অজয় রায়।
ট্যাক্সি চালিয়ে খায়।
আমার মত সওয়ারী পেলে শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়।
সে এক অতিমারী- পূর্ব সময়ের কথা। দূরত্ব মোটামুটি সর্বস্তরেই বিদ্যমান ছিলো, কেবল তার বাহ্যিক, 'সামাজিক' রূপ টাই দেখা বাকি থেকে গিয়েছিলো। যাইহোক, ঐরকম একটা সময়ে আলাপ হয়ে গেলো অজয়ের সাথে।
লোকাল ট্রেনের গাদাগাদি ভিড় ঠেলে, অগুন্তি নিষ্পাপ কনুই, অনভিপ্রেত অর্ধচন্দ্র-টন্দ্র হজম করে কোনোমতে পাঁকাল মাছের কায়দায় হাওড়া স্টেশন নামক প্রকান্ড ম্যানহোল থেকে বেড়িয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়েছি। ওদিকে মে মাসের রোদ্দুরের ভাবগতিক ও বিশেষ সুবিধের ঠেকলো না। সহনশক্তিকে যেন সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে অপেক্ষায় আছে আমার আত্মসমর্পনের। আমিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজে যাচ্ছি রোদে। সদ্য কেনা সাধের ফ্যাশ-ফ্যাশ প্রসাধনটি ও হাল ছেড়ে দেবার উপক্রম। সামনে দিয়ে চলে যাওয়া মিনিবাস গুলোয় তিল ধারণের জায়গা নেই। অবিশ্যি এই অবস্থাতেই কলেজ জীবনে রোজ লাফ দিয়ে বাসের প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে মুখ গুঁজে দিতুম চলন্ত অবস্থায়। শরীর গলানোর সৌভাগ্য হতে হতে গঙ্গা পেরিয়ে যেত বাস। তবে কি সদ্য চাকরির কানাকড়ি গুলো আমার 'ট্যাক্সি-মানেই-বুর্জোয়া' গোছের ভাবনা গুলোতে চিড় ধরাতে সক্ষম হয়েছে! এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘড়ির দিকে থাকতেই পিলে চমকে গেলো। আধ ঘন্টার মধ্যে নন্দন না পৌঁছলে এই প্রেম টাও কেঁচে যাবে। সুতরাং ট্যাক্সি ছাড়া কোনো গতি নেই।(প্রসঙ্গত: এটাও ওই চিড় ধরার ই আরেকটা প্রমান) যাক গে। ইতি উতি চাইছি, এমন সময়-
"কাঁহা জায়েঙ্গে?"
একটা বৃদ্ধ হলুদ ট্যাক্সি এসে থামলো। আমিও বাবা,'আমরা বাঙালি' সংগঠন করি।
"এই তো নন্দন যাবো। যাবেন? মিটারে যাবো কিন্তু!" এইবারে খেয়াল করলাম পুরু লম্বা গোঁফের ভিতরে একটা তরতাজা হাসি।
- "আচ্ছা, ঠিক হ্যায়, চলিয়ে"। উঠে পড়লুম। গোটা শরীর কাঁপিয়ে,বন্ধ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন চালু হলো শেষ বয়সে এসে পৌঁছনো, আমার কলকাতার এক বৃদ্ধ হলুদ ট্যাক্সির।
অজয় এবং আমার ছবি পাশাপাশি রাখলে এটা বোঝা একদমই দুস্কর নয় যে, চেনা শুরু হয় গোঁফ দিয়ে।
"আপনার গোঁফ খানা তো,যাকে বলে, ইয়ে আর কি!
ঈষৎ লজ্জিত হয়ে হেসে অজয় জানালো, তার বেশির ভাগ সওয়ারীই এই গোঁফের কথা বলে। আর সেটা যে ও তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে তা এখনো স্টিয়ারিং ধরে আরেক হাতে গোঁফে মোচড় দেওয়ার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়। পথের সাথে এগোতে থাকে 'বাতচিত', যেটাতে আমি বা অজয় কেউ ই কম যাইনা। যে কারণেই "আপনি" তা কখন "তুমি" হয়ে গেছে খেয়ালই করিনি।
যা বুঝলাম, এ শহরের পথ ঘাট,অলিগলি অজয়ের হাতের তালুর মত চেনা। আজ থেকে অন্তত ২০ বছর আগে যখন বিহারের মধুবনী থেকে ২ সন্তান আর 'ঘরওয়ালি' কে ছেড়ে অজয় তিলোত্তমার কাছে আশ্রয় চায় তখন অজয়ের বয়স ২৭। ভবাণিপুরের কাছে এক ঘুপচিতে বাসা বাঁধে সে। একটু বৃষ্টিতেই জল ঢোকে সেখানে, তবু সে ছাতুর বয়ামটাকে আগলে সেখানেই পড়ে থাকে বছরের পর বছর। এক বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সে বলে - একবার তার বড় মেয়েকে সে এখানে এনে রেখেছিলো চিকিৎসার জন্য। এই ঘরেই সে সেরে ওঠে ভারী রোগ থেকে,তারপর থেকেই তার মায়া পরে যায় ৮/১০ ঘুপচিটার ওপর। 'বিমারী গারিবকে ঘর আতা হ্যায় সাহাব' বলার সময়ও মুখে ওই অনাবিল হাসিটা, যা এক লহমায় তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দেয় জীবনের সব গ্লানি। অদ্ভুত এক শক্তি মানুষটার হাসিতে। ওদিকে বুড়ো গাড়ির লজঝড়ে রেডিওটাতে 'কোনো এক অজানা জ্বর' নিয়ে সতর্কতা চলছে, অজয় তো হেসেই খুন আমার দুশ্চিন্তা দেখে। 'নসিব মে' যা আছে তা হবে; কিন্তু বড়ো 'বিমারীর' ভাইরাস নিয়ে যে মানুষ খেলছে তার কি হবে সেটা ভাবায় অজয় কে। আপ্রাণ চেষ্টা করে বাংলায় কথা বলতে থাকা অজয় বলে চলে তার ইরফান ভাইয়ের কথা যার শুশ্রূষায় প্রাণে বেঁচেছিলো সে, যার মেয়েকে রাতে বাসায় ফিরে একবার কোলে না নিলে তার ঘুম আসবে না। সে তার 'গুড়িয়া' কে দেখে আসমার মধ্যে। স্কুলে বেশিদিন যাওয়া হয়নি অজয়ের, আর আমি স্কুলে পড়াই শুনে আবার ওই হাসিটা। তারপর প্রশ্ন- "উধার ইনসান বান না শিখাতে নেহি আপ লোগ?" উত্তর দিতে পারিনি। আমার গন্তব্য সামনে,কিন্তু ঝাপসা। কলকাতার মাথায় মেঘ জমেছে, তবু তার মাঝেই মেঘ ভেদ করে উজ্জ্বল রেখা দেখা যায় ইতি উতি।আমি নামলাম, হাত বাড়ালাম। কেজো মানুষের হাত,শক্ত,মজবুত হাতুড়ির মত, এক ঘাএ তুচ্ছ অপ্রাপ্তি গুলো ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। 'ফির মিলেঙ্গে', অজয় হাসলো, আবার. . . .কি অদ্ভুত জীবনীশক্তি, কি সত্যি, মন গলে যায়. . . . .হলুদ ট্যাক্সিটা এগিয়ে গেলো. .আবছা হয়ে গেলো গোটা হরফের 'NO REFUSAL' লেখাটা. .ধোঁয়া. . বৃষ্টি নামলো।
বেশ লাগল। এরকম অজয় রায়দের সংগে দেখা সাক্ষাত হয়ে যায় মাঝে সাঝে। বিহারি মানেই খারাপ, বাংলা না বলতে পারলেই খারাপ, এরাই বাংলাটা দখল করে নেবে এই স্টিরিওটাইপিংং ও তো ঠিক না। আবার মনে পড়ে গেল, এবার বইমেলা থেকে ফেরার সময়ই, রাতে, তিনি আবার বাংআলি বলে গালও দিচ্ছিলেন। বাংলা কিছু বোঝেন না, বুঝতে চান না, বোঝার দরকার নেই,,এসবও বলছিলেন।
কে জানে, কোন জেনেরালাইজেশন সম্ভব বা উচিত কিনা। কোন ট্রেন্ড সত্যিই দেখা যাচ্ছে কিনা।
যা বলেছেন। আসলে অতিমাত্রায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার এই সমাজে মানুষের মধ্যে স্থিতিস্থাপকতা কমে গেছে।মেরুকরণ বেড়েছে বিভিন্ন দিক দিয়ে। ফলে মূল্যবোধ,উচিত্যবোধ এগুুুলি ভীষণ ভাবে বিপদগ্রস্ত। আর সমাজের রাশ যাদের হাতে তারা তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করছেন। খুব কঠিন সময়।
দিব্যি তো। আরও আসুক।
যাঁরা খেরোর খাতায় নতুন লেখালিখি করছেন, গুরুচণ্ডা৯-র টেকনিকাল ফীচারগুলো তাঁদের কাছে ব্যাখ্যা করার জন্য আগামী শনিবার ভারতীয় সময় রাত ৮-১০টা আমরা একটা ওয়েবিনার করছি গুগল মীট-এ। ইচ্ছে আছে আগামী কয়েক সপ্তাহ জুড়ে প্রতি শনিবার ঐ নির্দিষ্ট সময়ে ওয়েবিনার করার। আপনাদের কী কী অসুবিধে হচ্ছে লিখতে বা একটা সামাজিক মাধ্যম হিসেবে গুরুচণ্ডালির পূর্ণ স্দ্ব্যবহার করতে, সেটাও আমরা নোট করব, যাতে এটাকে আরও উন্নত করা যায়, প্রযুক্তিগতভাবে। সম্ভব হলে থাকবেন। শনিবার রাত আটটায় নিচের লিংকে ক্লিক করেই মীটিং এ জয়েন করা যাবে।
@Anamitra
মহর্ষি বলেছেন বলে কতা! নিশ্চয়ই!