আরুগ্রামে আমরা ছিলাম বিলালভাইয়ের আতিথ্যে। রজত সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। পহেলগাম থেকে বারো কিমি দূরে ছোট্ট গ্রাম আরু। বিলালভাই এর গেস্টহাউস মিল্কি ওয়ের সামনেই বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা। ঘন পাইন বনের ওপাশে বরফে মোড়া পাহাড়চুড়ো। তিরতির করে বয়ে চলে আরু নদী। বিলাল ভাইয়ের দাদা ফৈয়জ ভাইকে মাইক্রফট হোমসের মত দেখতে। শার্লক হোমসের দাদাকে আমি দেখিনি, কিন্তু বর্ণনা পড়ে মনে হয় তিনি নিশ্চয়ই এমনই লম্বা, এমনই খাড়া নাক তাঁর, এমনই ক্ষুরধার দৃষ্টি। গেস্ট হাউসের কাঁচ ঢাকা বারান্দা থেকেই ইশকুলটা দেখা যায়। গ্রামের একমাত্র ইশকুল। ফৈয়জ ভাই বললেন টিফিনের ছুটির সময় মাস্টারমশাইয়ের সাথে দেখা করা যাবে। ইশকুলে সাকুল্যে চারজন শিক্ষক। দুইজন হিন্দি, উর্দু পড়ান। বাকি দুজন ইতিহাস, ভূগোল। বিজ্ঞান, অঙ্ক, ইংরিজি পড়ানোর কেউ নেই। ছেলেমেয়েরা কিন্তু দিব্যি বুদ্ধিমান। ছেলেরা মোটামুটি সকলেই লেখাপড়ার পাশাপাশি ট্যুরিস্ট সিজনে ঘোড়া ধরে। শুনে শুনেই চমৎকার ইংরিজি শিখে নিয়েছে। মাস্টারমশাই বললেন, কদিন আগে এক রিটায়ার্ড জেনারেল বেড়াতে এসেছেন। তাঁর ঘোড়া ধরেছে একটি বুদ্ধিদীপ্ত সপ্রতিভ ছেলে। জেনারেল রীতিমত অভিভূত হয়ে তার কথা জিগ্যেস করছেন গ্রামে। জানা গেল সে ছেলে পহেলগাম তফশিলে বোর্ডের পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে।
- ওরা কি আর পড়াশোনা করতে চায় না?
- বাবা-মায়ে ভয় পায় শহরের কলেজে পাঠাতে। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে যদি! ছেলেটাই যদি আর না থাকে!
আর মেয়েগুলো? ঘরের কাজ করছে। সেলাই করছে। দরদাম করে কাশ্মীরী হ্যান্ডলুম কিনে আনছে ট্যুরিস্ট। কলেজে যাচ্ছে কয়েকজন। গেলেই তো হল না। দুমদাম কার্ফিউ জারি হয়। পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। বছরের পর বছর নষ্ট হয়।
সন্ধ্যেবেলা ট্যুরিস্টদের প্রকোপ কমলে গেস্ট হাউসের সামনে উপত্যকায় ছেলেগুলো ক্রিকেট খেলে। আমি আর মিঠুন একপাশে দাঁড়িয়ে দেখি। মিঠুনের হাত-পা নিশপিশ করে। আমি বলি - তোর খেলতে ইচ্ছে হচ্ছে? সে হাসে - না না, দেখতেই ভালো লাগছে। একদিন বেলা প্রায় মরে এসেছে। এমন সময় একটা ট্যুরিস্ট বাস এসে দাঁড়ায়। সবাই নামেও না বাস থেকে। মহিলারা বিলাল ভাইয়ের পারিবারিক শালের দোকানে ঢুকে যান। পুরুষেরা সেলফি তোলেন। একজন ভদ্রলোক ইন্ডিজিনাস একটিভিটিতে অংশ নিতে এগিয়ে আসেন।
- তুমলোগ ক্রিকেট খেল রাহে হো? হাম ভি খেলেগা। ব্যাট দো মুঝে। দেখতে হ্যায় কওন মুঝে বোল্ড কর পায়েগা।
ছেলেগুলো মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ব্যাট দেয়। এক বলেই বোল্ড।
- ঠিক হ্যায়, অর এক বার।
আবার বোল্ড। তিন নম্বরটা ঠেকায়। তারপর আবার।
- হা হা! গুড জব। আচ্ছা লাগা তুমসে মিলকে। আচ্ছা, ইধার আও। এক ফটো লে লে? আচ্ছা, ওর এক ফটো। ব্যাট দো মুঝে। বহুত আচ্ছা!
এরপর ভদ্রলোকের খেয়াল হয় পাশেই উত্তরাধিকারী দাঁড়িয়ে। সুতরাং তাঁর ছেলেকেও ব্যাট করতে দিতে হয় যতক্ষণ না বাঁধিয়ে রাখার মত ছবি উঠছে। এইসব করতে করতে পাহাড়ে অন্ধকার হয়ে আসে। ছেলেগুলো খেলা গুটিয়ে ঘোড়া নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। ওদিকে মহিলাদের দোকান থেকে বার করতে হাঁকডাক শুরু হয়। আকাশছোঁয়া বরফচুড়োয় ঘেরা ওই বিস্তৃত উপত্যকায় দাঁড়িয়ে আমাদের দুই শহুরে মানুষের খুব লজ্জা লাগে। আমরা প্রাণপনে শতাব্দীপ্রাচীন মহাকারুণিক মানবাত্নার ক্ষমাভিক্ষা করতে থাকি।
আলতাফ ভাই অটোওয়ালাকে বলে রেখেছিলাম একদিন আমাদের শ্রীনগরের মসজিদগুলো ঘুরিয়ে দেখাতে হবে। ভদ্রলোক তো খুব রাজি। কিন্তু আমরা যা যা দেখতে চাই সেগুলোর সবকটা তাঁর সিলেবাসে পড়ছে না।
"গর ফিরদৌস বর রুয়ে জমিন অস্ত
হামিন অস্ত, হামিন অস্ত, হামিন অস্ত"
(পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তা এখানেই, এখানেই, এখানেই)
মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর কাশ্মীরে এসে এই লাইন ক'টি উচ্চারণ করেছিলেন জানা যায়। নাতি দারা শিকোও কাশ্মীরের প্রেমে মজেছিলেন। একথা আমরা অনেকেই জানি দারা শিকোর সুফি ইসলামের প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল। কাশ্মীর বহুদিন ধরেই সুফি সাধনার পীঠস্থান। মিয়াঁ মীর নামে এক সুফি সাধক কাশ্মীরে থাকতেন। দারা শিকোর ইচ্ছে হল তাঁর সাথে দেখা করার। কিন্তু দারা কাশ্মীরে আসার আগেই মিয়াঁ মীরের দেহান্ত হল। মিয়াঁর এক শিষ্য তাঁর উত্তরসুরী হলেন। নাম মোল্লা শাহ বদকশী। আখুন্দ শাহ নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। দারা কাশ্মীরে এসে তাঁর কাছে নাড়া বাঁধলেন। ডাল লেকের পশ্চিম তীরে হরি পর্বতের পাদদেশে একটি মসজিদ তৈরী হল আখুন্দ শাহের নামে। এই মসজিদটি যে এখন পরিত্যক্ত তা আমাদের জানা ছিল। কিন্তু এটাও শুনেছিলাম আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া মসজিদের সংস্কার শুরু করেছে। আমাদের আশা ছিল একবার শ্রীনগরে গিয়ে পড়লে নিশ্চয়ই মসজিদটার খোঁজ পাওয়া যাবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল লাল চকের হোটেল ম্যানেজার বা অটোচালক আলতাফ ভাই এই মসজিদের নাম শোনে নি। আলতাফ ভাইই তখন বুদ্ধি দিলেন - আপনারা তো আরও মসজিদ ঘুরবেন। সেসব মসজিদের বুর্জুগরা নিশ্চয়ই এই মসজিদের খোঁজ দিতে পারবেন। কথাটা মনে ধরল। লিস্টের অন্য নামগুলো মেলে ধরলাম আলতাফ ভাইয়ের সামনে।
পুরনো শ্রীনগরের মসজিদগুলোর অনেকগুলোই কাঠের তৈরী। পাহাড়ী জায়গায় এমন হওয়াই স্বাভাবিক। মসজিদগুলোর আকার প্যাগোডার মত। উত্তর-্পশ্চিম ভারতে বৌদ্ধপ্রভাবের জন্য এমনটা হতে পারে। আমার যদিও পড়াশোনা করা হয়নি এ নিয়ে। এমনই একটা মসজিদ খাজা বাজার নকশাবন্দ (বা নকশাবন্দ সাহিব)। প্রায় ছশো বছরের পুরোনো মসজিদ। নবী মহম্মদের চুল নাকি প্রথমে এখানেই আনা হয়। কিন্তু বাজারের মধ্যে ছোট মসজিদে দর্শনার্থীদের ভীড় সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। তখন ডাল লেকের ধারে ফাঁকা জায়্গায় হজরতবাল মসজিদ তৈরী করে নবীর দেহাংশ সেখানে স্থানান্তরিত করা হয়। হজরতবাল এখন শ্রীনগরের সবচেয়ে বিখ্যাত মসজিদ। ট্যুরিস্টদের ভীড় মূলত সেখানেই হয়। নকশাবন্দ মসজিদের ভিতরে অপূর্ব পেপার ম্যাশের কাজ আছে। আরেকজন সুফি সাধক শাহ হামদিন ১৩৯৫ সালে পারস্য থেকে কাশ্মীরে আসেন। পেপার ম্যাশে শিল্পটি তাঁর সাথেই ভারতে আসে বলে অনুমান করা হয়। শ্রীনগরে শাহ-এ-হামদিন মসজিদ পেপার ম্যাশের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। তবে নকশাবন্দ সাহিবও কম যায় না। আমার অবশ্য দেখার সৌভাগ্য হল না। মসজিদের ভেতর মেয়েরা ঢুকতে পারবে না। মিঠুনকে ওরা যত্ন করে দেখিয়ে দিলেন। তখনই আলাপ হল পীর সাহেবের সাথে। আখুন্দ শাহ বলতেই তিনি বুঝে গেলেন। অটোওয়ালা আলতাফ ভাইকে বলে দিলেন কিভাবে যেতে হবে। নিজের ফোন নাম্বারও দিয়ে দিলেন আমাদের দরকার হলে ব্যবহার করার জন্য।
আলতাফ ভাই ভারী খুশি হয়ে বললেন - মাখদুম সাহিব যাবেন আগে বললেই হত! ওখানে আমারও একটা কাজ আছে। সেরে নেব।
খানিক ভেবে বুঝতে পারলাম আখুন্দ সাহিবের মসজিদটা মাখদুম সাহিবের লাগোয়া। মাখদুম সাহিব শ্রীনগরের খুবই জাগ্রত মসজিদ। এটাও একজন সুফি সাধকের নামে। স্থানীয় লোকজন তাদের হাজারো সমস্যায় এই মসজিদে এসে প্রতিকার খোঁজে। আলতাফ ভাইয়ের দরকারটাও সেই গোত্রের মনে হয়। আমরা আর মাখদুম সাহিবে ঢুকলাম না। পাশ দিয়েই সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে যেখানে ASI একটা ভাঙা মসজিদ মেরামত করছে। ছেলেপিলেরা হাওয়া খেতে সেখানে যায় বটে। ভক্তরা ওঠে না।
আমরা উঠে দেখলাম চিনার গাছের তলায় ফ্যাকাশে হলুদ পাথরের মসজিদ। খুব বেশি বড় না। মাঝারি একহারা বাড়ি। ভাঙা থামের কিছু টুকরো পড়ে আছে সামনের চত্ত্বরে। তবে পরিত্যক্ত হলেও বেশ পরিস্কার। দুটি ছোট ছেলে পাঁচিলে বসে নিচের শ্রীনগর শহর দেখছিল। আমাদের দেখে ঘুরে তাকালো। আমরা ওদের হাত নেড়ে মসজিদের সিঁড়িতে বসলাম কিছুক্ষণ। দরজা বন্ধ। ভেতরে যাওয়ার উপায় নেই। দরজার ফুটোয় চোখ রেখে ভিতরে কি আছে দেখে এলাম। ভারী শান্তির পরিবেশ। মিঠুন বলল, চল পিছনে কি আছে দেখে আসি। ভাঙা পাথরের টুকরো পেরিয়ে পিছনে যাওয়া হল। এদিকটা একেবারেই পরিচর্যাহীন। গোটা তিনেক ছেলে গুলতানি মারছিল। আমরা ছবি-টবি তুলে আবার সামনের দিকে ফিরে এলাম।
ততক্ষণে আরও দুটো ছেলে হাজির হয়েছে চিনার গাছের নীচে। ওদের সাথে একটু গল্প করে ফিরে আসছি, এমন সময় এক মাঝবয়েসী ভদ্রলোককে দেখা গেল এদিকেই আসছেন। আমরা কোথা থেকে আসছি জানতে চাইলেন। বললাম এই মসজিদের কথা পড়েছি, খুব ভালো লেগেছে এখানে এসে।
মিঠুন বলল - মসজিদের ভিতরে বোধহয় ঢোকা যায় না, তাই না?
উনি বললেন - না, মসজিদ তো বন্ধ আছে।
তারপর কি ভেবে জিগ্যেস করলেন - আপনারা ভিতরে যেতে চান?
- যেতে পারলে তো খুবই ভালো হয়।
- আচ্ছা, একটু দাঁড়ান, আমি চাবি নিয়ে আসছি।
আমরা তো ভাবিইনি ভিতরে ঢুকতে পাবো। ছেলেদুটোও আমাদের সাথে চলল। খুবই সাদামাটা বাহুল্যবর্জিত মসজিদ। ভদ্রলোক বললেন, ভিতরের দেওয়ালে দামী পাথর বসানো ছিল। সে সত্যিও হতে পারে, মিথ্যেও হতে পারে। প্রশস্ত উঠোনটা থেকে আকাশ দেখতে ভারী ভালো লাগল। উঠোনের তিনদিকে কয়েকটি ঘর। অন্ধকার বটে, তবে ঝাঁটপাট দেওয়া। মূল দরজার মাথায় উর্দুতে কিছু লেখা। আমরা পড়তে পারি নি। আওরঙ্গজেব দারাকে হত্যা করলেও আখুন্দ শাহের গায়ে হাত দেন নি। তিনি শ্রীনগর থেকে লাহোর চলে যান এবং সেখানেই মারা যান।
দারা শিকোকে কি ভারতের শেষ স্বপ্নালু যুবরাজ বলা যায়? শাসক হিসেবে দারা কতখানি দক্ষতা দেখাতে পারতেন জানি না, তবে তাঁর বিদ্যোৎসাহিতা, সৌন্দর্যবোধ, মুক্তচিন্তার যে বিবরণ পাই তাতে মুগ্ধ হতে হয়। এই পোস্টটি লেখার সময় খুঁজে পেলাম আখুন্দ শাহ দারা শিকোর সাথে প্রথম দেখা হওয়ার পর বলেছিলেন
"নাই চিরাগিস্ত দারিন খানা-ই ভিরনা-ই মা
রোশন আজ আতিশ-ই ইশক-ই তু-শুদাহ খানা-ই মা"
(আমাদের এই বিজন ঘরে বাতি নেই
তোমার প্রেমের আগুনে এই ঘর ভাস্বর)
রাজপরিবারে এসব ভাবের কথা কি মানায়? চিনার পাতা চুঁইয়ে পড়া ঐশ্বরিক রোদের নিচে হলুদ পাথরের বেদীই তাঁর উপযুক্ত স্থান।
২০১৮ সালের কাশ্মীর ট্রিপের একেবারে শেষদিনের কথা। ভেরিনাগ থেকে যেতে হবে জম্মু, গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিলো কাশ্মীরের স্থানীয় পরিবহণ ব্যবস্থা কেমন সেই বিষয়ে একটু ধারণা তৈরী করা। একেবারে শেষের সেদিনের আগে সে সুযোগ তৈরী হয়নি। ঠিক হলো তড়িঘড়ি জম্মু গিয়ে যখন কোন লাভ নেই (বিকেলেই ট্রেন), অতএব রয়েসয়ে শেয়ারের জিপে করে যাওয়া হোক। টানা গেলে পাঁচ ছয় ঘন্টা, ভেঙে ভেঙে গেলে কত আর হবে, সাত ঘন্টাই লাগুক।
ভোরবেলা উঠে বাক্স ঘাড়ে জিপ স্ট্যান্ডে এলাম। নড়বড়ে সুমোর মাথায় বাক্স বেঁধে দিলো হেল্পার, দিয়ে জনা বারো লোক নিয়ে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে নদীর ধার পাহাড়ের গা বেয়ে হেভি স্পিডে, অনেকটা অনুসন্ধান ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের তাড়া খেয়ে আমজাদ খানের জিপ যেভাবে চলছিলো, সেভাবে চলতে থাকলো। প্রতি মুহূর্তেই মনে হতে থাকলো বাক্সটা বোধহয় পড়ে গেল, এমনকি একবার যেন আওয়াজও পেলাম। সে যাই হোক, অনতিবিলম্বেই এসে গেল বানিহাল, এখানে আমাদের গাড়ি বদলাতে হবে। শেয়ারের জিপেই আবার ওঠার কথা ছিলো, কিন্তু দেখা গেল সামনেই একখান পেল্লায় বাস দাঁড়িয়ে গাঁক গাঁক করে লোক ডাকছে।
আমি কিছু বলার আগেই তিতুম, "এইত্তো বাস, এই বাস জম্মু জায়েগা? এক্সপ্রেস হ্যায়? "ইত্যাদি বলে ছুটে গেল। দেখলাম ভাড়াও বেশ কম, জানলার ধারে সিটও আছে। অগত্যা উঠে বসলাম। কন্ডাক্টার আরো মিনিট কুড়ি দাঁড়িয়ে, এই ছেড়ে দিলাম, আর দাঁড়াবো না কিন্তু, এখনও সময় আছে এইরকম সব নানাবিধ অভিনয় করে টরে (অবশ্য এর মধ্যে অনেকক্ষণ কেটে গেছে তিতুমের বাথরুম খুঁজে পেতে) অবশেষে রওনা দিলো। প্রথম মিনিট চল্লিশেক বাস চমৎকার চললো, তারপর ক্রমশই একটা দুটো করে স্টপেজ দিতে দিতে শেষে এমন একটা সময় এলো যখন বাসটা আক্ষরিক অর্থেই শর্ট রুটের বাস কলকাতায় যেভাবে চলে, সেভাবে চলতে শুরু করলো। ততক্ষণে আগের লোকজনও সব নেমে গেছে, একজন করে উঠছে বটে কিন্তু তারা কেউই বেশিদূর যাচ্ছেনা। কাজেই চিরবিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী সত্ত্বা নিয়ে আমরা দুজনই খালি আপত্তি করে গেলাম। ততক্ষণে গরমও বেড়েছে বেজায়। শেষমেষ অবস্থা এমনই দাঁড়ালো যে এমনকি আমার ২০৮ আর কুঁদঘাট মিনি চড়া অভ্যস্ত মনেও বিরক্তিকর ঠেকতে লাগলো। বিদ্রোহ করে বললাম যে পয়সা ফেরত দাও আমরা নেমে যাবো। তাতে কন্ডাক্টার একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আবার গেটে গিয়ে দাঁড়ালো। এরপর বাস একটা ব্রেক নিলো, শিলিগুড়ি যাবার পথে যেমন রাতে কেষ্টনগর দাঁড়ায়, সেরকম। বাস স্ট্যান্ডের শুধ শাকাহারী দোকানে অখাদ্য সব মিষ্টি বিক্রি করছিলো, তার ভয়ানক কাটতি দেখে হতাশ হয়ে ঐই কিনে খেয়ে ফেল্লাম। তারপর আরো কতক্ষণ পরে বাস ছাড়লো, তারপর গরমে সেদ্ধ হতে হতে আর ভৈশ্নো দেবীর প্রভাবে চতুর্দিক নিরামিষে ছেয়ে যেতে দেখতে দেখতে কতক্ষণে জম্মু এলাম, কিছু মনে নেই। বোতলের জল এমন গরম যে কাপে ঢেলে টিব্যাগ ফেলে দিলে দিব্যি চা হবে। গরম বলে সে জল তিতুম গেলে নি, তার মধ্যে আবার পাকামি করে (পরে বলেছিলো আমায় রোদ থেকে বাঁচানোর জন্য) তার সিট জানলার ধারে, যেখানে অনেকক্ষণ ধরে রোদ পড়ছে। আমাদের কিনা রাস্তা দেখার ভারি শখ, তাই সে জানলা বন্ধ করা হয়নি। ও হ্যাঁ রাস্তায় দেখা গেল দাবানল। বাস এতই আস্তে চলছিলো যে বারকতক ভেবেচিন্তে শেষে একটা ছবি তুলেই ফেললাম।
যাই হোক, জম্মু স্টেশন অবধি আমাদের বাস পৌঁছে দিতে পারে নি, বরং খানিকটা দূরে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়, অতবড় বাস নাকি ঢুকবে না। নেমেই তিতুম বললো শরীরটা সুবিধের ঠেকছেনা, হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে, কাছ দিয়ে একটা অটো যাচ্ছিলো, তাতে উঠে বাকি পথটা যাওয়া হলো। কিন্তু তখনও বুঝিনি দীর্ঘক্ষণ রোদে বসে থেকে, জল না খেয়ে মারাত্মক ডিহাইড্রেশন হয়ে গেছে ওর।
স্টেশন চত্বরে ঢুকেই তিতুম হঠাৎ এলিয়ে বসে পড়লো। বললো জল খাবে। আমি দৌড়ে ঠান্ডা জলের বোতল এনে দিলাম, খেয়ে আরো দু পা এগিয়ে একটা দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে তারপর আবার ল্যাগব্যাগ করে এলিয়ে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। পড়ার ভঙ্গীটা অনেকটা পাতালঘর ছবিতে ঘুমপাড়ানি গান শুনে ন্যাপচা থেকে আসা ভিকের মত। দেখি জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে। বোতলের বাকি জলটা মাথায় মুখে ঢেলে, অকালবৈধব্যের আশঙ্কা বুকে নিয়ে কোনমতে দৌড়ে গিয়ে আবার জল আনলাম, সঙ্গে ফলের রস।
এরপরে আরো বহুক্ষনের চেষ্টায়, বিবিধ মানুষের দুর্ব্যবহার, এসি ওয়েটিং রুমের মেঝেতে গাদা মানুষের ভিড় ঠেলে (নন-এসি ওয়েটিং রুমেও গেছিলাম, সেখানে মেঝেতে বাথরুম ভাসানো জল এসে জমেছে), সর্বোপরি ভারতবর্ষ কীভাবে এখনও রাজাগজাদের জন্যেই রাখা আছে তা দেখে দুজনেই সুস্থ শরীরে ট্রেনে উঠেছিলাম সে আরেক গল্প।