এক একটা ঘটনা ধূপের গন্ধের মতো। ধূপের গন্ধ যেমন ঠাকুর ঘর মনে করায় তেমন বর্তমানে ঘটে চলা কোনো ঘটনা হাত ধরে নিয়ে চলে পুরোনো কোনো স্মৃতির অলিন্দে।
জগতের আনন্দজজ্ঞে সবে মাত্র সমাপ্ত হওয়া অলিম্পিক্স সেই ধূপের গন্ধ। অলিম্পিকের মানে বুঝতে আশির দশকের শিশুর ক্লাস সেভেনে উঠতে হয়েছিল। আর যেমনি বোঝা অমনি শুরু হল আয়োজন। এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার অধরা থেকে যাবে তা তো হয় না। মনে আছে আমাদের পাড়ার যে খেলার গ্ৰুপ ছিল সেখানে সদস্য হতে গেলে বয়সের কোনো সীমারেখা রাখা হত না। তা না হলে সদস্য বে-দল হতে পারে। প্রত্যেক সদস্যই নিজ নিজ যোগ্যতায় স্বমহিমায় থাকতেন।
সেই গ্ৰুপে একবার অলিম্পিক্সের আয়োজন করতে হবে স্হির হল। স্কুলের পর মিটিং করে ঠিক করা হবে কর্মসূচী। মিটিং হল। বহু তর্ক, বিতর্ক, সমর্থন, অসমর্থন, সাময়িক দলত্যাগ এসবের পর ঠিক হলো ইভেন্টের নাম। কিত্ কিত্, কুমীর ডাঙা, ল্যাংচা, ছোঁয়াছুঁয়ি। এই চারটি। আরও উন্নত নামকরা খেলা ছিল কিন্তু এই খেলাগুলোকে অলিম্পিক্সের মর্যাদা দান করাই আমাদের উদ্দেশ্য।
তা মিটিং এ সব কর্মসূচিই স্হির হল কিন্তু এই পাড়া-অলিম্পিক্সের আয়োজকরা বেকার। আর্থিক অবস্হা করুন। ভাল পুরস্কার না দিতে পারলে প্রতিযোগী পাওয়া অসম্ভব। তাই আলোচনা করে ঠিক করলাম চারজন অভিভাবককে সভাপতি, সহ সভাপতি ইত্যাদি পদে রেখে ওনাদের কাছেই সাহায্য চাওয়া যাবে। চিন্তা মন্দ ছিল না। কাজ হল। এহেন অলিম্পিক্স লাইভ দেখার আকর্ষনে অভিভাবকরা রাজী হয়ে গেলেন।
জোরকদমে কাজ এগোতে লাগলো। রোজই প্রায় স্কুলের পর মিটিং বসছে। তার ফলে দেরী করে বাড়ী ফেরায় কিছু সদস্যকে বাড়ীর বাইরে দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতেও হচ্ছে। কিন্তু মহৎ কাজে কোনো কিছুই বাধা হতে পারে না। রাস্তায় আসতে যেতে দু একজন অত্যন্ত মেধাবী কাকিমারা জিজ্ঞাসা করেছিলেন - তোরা নাকি অলিম্পিক্সে যাচ্ছিস? উফফ,পা টা যেন মাটিতে আটকে গেল, মনে হল সত্যি সত্যিই বুঝি আমাদের নামগুলি অলিম্পিক্স কমিটি জেনে ফেলেছে।
পূর্ণ উদ্যোমে প্রত্যেক সদস্যরা বেশ ভালোমতোই প্রতিযোগীদের নাম যোগাড় করল। হঠাৎ সমস্যা পাকালো কিত্ কিত্ এর খেলোয়াড়রা। তাদের বক্তব্য - তোদের সাথে খেলেছি, তোরা খুব চোট্টামি করিস। তোরা জাজ হলে নাম দেবো না। যাঃ বাবা একি অপমান?আমাদের অলিম্পিক্স, আমরা ঠিক করব জাজ কে হবে! মানু১ বলল কিত্ কিত্ অলিম্পিক্স থেকে বাদ। ওরাও ঠোঁট উল্টে বলল - বয়ে গেছে।
যাই হোক কোনমতে টুসির মধ্যস্হতায় দুপক্ষ সমঝোতা করল। বিচারক মন্ডলীও পাল্টানো হল। সেই আবার বড়দেরই শরণাপন্ন হলাম।
দেখতে দেখতে শুভদিন উপস্হিত। রবিবার বেলা এগারোটায় মহাভারতের পর সবাই মাইকেল মাঠে জড়ো হবে। আমরা আয়োজকরা মানু ১, মানু২, টুসি, মৌ, টুকুন, ইতু, মুনমুন, টুনু অবশ্য সেদিন মহাভারত বাদ দিয়েছি। প্রতিযোগিতা শুরু হল। দর্শক মন্দ হয় নি।আমরা শাড়ি পড়েছি। এক রঙের। চন্দনের টিপ পরিয়ে সভাপতি, বিচারক মন্ডলীদের বরণ করে নেওয়া হল। শাঁখ বাজিয়ে খেলার শুভসূচনা করেছিল গতবছর স্কুল স্পোর্টসে সবথেকে বেশী পুরস্কার পাওয়া মানু ২।
খেলা চলেছিল দিনভর। বড়দের অনেক প্রশংসা, আশীর্বাদ কুড়িয়েছিলাম। আজ এতদিন পরে সেদিনের ফলাফল আর মনে নেই। আয়োজকরাও কেউ খেলোয়াড় হই নি। কিত্ কিত্ এর নাম ও অলিম্পিক্সে যায় নি। ওটা শুধু একটা ঘটনা ছিল বোধ হয়। তবে আজ মনে হয়, ওটাই হল অলিম্পিক্সের আসল বিশালত্ব। রূপক হিসেবে মনের অন্দরে বাসা বাঁধে। হ্যাঁ সেদিনের গোল্ড মেডেল ছিল ৫০ টাকার পার্কার পেন।
বাপ্রে! কি সুন্দর আয়োজন!
খেলাধুলা পর্বের আরেকটু বর্ননা সহ বিস্তারিত লিখলে পারতেন