এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • প্রসঙ্গঃ আফগানিস্থান

    sayantan saha লেখকের গ্রাহক হোন
    ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৪৭৮ বার পঠিত
  • আফগানিস্থানের নাম বললেই আজকে আমাদের মনে হয় একটা এমন দেশ যেখানে খুন জখম সন্ত্রাস এইসব লেগেই রয়েছে, আমাদের বাঙ্গালীদের কাছে কিন্তু এই দেশটার আরো একটা পরিচয় আছে কাবুলিওয়ালার দেশ। এই মুহূর্তে যেসব ছবি এবং ভিডিও আমরা রোজ সংবাদমাধ্যমে দেখছি সেইটা খুব একটা আনন্দদায়ক নয়, সেই দেশের সাধারণ মানুষ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে নিজেদের প্রাণ রক্ষা করতে চাইছে এইটা নিশ্চয়ই ভালো থাকার দিকে ইঙ্গিত করে না। এইলেখায় আমরা মূলত আফগানিস্থানে রাষ্ট্রক্ষমতার যে পরিবর্তন সেই নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করবো, এবং সেই সাথে বর্তমান সময়কে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো।

    আফগানিস্থান স্বাধীনতা পেয়েছিলো ১৯২১ সালে। ভূরাজনীতিতে সেই সময়টা এমনিতেই খুব অস্থির একটা সময়, সবে সবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, ইংরেজরা প্রথম মহাযুদ্ধে জয়লাভ করলেও আফগানদের কাছে এই যুদ্ধে পরাজিত হয় (তৃতীয় ব্রিটিশ আফগান যুদ্ধ ১৯১৯-২০) এবং এই যুদ্ধের পরবর্তী কালে যার নাম সামনে আসে তিনি গাজী আমানুল্লাহ খান। আফগানভূমিতে এই সময় রাজতন্ত্র চালু থাকলেও গাজী আমানুল্লাহ খান বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সামাজিক সংস্কার করেছিলেন। প্রচলিত রীতিনীতির বাইরে এসে তিনি ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুলের ব্যবস্থা করেছিলেন এবং তাঁর আমলেই নারীদের বোরখা হিজাব এইসব ড্রেসকোড থেকে বহু কাঙ্ক্ষিত মুক্তি এসেছিলো প্রথমবারের মত, নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন চেষ্টা করেছিলেন, মনে করা হয় তাঁর স্ত্রী সোরাইয়া তারজির প্রভাব এই মানুষটির উপরে ভীষণ ছিলো। তাঁর সময়কালে এশিয়া এবং ইউরোপের সাথে নতুন করে বাণিজ্য শুরু হয় আফগানিস্থানের। আমানুল্লাহ খান আফগানিস্থানকে আধুনিক করতে চেয়েছিলেন এবং এর ফলে সেইদেশের তৎকালীন কট্টরপন্থী যে সমাজ ছিলো তাঁদের বিরোধিতার সামনেও তাঁকে বারবার পড়তে হয়েছে।

    ১৯২৭-২৮ এইসময়কাল জুড়ে আফগানিস্থানে হাবিবুল্লাহ কালাকানি নামক তাজিক নেতার উত্থান ঘটে এবং আফগানিস্থানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এইসময় গাজী আমানুল্লাহ খান ব্রিটিশ ভারত হয়ে ইউরোপে পলায়ন করতে বাধ্য হন এবং দীর্ঘ ৩০ বছর ইউরোপে কাটিয়ে ইটালিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। উল্টোদিকে কালাকানির এই উত্থান সেইটাও বেশীদিন স্থায়ী হয় নি, তিনি অল্পদিনের মধ্যেই পরাজিত হন নাদির শাহ্‌র কাছে। এই নাদির শাহ্‌র জন্ম ভারতবর্ষেই দেরাদুন শহরে (যদিও সেই সময় ভারত স্বাধীনতা লাভ করে নি অর্থাৎ ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার কথা বলা হচ্ছে) আফগান রয়্যাল ডাইন্যাস্টির মুসাইবান শাখায়। নাদির শাহ্‌ ১৯৩৩ সালে গুলিবিদ্ধ হন তাঁর নিজের দেশ(আফগানিস্থানে) একটি স্কুলের সমাবর্তন উৎসবে যোগ দিতে গিয়ে। নাদির শাহ্‌র মৃত্যুর পর আফগানিস্থানের ক্ষমতায় বসেন তাঁর পুত্র জাহির শাহ্‌।

    ১৯৩৪ সালে আমেরিকা নতুন দেশ হিসেবে আফগানিস্থানকে স্বীকৃতি প্রদান করলে আফগানিস্থান সারা বিশ্বের মানচিত্রে একটা আলাদা দেশ হিসেবে মান্যতা পেতে শুরু করে। ১৯৩০ এর দশকে আফগানিস্থানের অক্ষশক্তি অর্থাৎ(জার্মানি ইটালি এবং জাপানের) মৈত্রীভাব থাকলেও, আফাগানিস্থান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোনো পক্ষেই যোগদান করা থেকে বিরত রেখেছিলো নিজেদের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময় যে ভয়ঙ্কর মন্দা গ্রাস করেছিলো পৃথিবীকে যার প্রভাব এসে পড়েছিলো আফগান মুলুকেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়কালে আফগানিস্থানের বিভিন্ন যে ছোটো ছোটো জনগোষ্ঠী তারা নিজেদের ভেতর জীবনের মৌলিক চাহিদা মেটাতে অসফল হয়ে নিজেরা নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা হাঙ্গামায় লিপ্ত হতে শুরু করে বারবার। জাহির শাহ্‌ এমতাবস্থায় উপলব্ধি করেন যে দেশের আধুনিকীকরণ করাটা এই মুহূর্তে ভীষণ দরকারি, এবং এই কাজ জাতে সঠিক ভাবে হতে পারে সেই জন্য তিনি সরকারি ভাবে বিদেশী উপদেষ্টা নিয়োগ করেছিলেন যারা এই আধুনিকীকরণের প্রক্রিয়াটাকে ঠিকঠাক এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাঁর আমলেই আফগানিস্থানে প্রথম আধুনিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিলো। জহির শাহ প্রথম পূর্ব তুর্কিস্তান প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকারী উইঘুর ও কিরগিজ মুসলিমদেরকে অস্ত্র ও আফগান যোদ্ধা পাঠিয়ে সাহায্য করেছিলেন। কাশগরের যুদ্ধ ও ইয়ারকান্দের যুদ্ধে আফগান, উইঘুর ও কিরগিজ বাহিনী চীনাদের কাছে পরাজিত হওয়ায় প্রজাতন্ত্র রক্ষা করা সম্ভব হয়নি।

    ১৯৫৩ সালে আফগানিস্থানের প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় আসেন মহম্মদ দাউদ খান। দাউদ খান এই মুসাইবান পরিবারেই একজন সদস্য (রাজা জাহির শাহ্‌র চাচাত ভাই) ছিলেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি কান্দাহার প্রদেশের গভর্নর ছিলেন, তিনি কাবুল আর্মি কর্প‌সের কমান্ডার হিসেবে কাজ করেছ্বেন, এছাড়াও তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব সামলেছেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ফ্রান্সে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। প্রথম জীবনে দাউদ খান কমিউনিস্ট আদর্শ দ্বারা কিছুটা অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং তার বৈদেশিক নীতি ছিল সোভিয়েতমুখী। ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত ইস্যুকে কেন্দ্র করে তিনি ডুরান্ড লাইনে সেনা প্রেরণ করেন যদিও তা সফল হয়নি, এবং পাকিস্থানের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে রাজা জাহির শাহ্‌ ১৯৬৩ সালে দাউদ খানকে একপ্রকার পদত্যাদ করতে বাধ্য করেন এবং তাঁর পদত্যাগের মধ্যে দিয়ে এই সংকটের মীমাংসা হয় এবং দুদেশের আবার সীমান্ত খুলে দেয়া হয়।

    ১৯৬৪ সালে জহির শাহ নতুন সংবিধান চালু করেন। এসময় প্রথমবারের মত মন্ত্রীসভা থেকে রাজপরিবারের সকল সদস্যদের বাইরে রাখা হয়। এই নতুন সংবিধান কার্যকর করার প্রক্রিয়া হিসেবে সেখানকার মানুষকে Freedom of Thought (চিন্তার স্বাধীনতা), Expression (স্বাধীনভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করার স্বাধীনতা) এবং Assembly (সমাবেশ) করার যে মৌলিক অধিকার সেই অধিকার ফিরিয়ে দেবার একটা উদ্যোগ লক্ষ্য করা যেতে থাকে। এই সংস্কারগুলি কার্যকর হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আফগানিস্থানের ভেতর নতুন উদ্যমে ব্যবসা বানিজ্য গড়ে ওঠা শুরু হয় এবং আফগানিস্থানের রাজধানী কাবুল শহরকে কেন্দ্র করে যেন একটা নতুন জেগে ওঠার সূত্রপাত ঘটতে শুরু করে। জাহির শাহ্‌ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন আধুনিকভাবে আফগানিস্থানকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা হতে যাচ্ছে অর্থ এবং আফগানিস্থানের ইকনোমিতে প্রাণ সঞ্চার করতে হলে এবং দেশের অবস্থা ভালো করতে হলে তাকে সারা দুনিয়ার অর্থনীতির সাথে যুক্ত হতেই হবে এবং বিদেশীদের জন্য দেশের বাজারে বিনিয়োগের দরজা খুলে না দিলে এই অচলাবস্থা কাটবে না, কিন্তু এই কাজটা বলাটা যতখানি সহজ আফগানিস্থানের মতন দেশে এই কাজ সঠিক ভাবে করে ফেলাটা মোটেও সহজ কাজ ছিলো না।

    এই সময়টা ঐতিহাসিক ভাবেও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়, এইসময় সারাবিশ্ব প্রস্তুত হচ্ছিলো COLD WAR নামক এক দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের জন্য। এইসময় সারা পৃথিবী দুটো মেরুতে বিভক্ত হতে শুরু করে, একদল যোগ দেয় সোভিয়েত রাশিয়া সমর্থিত কমিউনিস্ট শিবিরে আরেকদল মার্কিনীদের উন্নত ক্যাপিটালিসম শিবিরে। আফগানিস্থান দেশ হিসেবে কোনো একটা শিবিরে যোগ না দিয়ে দুইদেশের সাথেই মোটামুটি সুসম্পর্ক বজায় রেখে দেশের উন্নতির কথা চিন্তা করেছিলেন এবং এই প্রকল্পে কিছুটা সফলও হয়েছিলেন। সেইসময় আফগানিস্থান জুড়ে ওয়াশিংটন এবং মস্কোর সহায়তায় নতুন নতুন ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরী হয়েছিলো যার মধ্যে নতুন নতুন ব্রীজ টানেল রাস্তাঘাট এইসব তো ছিলোই, এর পাশাপাশি নতুন নতুন ফ্যাক্টরি তৈরী হওয়া শুরু হয়। এবং মজার ব্যাপারটা হচ্ছে এই, যে কাবুল এতদিন ধরে শুধুই নিজের দেশের উৎপাদিত পন্যের উপর নির্ভর করে ব্যবসা করতো সেই কাবুলেরই বাজারেই তখন বিক্রি হচ্ছে ইতালির পাস্তা ডাচ সাইকেল আমেরিকান জিন্স।

    এইসবকিছু যেমন একদিকে চলছিলো অন্যদিকে আমেরিকা আর আফগানিস্থানের মধ্যে একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় যার ফলে এইবার থেকে আফগান ছাত্রছাত্রীরা আমেরিকায় গিয়ে পড়াশুনার সুযোগ পাবে (এই জিনিসটা এই কারণে দুই দেশের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ, কারণে শিক্ষা আনে চেতনা আর চেতনা তৈরি করে আইডিওলজি এই কথা রাষ্ট্র মাত্রই ভালোভাবে জানে)। এইদিকে এই ঘটনায় মস্কো যখন কপাল কুঁচকে বসে আছে যে ছেলে আমার হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রভাব বলয়ের বাইরে যাচ্ছে, এইটার কাউন্টার ন্যারেটিভ তৈরী করতে গিয়ে আফগানিস্থান মস্কোর সাথে আরেকপিস চুক্তি করে বসে, যেইটা ছিলো সামরিক চুক্তি, এই চুক্তি অনুযায়ী আফাগান মিলিটারী বাহিনী রাশিয়ার কাছ থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ অস্ত্র গোলা বারুদ মিসাইল ট্যাঙ্ক ইত্যাদি ইত্যাদির সাহায্য নেবে। এখানে বলে রাখা ভালো এইসবই হচ্ছে ঐ যে আগেই বলেছি COLD WAR নামক এক দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের কথা মাথায় রেখে। এই যুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকা রাশিয়া দুপক্ষই অনেক Proxy war খেলেছে, মানে নিজেরা সরাসরি যুদ্ধ না করে অন্যের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধ করা এইটাকে বলে ছায়া যুদ্ধ বা Proxy war ।

    জাহির শাহ্‌ এবং দাউদ খানের সংস্কারমূলক রাজনীতির পুরো সময়কাল জুড়ে আফাগানিস্থানে নারীদের সামাজিক অবস্থান ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করে, সরকারি চাকরিসহ বিভিন্ন পেশা যেমন ডাক্তার শিক্ষক এইসব ক্ষেত্রে নারীদের যোগদান এইসময় ছিলো চোখে পড়ার মতন। ১৯৬৫ সালে আফগানিস্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় আফগান কমিউনিস্ট পার্টি যার নেতা ছিলেন বারবাক কারমাল এবং নুর মোহম্মদ তারিকী। এইসময় আফগানিস্থানে প্রচুর বিদেশী পর্যটক আসা শুরু হয়, বিভিন্ন দেশের লোকজন কাবুলের ডাউনটাউনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান শুরু করে আফগানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, সবই ভালোই চলছিলো অনেকটা রূপকথার মতন জার্নি। কিন্তু ঝামেলা লাগলো ৭০ এর দশকে এসে। ১৯৭৩ সালে দাউদ খান জাহির শাহ্‌ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক সংসদীয় ব্যবস্থার অগ্রগতি দেখে হতাশ হয়ে পড়েন এবং তিনি তাঁর বিশ্বস্ত সেনাবাহিনী কে সঙ্গে নিয়ে একটি রক্তপাতহীন ক্যুপ ঘটান (১৭ জুলাই ১৯৭৩) যার মাধ্যমে ক্ষমতা রাজা (তাঁর নিজের কাকা জাহির শাহ্‌র) হাত থেকে তাঁর হাতে স্থানান্তরিত হয়, এবং এর মাধ্যমে দাউদ খান সমগ্র আফগানিস্থানে এতদিন ধরে চলে আসা রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রথমবারের মতন একটি রিপাবলিকান ষ্টেট প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এতসব করার পরেও এসে দেখা গেলো এক নতুন বিভেদ, এতদিন ধরে শিক্ষা নিয়ে টিয়ে আফাগানিস্থানের বুকে একদল টেকনোক্র্যাট তৈরী হয়েছে যারা মার্কিনীদের শিক্ষায় শিক্ষিত অর্থাৎ কিছুটা প্রো আমেরিকান আর উল্টোদিকে যেই সেনাবাহিনী যারা সোভিয়েত রাশিয়াতে গিয়ে নিজেদের ট্রেনিং কমপ্লিট করেছে তাঁরা কার্ল মার্ক্স এবং লেনিনের টুপি অলরেডি কিনে বসে আছে ফলে ঝামেলা লাগা ছিলো শুধু সময়ের অপেক্ষা।

    কোনো একটা দেশের ভেতর যখন বড় পরিবর্তন হয়, তা প্রথমে আসে যে কোনো দেশেরই প্রধান শহরগুলোতে সেখান থেকে সেইটা ছড়িয়ে যায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, কিন্তু আফগানিস্থানের ক্ষেত্রে কাবুল যেরকম ভাবে মডারনাইজ হচ্ছিলো সেই অনুপাতে কিন্তু গ্রামীণ জনপদগুলি হতে পারছিলো না। একদিকে শহুরে মিডলক্লাস মানুষ যারা কিছুটা পড়ালেখা শিখে পাশ্চাত্যের মতন করে কিছুটা বেঁচে থাকা রপ্ত করে ফেলেছিলো আর অন্যদিকে গ্রামের মানুষজন যাদের হাতে একটু কম টাকা পয়সা এবং আধুনিক চিন্তা/শিক্ষার সুযোগ কম যারা নিজেদের ওল্ড ইসলামিক ভ্যালুজ ট্র্যাডিশন নিয়ে এখনও বেঁচে আছে এঁদের মধ্যেও একটা চরম অসাম্য প্রকট হচ্ছিলো, ফলে এখানেও আরেকটা নতুন শ্রেণী তৈরি হয় শহর এবং গ্রাম। যেই সেনাবাহিনীর কথা একটু আগে আপানাদের বলেছিলাম তাঁরা ইতিমধ্যে সোভিয়েত রাশিয়াতে গিয়ে নিজেদের ট্রেনিং করে মার্ক্স এবং লেনিনের ভাবাদর্শে এতটাই ইনফ্লুয়েন্সড হয়ে যায় যে তাঁরা দেশে ফিরে সেই একই লেন্সে নিজের দেশকেও দেখা শুরু করে। এইদিকে এই দুপক্ষ ছাড়াও আরেকপক্ষ রেডি হয়ে গেছে অর্থাৎ রাম গেলো শ্যাম গেলো এইবার আসি যদুবাবুর কথায়। যদুবাবুর ছাত্ররা পূর্বের দেখানো কোনো পথেই না গিয়ে ইসলামিক আদর্শে দীক্ষিত হন যাকে আমরা “ওল্ড স্কুল অফ ইসলামিক থট” এই ক্যাটাগরিতে রাখবো, এরা সংখ্যায় ভালোই ছিলো এবং গ্রামীণ অঞ্চলে এঁদের একটা ভালো সাপোর্ট কিন্তু সেসময় ছিলো, এনারা একটা নতুন ব্র্যান্ডের জন্ম দেয় “আফগান ইস্লামিজম”।

    ক্ষমতা দখলের কিছুদিনের মধ্যেই আফগানিস্থান প্রজাতন্ত্রের ভেতর পূর্বে বর্ণিত তিনধারার যে আইডিওলজি তাঁর মধ্যে কনফ্লিক্ট চরম আকার নেওয়া শুরু করে। ফ্যাক্টরিগুলোতে আফগান লেবারেরা বেতনবৃদ্ধির দাবীতে আন্দোলন শুরু করে, ছাত্ররা স্কুলের গেটে তালা লাগিয়ে দেয়, মার দাঙ্গা খুন গুম খুন নারীদের ওপর অত্যাচার মানে এককথায় যাকে বলে অ্যানারকি সেই জরুরী অবস্থা শুরু হয়। দেশের এই অচলাবস্থায় হাল ফেরাতে আসরে নামেন প্রেসিডেন্ট দাউদ খান নিজেই, তিনি সেইসময় কমিউনিস্টদের সাথে মিলেমিশে গিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতার দখল নেন। দেশের এই সংকটময় সিচুয়েশনে এইটা করা ছাড়া তাঁর কাছে আর উপায় খুব একটা ছিলো না। ক্ষমতা নিজের হাতে নেবার পর ১৯৭৩ থেকে ৭৮ এই সময়কাল জুড়ে কমিউনিস্ট নেতাদের তিনি খুব সুকৌশলে ট্যাকল করেন এবং রেবেলদের নিউট্রালাইজ করতে শুরু করেন। এই কাজটি করতে গিয়ে হয়তো নিজের শত্রুও খুব বাড়িয়ে ফেলেছিলেন। এইসবের মধ্যে সেদেশের একজন কমিউনিস্ট রেভেলিউশনারি নেতা “হাফিজুল্লাহ আমিন” গোপনে প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্দেশ্যে রাশিয়ান সরকারের সাথে যৌথ প্রযোজনায় আরো একটা ক্যুপ করে বসেন। PDPA The People's Democratic Party of Afghanistan আফগান সেনা এবং রাশিয়া সমর্থিত জঙ্গীবাহিনী একযোগে প্রেসিডেন্ট দাউদ খান এবং তাঁর বাড়ির সদস্যদের হত্যা করে এবং ক্ষমতা দখল করে নেয় যা ইতিহাসে এপ্রিল ক্যুপ নামে পরিচিত।

    দাউদ খানের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন কউমিউনিস্ট নেতা নুর মহাম্মদ তারিকী। তারিকী ছিলেন একধারে PDPAর প্রতিষ্ঠাতা লেখক সাংবাদিক এবং হাফিজুল্লাহ আমিন এই ভদ্রলোক ছিলেন তাঁর এক্সিকিউটিভ হ্যান্ড। নুর সাহেব থিওরী দিয়েছিলেন আর প্র্যাক্টিক্যালি বিদ্রোহটা করেছিলেন বা করিয়েছিলেন হাফিজুল্লাহ আমিন। অনেক রক্তক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে বিদ্রোহ তো হলো ক্ষমতাদখল তাও হলো কিন্তু এইসময় PDPA নিজেই দুভাগে ভেঙে যায় [১. খালিকিস্ট(মেজরিটি) ২.পারচমিস্ট( মাইনরিটি)]। এর ফলে একদিকে আফগান সেনা এবং অন্যদিকে বাকি দুই এরা আবার নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে লড়াইতে জড়িয়ে পরে আর এই লড়াই ছিলো সশস্ত্র ফলে আবার রক্তপাত। এইসবকিছু মিলিয়ে এতদিনের যে সংগ্রাম বৃহত্তর আদর্শ সেই যত্ন করে গড়ে তোলা ইমেজটি কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকে।

    তারিকীর একরকম স্বপ্ন ছিলো workers’ paradise তৈরী করার যদিও তার কখনও সরকার চালানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো না, ফলে ভাবনা গুলো খুবই যুগান্তকারী হলও দেশের মাটিতে তার সফল প্রয়োগ কিভাবে হবে সেই সম্পর্কে তার ধারনা এবং দূরদর্শিতার অভাব যথেষ্ট ছিলো। যেমন একটা উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে, আফাগানিস্থানের সমাজ ব্যবস্থায় যে ধনী সম্প্রদায় ছিলো (জমি কিংবা সম্পত্তির মালিক) তাঁরা সেখানকার স্থানীয় মানুষদের ধার দিতো এবং এই প্রথা আফগানিস্থানে বহুবছর ধরে চলে আসা একটা প্রথা, এবং স্থানীয় সাধারণ আফগানরা এই ধারটা করতো হয় বিবাহ অথবা কেউ মারা গেলে তার শ্রাদ্ধ শান্তি করার যে খরচ সেইটা মেটানোর জন্য। তারিকী সাহেবের পেনের এক খোঁচায় মানে এই নতুন নীতি যেই নীতি অনুযায়ী (এই ধার বাকির কারবার অবৈধ বলে ঘোষিত হয়) ফলে ধনী সম্প্রদায় সাধারণ আফগানেদেরকে ধার দিতে অস্বীকার করলে সংকট ওঠে চরমে। ব্যাপারটা সহজেই অনুমান করা যায় যে সেখানে তখনও ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা অতটা ভালোভাবে গড়েই ওঠেনি তার উপরে এই নতুন নীতির ফলে তৈরী হওয়া টাকার সংকট লোকাল মানুষদের প্রতিদিনের যে বেঁচে থাকা সেইটাকে একটা ঝামেলার মধ্যে ফেলে দিয়েছিলো। এইগুলো নিয়ে তারিকী সাহেব হয়তো খুব একটা চিন্তা করে উঠতে পারেন নি ফলে গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে মানুষের মনে ক্ষোভ বাড়তে থাকে, পাশাপাশি জমী সংস্কার করতে গিয়ে যে নতুন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো তার সাথে বহু আফগান পরিবার মানিয়ে নিতে পারে নি। জমী থাকলেই তো খালি হবে না চাষের জন্য জল লাগবে সেই জলের মালিকানা হয়তো সকলের নেই আছে কোনো এক বড়লোকের এইবার সে যদি জল না দেয় তাহলে চাষ হবে না, ফলে উদ্দেশ্য মহৎ থাকলেও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এই সংস্কারমূলক কাজগুলি আসলে খুব একটা সাকসেসফুল হতে পারে নি সেইসময়। চাষ আবাদ ভালো না হবার কারণে দেশে খাদ্যের সংকট দেখা দেয় এবং সরকার খাদ্য সংকটের মোকাবিলা করতে ফেইলিওর হলে লোকাল মানুষের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে।

    এরমধ্যে ১৯৭৯ সালে আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এডলফ ডুবস আফগানিস্থানের মাটিতে খুন হলে আমেরিকার সাথে আফগানিস্থানের সম্পর্কএকেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে, এই পর্যায়ে আমেরিকা কাবুলের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলে কাবুল পুরোপুরি রাশিয়ার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একদিকে সারাদেশে কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে অন্যদিকে ব্যবসা বাণিজ্য ভালো চলছে না, এই সময় আফগানিস্থানের ইকোনমি সবদিক থেকে খারাপ হতে শুরু করে। তারিকী সরকার বাধ্য হয়ে এইসময় রাশিয়ান সরকারের কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠালে তাঁরা নিজেদের দেশ থেকে টেকনোক্রাট এবং মেলেটারি সাপোর্ট পাঠায়। এঁদের উদ্দেশ্য ছিলো নতুন আফগান সরকারকে পলিসি তৈরীতে সাহায্য করা এবং সরকারকে স্টেবেলাইজ করা। এইসবের মধ্যেই হেরাট শহরে কোনো এক শীতের সকালে স্থানীয় মানুষেরা রাশিয়ান আগমনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জানাচ্ছিলো, এইসময় স্থানীয় আফগানদের হাতে কিছু রাশিয়ান সোলজার মারা গেলে পরিস্থিতি সাংঘাতিক হয়ে ওঠে, এর পর যা যা ঘটেছিলো তা আসলেই কল্পনার অতীত। তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া তাঁদের বোমারু বিমানগুলিকে পাঠায় আফগানিস্থানের হেরাটে বম্বিং করার জন্য। এবং এই একটা ঘটনাই আসলে হেরাট শহরটাকে প্রায় ধ্বংসস্তূপ বানিয়ে ছেড়েছিলো, বলাই বাহুল্য প্রচুর নিরীহ মানুষ মারা যায় এই ঘটনায়।

    ১৯৭৯ সালে ইরান বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে এইসময় আরো একটা জিনিস স্পস্ট হতে শুরু করে যে ইসলামিক দুনিয়ার ভেতর একটা মেজর চেঞ্জ আসবো আসবো করছে। সোভিয়েত সমর্থিত তারিকী সরকার আইন অমান্যকারীদের সম্ভবত একটা চরম শিক্ষাই দিতে চেয়েছিলো কিন্তু এতটা এক্সট্রিম ব্যাপার স্যাপার সেই দেশে একটা অ্যান্টি কমিউনিস্ট সেন্টিমেন্টের জন্ম দেয়। সোভিয়েত রাশিয়াকে প্রতিহত করার জন্য সেই দেশে তৈরী হয় ইসলামিক ভাবাদর্শে দীক্ষিত একদল সশস্ত্র রেবেল বাহিনী যার নাম মুজাহিদীন। এই আফগান ইস্লামিস্ট যারা যদু বাবুর ছাত্র ছিলো তাঁরা এইবার পুরোপুরি আসরে নামে। অন্যদিকে নুর মোহাম্মদ তারিকী এবং তার সেনাপতি হাফিজুল্লাহ আমিন ক্ষমতা কার অধীনে থাকবে এই নিয়ে নিজেরা নিজেদের বিরুদ্ধে প্লট করা শুরু করে দেয়, এর মধ্যে তারিকী মারা গেলে আমিন হয়ে ওঠে দেশের সর্বময় কর্তা। এই আমিনের রাজত্বকালে আফগানিস্থানে শান্তিরক্ষার নামে প্রায় রেগুলার বম্বিং চালাতো রুশ বোমারু বিমান।

    এত কিছু ঝামেলা ঝঞ্ঝাটের মধ্যে সোভিয়েত সরকার উপলব্ধি করে যে আমিন সঠিক লোক নয় এবং এও উপলব্ধি করে আমিন রাশিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে বড় কিছু একটা ঝামেলা করার আগেই আমিনকে সরানো দরকার এবং নিজেদের পছন্দের কাউকে আফাগানিস্থানের মসনদে বসানো দরকার। আমিন সম্ভবত রাশিয়ানদের চটাতে চায় নি, বরং রাশিয়ান সাপোর্ট নিজের সাথে রেখে সে চেয়েছিলো আফগানিস্থানের কনট্রোল নিজের উপর রাখতে, কিন্তু দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ততদিনে নষ্ট যা হবার হয়ে গেছে। ডিসেম্বর ১৯৭৯ রেড আর্মি আফগানিস্থান দখলের জন্য অগ্রসর হতে থাকে এবং একটা সময় আফগানিস্থানের অনেকটা বড় অংশ দখল করেও ফেলে। এইসবের মধ্যে হাফিজুল্লাহ আমিন সেও মারা গেলে সোভিয়েত সরকার পড়ে বিপদে, কারণে আফগানিস্থান একটা সার্বভৌম দেশ সেই দেশের ইন্টারন্যাল ব্যাপারে এই যে রাশিয়ান নাক গলানো এইটাকে বৈধতা দিতে পারে এমন একটা লোকের খুব দরকার ছিলো মস্কোর, নাহলে বহির্বিশ্বের সামনে তাঁদের নিজেদের প্রেস্টিজ থাকবে না। আমিন ছাড়া এই আফগানিস্থানের মাটিতে সোভিয়েত মেলেটারির আগমন আন্তর্জাতিক নিয়মের পরিপন্থী ফলে মস্কো সেইসময় হন্যে হয়ে একটা ফেস খুঁজতে থাকে কাকে বসানো যায় জাতে শ্যাম কূল দুই রক্ষা হয়। সেইসময় সোভিয়েত প্রধান ব্রেজনভ বাবরাক কারমালকে আফগানিস্থানের ক্ষমতায় এনে সাময়িক ভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এই কারমাল ভদ্রলোক আফগানিস্থানের কমিউনিস্ট পেরিফেরিতে খুবই পরিচিত মুখ ছিলেন কিন্তু দাউদ খানের নিউট্রালাইজেশনের ভয় থেকে তিনি বিদেশে গিয়ে থাকা শুরু করেন এবং আফগান পাওয়ার পলিটিক্সের সাথে তিনি খুব একটা পরিচিত ছিলেন না।

    সোভিয়েতরা আফাগানিস্থানের বিস্তীর্ণ এলাকায় যে দাবাং দাবাং চালিয়েছিলো সেই ক্ষতি আফগানিস্থানের সাধারণ মানুষের জন্য মোটেই সুসংবাদ বয়ে আনে নি, বারবাক কারমাল দেশের হাল ফেরাতে চরম ভাবে অসফল হন এবং লোকাল আফাগান মানুষের প্রতি রেড আর্মির খারাপ আচরণ পুরো বিষয়টাকে আরো জটিল করে ফেলে। হয়তো দুপক্ষের কেউই এইটা চায় নি কিন্তু আফগান মানুষের মনে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর প্রতি যে তীব্র ঘৃণা জন্ম হয়েছিলো সেই ঘৃণা কিন্তু সহজে যায় নি। এই এন্টি কমিউনিস্ট সেন্টিমেন্ট সঙ্গে প্রতিশোধের আগুন এইদুটোকেই পরবর্তীতে আবার ইউজ করে cold war এর রাশিয়ার প্রধান প্রতিপক্ষ আমেরিকা, এই আমেরিকা এবং তাঁদের এলাই সৌদি আরব এবং পাকিস্থান ১৯৮০ সালে তৈরী করে মুজাহিদীন। ১৯৮০ সালে সৌদি আরব থেকে বিন লাদেন এসে যোগ দেয় এই মুজাহিদ বাহিনীর সাথে। আসলে মুজাহিদ বাহিনীকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ টাকাপয়সা এইসব দিয়ে টিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ হিসেবে খাড়া করেছিলো এই আমেরিকাই। এই মুজাহিদ নেতাদের মাথায় নিজেদের দেশকে স্বাধীন করবো বাইরের শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করবো এই চিন্তাটা কাজ করলেও আমেরিকা চেয়েছিলো যে কোনো মূল্যে রাশিয়াকে কাবু করতে এবং এই প্রকল্পে আমেরিকা বেশ অনেকটাই সফল। মুজাহিদীন বাহিনী হিন্দুকুশ পর্বতের ভেতর থেকে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে গেছে ১৯৮০ থেকে ৮৯ পর্যন্ত। আফগানিস্থানের প্রতিকূল আবহাওয়া এবং হিন্দুকুশ পর্বতের আড়াল থেকে চালিয়ে যাওয়া গেরিলা যুদ্ধ সাথে ইন্টারন্যাশনাল পাওয়ারের সাপোর্ট এবং ধর্মের নামে হোলি ওয়ার এবং সর্বোপরি সেইখানকার লোকাল মানুষের সাপোর্ট এইসব ফ্যাক্টর গুলো মিলেমিশে মুজাহিদীন বাহিনী ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে থাকে। এবং দ্যা গ্রেট সোভিয়েত রাশিয়া ততদিনে আর নিজেও ততটা গ্রেট থাকতে থাকতে ভেতরে ভেতরে কোথাও একটা দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো ফলে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়া বাধ্য হয় নিজেদের সেনা আফগানিস্থানের মাটি থেকে প্রত্যাহার করে নিতে। মুখে না বললেও আমেরিকার কাছে এই জয় নিঃসন্দেহে বড় ঘটনাই ছিলো। এর ঠিক দুবছরের মাথায় ১৯৯১ তে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যায় এবং পৃথিবীর ভূরাজনীতিতে এই ঘটনাটি নানা দিক থেকেই ঐতিহাসিক এবং সেই আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয় তাই করছি না।

    ১৯৮৭ সালে আফগানিস্থানের মসনদে বসেন মহম্মদ নাজিবুল্লাহ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রাশিয়া এই দেশে আর খুব বেশীদিন থাকতে পারবে না ফলে ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিস্ট যারা আছেন তাঁদের একটা রাজনৈতিক স্পেস দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, এবং এই চেষ্টার একটা দিক ছিলো যে তাঁর নিজের এবং দলের ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদে জাতে বজায় থাকে সেইটাও সুনিশ্চিত করা। কিন্তু রাশিয়া সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর আফগানিস্থানের ভিন্ন ভিন্ন যে জনগোষ্ঠী তাঁরা ক্ষমতা দখলের জন্য নিজেদের ভেতরে যুদ্ধ শুরু করে দেয় ফলে আবার একটা জরুরী অবস্থা শুরু হয় আফগানিস্থানে। ১৯৯২ সালে আহমদ শাহ্‌ মাসুদ (এথনিসিটি তাজিক) কাবুল দখল করে নেন এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট(দল PDPA) মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ আফগানিস্থানের একটি বিলাসবহুল প্রাসাদে (ইউনাইটেড নেশনস ভবনে) নজরবন্দী হয়ে যান, এবং সেখানে তিনি চার বছর ছিলেন, এরপর তালিবানরা ১৯৯৬ তে ক্ষমতা দখল করলে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

    আফগানিস্থানের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ পাস্তুন সম্প্রদায়ের লোক, এছাড়াও আছে তাজিক উজবেক এবং তুর্কমেন হাজারাস এইরকম ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক। আফগানিস্থানের রাজনীতির অঙ্গনে ১৯২১ থেকে ১৯২৬ আমিরাত ১৯২৬ থেকে ১৯৭৩ রাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের ফ্লেভারযুক্ত রাজতন্ত্র এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত রিপাবলিকান সরকার চলেছে। এরমধ্যে একদম শুরুর দিকে হাবিবুল্লাহ কালাকানির যে উত্থান ঘটেছিলো অল্প সময়ের জন্য এই কালাকানি ছিলেন তাজিক সম্প্রদায়ের মানুষ। ১৯৯২ সালে আরেক তাজিক নেতা আহমদ শাহ্‌ মাসুদ আরো একবার কাবুল দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন কিন্তু এইবারেও এঁদের শাসনকাল খুব বেশীদিন স্থায়ী হতে পারে নি।১৯৯২ থেকে ৯৬ চারবছর আফগানিস্থানের শাসনভার সামলেছিলেন আহমদ শাহ্‌ মাসুদ, ১৯৯৬ সালে আফগানিস্থানের রাজনীতিতে উত্থান ঘটে তালিবান নামে একটি সংগঠনের যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন পাস্তুন সম্প্রদায়ের একজন ধর্মগুরু মোল্লা উমর। পুস্তু ভাষায় তালিব শব্দের অর্থ ছাত্র, মনে করা হয় এই ধর্মগুরু তাঁর মাত্র ৫০ জন অনুগামী বা ছাত্র এই নিয়ে এই সংগঠন চালু করেছিলন এবং এঁদের মূল বিশ্বাস হচ্ছে ইসলামকে আবার সহি কায়দায় প্রতিষ্ঠা করা এবং বাকিদের খতম করা এবং শরিয়া আইনের কঠোর প্রয়োগ। ১৯৯৬ সালে তালিবান কাবুল দখল করে নিলে আহমদ শাহ্‌ মাসুদ আফগানিস্থানের উত্তরঅংশে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন।

    তালিবানের ক্ষমতায় আসার পর রাজধানী কাবুল থেকে কান্দাহারে পরিবর্তন করা হয় এবং তাঁর কিছুদিনের মধ্যেই মেয়েদের স্কুলে যাওয়া অফিসে যাওয়া বাইরে গিয়ে কাজকর্ম করা এইসব নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে দেওয়া হয়। এমনকি মেয়েদের প্রকাশ্য জনপথে লাঞ্ছিত করাই নয় অনেকসময় লাঠিপেটা জুতোপেটা করার দৃশ্য সামনে এসেছে বহুবার। আপানদের নিশ্চয়ই মনে আছে মালালা ইউসুফজাই নামক সেই মেয়েটার কথা যাকে স্কুল যাওয়ার জন্য তালিবানরা খুন করতে চেয়েছিলো, মালালার নামটা সামনে এসেছে এইরকম কত মালালা কবরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে সেই সঠিক হিসেব কারো কাছে নেই। ২০০১ সালে তালিবান নেতা মুল্লাহ মোহাম্মদ উমরের নির্দেশে আফগানিস্থানের বামিয়ান ভ্যালিতে অবস্থিত হাজার বছরের প্রাচীন বুদ্ধের মূর্তিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো তালিবানরা। ইসলামে মূর্তি পুজা হারাম ফলে সবকটা মূর্তি পূজার ঠেকগুলোকে মেরে ধরে নষ্ট কর। বাংলাদেশের হিন্দু মন্দিরগুলো আজকে ঠিক কটা ভালো আছে কতটা ভালো আছে এইটা রিসার্চের টপিক হতে পারে। এবং মজার ব্যাপার এই মন্দির গুলোকেও সুকৌশলে ভেঙে দেবার গভীর চক্রান্ত চলছে কিন্তু কিছু বলার উপায় নেই। মনের ভেতর এই এক তালিবানি মানসিকতা পুষে রেখে অন্য ধর্মের সবকিছুকে নস্যাৎ করার যে ট্র্যাডিশন এইটা কিন্তু ইসলামেরই আরেকটা ইন্টারপ্রেটেশন। যেহেতু ইসলাম কেবল ধর্ম আকারে আসে নাই এসেছে রাজনীতির সাথে ফলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হবে না, তোমাকে আমার মতই হয়ে উঠতে হবে নাহলে তোমার খবর আছে। যাঁদের মস্তিষ্কের ভেতর এতটা বিষ ঢুকে গেছে তাঁদের কে ছাত্র বলে লঘু করা যায় না আর। একবার ভাবুন এইরকম যদি ছাত্রের নমুনা হয় তাহলে মাষ্টার কি হতে পারে বা কতটা হতে পারে আপনারা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই। আফগানিস্থানের মাটিতে তালিবানের এই উত্থানকে পৃথিবীর প্রায় সকল সভ্যদেশই বর্জন করেছিলো এবং তালিবান সরকারকে একমাত্র সৌদি আরব পাকিস্থান এইরকম গুটিকয়েক রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছিলো। ভারতের সাথে আফগানিস্থানের যে সম্পর্ক সেই সম্পর্ক (রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের কিংবা মানুষের সাথে মানুষের) সেই সম্পর্ক মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণই ছিলো কিন্তু ১৯৯৯ সালে তালিবান সমর্থিত জঙ্গীবাহিনী ভারতীয় বিমান IC 814 কে হাইজ্যাক করে নিয়ে যায় এবং সেই বিমানের ১৬০ জনের জীবন ফিরিয়ে দেবার বিনিময়ে মুক্ত করে নিয়ে যায় তিন কুখ্যাত জঙ্গীকে। এবং এই তিনজনের একজন ছিলেন মৌলানা মাসুদ আজাহার যিনি পরবর্তী কালে জন্ম দেবেন জয়শ-ই- মহম্মদ নামক একটি টেররিষ্ট অরগ্যানাইজেশনের যেই অরগ্যানাইজেশন ২০০১ সালে ভারতীয় পার্লামেন্টে নাশকতা চালায় এবং সেখানেই শেষ নয় এরপর উরি পাঠানকোট পুলয়ামা একের পর এক নাশকতা চালিয়ে গেছে এই টেররিষ্ট অরগ্যানাইজেশনটি। এছাড়াও ছিলেন মুস্তাক আহমেদ জারগর এবং উমর শেখ। উমর শেখ ৯/১১ আমেরিকায় ঘটে যাওয়া সেই কুখ্যাত বিমান হামলার জন্য ফাইন্যান্সিং করেছিলো যেই তথ্য পরে সামনে আসে। তালিবান শাসনকালে আফাগানিস্থানের মাটিকে ব্যবহার করেছিলো বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনগুলি, এবং ২০০১ সালে ঘটে সেই কুখ্যাত ঘটনা যা ৯/১১ নাইন এলেভেন নামে পরিচিত। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হানা চালিয়েছিলো জঙ্গী গ্রুপ আল কায়দা এবং তাঁদের নেতা ওসামা বিন লাদেন। আর আরো আশ্চর্য এই ঘটনার ঠিক দু দিন আগে সেই আহমদ শাহ্‌ মাসুদ ১৯৯২ সালে কাবুলের মসনদে বসেছিলেন যেই তাজিক নেতা, তিনিও আশ্চর্যজনকভাবে খুন হয়ে যান।

    ২০০১ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন জর্জ বুশ, তিনি সেপ্টেম্বর ৯/১১ ঘটনার পর টেররিজমের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহন করেন এবং আমেরিকা বিন লাদেনকে ধরবার উদ্দেশ্যে আফগানিস্থান আক্রমন করে। এই ঘটনার কিছুদিনের ভেতর আফগানিস্থানে তালিবানের যে রমরমা সেই অবস্থার অবসান ঘটে, ক্ষমতায় আসেন হামিদ কারজাই। ২০০১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত এই দশবছর আমেরিকান ট্রুপ আফগানিস্থানের মাটি আঁকড়ে পড়েছিলো সন্ত্রাসবাদকে চিরতরে নির্মূল করার লক্ষ্য নিয়ে এবং এইসময় তালিবানরা তাঁদের পূর্বসূরি মুজাহিদ ভাইদের অনুকরণে ঠিক আগের কায়দায় হিন্দুকুশ পর্বতের আড়াল থেকে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে গেছে এবং তাঁদের অস্ত্র গোলা বারুদ এইসবের সাপ্লাই করে গেছে আরেকদল ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেট পুঁজি। ২০১১ সালে বিন লাদেন নিহত হন পাকিস্থানের এবোটাবাদে এবং এইটা সেই এবোটাবাদ যা পাকিস্থানি মেলেটারি হেড কোয়ার্টারের একদম নাকের ডগায় মাত্র কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। যে কুখ্যাত জঙ্গীকে সারা পৃথিবীর থানা পুলিশ আর্মি সবাই খুঁজে খুঁজে হয়রান সেই লাদেন বাবু কিনা পাকিস্থানের সেনা ছাউনির এক কিমির ভেতর অবস্থিত। এই এক কিমির ভেতর এত বড় এক তিমি ঘাপ্টি মেরে বসে আছে এই তথ্য পাকিস্থান ইন্টেলিজেন্স গভর্নমেন্ট কারো কাছেই ছিলো না এইটা বিশ্বাস করা শক্ত। তাঁর মানে পাকিস্থান কি সরাসরি জঙ্গীবাদকে সমর্থন করে আসছে, এর উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ, এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন। এই কেনোর কোনো একমাত্রিক উত্তর নেই। এখানে পাকিস্থানের অনেকগুলো ইন্টারেস্ট আছে, সেইটা পলিটিক্যাল ইন্টারেস্ট, ইকোনমিক ইন্টারেস্ট এবং ভূরাজনীতিতে নিজেদের অস্তিত্বকে আরো প্রমিনেন্ট করার স্বার্থ আছে এতে, কিন্তু পথটা সম্ভবত সঠিক নয়। কিন্তু বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে কে আর কবে ঠিক ভুল নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে!আসলে বিন লাদেন তো শুধু একটা মুখ ছিলো মাত্র, এই যে টেররিষ্ট সংগঠনের চোরা নেটওয়ার্ক ছরিয়ে আছে পাকিস্থান আফগানিস্থান সহ মধ্য এশিয়া জুড়ে সেই নেটওয়ার্ককে ধরা মোটেও সহজ কাজ নয়। আফগানিস্থানের ভেতর তালিবান কোণঠাসা হয়ে পড়লে তাঁদের জন্য সেফ হোম ছিলো পাকিস্থান। পাকিস্থানের একটা বড় অংশের লোক পাস্তুন সম্প্রদায়ের এবং আফগানিস্থানেও তাই, ফলে আফগানিস্থান সীমানা টপকে পাকিস্থানের যে সাধারণ জনগোষ্ঠী তাঁদের মধ্যে মিশে যেতে পারে এই জঙ্গীরা এবং পাকিস্থানের এই ব্যাপারটাতে সরাসরি আশ্রয় প্রশ্রয় দুই ছিলো, ফলে তালিবান আফগানিস্থানে একটু ব্যাক মার্কেট হয়ে গেলেও ভেতরে ভেতরে এই তালিবানি আদর্শ সংগঠন সবই আসলে এক্টিভ ছিলো।

    ২০১০ সালে মুল্লাহ বেরাদর ঘানি বর্তমানে পলিটিক্যাল ডেপুটি ফর তালিবান করাচিতে এরেস্টেড হন, এবং ২০১৮ সালে কোনো এক অজ্ঞাত লজিকেই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর তিনি কাতারের রাজধানী দোহাতে তালিবানের রাজনৈতিক অফিস স্থাপন করেন এবং সেইখান থেকেই রাজনৈতিক এক্টিভিটি পরিচালনা শুরু করেন। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসেন আশরাফ ঘানি। মনে করা হয় আব্দুল ঘানি বেরাদর সেইসময় চেয়েছিলেন আশরাফ ঘানির সরকারের সাথে একপ্রকার শান্তি চুক্তি স্থাপন করতে জাতে এই শেষ না হওয়া রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে এবং আফগানিস্থানে শান্তি ফেরে কিন্তু সেই জিনিসটা বাস্তবে হতে পারে নি কারণ এইটা পাকিস্থানের ইচ্ছে অনুযায়ী হচ্ছিলো না। পাকিস্থান চেয়েছিলো আফগানিস্থানে তাঁদের পাপেট সরকারকে/তালিবান সরকারকে ক্ষমতায় আনতে যাতে আফগানিস্থানের মাটিতে পাকিস্থানের প্রভাব প্রতিপত্তি দীর্ঘ মেয়াদী শক্তিশালী হতে পারে। তালিবানকে জন্ম দিয়েছে পাকিস্থান লালন পালন করেছে এবং এই মুহূর্তে আলোচনার টেবিলে এনে বসিয়েও দিয়েছে পাকিস্থান যাতে করে পেছন থেকে সমস্ত খেলাটার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখা যায়। এইবার পাকিস্থান নিজের স্বপ্ন কতটা পূর্ণ করতে পারে তালিবানের হাত ধরে এর উত্তর সময় দেবে।

    ১৯৯৬ সালে তদানীন্তন চীন সরকার তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয় নি, কিন্তু ২০২১ সালে চায়না তালিবানকে সমর্থন জানিয়েছে, এবং এই সমর্থনের আভাষ কিন্তু অনেকদিন ধরেই একটু একটু করে পাওয়া যাচ্ছিলো। ৯৬ সালে চীন সরকার ভূরাজনীতির প্রেক্ষাপটে যতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো এই সময় তাঁরা ধারে এবং ভারে আগের চেয়ে অনেক বেশী ফলে চায়নার তালিবানকে সাপোর্ট করা ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ। চায়না নিজে যেখানে নিজের দেশের উইঘুর মুসলিমদের ক্যাম্পে রেখে মগজ ধোলাই করে যাচ্ছে সেখানে তালিবানদের সাথে এই দোস্তি উভয় পক্ষের জন্যই অস্বস্তি হতে পারতো, কিন্তু এইসব কিছুই হচ্ছে না কারণ BRI বেল্ট ন্ড রোড ইনিসিয়েটিভ। এইটা সেই প্রাচীন রেশম পথের ফিউচারিস্টিক ভার্সন যেইটা চীন থেকে পাকিস্থান আফগানিস্থান হয়ে মধ্য এশিয়া হয়ে ইউরোপের সাথে কানেক্ট হচ্ছে। এই প্রকল্পটি কয়েকশো হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প এবং এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এশিয়ার সাথে ইউরোপের যোগাযোগের ব্যাপারটা রেভুলিউশনাইজ হয়ে যাবে, এবং অবশ্যই এতে শুধু চায়না নয় এর সাথে যুক্ত প্রতিটি দেশের ব্যবসা বাণিজ্য বাড়বে। এই রাস্তাটির BRI বেল্ট ন্ড রোড ইনিসিয়েটিভের বেশকিছুটা রাস্তা গেছে আফগানিস্থানের ভেতর দিয়ে, ফলে এই মুহূর্তে সেই রাস্তার সিকিউরিটির স্বার্থে তালিবানকে দরকার। বেল্ট ন্ড রোড ইনিসিয়েটিভের স্বার্থেই আফগানিস্থানে একটা সুস্থিত সরকারকে দরকার বৃহত্তর বাজারের, ফলে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ মেনেই তালিবানকে সাথে নিয়ে পথ চলতে চাইছে বেজিং।

    একমাত্র তালিবান সরকারকে বাদ দিলে ভারতের সাথে আফগানিস্থানের বাকি যে প্রেসিডেন্টরা ছিলেন তাঁদের সাথে সম্পর্ক বেশ ভালোই বলা যায়। এই তালিবান সরকার কিন্তু প্রথম থেকেই ভারতের সাথে সামনা সামনি একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে, ব্যাক অফ দ্যা চ্যানেলে কিছু কথাবার্তা হচ্ছে কিনা সেইটা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়, যদি হয়ে থাকে তাহলে সেই আলোচনা চলুক কিন্তু ভারতের এই মুহূর্তে অবস্থান হচ্ছে স্ট্রাটেজিক সাইলেন্স। ভারতের পক্ষে আফগানিস্থানের রাজনীতিকে ঠাণ্ডা করতে যাওয়ার মানেই হয় না, দুর্ধর্ষ ব্রিটিশরা গ্রেট সোভিয়েত রাশিয়ানরা এমনকি প্রযুক্তি সমরসজ্জায় সজ্জিত আমেরিকা যা পারেনি সেই কাজ ভারত করে ফেলবে এই কথা ভাবা যুক্তিযুক্ত নয়। ভারতের আফগানিস্থানের মাটিতে বেশ কিছু ইনভেস্টমেন্ট আছে সেইগুলি যাতে নষ্ট না হয় সেই ব্যবস্থা ভারত সরকারকে নিতে হবে, এবং ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের যে লোকগুলি আফগানিস্থানে আটকে গেছে তাঁদের নিরাপদে দেশে ফেরাতে হবে। ভারতবর্ষের নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য আগামীদিনে তালিবান থ্রেট হয়ে ওঠে কিনা এই নিয়ে একটা বড় চিন্তার জায়গা থেকেই যায় কারণ তালিবান এর আগেও ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছে এবং আগামী দিনেও সেই প্রকল্পে খুব বিরাট পরিবর্তন হবার আশা এখনই করা যাচ্ছে না। ভারত এখন তাহলে কি নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকবে অবশ্যই তা নয়, ভারতের মতন একই সমস্যা আছে ইরানের, সেখানকার মেজরিটি শিয়া মুসলিমদের ঠিক আমাদের মতই একইরকম থ্রেট রয়েছে আফগানিস্থানের দিক থেকে ফলে ইরানকে এই আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে হবে যাতে করে আফগানিস্থানের তালিবান সরকারের বিরুদ্ধে একটা প্রেশার তৈরী করে রাখা যায়। এছাড়াও বলিউড এবং আইপিল সেইদেশে জনপ্রিয় এবং আফগানিস্থানের বহু ছেলেমেয়ে ভারতীয় কলেজে পড়াশুনা শিখতে আসে প্রতিবছর, সুতরাং ভারতের প্রভাব এত সহজে মুছে ফেলা যাবে না বলেই মত সংশ্লিষ্ট মহলের। এছাড়াও একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রায় ৭০ শতাংশ আফগানবাসী মনে করে ভারত আফগানিস্থানের জনজীবনে পজিটিভ এফেক্ট রেখেছে যেখানে মাত্র ৫ শতাংশ মনে করে পাকিস্থান তাঁদের পক্ষে মঙ্গলময়। সবশেষে বাজার অর্থনীতির অঙ্কেও ভারত এখন ১৩০ কোটির বাজার, তালিবান কেন যে কোনো দেশের সরকারই এই ১৩০ কোটিকে অগ্রাহ্য করতে পারবে না চাইবেও না, ফলে আগামী দিনে যদি তালিবান এবং তাঁদের পলিটিক্যাল থিঙ্কট্যাঙ্ক নিজেদের হিংসাত্মক এজেন্ডা বাদ দিয়ে মূলধারায় ফিরে আসার সাহস দেখাতে পারে, ভারত নিশ্চয়ই তাঁর পুরানো ভালো বন্ধুর হাতটা কখনোই ছেড়ে দেবে না।

    এই মুহূর্তে বাংলার পলিটিক্সেও এই ইন্টারন্যাশনাল ঢেউ এসে লাগছে এবং এই নিয়ে জনগণ আবার দুভাগে বিভক্ত। পশ্চিমবাংলার বুকে বহু শিক্ষিত রুচিবান মুসলিম আজ তালিবানকে সমর্থন জানিয়ে পোষ্ট দিয়েছে এবং দিচ্ছে। এই বর্বর তালিবানিদের সকল কুকীর্তি জানবার পরেও আফগানিস্থানে তালিবানদের এই জয়কে সেলিব্রেট করছে উপভোগ করছে নিজেদের জয় বলে ভাবছে এই জায়গাটা দুশ্চিন্তার। নাগরিক কবিয়াল কবীর সুমনের দুটো লাইন দিয়ে এই লেখা শেষ করবো, লাইনটা আমরা অনেকেই খুব গাইতাম।

    শোনো তালিবান তালিবান আমি তোমাদের দলে নেই

    আমি ধর্মে মুসলমান আছি লালনের সঙ্গেই!

    শুভ বুদ্ধি শুভ চিন্তার উন্মেষ ঘটুক এই আশাটুকু নিয়েই এই লেখা শেষ করছি, সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Amit | 120.22.***.*** | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১২:২২497452
  • এদ্দিনে একটা ঠিক ঠাক রিয়ালিস্টিক লেখা এলো আফগানিস্তান নিয়ে গত কদিনের কয়েকটা আগমার্কা ভাটের পর।
  • Supriya Debroy | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৬:০৯497456
  • খুব সুন্দর ভাবে লাস্ট ১০০ বছরের আফগানিস্তান এর ইতিহাস জানানো হলো ভালো লাগলো ​​​​​​​পড়ে  
  • aranya | 2601:84:4600:5410:c13:2782:d9e9:***:*** | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৮:৫৯497473
  • ভাল লেখা 
  • Sandipan Majumder | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৮:১৯497517
  • ভালো। তথ্যপূর্ণ,অনাবশ্যক  আবেগ বর্জিত লেখা।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন