এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দ্যুতি | ***:*** | ০৩ জুলাই ২০১৯ ১৫:৫৮383150
  • যারা রথ টানো না, জি বাংলা দেখো সন্ধ্যে থেকে সব সাধ পূরণ হবে। রথ মানেই নস্টালজিয়া, পিছুটান, ছোট্টবেলা। আমার জীবনে রথ মানে বাবা আর ঠাকুমা। হাওড়া শহরে তেমন গাছপালা আমাদের বাড়িতে ছিল না। তবু রথের দিন রকমারি ফুল, পাতার অভাব দেখিনি। বাবার সেদিন আলাদা উদ্দম। যে কোনো হুজুগ কি করে উপভোগ করতে হয় বাবা জানে। আগে ছোট রথ ছিল, একবার কাঠের কারখানায় বলে একটা তিন তলা রথ জুটলো আমাদের। সে কি আনন্দ আমার। কেমন করে শিখেছিলাম রথ সাজাতে মনে নেই, মার্বেল কাগজ এনে দিতো বাবাই। সেই কাঠের রথকে কাগজে মুড়ে নতুন রূপ দেওয়া। আমার মামার বাড়িতে সাদা কালো, সাদা সবুজ মার্বেলের মেঝে ছিল। আমাদের এমনি এক রঙা মেঝে হাওড়া বাড়ির। ওই তিন তলায় কাগজ কেটে কেটে সেই মামা বাড়ির মেঝের মত নকশা করা গোল গোল থামের মত ওই কেঠো সাপোর্ট গুলোকে সবুজ দিয়ে মুড়তাম। আমার ইস্কুলের ঠাকুর দালান মনে গাঁথা চিরকাল। রথের মাথার চুড়োটা হলুদ কাগজে মুড়ে, তার উপর যে ছোট কাঠি গোঁজার ফুটো সেখানে একটা লাল তিনকোনা পতাকা রাখতাম, পরের বার আবার ওই চুড়ো লাল রঙ আর পতাকা হ্লুদ হতো। কাগজের কাজের প্রধান উপকরণ আঠা, ঠাকুমা আটা জলে গুলে উনুনে ফুটিয়ে বানিয়ে দিতো। তাতে দিব্যি কাজ চলতো। এরপর শুরু হত জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার সাজগোজ।তাদের মালা গাঁথা, মুকুট পরানো, সেই সাথে সারা রথ ফুল পাতা দিয়ে সাজানো।কলকে, বেলি, জুঁই, টগর, দোপাটিদের সাথে পাতা বাহাররা পাল্লা দিত। সামনে দুটো ঘোড়া বাঁধা থাকতো। আমার মনের ঘোড়ার সাথে তাদের দৌড় চলতো অহরহ। ঠাকুমা ঠিক মোটা রশি জুটিয়ে দিতো। প্রতিবার আগেরবারের রশি ফেলে নতুন রশি লাগাতাম। ছোট্ট থালায় কিছু ফল, মিষ্ট প্রসাদ আর ধুপদানিতে ধুপ। আমার সাধের রথ তৈরি। ওদিকের বড়ঘরে দাদু ততক্ষণে মালকোচা মারা ধুতি আর সাদা ধবধবে ফতুয়াতে তৈরি। দাদুর সবকিছুই ছিল পরিপাটি, দেখতে কালো হলে কি হবে মনের আলোতে সদা উজ্জ্বল। ওই ধবধবে সাজে যেন আরো সুন্দর লাগতো দাদুকে। দাদুর রুমালটিও পাটে পাটে পাট করা থাকতো। দাদুর চটিজোড়া সেও যেন ডেকে বলতো আমায় দেখো। এ যত্নশীলতা দাদুর বড় গুণ, যার সবটূকু দায়ভার দাদুর নিজের। বাবা কাকারা যে যার সময় মত এসে জুটতো। হাল্কা ছাপা বাহারে ফ্রকে আমি তৈরি, দিদি বোন ভাই যারা থাকতো সবাই রেডি।
    মনে এইভাব আমার রথের সাজ সবার সেরা। কিন্তু রাস্তায় বেরিয়ে এর ওর তার রথ দেখে প্রতিবারই কিছু ভালোটা, মন্দটা চোখে পরতো। মনে মনে ঠিক করতাম পরের বার এটা এমন, ওটা ওমন করবো। রাস্তায় কেউ দাঁড় করিয়ে রথের সাজ দেখে বাহবা দিলে গলে যেতাম। আহা তাই তো, তাই তো, এ রথই সেরা আবার মন বলে ওঠে। প্রতিবারই কিছু অসুবিধা এসে জুটতো রথ টানতে গিয়ে। বেশি এবড়োখেবড়ো রাস্তা হলে প্রসাদের থালাগুলো এগিয়ে আসতো, ঠাকুরও নড়বড় করতো, ধুপদানি পরে যাচ্ছিল আরেকটু হলে, কিম্বা ঘোড়াদুটো খালি লেঙ্গি খেয়ে কাত হয়ে যাচ্ছে। দাদু বলতো, 'বনি আরেকটু কষে বাঁধবে তো।' এ পাড়া ও পাড়া ঘুরে সন্ধ্যের আগে বাড়ি ঢোকার তাড়া। কতো কে এসে রথের রশি টেনে দু টাকা - পাঁচটাকা রেখে যাচ্ছেন প্রসাদের থালায়। দাদুর বন্ধুদের আড্ডায় গেলে বেশ কিছু আমদানি হত। মনে মনে লাড্ডু ফুটতো। বাড়ি ঢুকতেই চারদিক গন্ধে ম ম করতো। ফুলুরি, পাঁপরভাজা, ঘুগনি,নিমকি আরো কত কি রেডি। এতো ঘুরে পেটের ছুঁচোগুলোও লাফালাফি জুড়েছে। বাড়তি লোকের অভাব ছিল না বাড়িতে। কে আপন কে পর সেসব বুঝিনি কোনোদিন।এসব লিখছি আর আফশোস হয়, এই পরিবেশ তো আর আজকের প্রজন্মকে দেওয়া হলো না তেমন করে। এবার জামা বদলে একটু চুল বেঁধে টেঁধে দেখতাম ঠাকুমাও লাল চওড়া পেড়ে শাড়ি পরে রেডি সেডি গো। সিঁথির সিঁদুরের দু চার ছিটে নাকে না পরলে হয় না, কপালের সিঁদুরের টিপটা চিরকাল একটু থ্যাবড়ানো, ধ্যাবড়ানোই থাকতো, ওটাই স্টাইল। আর মুখে জর্দা পান। আঁটপৌড়ে শাড়ির আঁচলে আটকা গিন্নিমায়ের চাবির গোছা। ও চাবিতে ঢের বেশি অকেজো চাবি, কিছু জং ধরা, জং পরতো হাতের নোওয়াতেও। মোটা শাঁখা, পলা। কোনোদিন এদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয় নি আমাদের মত, কোনোদিন এসবের জন্য নারীবাদী গান গাইতে শুনিনি। যাই হোক সাথে সাথে ছোট ঘর থেকে তারাদি সাদা ধপধপে থানে তৈরি, হাতে সাজা আরো দু খিলি করে পানের বাটা।
    বাবা যেখানেই থাকতো সন্ধ্যেবেলা জুটে যেত। বাবা ছাড়া এসব রথের মেলা ট্যালা জমে না। ঠাকুমার জমানো খুচরো, আমাদের ভাঁড়ে জমানো টাকা আর সদ্য রথ চালিয়ে যা আমদানি হত তাই দিয়ে কলা বেচার গপ্প। হাওড়া ময়দানের রথের মেলার সাথে হাত ধরাধরি করে আসতো বৃষ্টি, কাদা, আর জ্যামজট। ওলা, উবের তখন কারোর স্বপ্নেও আসেনি। পা গাড়ি ছিল বেস্ট, ছিল পাড়ার বুধো জ্যেঠুর রিক্সা। মেলায় ঢোকার কি উন্মাদনা, আমার হলুদ-সবুজ ফ্রক বেয়ে নেমে যাওয়া সাদা ঠ্যাঙ জুড়ে কাদার আল্পনা। তার কোথাও সাইকেলের টায়ারের ছোপ, কাদার ছিটে ফ্রকেও লাগছে,বেশ বুঝতে পারছি। ওসব মারো গুলি, চলো চলো, ইলশেগুঁড়ি শুরু, মনে আঁকা বিশাল ফর্দ। গেলোবার রাশে রাধাকৃষ্ণটা কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছিল, এবার একটা সুন্দর রাধাকৃষ্ণ কিনবো,সেবার ঝুলনে ভাই কাঁচের শিব মূর্তিটা ভেঙে ফেলেছিল, এবার একটা বড় দেখে শিব মূরতি কিনবো। ঝুলনের জন্য কটা সাইকেল, রিক্সা, গরুর গাড়ির মডেল, কিম্বা বর-বৌ, চাষী এসব কিনতে হবে। ও হ্যাঁ, কাকার মেয়ের জন্য হ্যাপি ফ্যামিলি পুতুল, ভাইদের পছন্দের ব্যাট বল, একটা কাঠের ব্যাগাডুলি, লুডোর বোর্ডটা ছিঁড়ে গেছে তাই একটা নতুন চাই। একটা ঘাড় নাড়া বুড়ো। ওদিকে চলো, মায়েদের লিস্টিগুলো সারি, ভালো একটা বেলুন চাকি, আরো দু একটা বড় সাইজের হাতা খুন্তি, কিম্বা লোহার কড়াই। এসব সারা হলে ওই সামনে গাছের চারার ওখানে চলো। এবার গরমে বেলির চারাগুলো শুকিয়ে গেলো, রজনীগন্ধাটার স্টিকগুলো তেমন ভালো না, আরো কটা জবা, গোলাপের কলম। ভাবছো শেষ? আরো আছে। আরে ওই যে রংবেরঙের বদরি পাখি ক খানা এবার নিয়ে যাবোই। ছোটপিসির গঙ্গারামকে কিছুদিন হল বেড়ালে খেয়েছে। ঠাকুমা এই পাখি পোষার চরম বিরোধী, অত শুনলে তো। ভাই একবার দুটো খরগোশ এনেছিল, নাম দেওয়া হয়েছিল রোমিও জুলিয়েট, ভাগ্যে সেক্সপীয়র সাহেব জানতে পারেন নি।
    এই রে এবার বৃষ্টি জোড় হল, পা চালিয়ে গিয়ে ফিফটি ফাইভে উঠে পরো, তাড়াতাড়ি হবে। চলন্ত বাসে উঠে, আস্তে লেডিস বলে ঠাকুমা, তারাদিকে টেনে তোলা হোত, বাবা সবার শেষে। কোথায় ছিল হাফানি আর দমের কমি। ফজির বাজার আসতেই ধপাধপ নামা হোত,বৃষ্টি আবার একটু ধরেছে, ঐ তো পাগলার রিক্সা দাঁড়িয়ে, সবাই মিলে কেমন করে যেন এঁটে যেতাম। বাবা হেঁটে ফিরবে, বাস স্ট্যান্ডের মাসির চপ, সুধীরের দোকানের জিলিপি, গরম বোঁদে, কচুরি সাথে। তারাদি একটা নতুন হাওয়াই কিনে পুরানোটাকে মেলাতেই বিদায় দিয়ে এলো।
    হ্যাঁ, দিনটা এভাবেই ফুরিয়ে যেত। কোনো তেমন রথের ছবি কিম্বা ফেবু আপডেটের বালাই ছিল না। ছিল পরম সুখ। তালপাতার ভেঁপুর আওয়াজ আজো কানে ভাসে।হাওয়াই মিঠাইয়ের চুপসে যাওয়া ঠোঁটের রসে, লাল লাল জিভ এসবে ছিল নির্ভেজাল আনন্দ। আরো রাত অব্ধি চলত আরো আড্ডা, গান। এতকিছুর মাঝে কোথায় ছিল কালকের বাকি থাকা হোম ওয়ার্ক আর উইকলি টেস্টের ধুম কে জানে। হয়ত তাই বড় প্রোফাইল হওয়া গেলো না, ফর ফর করে ইংরিজি বলে আই টি সেক্টরের ডিওতে প্রাণ ডবানো হলো না। তাতে কি তাতে কি! জীবনটা হুজুগ বৈ তো কিছু নয় হয়ে রইলো না মানে বাঁচলো। আজো সেই রসদ বাঁচিয়ে বাঁচি। আজো হাওড়া হাতছানি দেয় সকাল থেকে রাত, উপরের মাঝের ঘরের তাকে আজো ওই রথ রাখা জানি। ওই কাদায় লুটোপুটি খেতে মন চায়,হারানো শৈশব পিছু ডাকে।।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন