একটি বইয়ের গ্রুপে একজন নজরে আনলেন। শ্রেয়া ঘোষ লিখেছেন,
(১)
প্রথম দিকের গল্প "জীবনগানে"। সেপ্টেম্বর ২০০৫ এ প্রকাশিত। কয়েকজন বন্ধু মিলে প্রকাশ করা হয়েছিল একটা সংকলন - অলিন্দ।
সেই গল্পেই বোঝা গিয়েছিল সম্ভাবনা। গল্প জুড়ে সম্পর্কের টানাপোড়েন, চোরা অভিমান আর গল্প জুড়ে গান।
- " গগনে তব নিবিড় নীল? নীলিম নীল?" নীলের আগের শব্দটি মনে পড়েনা সঠিক সরমার। যাঁর মৃত্যু দৃশ্য দিয়ে শুরু গল্প। -" ভুবন জোড়া নীল তাঁকে ঘিরে নেয় প্রশ্নে, আলস্যে,শীতে। শিরায়, শিরায় গগনে তব অসীম নীল, অমল নীল, অমল মামা, তপু মাস্টারমশাই,ফোঁটায় ফোঁটায় নীল সরমার কপাল বেয়ে মাটিকে ছোঁয়, ছুঁতেই থাকে।" গল্পের শেষে মৃতা সরমার মনে পড়ে - "গগনে তব বিমল নীল" - স্বপ্নে এসে নাতনিকে বলে যান।
ইন্দ্রাণীর লেখা বদলেছে। বদলাবেই। ২০০৫ থেকে এই ২৪ অব্দি। কিন্তু লেখার ভরকেন্দ্র তখন থেকেই সম্ভবত নির্দিষ্ট।
যেমন পুরোন এই গল্পটায় ছোট ছোট পরিচ্ছেদে অতীত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান নিয়ে এক্কা দোক্কা খেলা। মূলত: সংলাপে নির্মিত কাহিনী । আগু পিছু করে গল্পের বুনন। সরাসরি ধারাবিবরণী দেওয়া গল্পের থেকে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। তবে এই নির্মাণ আরোপিত নয়। সহজাত এই ভঙ্গীর সঙ্গে পাঠকের আরও নিবিড় পরিচয় ঘটবে ক্রমশঃ ।
(২)
প্রথম দিকের আরও দুটি গল্প , পিঁপড়ে আর খুঁটে খাওয়ার গ্রাফিতি।ইন্দ্রাণীর লেখার প্রাণ তাঁর সুতীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি আর সংবেদনশীলতা। প্রথম থেকেই। একদম প্রথম দিকের গল্প পিঁপড়ে, ২০০৬ সালে লেখা। মনে আছে আজও। জীবন মৃত্যুর কিনারা ঘেঁষে রাস্তা পার হওতে চাওয়া একটা পিঁপড়ে। যেমন পিঁপড়ে আমি বা তুমি। ভয় শুধুমাত্র মৃত্যুর নয়, আগে পরে সর্বদা, সর্বত্র বিপদ। গল্পে বলা শুধু পিঁপড়ের কথা। অতিক্রমটুকু পাঠকের মনে। নিজেকে ঐ পিঁপড়ের জায়গায় বসাতেই হবে। প্রতিনিয়ত বিপদের পাশ কাটিয়ে চলার এই গল্পের শেষ বলে কিছু নেই।
ইন্দ্রাণীর লেখা শুরু হয়েছে খানিকটা দেরি করে। দীর্ঘ সময়ে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, যখন তা স্মৃতি হয়েছে, তখন শুরু হয়েছে লেখা। অনেকটা যাপনের পর পিছন ফিরেছেন। ফলে দূর থেকে একটা বিস্তৃত সময়ছবি ধরা পড়েছে। জীবন সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা তৈরির পর তাকে অনুবাদ করেছেন ভাষায়। শৈশব থেকে পড়ে চলেছেন নানা বিষয়ের বই। তার সঙ্গে ফিল্ম, ক্রিকেট, গান । প্রত্যেক ক্ষেত্রে অনুশীলনের সঙ্গে মিশেছে ভালবাসা। শুধু শেখা নয়, সব কিছু ধারণ করেছে তাঁর মেধা আর মনন। আবেগ জারিত নিষ্ঠা ইন্দ্রাণীর লেখাকে এই উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
২০১৯ এর বইমেলায় প্রথম বই পাড়াতুতো চাঁদ প্রকাশিত হল।
এই যে বলছিলাম, দীর্ঘ সময়ের সঞ্চয় নিয়ে ইন্দ্রাণী লিখতে শুরু করলেন, এযাবৎ আহরিত অভিজ্ঞতা, পাঠ, দর্শনের আত্তীকরণের পর সবটুকু মিশে গেছে গল্পে। আমার ধারণা অক্ষরে অক্ষরে সমর্থন করে "পাড়াতুতো চাঁদ"।
বলতে গেলে দুজনের গল্প - লতিকা আর অশোক। ওদের বিয়ে থেকে শুরু। এ গল্প পড়ছি, না দেখছি ধাঁধাঁ লাগে। লতিকাদের পাড়াটাই যেন এক খণ্ড ফিল্ম ওর কাছে। বিয়ের পর বর বউ গাড়ি করে গলি থেকে বেরোল যখন আকাশের চাঁদ আর পাহাড়ি সান্যাল একাকার, তিন তলার বারান্দা থেকে হাত নেড়েছিলেন ওদের। ফুলশয্যায়, লতিকা বলেছিল সে ভয় পেয়েছিল খানিক, অশোক যদি অশোক কুমারের মতন বুড়ো বুড়ো হয়....
- তো , দেখলে কেমন? বুড়ো বুড়ো?
- তোমাকে না শুভেন্দুর মতো লাগে।
২০০৬ -এ প্রথম প্রকাশিত গল্প, তারপর ২০১৯-এ প্রথম গল্পগ্রন্থ। দীর্ঘ সময়ে একটু একটু করে বদলেছে নির্মিতির স্টাইল। প্রথমদিকের গল্পে বিস্ময় জাগত খুঁটিনাটি - গল্পের-ই হোক কি যাপনের, তার ওপরেই গল্পের ভিত আর পোক্ত নির্মাণ। ইন্দ্রণী গল্পে শুধু ঘটনা বলে যান। তার বাইরে আর কিছুনা। অনুভূতির বর্ণনা অনুপস্থিত, অথচ তা স্পষ্ট বিদ্যমান।
- " পরদিন অফিস যায় নি নীলকমল। দাড়ি কামায়নি, স্নান করেনি। কাগজ কোলে শুয়ে ছিল বাইরের ঘরে। জানলা দিয়ে দুপুর দেখছিল। দুপুর, রোদ, গরম হাওয়া।রাস্তায় পিচ গলছিল বোধহয়। হাওয়ার জোর বাড়ছিল। শুকনো পাতা উড়ে যাচ্ছিল বাগানে। জানলার কাচে রোদ ঠিকরোচ্ছিল, চোখে লাগছিল নীলকমলের।
স্বপ্না সকালেই ডাক্তারের কাছে গেছে।টেস্টগুলো হবে তারপর স্কুলে যাবে। রিপোর্ট নিয়ে ফিরতে বিকেল। রুফাস বারান্দায় ছিল.... '
স্বপ্নার প্রেগনেন্সী টেস্টের রিপোর্টের অপেক্ষায় ছিল নীলকমল। দম বন্ধ করা অপেক্ষায়। এরকম একটা সময়ের ছবি হাল্কা আঁচড়ে এঁকে গেছেন লেখক, একটিও প্রচলিত শব্দ ব্যবহার না করে।নীলকমলের টেনশনে আমিও আক্রান্ত হই। বাক্যগুলি দ্রুত পেরিয়ে যাই, কতক্ষণে স্বপ্নার রিপোর্ট আসবে ....
প্রথম বইএর প্রথম গল্পটি ই (রোব্বারের পরদিন) ছাপ রেখেছে বাঁক বদলের।
“খুঁটে খাওয়ার গ্রাফিতি”তে গল্পের চরিত্র বারবার বলে, "এ এক অদ্ভূত জগৎ।" গল্পের চরিত্র একটু হলেও কিছু কথা বলে। সামান্যতম এই কম্যুনিকেশন অদৃশ্য ক্রমশঃ। পাঠককে পূর্ণ স্বাধীনতা।
ইন্দ্রাণী লিখে চলেন তাঁর গল্প। পাঠক তৈরি করবেন নিজস্ব ভাবনায়, নিজস্ব আখ্যান। এক ফোঁটাও চেষ্টা নেই তাঁর তরফে পাঠককে তাঁর বেঁধে দেওয়া পথে চালানোর। শব্দের এই পরিমিতি বোধ লেখক আর পাঠকের মধ্যে একটা যৌথ প্রক্রিয়া শুরু করে। পাঠকের সঙ্গে একই তলে বসে লেখকও বোনেন কাহিনী। এভাবেই নেশা ধরান তিনি। ঠিক এই কারণেই আমরা অপেক্ষায় থাকি তাঁর গল্পের।
তবে ইন্দ্রাণীর এযাবৎ লেখা সব গল্পের মধ্যে আমাকে সবচেয়ে স্পর্শ করেছে "আকর্ষ" গল্পটি। আজ এই মুহূর্তে লিখছি যখন, আবার পড়লাম যখন, সেই প্রথমবার পড়ার মতোই আর্দ্র হল মন আর চোখ। এ গল্প যতবার পড়ি অন্ততঃ একটা করে বাক্য যেন সেই পাঠে খোলস ছাড়িয়ে নতুন করে ধাক্কা দেয় আমার অনুভূতিতে। এই গল্পের কোন বিশ্লেষণে যাবনা আমি। স্বামী - স্ত্রীর যৌথ যাপন নেই এ গল্পে। অথচ সে অর্থে বিচ্ছেদও নেই । প্রেম আছে কি নেই তাও বুঝতে পারিনা। গোটা গল্প জুড়ে অসম্ভব এক মায়া শুধু। মায়া না স্নেহ? - বুঝতে পারিনা। ভালোবাসা শব্দটা যেন ছোট্ট একটা বিন্দু হয়ে যায় এ গল্পে । গল্পের নাম আকর্ষ। অপরাজিতার আকর্ষ যেমন, - পেলব আর সবুজ । গাছকে শক্ত করে ধরে রাখে অথচ নিজে কি অসহায় আর দুর্বল। সামান্য টান দিলেও যুঝে উঠতে পারেনা। গল্প পড়তে পড়তে আকর্ষ দিয়ে বেঁধে ফেলে মন অজান্তে ছোট ছোট গাছের চারাগুলি, গল্পেই বড় হওয়া ছোট্ট কুকুরছানা, পরিচয়ের রহস্য মাখা বাবুলাল, বারে বারে হারিয়ে গিয়ে ফিরে আসা সুপ্রকাশ আর যার নাম দেননি লেখিকা ইচ্ছে করেই, আখ্যানমুখ্য চরিত্রটি,পঞ্চাশোর্ধ ভূগোল দিদিমণি।
পাড়াতুতো চাঁদ
ইন্দ্রআণঈ
গুরুচণ্ডালী প্রকাশন