এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কলকাতার চীনে খাবারের হাল-হকিকৎ

    ন্যাড়া লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ২৬ অক্টোবর ২০১৯ | ২৭৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ন্যাড়া | ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ১১:১৯388297
  • ধরুন সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে চৌরঙ্গির দিকে যাচ্ছেন। গণেশ অ্যাভিনিউয়ের মোড়ে এসে ডান দিকে বেঁকে - মানে গণেশ অ্যাভিনিউতে ঢুকে - একটু এগোন। বাঁদিকে একটা গ্যারেজ কাম মৃত গাড়ির খোলা গুদোম পড়বে। আগে পেট্রোল পাম্প ছিল। এর পেছনে একটা তিনতলা বাড়ির দোতলায় পুরনো চীনে খাবার দোকান ইউ চু। আশির দশকে অল্প-কিছু লোকের ছোট গন্ডি থেকে সাধারণ্যে ট্যাংরার শুভমুক্তির আগে টেরিটিবাজার-বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট অঞ্চল ছিল প্রামাণ্য চীনে খাবার জায়গা। সত্তরের দশকে জানেওয়ালে লোকেদের মধ্যে বিশিষ্ট চীনে খাবার দোকান হিসেবে পরিচয় ছিল ইউ চু-র।

    ইউ চু একটা বিশেষ জিনিস পরিবেশন করত যা কলকাতার আর খুব কম জায়গাতেই খেয়েছি। সেটা হল চিমনি সুপ। একটা জ্বলন্ত চুলা আর তার ওপর একটা বড় পাত্রে টগবগ করে ফুটন্ত জল এনে আপনার টেবিলে রাখবে। আর সঙ্গে দেবে শাকসব্জি, মাছ-মাংস। এবার আপনি আপনার পছন্দমতন জিনিস ওই জলে ফেলুন। নুন দিন, মরিচ দিন, সয় সস দিন, চিলি সস দিন, ভিনিগার দিন - দিয়ে নিজের মতন সুপ রান্না করে হাতা দিয়ে বাটিতে ঢেলে ঢেলে খান। "টিচ ইওরসেলফ কুকিং সুপ" টাইপের ব্যাপার। ফুটন্ত জল যেটা বললাম, সেটা খুব সম্ভবতঃ চিকেন স্টক বা ব্রথ। বেশ ক'বছর পরে ফ্রিস্কুল স্ট্রিটের একটা দোকানেও দেখেছি চিমনি সুপ পাওয়া যায়।

    এই চিমনি সুপের সহোদর না হলেও জ্ঞাতিভাই হল হটপট। আবার অন্য এক জায়গায় দেখছি চিমনি সুপ নাকি তিব্বত থেকে এসেছে। সেই কলকাতা, রাণাঘাট, তিব্বতের তিব্বত। আমি কিন্তু হটপটেই আস্থা রাখলাম। হটপট পদটি যা দেখছি ১০০০ বছরের পুরনো। আদতে মঙ্গোলিয়ার পদ। সেখান থেকে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, চীন, তাইওয়ান - এইসব দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। জাপান আর কোরিয়ায়ও। এতদিনের পুরনো খাবার, এতগুলো দেশে ছড়িয়েছে, নির্ঘাত প্রতিটা অঞ্চল নিজেদের মতন করে একে সাজিয়ে নিয়েছে।

    অনেক বছর বাদে ২০১৩ না ২০১৪ সালে চিমনি সুপ খেতে আবার ইউ চু গেলাম। খুব যে মুগ্ধ হলাম, তা বলব না। যদ্দুর মনে পড়ে ছেলেবেলাতেও তেমন হইনি। স্বাদের থেকে নভেলটিই বেশি টেনেছিল। বাকি সব খাবার দিব্যি ভাল। ব্যক্তিগতভাবে দীর্ঘ বিদেশবাসের পরে কলকাতার চীনে খাবার আমার জিবে একটু বেশি মশলাদার লাগে। আর যেটা সহ্য করতে পারিনা সেটা হল ভাতের মাড় বা কর্নস্টার্চ দিয়ে থকথকে গ্রেভি জিনিসটা। কাজেই পারলে সব খাবারই 'ড্রাই' দিতে বলতে হয়।

    ছেলেবেলায় শুনেছিলাম চীনে খাবারের চার স্টাইল মানে সাব-কুইজিন। ক্যান্টোনিজ, সেজুয়ান, হুনান আর ম্যান্ডারিন। এখন উইকিপিডিয়া-যুগে এসে দেখছি চার থেকে ন'রকম ভিন্ন স্টাইলের কথা বলছে। ম্যান্ডারিনকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছি না। মেন চারটের মধ্যে ক্যান্টোনিজ আছে - এই যা বাঁচোয়া। কলকাতার চীনে মূলতঃ ক্যান্টোনিজ স্টাইল। সব চীনে স্টাইলের মধ্যে ক্যান্টোনিজই সবথেকে হাল্কা স্বাদের। কিন্তু আজকের কলকাতার চীনে খেলে সেকথা বিশ্বাস করা অসম্ভব। তবে এও সত্যি কলকাতার চাইনিজ এখন এক নতুন কুইজিন - যা ইন্ডো-চাইনিজ নামে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক বাজারে কল্কে পাচ্ছে। চীনেরা অসম্ভব উদ্যমী বলে বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় কুইজিন হল চীনে কুইজিন। কিন্তু সব দেশ বা জাতই সেই চাইনিজকে নিজের মতন করে পালটে নিয়েছে। এটা অবশ্য সব বিদেশী খাবার সম্বন্ধেই খাটে। ইন্ডো-চাইনিজও অ্যায়সা মাফিক। অ্যামেরিকার সাধারণ দোকানের চীনে সাহেব-মেমদের মুখের মতন রান্না করা - হাল্কা এবং অনেক রান্নাতেই মিষ্টির প্রাধান্য। তবে এই সিলিকন ভ্যালিতে - যেখানে বিদিশি প্রচুর, বিশেষতঃ চীনে ও ভারতীয়, সেখানে - বেশ কিছু বিভিন্ন স্টাইলের প্রামাণ্য চীনে দোকান আছে। সেজুয়ান স্টাইলের একটি দোকান বিশেষভাবে মন কেড়েছিল। দক্ষিণ-চীনের রান্না। চীনে বন্ধুরা ব্যক্তিগতভাবে সার্টিফিকেট দিয়েছিল যে এই দোকানের খাবারই আথেন্টিকতার সবচেয়ে কাছ দিয়ে যায়। রান্না অতীব ঝাল। সাহেব বন্ধুরা খেতে গিয়ে দরদর করে ঘামত আর "অসাম, টু গুড" বলে খাবার গলাধঃকরণ করত। অতথিদের যতবার খাইয়েছি, সে দোকান আমার মুখে রেখেছে। হায় রে, আজ সে দোকান থাকলেও তার খাবারের মান আর মন টানে না। এখানে রেড-হট-চিলি-পেপার বলে একটি রেস্তোঁরার আছে, স্বঘোষিত ইন্ডো-চাইনিজ। তবে তার চেফ ছিল সিঙ্গাপুরের লোক। গেল মাসে বলল, ছেড়ে যাচ্ছে। আরেকটা স্বঘোষিত ইন্দো-চাইনিজ ইনচিন ব্যাম্বু গার্ডেন। এই দুই রেস্তোঁরাতেই মুল পদের (অঁট্রে) থেকে অ্যাপেটাইজারগুলো খেতে ভাল।

    আশি-নব্বইয়ের দশক অব্দি ট্যাংরার খাবার খুবই ভাল লাগত। বিশেষত ছোট দোকানগুলোয়। ট্যাংরা নামী ও বড় হয়ে সেই গৃহপালিত ব্যাপারটা হারিয়ে ফেলল। আজকাল ট্যাংরার খানাকুলের প্রতিও আর বিরাট কিছু আকর্ষণ বোধ করি না। মেনল্যান্ড চায়না কোনদিনই রসনা জয় করতে পারেনি। ক্যালকাটা ক্লাবের চীনে খাবার অতি উৎকৃষ্ট ছিল। তবে সেও শেষ গেছি বছর দশেক আগে বোধহয়। সত্তর-আশির দশকের বেঙ্গল ক্লাবের চীনে খাবারের খ্যাতিও ছিল কিংবদন্তীসম। তিরিশ বছরে শুনেছি সে গৌরব আর নেই। শেষ বছর পাঁচেকের মধ্যে নবরূপে ওয়ার্ল্ডর্ফও পুরনোদিনের স্বাদ ফিরিয়ে দিতে পারেনি। সেই তুলনায় ইউ চু-র খাবার অনেক তৃপ্তিদায়ক।

    শুধু চীনে খাবারই নয়, কলকাতায় বিভিন্ন শৈলির অনেক নতুন রেস্তোঁরায় খেয়ে আমার এই বিশ্বাস দৃঢ়তর হয়েছে যে রসনা এবং পকেট - দুয়ের দিক থেকেই নতুন অ্যাম্বিয়েন্স-সর্বস্ব রেস্তোঁরার থেকে কলকাতার সাবেক খাদ্যবিপণীগুলো অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য। সে ধারণায় আরও গত্তি লাগল ২০১৫-র ডিসেম্বরে কলকাতার পুরনো চীনে দোকান "জিমি'জ কিচেন"-এ খেয়ে। আজকের কলকাতার হিসেবে অ্যাম্বিয়েন্সের ঘাটতি থাকলেও স্বাদের দিক দিয়ে খুবই তৃপ্তিদায়ক এবং পকেটের দিক দিয়ে গেরস্তপোষা।

    পুরনো চাল শুধু ভাতেই নয়, ফ্রায়েড রাইসেও বাড়ে। তা বাড়ুক। কলকাতার এখনকার চীনে খাবারের হাল-হকিকৎ নিয়ে শুনতে চাই।
  • AD | ***:*** | ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ১৩:২৩388298
  • জিমিস কিচেনের অ্যাড্রেসটা কোথায় একটু জানা যাবে?
  • গবু | ***:*** | ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ১৪:১৮388299
  • কলামন্দির থেকে সামনের বড়ো চৌমাথা পৌঁছে বাঁ দিকে ঘুরলেই জিমিস কিচেন। বরাহ অতি উপাদেয়!
  • গবু | ***:*** | ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ১৪:২১388300
  • ন্যাড়া, টুং নাম গিয়েছেন কি?

    পোদ্দার কোর্টের পিছনে। বেশ জায়গা, বেশ খাবার। পাতি বেঞ্চিতে বসে খাওয়া, যারা ambience চান, তাদের জন্যে নয়।
  • ন্যাড়া | ২৭ অক্টোবর ২০১৯ ১১:০৫388301
  • কলকাতায় জিমিজ কিচেন দেখছি এখন চারটে। আদি ওই গবুবাবু যেমন বললেন। আমি শেষ গেছিলাম বাইপাসের ওপর যেটা - সেটায়।

    টুং নাম চেনা লাগছে না। কিন্তু আজ থেকে সাঁইতিরিশ বছর ওই পোদ্দার কোর্টের পেছনে অতি ছোট বেঞ্চি পাতা, টিনের ছাতওলা একটি চীনে দোকানে পিতৃদেবের সঙ্গে গেছিলাম। এলাকায় তিব্বতি রেস্তোরাঁ কুঙ্গা তখনও বেঁচে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন