আমি নিজে একটি ধার্মিক ও ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছি। ছোটবেলায় রীতিমত মেনেছি সবকিছু। সব সেভাবেই চলছিল, শুধু কখনো কখনো আর্থ-সামাজিক কারণে অনেক প্রশ্ন মাথায় আসতো। বেশ মনে আছে, ফাইভের বিজ্ঞান বইতে পড়েছিলাম, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দূষিত পুকুরে সিন্নি টাইপের প্রসাদ বানানোয় অনেক লোক অসুস্থ হয়ে যায়, বিশেষ করে গ্রামের দিকে এরকম প্রচলন রয়েছে। স্নানজল, প্রসাদ খেয়ে মানুষ কেন অসুস্থ হবে? এই ব্যাপারটা তখন মনে এসেছিল, যে যদি ঈশ্বর মানুষের ভালোর জন্যই, তাহলে মানুষের ক্ষতি কেন হলো তারই প্রসাদে? কেন পুজো দিয়ে আসার পথে দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণ যায়? কেন বলি হয়? যদি সব প্রাণীই ঈশ্বরের সৃষ্টি, তারই সন্তান, তাহলে নিজের সন্তানকে কেন খায় সে? কোপারনিকাস, গ্যালিলিও, ডারউইনকে কেন ধর্মের ধ্বজাধারীরা অত্যাচার করেছিল? কেন ব্রুনোকে মারা হলো?
এই ধরণের চিন্তার জন্য বকুনিও খেয়েছি বা কখনো খাইনি বা কখনো উত্তরও পেয়েছি নিতান্ত নিরাশ করার মত। একটা বিরক্ত সৃষ্টি হয় পুজোর ফর্দ দেখে, তারপর পুরোহিতের অযাচিত চাহিদা দেখে। আসতে আসতে "সংশয়বাদী" হয়ে যাই। যদিও এই টার্মটা জানতাম না, বলতে গেলে কিছুই জানতাম না। ধর্ম সম্পর্কে সেসময় শুধুমাত্র নিরাশ ছিলাম, কাজ করতো ধর্মের ব্যাপারে ভয়। এটা মোটামুটি ৪-৫ বছর চলে। এই সময় চার্বাক সম্পর্কে জানতে পারি, তাদের বস্তুবাদী চিন্তা আকৃষ্ট করে।
তারপর ২০১৪ সালে আমার পৈতে হয়, একদিনেই সবকিছু করা হয়। এবার মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাকে বলা হয়েছিল, যা কিছু হয়ে যাক, পৈতে যেন না খোলে গা থেকে, এটা একদম মৃত্যুর সময় শরীরের থেকে আলাদা করা হবে, তার আগে কখনোই না। আগেই বলেছি, ধর্ম সম্পর্কে এই সময়ে শুধু ভয়টুকু কাজ করতো, তাই ভেবেছিলাম কি জানি খুললে যদি ক্ষতি হয় কিছু। কিন্তু পৈতের পরের দিনই, জামা পাল্টাতে গিয়ে অনভিজ্ঞতা বশত পৈতে খুলে মাটিতে পড়ে যায় জামার সাথে। কিছুক্ষণ বসে ছিলাম চুপচাপ, কেউ দেখে ফেলেনি তো? কাওকে কিছু বলিওনি। যাই হোক, যখন দেখলাম মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো না বা মাটি গিলে নিলো না, তখন সেটা মনে এফেক্ট করলো, কিছুটা ভয় কাটল।
এরকম ভাবে অনেক বিষয়েই নিজে থেকে পরীক্ষা করে দেখেছি, কাঁচকলা খারাপ কিছু হয়। এভাবে ভয় কাটতে থাকে। তবে এই পৈতে র কয়েকমাস বাদে আমার সবচেয়ে আপন দিদিমা মারা যান। তখন এই ঈশ্বর বস্তুটার ওপর ভীষণ রাগ হয়েছিল, এক লাথি মেরেছিলাম, ধূপের প্যাকেটে। এর পর এভাবেই চলে। শরৎচন্দ্রের লালু চরিত্রটির প্রতি আকৃষ্ট হই, হাইনরিষ ব্যোল-এর "ক্লাউন", তারপর আরও কিছু বই পড়ি"(বাকি গুলোর নাম মনে আসছে না)। জাত-ব্যবস্থার প্রতি অনীহা তৈরি হয়, ধর্ম ও জাতপাতের নামে দম্ভ, দাঙ্গা, এই চূড়ান্ত নোংরামিগুলো মেনে নিতে অসুবিধা হতো। এভাবে একসময় নিজেকে নাস্তিক বলে দাবি করি, যদিও সম্পূর্ণ সংস্কার মুক্ত হতে পারিনি(এখন অনেকটা কমলেও, পুরো হতে পারিনি)।
তারপর ইলেভেনে হাতে স্মার্টফোন আসে। আমার মা হলো রামকৃষ্ণ , বিবেকানন্দ ভক্ত। সেই হিসাবে, আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে তর্ক করতে গিয়ে জানতে পারি, অভেদানন্দের "মরণের পারে" বইটির কথা। সেটা নিয়ে সার্চ করতে গিয়ে, একটা লেখা পাই "স্বামী অভেদানন্দের ‘মরণের পারে’ – একটি বিশ্লেষণ"(https://blog.mukto-mona.com/2013/05/27/35552/)। এর সাথেই মুক্তমনার সাথে পরিচয় হয়। এটাই হয়তো পুরোদস্তুর নাস্তিক হবার চেষ্টার পথে, একটা মাইলস্টোন বলতে পারি। অভিজিৎ রায় একটা বড়ো ফ্যাক্টর ছিলেন আমার নাস্তিক জীবনে। এটা ২০১৬-১৭ সালের ঘটনা। এরপর পরিচিত হই রাফিদা আহমেদ বন্যা, অনন্ত বিজয় দাশ, নিলয় নীল, ওয়াশিকুর বাবু, রাজিব হায়দার, হুমায়ূন আজাদ প্রমুখ, বাংলাদেশে গড়ে ওঠা ব্লগার আন্দোলন, প্রভৃতি বিষয়ে। মুক্তমনা থেকেই জানতে পারি রিচার্ড ডকিন্স, স্টিফেন হকিং, প্রবীর ঘোষ, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কথা জানতে পারি। আরও পরে জেনেছি ভারতে চলা মুক্তচিন্তার আন্দোলন, এম এম কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, রোহিত ভেমুলা প্রমুখের কথা। এরপর ফেসবুকে আপনাদের মত সমমনা বন্ধুদের পেলাম, প্রত্যেকের লেখায় আরও সমৃদ্ধ হলাম। আর ধর্মের ঠুনকো বিশ্বাসে জড়িয়ে থাকতে হয়নি। প্রতিদিন যতটা পারছি সংস্কার মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। নিজের মত প্রকাশ করতে যতক্ষণ পারবো, করে যাবো, না পারলেও চেষ্টা করে যাবো।
খুব ভালো লেখা হয়েছে স্বর্ণাভ।
ধন্যবাদ অভিষেক দা❤️
কেউ দিদিমা মারা যাওয়ায় ঠাকুরের ওপর রাগ করে লাথি ছোঁড়ে, কেউ ভাবে ঠাকুরের বাগানে দিদিমা খুব শান্তিতে চিরানন্দে আছেন। সবটাই ভেবে নেওয়ার ব্যাপার।