আজকে সোশাল মিডিয়ায় একটা কান্ড দেখে চমকে গেলাম। একটি ছেলে, বৃত্তে মোটামুটিভাবে পরিচিত, একটি রাজনৈতিক প্রচারাভিযানেও যার সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখেছি, তার বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এসেছে। এক নয়, একাধিক। এবং রীতিমতো হিংসাত্মক নিগ্রহ।
ছেলেটির নাম করছিনা, কারণ, এসব ব্যাপারে আমার অবস্থান খুব স্পষ্ট। একদিকে যেমন অভিযোগ আসা মাত্রই কেউই অপরাধী হয়ে যায়না, ফলত সে নিয়ে খাপ বসানো আমি অনুচিত বোধ করি। কিন্তু একই সঙ্গে, আমার ব্যক্তিগত কিছু বিচারবুদ্ধিও কাজ করে। অভিযোগের ধরণ, এবং গুরুত্ব অনুযায়ী, আমি সিদ্ধান্ত নিই, অভিযুক্তের সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে কাজ করব কিনা। একাধিক নিগ্রহের অভিযোগের ক্ষেত্রে অভিযুক্তটি জালি জানা থাকায়, বা মনে হবার যথেষ্ট কারণ থাকায়, তাদের সঙ্গে আর কাজ করিনি। যদিও ঢাকঢোল পিটিয়ে খাপ-টাপ বসাইনি । এটা শুধু যৌন নিগ্রহে নয়, চুরি, রাহাজানি, খুন-জখম সবেতেই প্রযোজ্য। এক মহিলা আমার একটি স্ক্রিনশট জালি করেছিলেন, বা জাল স্ক্রিনশট প্রচার করেছিলেন, তাতে অবশ্য ভয়াবহ খারাপ কিছু লেখা ছিলনা, কিন্তু তাতেও আমি ওটা ইচ্ছাকৃত জালিয়াতি এবং অথবা কুৎসারটনা মনে করেছিলাম। তাঁর সঙ্গেও আমি ভবিষ্যতে কাজ করবনা। তা, এই ক্ষেত্রেও অভিযোগগুলি জলজ্যান্ত, হিংসাত্মক, এবং একাধিক, সবই একসঙ্গে মিথ্যে হবার সম্ভাবনা খুবই কম। ফলে ছেলেটির সঙ্গে আমি কাজ করতামনা। ব্যক্তিগতভাবে।
কিন্তু যেটায় আমি স্তম্ভিত হলাম, সেটা হল, ছেলেটির সঙ্গে এতদিন যাঁরা কাজকর্ম করেছেন, এখন এসব প্রকাশ্যে আসার পর, পড়ে-টড়ে দেখলাম, তাঁরা আগে এসবের কিছুটা, এমনকি অনেকে প্রায় পুরোটাই জানতেন। এবং জেনে চক্ষু বুজে ছিলেন। শুধু চক্ষু বুজে থাকাই নয়, একসঙ্গে কাজকর্ম করেছেন। ছবিটবি তুলেছেন। আহ্লাদি কথোকথনে গেছেন। এঁরা আনপড় তা কিন্তু নয়, বরং সামাজিক ন্যায় নিয়ে চতুর্দিকে নানা কথা বলতেই দেখা যায়। এবং মুড়ি-মুড়কির মতো এনেবলার, মিসোজিনিস্ট এইসব বাক্যবন্ধ চারদিকে বিতরণ করেন। এঁরা কোথায় কোন টিম হান্ট একটি বক্তৃতায় কী রসিকতা করে নারীজাতির কী সর্বনাশ করে দিয়েছেন, কোথায় কোন ভট্টাচার্যের বিবৃতি ঠিক কত ইঞ্চি বিষাক্ত পৌরুষ আর কত ফুট এনেবলিং, এই নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে থাকেন, সাধারণ মতবিরোধে শেষ কথা বলার ভঙ্গীতে "ম্যানস্প্লেনিং" ট্যাগ মেরে দেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঘটনা নিজের বৃত্তে এলে, সকলেই ধামাচাপা দিতে শশব্যস্ত। "আমার ছোট্টো ভাই, ভুল ধরিতে নাই"।
এটা শকিং, কারণ, এই আমার-ভাই-ভালো-ওর-ভাই-বদ, এটা তো কোনো অবস্থান হতেই পারেনা। যদি মনে হয়, এই সমস্ত বিষয়ে অনেক ধোঁয়াশার স্তর থাকতে পারে, ব্যক্তিগত অবস্থান নেওয়াও এত সোজা না, তো সেটা বলুন। সেটাও একটা অবস্থান। সে নিয়ে আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার। যদি অন্য কিছু মনে হয়, তা নিয়েও তর্কবিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু পরিবর্তে যা হয়, সেটা হল বিষাক্ত গোষ্ঠীবদ্ধতা। ভিন্নমত সেখানে বিষবৎ। গোষ্ঠীর সেখানে সাতখুন মাপ, ভিন্নমত যেকোনো মূল্যে বধ্য। দেখবেন, যেকোনো সুস্থ বিতর্ককেই স্ট্যাম্প মেরে বন্ধ করে দিতে এই মোড দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। পশুপ্রেমের যাথার্থ থেকে শুরু করে যৌন-নিগ্রহের আইন জেন্ডার নিউট্রাল হওয়া উচিত কিনা, এসব যেকোনো বেড়া-টপকানো আলোচনাই, "এ তো মিসোজিনিস্ট ( কিংবা রেসিস্ট, কিংবা অন্য কিছু, কী সেটা প্রসঙ্গের উপর নির্ভর করছে)" বলে বন্ধ করে দেবার একটা প্রবণতা এখন সর্বগ্রাসী। তার চেয়েও বড় কথা হল, এসব মেয়েদের পক্ষেও একেবারেই যাচ্ছেনা। বাইরের লোককে পান থেকে চুন খসলেই এমনকি না খসলেও বানিয়ে-বানিয়ে চোখা-চোখা টার্মিনোলজি নিয়ে গাল দেব, কিন্তু "অমুক আমার ঘরের লোক" বলে সত্যিকারের অপরাধেও চোখ বুজে থাকব, ইন্টিগ্রিটিহীন এই বুলিসর্বস্বতা যেকোনো বাণীকেই নিছক হাস্যরসে পরিণত করে। এক্ষেত্রেও তাইই হয়েছে এবং হচ্ছে। হয়েছে বললাম, কারণ এ ধরণের জিনিস আগেও কানে বা নজরে এসেছে। এগুলো এনেবলিং না হলে এনেবলিং কী?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।