন্য সংকল্প নেওয়া হয়। সন্ধ্যায় পালন করা হয় বেল গাছের নীচে বোধন, এরপর অধিবাস এবং আমন্ত্রণ। পান, দূর্বা, সিন্দুর, আলতা, শিলা, ধান, কলার ছড়া, ইত্যাদির সহিত সজ্জিত কুলো দিয়ে স্বাগত জানানো হয় দুর্গা মাকে - ঢাকের বাদ্দি সঙ্গে শঙ্খ ধ্বনি উলুধ্বনি কাঁসর ঘন্টার মধ্যে। শৈশবে দেখতাম আমার ঠাম্মা মাথায় কুলো নিয়ে পূজা মণ্ডপে যেতেন দুর্গামায়ের অধিবাস এবং আমন্ত্রণ সম্পূর্ণ করার জন্য আমাদের পারিবারিক পূজারীর দ্বারা। এই ঐতিহ্যবাহী উত্তরাধিকারটি ঠাম্মার থেকে আমার মায়ের কাছে আসে, তারপর কাকিমারা এবং এখন আমাদের প্রজন্মের স্ত্রীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

    এই বছর আমার এবং রূপালীর পুত্রবধূ নেহা-কে দেওয়া হয় এই দায়িত্ব এবং সম্মান। আমার চোখে দেখা চারপুরুষের ঐতিহ্যবাহী হস্তান্তর অফ লিগাসি। অধিবাসের কুলো মাথায় আমাদের পুত্রবধূ নেহা-র প্রবেশ যখন মন্দিরে দেবীর আমন্ত্রণের জন্য পূজারীর দ্বারা, উপলব্ধি করতে পারছিলাম - আমার দাদুভাই, ঠাম্মা, বাবা, মা, কাকুমণির আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে ওনাদের বংশের নববধূর উপর অকাতরে।

    মহাসপ্তমীর দিনে মা দুর্গার সামনে সবুজ নারকেল ও আমের পাতা দিয়ে কলস স্থাপন করা হয়, একটি লাল সুতো দ্বারা চারদিকে বেষ্টিত করে। বলা হয় এটিকে কলস স্থাপন। পূজা শ্রী গণেশের সাথে শুরু হয়, কলা বউ ( লাল পার শাড়ি দিয়ে আবদ্ধ আটটি গাছের সাথে একটি কলার গাছ ) শ্রী গণেশের ডান পাশে স্থাপন করা হয়।

    আমাদের বাড়ির দুর্গামায়ের বামদিকে থাকেন গণেশ ঠাকুর। ছোটবেলার প্রচন্ড কৌতূহল, গণেশ ঠাকুর আর সবার বাড়িতে দুর্গামায়ের ডানদিকে। তাহলে আমাদের বাড়িতে কেন দুর্গামায়ের বামদিকে গণেশ ঠাকুর? কৌতূহলের নিরসণ করেন দাদুভাই। আমাদের বংশের পুরোহিত হারাধন ঠাকুরমশাইয়ের উপদেশে এটা পালন করা হয়েছে প্রথম থেকে। ওনার মতে পূজা শুরু হয় গণেশ ঠাকুরকে দিয়ে, এবং পূজা শুরু করা উচিৎ পূজারীর ডানদিক থেকে। পরে আমার কুট্টিপিসি জানায় আর একটি কারণ, গণেশঠাকুর হচ্ছেন দুর্গামায়ের সবচেয়ে লাডলা - আর সাধারণত মায়েরা তাঁদের সন্তানদের বাম কাঁখে নেন।

    আরো একটি প্রশ্ন থাকতো মনে, গণেশ ঠাকুরের কলাবৌকে কেন রাখা হয় কার্তিক ঠাকুরের ডানপাশে। অন্য সব জায়গায় দেখতে পাই কলাবৌ আছেন গণেশঠাকুরের পাশে, কারণ গণেশ ঠাকুর আছেন দুর্গামায়ের ডানপাশে। কিন্তু আমাদের গণেশ ঠাকুর তো দুর্গামায়ের বামপাশে। তাহলে কলাবৌ কেন নেই গণেশ ঠাকুরের পাশে ? দাদুভাইয়ের উত্তর, বৌ সবসময় পুরুষের ডানপাশে থাকেন। পরে বড় হয়ে বুঝতে পারি, যে কোনো শুভ কাজে - নববধূর আগমন অথবা গৃহপ্রবেশ - যে কোনো অনুষ্ঠানে সবসময় পুরুষের ডান পাশে থাকেন বধূ, আর যে কোনো শুভ কাজ শুরু হয় বধূর ডান পাঁ দিয়ে - সেটা গৃহপ্রবেশ হোক অথবা নববধূর হোক প্রথম পদার্পণ শ্বশুরবাড়িতে।

    দুর্গা পূজা উদযাপনের অষ্টম দিনকে দুর্গাষ্টমী বা দুর্গা অষ্টমী নামে পরিচিত এবং হিন্দু ধর্ম অনুসারে এটি অন্যতম শুভ দিন। এটি হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুসারে আশ্বিন মাসের উজ্জ্বল চন্দ্র পাক্ষিক অষ্টমী তিথিতে পড়ে। দুর্গা পূজার সময় যে অষ্টশক্তি পূজা করা হয় তা হল ব্রাহ্মণী, মহেশ্বরী, কৌমারী, বৈষ্ণবী, বরাহী, নরসিংহী, ইন্দ্রাণী এবং চামুণ্ডা। অষ্টমীতে হয় সন্ধি পূজার আরাধনা একশত আট প্রদীপ হাতে।

    দাদুভাই বলতেন ছোটদের উপোস করে অঞ্জলি না দিলেও কোনো অসুবিধা নেই, শুদ্ধ এবং ভক্তিভরে পুষ্পাঞ্জলি দেবে। শৈশবে সপ্তমী অথবা নবমীতে আমরা ছোটরা পুষ্পাঞ্জলি উপোস না করে দিলেও, অষ্টমীর দিন কিন্তু আমরা সবাই উপোস করেই অঞ্জলি দিতাম।

    প্রথম পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র :

    ওঁ জয়ন্তি, মঙ্গলা, কালি, ভদ্রকালি, কপালিনি।
    দূর্গা, শিবা, ক্ষমা, ধাত্রি, স্বাহা, স্বধা, নমোহস্তু তে॥
    এষ সচন্দন গন্ধ পুস্প বিল্ব পত্রাঞ্জলিঃ, ওঁ হ্রীং দুর্গায়ৈ নমঃ॥

    দ্বিতীয় পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র :

    ওঁ মহিসাগ্নি, মহামায়ে, চামুন্ডে, মুন্ডমালিনি।
    আয়ুরারোগ্য বিজয়ং দেহি দেবি নমোহস্তু তে॥
    এষ সচন্দন গন্ধ পুস্প বিল্ব পত্রাঞ্জলিঃ, ওঁ হ্রীং দুর্গায়ৈ নমঃ॥

    তৃতীয় পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র :

    ওঁ সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে, শিবে, সর্বার্থসাধিকে।
    শরণ্যে, ত্রামবকে গৌরী, নারায়নি নমোহস্তু তে॥
    সৃষ্টিস্থিতি বিনাশানাং, শক্তিভূতে, সনাতনি।
    গুণাশ্রয়ে, গুণময়ে, নারায়নি, নমোহস্তু তে॥
    শরণাগত দীনার্ত পরিত্রাণ পরায়ণে।
    সর্বস্যার্তিহরে, দেবি, নারায়নি, নমোহস্তু তে॥

    মনে আছে রোজ দুপুরে অনিল ঠাকুরের রান্না করা খিঁচুড়ি খাওয়া বেগুনভাজা পাঁচমিশালি তরকারি অথবা লাবড়ার সাথে পায়েস সহযোগে পিছনের বারান্দায় ঢালাও আসন পেতে। পাত পড়তো প্রায় দেড়শোজনের, দু-বেলা। আমার বাবা ছিলেন 'বাজার সরকার', রান্নার তত্ত্বাবধানে। তারপর আমাদের লুকোচুরি খেলা পিছনের ধানক্ষেতে। দাদাভাই, দিদিভাই, দিদি, রত্না-দি, বুলু-দি, দুলু, ঝুমঝুম, পল্লব এবং আরো অনেকে মিলে।

    ঘুম-না হওয়া চোখে রোজ কাক-ভোরে যেতাম ফুল তুলতে দিদি, রত্না-দির সাথে। ঘুম তখন আমাদের চোখ থেকে যেত উবে, চাইতাম না এই-কটাদিনের আনন্দ-মুহূর্ত এক চিমটে হারাতে।

    নবমী পূজা শুরু হয় মহা স্নান এবং এর পর ষোড়শোপচার পূজা দিয়ে।হিন্দু পুরাণ অনুসারে, মহা নবমীতে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে পরাজিত করেছিলেন। মহানবমীর দিন, দেবী দুর্গা মহিষ রাক্ষসের উপর চূড়ান্ত আক্রমণ করেছিলেন এবং পরের দিন সকালে তাকে হত্যা করতে সফল হন যা বিজয়া দশমী বা দশেরা হিসাবে পালিত হয়। এই কারণেই এই দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুরমর্দিনী হিসাবে সম্মানিত হন।

    এই দিনটি কেবল দেবী দুর্গার আরাধনা নয়, মন্দের উপর ভালোর জয়। এটা বিশ্বাস করা হয় যে যারা এই উৎসব এবং বিশেষ করে দুর্গা অষ্টমী, মহা নবমী এবং বিজয়াদশমী উদযাপন করে তাদের অন্য কোন উৎসব পালন করার প্রয়োজন নেই।

    নবমীর দিন থেকে, আমাদের মুখগুলি বিষণ্ণ হয়ে উঠত কারণ আমরা বুঝতে পারতাম যে পূজা আর একদিন পর শেষ হতে চলেছে এবং সমস্ত আত্মীয়স্বজন একে একে চলে যেতে শুরু করবেন।

    যদিও দাদাভাই বড় আমার থেকে সাত-আট বছরের, কিন্তু ছিল একটা আলাদা টান দাদা এবং ভাইয়ের দুজনের মধ্যে। দশমীর সকালে দুর্গামায়ের বিসর্জন অনুষ্ঠানের পর, দই-চিড়ে মাখা খেতে খেতে অপেক্ষা করতাম ওই মুহূর্তের জন্য, যখন দেবে দাদাভাই ইশারা আর আমি তুলে আনবো নারকেল-ডাব ঘট থেকে পূজারীর অনুপস্থিতিতে। বকাও খেতাম মা-পিসিদের থেকে। দাদাভাইকেও বকতেন পিসিমণি - আমাকে এই দুষ্টু-বুদ্ধি দেওয়াতে।

    কিন্তু এইগুলো ছিল আমাদের শৈশবের সবচেয়ে আনন্দ-ঘন মুহূর্ত।

    আমাদের বাড়ির দুর্গাপূজা হয় বৈষ্ণব মতে। দশমীর দিন হয় নিরামিষ ভঙ্গ পুকুরের মাছ দিয়ে। সকাল থেকেই জেলেরা ধরতো মাছ জাল ফেলে, আর আমরা সব পুকুরের পারে দাঁড়িয়ে দেখতাম জেলেদের মাছধরা উৎসব।

    দশমীতে মায়ের বিদায় দুঃখ মনে, সাথে মায়ের বরণ আর সিঁদুর খেলা।

    দশমীর সন্ধ্যায়, কাকারা ভাঙ্গ তৈরি করতেন। আমিও সেই বয়সে খেয়েছি কয়েক চুমুক।

    দশমীর সন্ধ্যায় সবাই যখন খুব ব্যাস্ত, কেউ ভাঙ তৈরী করতে, কেউ ব্যাস্ত প্রতিমা বিসর্জনের। কাকিমা-পিসিরা সবাই ব্যাস্ত দূর্গা-মাকে বরণ করতে অথবা সিঁদুর খেলতে, আমি লোকজন ভরা সারা বাড়ি তন্ন-তন্ন করে খুঁজে বেড়াতাম মাকে। যখন প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছি সবাইকে জিঞ্জেস করতে করতে, দেখতে পেতাম মাকে পিছনের বারান্দায় সিঁড়ির কোনে আছে লুকিয়ে অন্ধকারে, মুখ সিঁদুরে রাঙা - একদম যেন আমাদের মণ্ডপের দুর্গামায়ের মতো। দৌঁড়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম মায়ের কোলে ঠোঁট ফুলিয়ে।

    ছোটোকাকুর ডান হাতে কেরোসিনের বোতল, বাঁ হাতে কাঠের ডান্ডার উপর কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে মশাল - মুখ থেকে কেরোসিন ছুড়ে জ্বালাতেন মশাল, তারসাথে ধুনুচি নাচ, ঢাকের বাদ্দি কাঁসর ঘন্টা - সঙ্গে সমবেত চিৎকার 'আসছে বছর আবার হবে'; সে সময় আমাদের বয়সে দেখার মতো ছিল এই দৃশ্য।

    এরপর শান্তির জল, গুরুজনদের প্রণাম, কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ।

    এই ভাবেই শেষ হতো আমাদের বাড়ির দুর্গাপূজা। এখনো চলেছে সেই রীতি - শুধু নেই আমাদের দাদুভাই, ঠাম্মা, বাবা, মা, কাকুমণি,শীতল কাকু-কাকী, বড়পিসা, মেজপিসা, রাঙা পিসা-পিসি, দাদাভাই এবং আরো অনেকে। কিন্তু আছে ওনাদের প্রাণভরা ভালোবাসা আর আশীর্বাদ আমাদের সকলের মাথার উপর।

    "প্রার্থনা মা তোমার কাছে রাখো সবাইকে সুস্থ।
    প্রার্থনা মা তোমার কাছে বর্ষিত হোক শান্তিধারায় এই মর্ত্যলোক।"
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • reeta bandyopadhyay | ২৭ অক্টোবর ২০২১ ১৪:০৯500273
  • লেখাটা পড়ে খুব ভালো লাগলো কিন্তু  এত ভাল লেখার মাঝে বানান ভুল  একটু দৃষ্টিকটু,  নারু, দূর্গা...আর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র'র গলা একেবারেই ব্যারিটোন ছিলনা।
  • Supriya Debroy | ২৭ অক্টোবর ২০২১ ১৫:২৫500274
  • ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। 'নাড়ু' হওয়া  উচিৎ ছিল। তবে 'দুর্গা' আমার মনে হয় সবজায়গায় লেখা হয়েছে।   
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন