ধাক্কা
শীতের দুপুরে আমার দোতলার ছোট্ট বারান্দাটিতে, যতক্ষণ রোদটাকে ধরে রাখা যায় আর কি, গায়ে রোদ লাগিয়ে বসে থাকি আমার আরামকেদারাটায়। বই পড়ি, রাস্তা দেখি, বই বন্ধ করে কিছুক্ষন ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ করি। আবার রাস্তার দিকে তাকাই। আবার বইটা উঠিয়ে নিই। পড়তে পড়তে ঢুলি। যখন মোটা উলের আফগানি টুপিটা মাথায় দিয়ে ১৪১১ এর মৃগাঙ্ক বাবু হাঁটতে বের হন, তখন বুঝি যে সূর্য এবার ঢলতে আরম্ভ করবে। আজও বসে আছি বারান্দায় শরীরটাকে রোদে ডুবিয়ে। সাকির মস্ত মোটা বইটা হাতে। মিসেস জোয়ান চিন্তায় পড়েছেন, কি করে তাঁর অতিথির আগমনটাকে আটকানো যায়। সাকির ছোট ছোট গল্পগুলো ধীরে সুস্থে এগোতে থাকে। রসিয়ে রসিয়ে পড়া যায়।
কোলের উপর বইটা রেখে রাস্তার দিকে তাকালাম।
হ্যাঁ, টুপি মাথায় মৃগাঙ্ক বাবু বেরিয়েছেন। কারো সাতেও না পাঁচেও না, দুবার কলোনিটা চক্কর লাগিয়ে পার্কটাতে একটু খানিকের জন্য বসেন। বড় করে বেশ কয়েকবার নিঃশ্বাস টানেন, বার করেন, মানে প্রাণায়াম করেন আর কি।
রাস্তার ডান দিক ধরে ধরে চলেছেন মাথা নিচু করে মৃগাঙ্ক বাবু। হুড ওয়ালা জ্যাকেট পড়ে এক যুবক নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আসছে উল্টো দিক থেকে। আজকাল ওরা ফোনটা পকেটে রেখে, কানে পাতলা ইয়ার ফোন লাগিয়ে আপন মনে কথা বলে যায়। দেখতে বেশ মজা লাগে। চলতে চলতে মৃগাঙ্ক বাবুর সঙ্গে ধাক্কা আর ছোটোখাটো মৃগাঙ্ক বাবু পড়তে পড়তে কোনরকমে সামলে নিলো। ছেলেটি মৃগাঙ্ক বাবুকে ধরে ‘সরি আঙ্কেল টাঙ্কেল’ কিছু বলল বুঝি। মৃগাঙ্ক বাবু মাথাটা একটু নেড়ে আবার হাঁটা শুরু করলেন নিজপথে।
আমি ভাবছিলাম মৃগাঙ্ক বাবুরই দোষ হয়তো। রাস্তার ডান দিক দিয়ে হাঁটবেনই বা কেন তিনি? আবার ভাবলাম, হাঁটবে নাই বা কেন? আমরা কি গাড়ী ঘোড়া? অবশ্য ঘোড়ারা ও তো রাস্তার বাঁদিক ধরে চলে। কিন্তু খোলা মাঠে? রেসিডেন্ট অ্যাসোসিয়েশানের খেরা সাহেবের কাছে কথাটা পাড়লে কেমন হয়? পরে ভাবলাম, না, দরকার নেই। উনি বলবেন, আপনিই ড্রাফট করুন। এমন সময় হঠাৎ কানে এল একটা গাড়ীর ব্রেক কষার তীব্র আওয়াজ, আর সাথেসাথেই এক বিরাট ভাঙ্গাচোরার শব্দ। কোথাও বুঝি একটা গাড়ী ধাক্কা মারল। তাড়াতাড়ি চেয়ার ছেড়ে উঠে বারান্দার কোণে গিয়ে দেখি একটা কালো রঙের গাড়ী আমাদের ৪ নাম্বার গেটের উপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ওই ছেলেটি যার সঙ্গে মৃগাঙ্ক বাবুর ধাক্কা লাগলো এই কিছুক্ষণ আগে, দেখি সে গেটের কাছে থ হয়ে দাঁড়িয়ে। কয়েকজন গেটের কাছে ছুটে আসছে। ড্রাইভারটাও গাড়ীর দরজা খুলে বেরিয়ে এল। বোধহয় কিছু হয়নি তার।
রাস্তার কিছু লোক ছুটে এল। হৈচৈ, উত্তেজনা। কলোনির কিছু লোক জড় হয়েছে। না, কারো কিছু হয় নি। খেরা সাহেব এসে দেখলেন, শুনলেন। ড্রাইভারটা আবার গাড়ীটাতে ঢুকল। তারপর গাড়ীটা গেট থেকে পিছু হটিয়ে রাস্তার এক পাশে দাঁড় করালো। এবার বোধহয় পুলিশ আসবে।
এসব হতে হতে বিকেল। জামা জুতো পড়ে, ছড়িটি নিয়ে কিছুক্ষন পরে আমিও নীচে নেমে এলাম আমার প্রাত্যহিক সান্ধ্য ভ্রমণে।
সর্বপ্রথমে গেটটা পর্যবেক্ষণ করলাম। নিঃসন্দেহে গাড়িটি স্পীডে ছিল। ভাগ্য ভাল, গেটের সামনে কেউ ছিল না। তখনই ঐ ছেলেটির কথা মনে হল। গেটের দিকেই তো আসছিল সে। ভাগ্যিস মৃগাঙ্ক বাবুর সঙ্গে ধাক্কাটা লেগেছিল। তারপর টাল খেয়ে পড়ে যাওয়া মৃগাঙ্ক বাবুকে ধরা, সরি আঙ্কেল বলা ইত্যাদিতেও তো বিশ পঁচিশ সেকেন্ড লেগেছিল। যদি ধাক্কাটা না লাগতো! ছেলেটি তো সরাসরি গেটে চলে আসতো, আর তারপরেই নির্ঘাত ভয়ানক কিছু ঘটতো। হয়তো প্রাণটাই খুইয়ে বসতো ছেলেটা। তার মানে ঐ ছোট্ট ধাক্কাটা, মানে মৃগাঙ্ক বাবুই বাঁচালেন ছেলেটিকে। যদি মৃগাঙ্ক বাবু রাস্তার বাঁ দিক ধরে হাঁটতেন তাহলে? এইরকম নানা ধরণের কি হতে পারতো বা না হতে পারতো, কত কি যে চিন্তা, ছবি মনে ভিড় করতে আরম্ভ করল কি বলবো! সামান্য একটা ধাক্কা কি ভাবে একটা বিরাট বিপর্যয়কে রুখে দিল। এ নিয়ে কোনদিন কোন কথা হবে না, কেউ জানবে না। কি অদ্ভুত! আমাদের চোখে শুধু মোটা মাপের জিনিষগুলিই নজরে পড়ে, আর তা নিয়ে এত হল্লা!
পাড়ার একদল সান্ধ্য ভ্রমণকারী এদিক পানেই আসছে। একে ওকে হ্যালো করতে মন চাইলো না, কারন এই মুহূর্তে আমার মন এক প্রকাণ্ড বিস্ময়ের দরজায় দাঁড়িয়ে। আমি ওদেরকে এড়িয়ে হাঁটা দিলাম হসপিটাল গ্রাউন্ডটার দিকে।
কি অবাক কাণ্ড, ওদের দুজনের মধ্যে ধাক্কাটা লাগার পর আমি তো এও ভাবছিলাম যে খেরা সাহেবের সঙ্গে কথা বলে এই ভ্রমণকারীদের জন্য ডান আর বাঁ দিকটা ঠিক করে দেওয়া যায় না কি! যদি তাই হতো, ওদের দুজনের মধ্যে ধাক্কাটা কি লাগতো? দিব্যি যুবকটি সেল ফোনে কথা বলতে বলতে গেটের কাছে চলে আসতো, আর সেই মুহূর্তেই গাড়ীটি এসে পড়তো ওর গায়ের উপর। ভগবান তোমাকে বোঝা ভার, তোমার ইচ্ছাকে ব্যাখ্যা করতে যাওয়া বৃথা। আমি তো শুধু মাত্র আমাদের কলোনির গেটের এ পাড়ের কথাই ভাবছি। ঐ ড্রাইভারটাও কি চিন্তা করছে না যে আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল, কেনই বা সে ওই সুমো গাড়ীটার সঙ্গে ফালতু পাঙ্গা নিল বা ওরকম একটা কিছু? তারপর মনে হল মৃগাঙ্ক বাবু নিজেও হয়তো জানেন না যে আজ তাঁর কারণেই একটি তরুণ যুবকের প্রাণ রক্ষা পেল। তিনি যেরকম ভোলা মনের মানুষ এরকম চিন্তা নিশ্চয় তাঁর মাথায় আসে নি। ফেরার পথে একবার উনার সঙ্গে দেখা করে যাবো ভাবলাম।
মিলন বাবু, মিলন বাবু, বলে কেউ ডাকল। মজুমদার, তিওয়ারি, রায়বাবুরা কোণের বেঞ্চিটাতে জমিয়ে বসে আছে। মজুমদার হাত নাড়ল। আমিও হাত নাড়লাম। চেনা পরিচিত আরো কয়েকজন রয়েছে দেখছি। ছোট ছোট জায়গা নিয়ে ছোটরা ক্রিকেট খেলছে। মাঠের বিরাট অংশটি বড়দের দখলে। সাবধানে হাঁটতে হয়, কখন যে ধুম করে কাঠের বল গায়ে এসে পড়বে! মিলন’দা, বলে এক মেয়ে কন্ঠের ডাক শুনলাম। দুতিন জন মহিলা বেঞ্চটাতে বসে। ওখান থেকেই ডাকটা এল মনে হল।
চিনতে পারছেন না? আমি প্রতিমা।
সত্যি বলতে কি, মোটা মত বয়স্কা মহিলাটিকে চিনতে পারলাম না।
চিনতে পারছেন না? প্রতিমা – প্রতিমা! আপনি এই পাড়াতেই থাকেন?
কে প্রতিমা, চিন্তা করার মত অবকাশ নেই কারন আমার মনে তখন অন্য খেলা চলছে। একটু দেঁতো হাসি হেসে এড়িয়ে গেলাম। অভদ্রতা হল জানি, কিন্তু কি করবো?
কলোনিতে ফিরে দেখলাম গেটের পাশে গাড়ীটা আর নেই। আসারাম না কি রাম যেন রোগা চৌকিদারটিকে গেটে মোতায়েন করা হয়েছে। কিসের জন্য কে জানে? ঘরে ঢোকার আগে মনে হল একবার মৃগাঙ্ক বাবুর সঙ্গে দেখা করে আসি না কেন!
হ্যাঁ, তিনি জানেন এক্সিডেন্টের ঘটনাটা। ওনার স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন এক কাপ চা বানাবেন কিনা। আমি না করলাম, কারণ এই সময়ে আমি চা খাই না।
জিজ্ঞেস করলাম মৃগাঙ্কবাবুকে, তিনি কি অবগত যে তাঁর সঙ্গে ঐ যুবকটির যদি ধাক্কা না লাগতো কিরকম একটা বিপর্যয় হতো! তিনি প্রথমে বুঝতে পারলেন না আমি কি বলতে চাইছি। আমি বুঝিয়ে বললাম।
চুপ করে তাকিয়ে রইলেন মৃগাঙ্ক বাবু আমার দিকে। তারপর অন্যমনস্ক ভাবে মাথাটা একটু নাড়লেন। আমি জাস্ট ওনার হাতটা ধরে হ্যান্ডশেক করে ঊঠে পড়লাম।
ফ্ল্যাটে ফিরে সকালের কাজের মেয়ের রান্না করে রাখা রুটি সব্জি ডাল মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিয়ে টিভিটার সামনে গিয়ে বসা আমার বরাবরের অভ্যেস - মানে যবে থেকে পরিবারের ঝামেলা টামেলা মিটিয়ে এই বছর দুয়েক আগেই এই ফ্ল্যাটটাতে উঠে এসেছি তবে থেকে আর কি। যদি বেশী পয়সার লোভে এই ফ্ল্যাটটা আর্মির অফিসারকে না দিয়ে প্রাইভেট লোককে ভাড়া দিতাম, তাহলে কি এই ক্ষণে নির্ঝঞ্ঝাটে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকতে পারতাম? তবে প্রাইভেট পার্টিকে না দিয়ে মাসে সাত আট হাজার টাকা করে তো খোয়ালাম! আবার মাথার মধ্যে একটা অঙ্ক এসে গেল। গত আট বছরে, মানে যবে থেকে ফ্ল্যাটটা কিনেছি আর কি সুদে আসলে তো প্রায় পঁচিশ তিরিশ লাখ টাকা ব্যাঙ্কে আসতো। আবার মনে হল ব্যাঙ্কে টাকাটা এল না, কিন্তু ভাড়াটে তোলার ঝঞ্ঝাটটা তো এড়ালাম। শুধু তাই? পারিবারিক ঝামেলাটাকেও কেমন বাইপাস করে বেরিয়ে এলাম! গুড ডিসিশান। তার মানে ভাগ্যটা নির্ভর করছে ডিসিশান এর উপর। কিন্তু তারপরেই মনে হল, পারিপার্শ্বিক অবস্থা তো একটা গুড ডিসিশানকেও অকেজো করে দিতে পারে এক মুহূর্তেই! যেমন ঐ গাড়ীটির ড্রাইভার। কথা নেই বার্তা নেই, এসে মারল গেটে। তার মানে যতই তুমি ভেবে চিন্তে রাস্তায় নামো না কেন, বিনা মেঘে বজ্রপাত তো হতেই পারে! তাকে এড়াবে কি করে? তার মানে সবই ভাগ্য? না, তা কেন হবে? ছেলেটা নিয়মমাফিক রাস্তার ডান দিক ধরে হাঁটছিল বলেই তো মৃগাঙ্ক বাবুর জন্য বেঁচে গেল! তার মানে পারিপার্শ্বিক অবস্থার উপরও তোমার ভাগ্যটা নির্ভর করছে।
খেয়াল হল তখন থেকে শুধু যদি’র খেলা খেলে চলেছি। টিভি পর্দায় মন নেই। শুতে গেলাম কিন্তু চিন্তা ছাড়ে না যে! কারণ, তার পিছনের কারণ। এ পাশ ও পাশ করি। দেওয়াল থেকে কাজী নজরুল ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছেন। ছেলের আঁকা ছবি সেই কবে - ক্লাস নাইন কি টেনে প্রাইজ পেয়েছিল। বাপের নেওটা ছিল। কি সুন্দর সুখের একটা জীবন হতে পারতো। শালা নিজের ফ্ল্যাট তবুও চোরের মত লুকিয়ে লুকিয়ে বাস করতে হয়। পেনসনের অর্ধেকটা যায় বিনুর কাছে। ছিঃ ছিঃ। এটা কোন জীবন হল? মা বার বার করে বলতো, “অ মনা, একটু মন লাগিয়ে পড় বাবা!” হায়, যদি মা’র কথা শুনতাম!
রেজাল্টের পর রান্নাঘরের পিছনে বাসুদের বাগানে গিয়েছিলাম একটু একলা থাকতে। জ্যোৎস্না ছিল। কামিনী ফুল গাছটার পিছন থেকে ছায়ার মত বেরিয়ে এসেছিল বিনু।
এই, লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া হচ্ছে? বলে দেবো।
কাছে এল ও যখন, ওর মুখে জ্যোৎস্না পড়েছিল। কি যে হল, আমি কেমন যেন বিহ্বল হয়ে, ‘বিনু, আমি পরীক্ষায় ফেল করেছিরে’ বলে, ওর বুকে মুখ গুঁজে হুহু করে কেঁদে উঠেছিলাম।
মা’র কথা শুনলে, না আমি যেতাম বাগানে সেই সন্ধ্যায়, না আমাকে প্রেমে পড়তে হত। জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। মোট কথা ফেল করেছিলাম বলেই না বিনু আমার ঘাড়ে চাপল।
না রে পাগলা না। চাঁদের আলোয় বিনুর মুখ দেখেছিলি বলেই তো তুই মজলি! মায়ের গঞ্জনায় তোর দুঃখী মন কোন কিছু আশ্রয় চাইছিল। তাই তো তুই বিনুর কাছে বাঁধা পড়লি। কিম্বা...কিম্বা......সিগারেট ধরেছিলি বলেই না তোকে বাড়ীর লোকের নজর এড়িয়ে বিনুদের বাগানে যেতে হয়েছিল। তারপরেই তো চাঁদ, বিনু, জ্যোৎস্না ইত্যাদির কারণে তুই ওর বুকে মাথা মুখ গুঁজে কেঁদে উঠেছিলি।
পুরো রাত আমার মস্তিস্ক কারণ খুঁজে খুঁজে হয়রান। মনে হল এটা কোন ভালো কথা নয়। কোন মনের ডাক্তারের কাছে না আবার যেতে হয়! ঘুম হল না পুরো রাত।
সকাল হতেই যাবো কি যাব না করতে করতে অলিম্পিয়া হাসপাতালে চলেই গেলাম।
সমস্ত শোনার পর ডাক্তার বিন্দু গুরনানি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই মুহূর্তে কি ভাবছেন’?
আজ্ঞে, কি ভাবছেন মানে?
মানে এরকম কি কিছু ভাবছেন যে আপনার ঐ লোকটি আর ছেলেটির মধ্যে ধাক্কা লাগার কারনেই এই মুহূর্তে আপনি আমার চেম্বারে বসে আছেন।
আজ্ঞে?
ডাক্তার চেয়েই আছেন আমার পানে।
হ্যাঁ ডাক্তার, অনেকটা তাই।
এবার একবার চিন্তা করে দেখুন, ভাগ্যিস গাড়ীর আবিস্কার হয়েছিল তাই তো আপনি আমার কাছে এলেন?
বুঝতে পারলাম না ঠিক।
যদি গাড়ীর আবিস্কার না হত, আপনার ওই গেটে কোন গাড়ীর ধাক্কা লাগার প্রশ্নই আসতো না। না আপনাকে এই হাসপাতালে আসতে হত।
দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি আমায় বিভ্রান্ত করছেন।
এক্স্যাক্টলি তাই। যাইহোক ভাবনার কিছু নেই। আমাদের আরো আট দশটা সিটিং এর দরকার।
এতগুলো সিটিং?
দেখুন, এই কারণের কারণ বার করা কিন্তু এক ধরনের নেশা। একবার যখন আপনার মাথায় ঢুকেছে, এর থেকে বার হওয়া মুস্কিল। তাই বলছিলাম আপনার ঐ কারণের জড়টাকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে এবং এটা এত সোজা কাজ নয়। মানে ওই দু চারটে সিটিংএর কাজ নয়।
তা বলে কারণ জানবো না?
জেনে কি আপনার পাখা গজাবে? এই কারণের কারণ বার করতে করতে আপনাকে হাজার কোটি বছর পেছনে হাঁটতে হবে। পারবেন? আর দ্বিতীয়ত, ঘটনাটা ঘটার পর কারণ জানলেন, কি এমন হল তাতে? যা ঘটার তো ঘটে গেছে, তাকে তো বন্ধ করতে পারেন নি।
ওঃ।
হ্যাঁ। কারণকে সনাক্ত করা আমাদের শক্তির বাইরে। তাইতো বলি ভাগ্য। তাহলে কাল এই সময়টাতেই আসুন।
ডাক্তার এও বলল যে চিকিৎসা না করালে মানসিক চাপজনিত সমস্যা হতে পারে। অবাক দুনিয়া। এতক্ষণ ছিলাম এক সুস্থ সবল মানুষ, তারপর হঠাৎ হয়ে গেলাম কিনা রোগী! আর তা ছাড়া এত বার এসে করবোটাই বা কী? উনিও করবেনটাই বা কী? জীবনের প্রায় সব কথাই তো বার করে নিয়েছেন। খাটের তলা, ট্রাঙ্কের তলা থেকে ঝাড়ু দিয়ে দিয়ে সব কথাই তো শোনালাম। শেষ বয়সে বৌ কেন আমাকে তাড়াল, তাও শোনালাম। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
কলোনিতে ঢুকে দেখি আমার গাড়ী পারকিং এর জায়গাটা কেউ মেরে দিয়েছে। বেপাড়ার গাড়ী। গাড়ীর কাছে কিছু লোকও জমায়েত হয়েছে। অ্যাসোসিয়েশানের খেরা সাহেব, মুখার্জিকেও দেখছি। ব্যাপারটা কি? আমি গাড়ীটা নিয়ে কোথায় যাবো ভাবছি, দেখি খেরা এগিয়ে এলেন।
মিলন বাবু, আপ গাড়ী ইস কিনারেমে রাখ দিজিয়ে। ইন লোগ আয়ে হে আপসে বাত করনে কে লিয়ে।
কিন লোগ?
এক ওকিল সাহাব, ঔর আপকি পত্নী।
মেরি পত্নী?
আপ আইয়ে না!
আমি বাকশক্তিহীন। দেখি মোটা ভারী চেহারার এক মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হ্যাঁ, বিনুই তো। ও কি করে এখানে চলে এল?
কে যেন আমার হাত থেকে গাড়ীর চাবিটা নিয়ে বলল, “আপ ইনলোগোঁকো ঘর লে যাইয়ে। ম্যায় গাড়ী পার্ক কর দেতা হুঁ।
ঘরে ঢুকেই প্রথমে তো বিনু সমস্ত ফ্ল্যাটটা ঘুরে ফিরে দেখলো। তারপর সামনাসামনি হল।
ছিঃ ছিঃ ছিঃ। চোর, চিটিংবাজ, আরো কত গালাগাল যে দিল! মোটকথা বিনুর অনুযোগ, ভাগ বাটোয়ারার সময় আমি নাকি ধোঁকা দিয়েছি। উকিল বলল, এই এত্ত বড় ফ্ল্যাটটার কথা চেপে রাখা নাকি ক্রিমিনাল অ্যাক্ট ।
কিন্তু জানলো কি করে এই ফ্ল্যাটটার কথা?
বলল, ভাগ্যিস প্রতিমা কাল টেলিফোন করে জানালো।
আমি ভাবছি প্রতিমাটা কে? তখনই খেয়াল হল, কাল হাসপাতাল ময়দানে সেই মোটা মেয়েটা, প্রতিমাই তো নাম বলল।
ছিঃ। কে বলেছিল আমাকে কাল হাসপাতাল ময়দানে সান্ধ্যভ্রমণে যেতে? মৃগাঙ্ক বাবুর উপর আমার মনটা বিরূপ হয়ে গেল। তাঁর জন্যই তো হল? হে ভগবান, কোথাকার জল নদী বেয়ে সাগরে বেয়ে ঘুরে ফিরে বোতলে বন্দী হয়ে কারো পায়ের ধাক্কায় গ্লাস উলটে কোথায় গড়াল? খেয়াল করলাম বিনু একটা বড় সুটকেসও নিয়ে এসেছে। একেই বলে বোধহয় নিয়তি। তর্কবিতর্ক করে কোন লাভ হবে না। তবুও বললাম, এসব কথা কোর্টে বিচার হবে। তার আগে এক অনাত্মীয়াকে আমি আমার বাড়ীতে রাত কাটাতে দিতে পারি না।
পারো না মানে? আলবৎ পারো। আমি এখানেই রাত কাটাবো। এই বাড়ীটার উপর আমার হক আছে। কি বজ্জাত লোক রে বাবা!
উকিল ও বলল, প্রথমত স্যার, আমাদের খবর এই ফ্ল্যাটটা আপনি ডিভোর্স এর ৫/৬ বছর আগেই কিনেছিলেন যাতে কিনা বিনু দেবীর ভাগ আছে। আর তা ছাড়া এই ফ্ল্যাটটা যে এত বছর ধরে সবার অগোচরে রেখেছিলেন , তার মানে এটাই দাঁড়ায় আপনি আসলে আপনার স্ত্রীকে ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন অনেক বছর ধরে। এটা ক্রিমিনাল ব্যাপার।
ইতিমধ্যে বিনু ফ্রিজ খুলে লিমকা না কি একটা খুঁজে বার করে এনেছে উকিল সাহেবের জন্য। দরজায় বেল বাজছে।
দরজা খুলে দেখি মৃগাঙ্ক বাবু। আমি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, “আপনি কেন এই সময়ে”?
মিলন বাবু, আমি বলতে এলাম যে, কাল আপনি আমার বাড়ী বয়ে এসে কি সব বলে গেলেন, পুরো রাত ঘুমোতে পারিনি। আজও সমস্ত দিন ভেবে ভেবে মন প্রায় বিকল। এই কিছুক্ষন আগে ছেলেটাকে খুঁজে তার বাড়ী গিয়ে বলেছিলাম যে ওই ধাক্কাটা যদি না লাগতো ওর কি হতে পারতো। ভালোমনেই বলেছিলাম।
তা এই কথাটা বলার জন্য এই রাতে বাড়ী এলেন?
মশাই, একে তো আমার মাথায় এসব কি আজে বাজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন, তারউপর ওই ছেলেটা যাকে বাঁচালাম, তারই হাতে অপমানিত হতে হল। ছেলেটা বলে কিনা,ওর সেল ফোনে কথা বার্তায় যদি না এমন বিমগ্ন থাকতো ও, তাহলে কি ধাক্কাটা লাগতো? ওর সেল ফোনটাই নাকি ওকে বাঁচিয়েছে। আর এটাও বলতে এলাম আপনাকে যে, অপরের ব্যাপারে নাক না গলিয়ে নিজের চরকায় তেল দেবেন এবার থেকে। এই সব অরাজক ব্যাপার নিয়ে আমার বাড়ী আর আসবেন না।
মৃগাঙ্ক বাবু আমায় বকে চলে গেলেন। আমি থ হয়ে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। হঠাৎ কি মনে হতে আমার বুকটা ধক করে উঠলো। তাড়াতাড়ি পেছনে ফিরে দেখি, না, দরজাটা খোলাই আছে।
.......................
কোনো কিছুই অপরিহার্য নয় বরং জীবন সম্পুর্ণ ভাবে Randomised. সাকির জগৎ থেকে বহুদূরে অবস্থিত। রসোমন ছবির আভায় আলোরিত অন্য এক চিত্রকল্প। কালো হাঁসের মত ঘটনা ক্রম উড়ে এসে জুড়ে বসল। একটা আপাত innocent ধাক্কায় গল্পের রেশ বহমান হলো। আর তার গতি প্রকৃতি চলতে থাকে জীবনের গোলোকধায়। এক অদ্ভুত ও অদৃষ্ট চালকের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত। এক অনুপস্থিত agency ঘিরে রেখেছে চরিত্র গুলো কে। আর ঘটনা ক্রম চরিত্র গুলোর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এক অসহায় অবসাদে আবৃত।
গড় গড় করে পরে গেলাম। কর্ম হীন অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির একটু ভিন্ন ধরনের একটি দিনের রোজনামচা। মানসিক রোগের চিকিত্সকদের প্রিয় খাদ্য। ধাক্কা নামটা সার্থক।
ভালো লাগল।ঝরঝরে। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের এই ছোট ছোট ঘটনাবলী অনেক সময় আবেগপ্রবণ মনে ধাক্কা দেয়। এটা বাস্তব আরও বাস্তব এদের কেউ বোঝেও না বুঝতে চায়না । তখন ডাক্তার হয় সঙ্গী ।
As expressed in an earlier post, Jahar Kanungo’s short stories are always eminently interesting. The present one titled ‘Dhakka’ (‘The Collision’ in English?) is no different. The story explores, through its main protagonist and narrator Milon, the role that chance plays in the lives of individuals and daily events. Milon’s mind immediately embarks upon a journey that examines the chance elements involved firstly, in a collision between Mriganka, an acquaintance of his out on his daily evening walk, with a young pedestrian which renders both to waste some precious minutes in getting back their bearings and then the collision of a car with the gate of the residential colony (in which Milon and Mriganka both reside). The young pedestrian, apparently walking towards the gate, has been able to avoid the possibility of being a part of this second collision simply due to his involvement in the first.
But this simple incident seems to cause such great commotion in Milon’s mind that he immediately becomes obsessed with how the incident could have played out if certain elements of the incident chanced to unfold differently. His mind doesn’t stop ruminating about these elements involved in this particular incident but fixates on the effects of chance on other events including how his falling in love with his now divorced wife Binu could have been sheer chance. He even informs Mriganka that the young man might be dead had he not collided with him and reached the spot of the car crash a little earlier.
His obsession with the incident is such that he consults a psychiatrist who, seeing that she can profit from her patient’s peculiar obsession, advises him that he would have to attend several sessions to enable her to fix the problem. In the evening, after his return from the psychiatrist, Milon is confronted with another chance event – that of his ex-wife accompanied by her lawyer who has come calling on him demanding a share of the flat that he now lives in having come to know of it recently through a friend of hers who by chance resides in the same vicinity. Finally, he is accosted by Mriganka who tells him that he has since had a chat with the young man whose life he has apparently chanced to save by colliding with him but who thinks that it was purely his cell phone which is to be given credit- and not Milon- for having saved him from a worse fate. Milon reprimands Mriganka by telling him to keep out of other people’s affairs and leaves abruptly.
The basic idea of exploration of the role of chance events in our lives is interesting in itself. Chance abounds in our daily lives in an endless variety of forms. It can impact individual lives in both positive and negative ways or not at all. It can prevent us from realising our goals or provide immense happiness. So chance is always a subject of great intrigue for us. In fact, chance elements are an integral part of the history of individuals and of society.
However, chance is not the only or the most important factor in our lives. Necessity is; and it is a combination of these two that constitutes the history of individuals and of society. The role of chance has been a theme in some of Jahar’s stories in his excellent ‘Tiffin Time’. Since Jahar doesn’t restrict himself to any particular theme or idea we would like him to explore the role of necessity in our lives with a combination of chance.
One can obviously find some elements in the story that can be critically scrutinised – e.g., although Milon has been set up before the readers as just another retired person enjoying his afternoons in the winter sun from his balcony and keeping an eye on the goings-on on the road below as any normal retiree in our neighbourhood would, his analysis of the main incident appears to inform the reader that he is anything but. Milon’s thought process somehow seems to identify him as suffering from some form of obsessive compulsive disorder. If that be the case, then the reader is apt to feel that this aspect should have had a closer look from the author. May be, Jahar would someday in the future write a story that would be some kind of study on compulsive disorders suffered by his fellow human beings.
But as usual the story is very good and eminently readable written in Jahar’s easy conversational style with characters who are identifiable human beings and which at the same time provokes the reader to think beyond the immediate storyline. We will eagerly await his next one.
Mrinal Ray চৌধুরী from your perspective I read my story again . I got a wider understanding because of your insights. Thanks