এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • আধার কার্ড নিয়ে সরকারি আগ্রাসী নীতি ও তার রাজনৈতিক মাত্রা

    Bagchi P লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ১৯ নভেম্বর ২০১৭ | ২১২৩ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Bagchi P | ২০ নভেম্বর ২০১৭ ২১:২৬370371
  • আধার নিয়ে ‘আঁধার’

    মাস কয়েক আগে পিতৃপক্ষের অবসানে যেদিন দেবীপক্ষের সূচনা হয় এবং পরজন্মে বিশ্বাসী আমজনতা হাঁকুপাঁকু করে নদীর ঘাটে পৌঁছে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে জল বা পিন্ড দান করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন, ঠিক সেইদিনই সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল একটি ছবি। নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে এক পুরোহিত তার যজমানকে বলছেন, নিন এবার আপনার আধার নম্বর বলুন, না হলে পূর্বপুরুষদের সঙ্গে আপনাকে লিঙ্ক করা যাবে না ! নিছক কৌতুক ---- সোশ্যাল মিডিয়ায় রাতদিন এইরকম মজার ছবি, জোকস, বিদ্রূপ ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং মিলিয়ে যাচ্ছে, আবার এসে পড়ছে নতুন কিছু। সেইসবের মধ্যে বিনোদন, হাল্কা যৌনতা, ঠাট্টা। কিন্তু এই ছবিটা কেবলমাত্র একটা জোকস নয় এর মধ্যে একটা ভাবনার সূত্র আছে। সেই ভাবনা পূর্বপুরুষের সঙ্গে আমাদের যোগসূত্র স্থাপনের মজাটুকু পেরিয়ে ভিন্ন একদিকে আমাদের চালিত করে। কারণ, এই মুহূর্তে রাস্তার মোড়ে মোড়ে যত মোবাইলের দোকান তার সামনে কাতারে কাতারে ভিড়, ব্যাঙ্কের ভিতর ও বাইরে সমস্ত গ্রাহকই দুশ্চিন্তা নিয়ে ছূটছেন তাদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেল না তো? সব জায়গায় সরকার রক্তচোখ দেখাচ্ছেন আধার না জুড়লে সমস্ত নাগরিকের পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হবে। খোলা জায়গায় শৌচ করা বন্ধ, আধার না জুড়লেও মোবাইল বন্ধ, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ, গ্যাস বন্ধ। অনেকেই জানেন না কারণ সেইভাবে বিজ্ঞাপিত হয়নি, এই বছর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ন্ত্রণাধীন সংস্থার অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের পেনশন প্রাপকদের লাইফ সার্টিফিকেট আর ব্যাঙ্কের মাধ্যমে দাখিল করা যাচ্ছে না। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে পেনশন প্রাপকদের নিজেদের বেঁচে থাকার অস্তিত্ব জাহির করতে হবে। যদিও প্রযুক্তিগতভাবে বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে বায়োমেট্রিক পরীক্ষায় কিছু অসুবিধে থাকে , বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের হাতের আঙ্গুলের রেখাগুলি অস্পষ্ট হতে থাকে কিন্তু এইসব অসুবিধেকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো বিবেচনাবোধ কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে আশা করা বাতুলতা। নোটবাতিলের হুজুগে তারা শতাধিক মানুষকে পথে দাঁড় করিয়ে মেরেছিলেন, আধার সংযুক্তি করাতে গিয়ে যদি কেউ বেঘোরে মারা পড়েন বা ঠিকমতো হাতের ছাপ না ওঠায় পেনশন না পেয়ে সংকটে পড়েন তাতে তাঁদের কিসসু যায় আসে না। যিনি হাতের ছাপ মেলাতে পারলেন না নিশ্চয়ই তিনি দেশবিরোধী ! এই তথ্য দেশবাসীকে গিলিয়ে দেওয়া এখন প্রায় জলভাত। সম্প্রতি ঝাড়খন্ডে এক দলিত কিশোরী রেশনের চাল না পেয়ে অনাহারে মারা যান যার একমাত্র অপরাধ ছিল তার আধার কার্ড ছিল না।

    আসলে পাকেপ্রকারে কেন্দ্রীয় সরকার ও সেই সরকারের পরিচালক দলটি ধরেই নিয়েছেন আধার এমন একটি অস্ত্র যা দিয়ে নাকি দেশব্যাপী যাবতীয় ‘ভ্রষ্টাচার’কে জব্দ করা সম্ভব। প্রায় একই মন্ত্র তারা আউড়েছিলেন নোট বাতিলের সময় যা আদতে ধোপে টেকেনি। নানা আর্থিক সংস্থা বিভিন্ন সমীক্ষা করে দেখেছেন এতে আদপে দেশের অর্থনীতির কোনও সুমতি হয়নি , দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্কও ঠারেঠোরে এটাই মেনে নিয়েছেন। কিন্তু প্রবল পরাক্রমী প্রধানমন্ত্রী ভাঙেন তবু মচকান না আর তিনি ধরেই নিয়েছেন যে তার দলের কোটিপতি সাংসদ্, উঁচু তলার নেতারা ও তার বশংবদ কিছু শিল্পপতি ছাড়া দেশের বাকি আম আদমি নেহাতই চোর ডাকাত --- সরকারি ভর্তুকি তারা চুরি করে নিজের নামে নেন, ঠিকমতো আয়কর দেন না, মোবাইল ফোন নিয়ে সন্ত্রাসী কাজ কারবার চালান, ব্যাঙ্কে দেদার কালো টাকা জমান ইত্যাদি ইত্যাদি। সুতরাং এদেরকে ঝাড়ে বংশে উচ্ছেদ করতে গেলে আধার বিনা গীত নেই। তাই ফরমান জারি করে বলা হচ্ছে সমস্ত পরিষেবার সঙ্গে জুড়তে হবে আধার নয়তো আপনি এই দেশের নাগরিকই নন --- হয় সন্ত্রাসী নয় বিদেশি রাষ্ট্রের চর নয়তো দেশদ্রোহী ফলে আপনাকে কোতল করা রাষ্ট্রের অন্যতম পবিত্র কর্তব্য !

    এই রকম একটা হুলুস্থুলুশের মধ্যে দাঁড়িয়ে সভয়ে কয়েকটা কথা বলি। যার সর্বপ্রথম বাক্য হল, আধার নাগরিকের পক্ষে তার নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র নয় এটা আধারের ফরমে ও আধার কার্ডে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে। দ্বিতীয় কথা হল, আধারের এনরলমেন্ট ফর্মে এইটাও ছোট ছোট করে লেখা আছে Aadhar (Targeted Delivery of Financial and Other Subsidies, Benefits & Services) Act 2016 এর ৩(২) ধারা অনুযায়ী এইসব তথ্য আপনার থেকে নেওয়া হয়েছে, সুতরাং যেখানে আর্থিক সুবিধে বা অন্য কোনও সরকারি সুবিধে আমরা নাগরিকরা নিচ্ছি না সেখানে আধার কেন প্রয়োজন হবে এই প্রশ্নের সহজ জবাব নেই। মোবাইল পরিষেবার মাশুলে বা ব্যাঙ্কের সুদের হারে কোনও সরকারি ভর্তুকি আছে বলে কোনও কালে শোনা যায়নি তবু এই দুই পরিষেবার জন্য কেন আধার প্রয়োজন তার কোনও ব্যাখ্যা এখনও পর্যন্ত জনপরিসরে আসেনি। কিন্তু গণ্ডগোল এর সূত্র আরো গভীরে যার কিছু কিছু ইতিমধ্যেই কোথাও কোথাও প্রকাশিত। আর সেগুলি মোটেও উড়িয়ে দেওয়ার মতো কিছু নয়, যদিও আধার নিয়ে সরকারি আগ্রাসনের বিপরীতে সমস্ত দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনাকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়াই আপাতত সরকারি দস্তুর। তবু নাগরিকের সামনে থেকে যায় কিছু নাছোড় প্রশ্ন।

    ভারতের মতো এত বড় ও এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে এ ধরণের একটি উদ্যোগ নেওয়ার পেছনে সঠিক অভিমুখটা কী? একটু পেছন ফিরে দেখলে দেখা যাচ্ছে ১৯৯৮ সালে কারগিল সীমান্ত সংঘর্ষের পর সেই সময়ের এন ডি এ সরকার সেই যুদ্ধ বিষয়ে ‘কার্গিল রিভিউ কমিটি’ নামে একটি কমিটি করেন যারা পরামর্শ দেন দেশের সীমান্ত এলাকার নাগরিকদের জন্য একটি পরিচয়পত্র দেওয়ার। এই প্রস্তাব নিয়ে কাটাছেড়া করে একটি পর্যালোচনা কমিটি , যার চেয়ারম্যান ছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি, মোটামুটি সেটাই মেনে নেন এবং সরকার এই বিষয়ে এগোবে এটা ঠিক হয় এন ডি এ আমলেই। কিন্তু ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে এন ডি এ জোটের ভরাডুবিতে এই প্রস্তাব আর কার্যকর করা গেল না। ইতিহাসের কী পরিহাস, এন ডি এ সরকারের প্রস্তাবিত এই পরিচয়পত্র নিয়ে এবার আগুয়ান হলেন ইউ পি এ সরকারের প্রধান। ২০০৬ এর গোড়ার দিকে এটা নিয়ে শুরু হল নতুন ভাবনা। আবারও একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রীগোষ্ঠী, যার প্রধান ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যা্য়, নাগরিকদের অভিন্ন পরিচয়পত্র দেওয়ার বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আওতায় ইউনিক আইডেন্টিটি অথরিটি অফ ইন্ডিয়া ( ইউ আই ডি এ আই অথরিটি) তৈরির প্রস্তাব অনুমোদন করলেন। ২৮ জানুয়ারি, ২০০৯ ইউ আই ডি এ আই তৈরি হল, যার প্রধান হলেন নন্দন নিলেকানি। এর বছর দেড়েক পরে আধার এর লোগো ও ব্র্যান্ড নাম প্রকাশ হল এবং প্রকাশ্যে জানানো হল ২০০টি এজেন্সির নাম যারা সারাদেশে নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করবেন, বলা বাহুল্য এগুলো সবই বিভিন্ন বেসরকারি এজেন্সি যাদের সরকার অনুমোদন দিলেন কাজটা করার। কিন্তু পঞ্চদশ লোকসভার অর্থমন্ত্রকের স্ট্যান্ডিং কমিটি, বিজেপি সাংসদ যশোবন্ত সিনহার নেতৃত্বে তাঁদের ৪২তম প্রতিবেদনে যে রিপোর্ট দিলেন তাতে এই আধার বিষয়ে সরকারের সমালোচনা ছিল প্রচুর। অন্য দেশের এই একই ধরণের কর্মসূচির সঙ্গে তুলনা করে সেখানে বলা হল এই প্রকল্প প্রচুর ব্য্যসাপেক্ষ, অসম্ভব জটিল, এখানে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে তা নির্ভরযোগ্য নয় ও নাগরিকদের নিরাপত্তার পক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ। পাশাপাশি, যেসব এজেন্সিকে তথ্য সংগ্রহ করতে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রযুক্তিগত ভাবে যেসব গবেষণার ওপর ভিত্তি করে এই বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে তার ভুলের হার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল কমিটি।

    মজার ব্যাপার, এই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করেই ভাজপা সেই সময় (২০১১-১২) আধার প্রকল্পের চরম বিরোধিতায় নামেন।তখন মোদী অ্যান্ড কোং এর মনে হয়েছিল আধার একটি চূড়ান্ত দেশবিরোধী কাজ ও জনসাধারণের অর্থের অপচয়। এমনকি আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে (২০১৪) জয়লাভ করলে আধার প্রকল্প বন্ধ করা ও প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকদের চাকুরি বাতিল ও তাঁদের গ্রেফতার করা হবে এমন প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঘটল একেবারেই তার বিপরীত। ক্ষমতায় বসার পরেই নন্দন নিলেকানি বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন ও তার পরেই একেবারে সরকারিভাবে আধার নিয়ে উঠেপড়ে লাগার ঘোষণা হয়। এমনকি একটা দেশের এত বড় একটা প্রকল্প সংসদে পাশ না করিয়েই চালু করে দেওয়া হয় প্রশাসনিক আদেশবলে। সংসদে পাশ করাতে গেলে তা দুই কক্ষেই পাশ করাবার বাধ্যবাধকতা ছিল সরকারের, কিন্তু লোকসভায় বিপুল গরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্যসভায় বর্তমান সরকারের সেই গরিষ্ঠতা ছিল না।এই পরিস্থিতিতে এটিকে অর্থবিলের মর্যাদা দিয়ে শুধু লোকসভায় পাশ করানো হয় ২০১৬ তে (সাংবিধানিকভাবে অর্থবিল সংসদের উভয় সভায় পাশ করানো বাধ্যতামূলক নয় )এবং তার পরে ধাপে ধাপে আধার নিয়ে ফাঁস চাপিয়ে দেওয়া হয় সাধারণ মানুষের ওপর, যে ফাঁস আরও শক্ত হয়ে চেপে বসছে ইদানিং। এই বছরের মধ্যে (২০১৭) ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট-এর সঙ্গে আধার না জুড়লে নাকি সমস্ত অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে শোনা যাচ্ছে, মোবাইলের ক্ষেত্রে এই সময়সীমা কী তা মোবাইল পরিষেবা সংস্থাগুলিও জানেন না, কিন্তু তারা লাগাতার চেতাবনি পাঠাচ্ছেন গ্রাহকদের। এই আবহাওয়াটাও এক ধরনের সন্ত্রাস ঠিক যেভাবে যুদ্ধের সময় সবাইকে বলা হয় সাইরেন বাজলেই বাঙ্কারে ঢুকে যেতে। সেখানে মানুষ প্রাণভয়ে যায় আর এখানেও তার দৈনন্দিন অস্তিত্বের প্রশ্ন। কিন্তু মুশকিল হল, আমাদের ভারত ভাগ্যবিধাতার শোনবার বড় একটা অভ্যাস নেই, তিনি শুধুই বলেন --- কখনো উদ্বেলিত ভাষণ, কখনো মন কি বাত। ফলে আপনি আমি যতই প্রশ্ন করি তাতে কিছু আসে যায় না। আধার চলছে চলবে !

    কিন্তু কথাটা হল,সরকারের বক্তব্যও যদি মেনে নেওয়া যায় যে আধার সংযুক্তির পরে সরকারি আর্থিক ভর্তুকি, গণবন্টন ব্যবস্থা, এনরেগার জব কার্ড ইত্যাদি একেবারে নির্দিষ্ট প্রাপকের কাছেই পৌঁছে যাবে এবং এই স্বচ্ছতার অভিঘাতে যে বাড়তি অর্থ সরকারের সাশ্রয় হবে তা বৃহত্তর উন্নয়নের কাজে লাগানো যাবে তাহলেও দু-একটি বেয়াড়া জিজ্ঞাসা পথ আটকে দাঁড়ায়। দেশের মধ্যে সরকারি ভর্তুকি যারা পান বা ন্যায্য অর্থে যাদের পাওয়া দরকার তারা মূলত প্রান্তিক মানুষ যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই থাকেন গ্রামে এঁদের পেছনে ভর্তুকির অপচয়ই কি দেশের দুর্নীতিভিত্তিক অর্থনীতির একমাত্র উৎস? বরং কালোটাকা যাদের হাতে ঘুরপাক খায় ও নানাখাতে বয়ে চলে তারা কেউই ভর্তুকি পাওয়া আম আদমি নন, আর ওই গ্রামের গরিব মানুষগুলি নয়, বরং ওই কালো রতনগুলিই ক্ষমতাবৃত্তের কাছের মানুষ। কালো টাকার ভ্রষ্টাচার ধরার জন্য এর আগে আয়কর দফতর প্যান বাধ্যতামূলক করেছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নোট বাতিল করেছেন তার ফলে কত কালো টাকা উদ্ধার করা গেল তার একটা বিশ্বাসযোগ্য হিসেব দিনের আলোয় আসা দরকার। দ্বিতীয়ত, যদি গ্রামের দীন-দুঃখী মানুষের জন্যই আধার কার্ড হয় তাহলে এটাও তো ভাবা দরকার এই পদ্ধতিতে প্রাপকের সঠিক পরিচয় কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার থেকে যাচাই করে তাকে সেই পরিষেবা বা সুবিধে দিতে গেলে প্রত্যন্ত গ্রামে অন্তত নিরবিচ্ছিন্ন উন্নতমানের ইন্টারনেট কানেকশন চাই, চাই বিদ্যুৎসংযোগ। সরকারি হিসেব বলে দেশের সাড়ে ছয়হাজার গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ যায়নি, আর এমন গ্রামের সংখ্যা প্রচুর যেখানে বিদ্যুৎ গেলেও গড়ে পাঁচঘণ্টার বেশি সেখানে বিদ্যুৎ থাকে না। দেশের প্রায় ৪৫ কোটি দারিদ্র সীমার নিচে থাকা মানুষ এইসব গ্রামগুলিতেই থাকেন। যতদিন উন্নয়নের কান্ডারী ওইসব গাঁ গঞ্জে বিদ্যুতের খুঁটি না পুঁততে পারেন ততদিন সেখানকার মানুষগুলি পেটে কিল মেরে কুলুঙ্গিতে আধারকার্ড রেখে কি জয় শ্রীরাম ধ্বনি দেবেন?

    এবার দেখা যাক কতগুলি প্রযুক্তিগত দিক। ইউ আই ডি অথরিটি যখন এই প্রকল্প শুরু করেন তখন তারা একটা প্রাথমিক সমীক্ষা করে দেখেছিলেন যে বিজ্ঞানসম্মতভাবে একজন মানুষের বায়োমেট্রিক পরিচয় ( আঙ্গুলের ছাপ, চোখের আইরিশের ছবি) একেবারে তার নিজস্ব (ইউনিক) হলেও বাস্তবে সেটা হয় না। একটি পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, প্রতি ১২১ জনে একজনের মধ্যে ডুপ্লিকেট হওয়ার সম্ভাবনা আছে --- সেক্ষেত্রে দেশের অন্তত ১২ কোটি মানুষ থাকবেন যারা ডুপ্লিকেট এবং কাদের সঙ্গে তাঁদের বায়োমেট্রিক পরিচয় মিলে যাবে তা একটি কেন্দ্রীয় তথ্য ভান্ডারের সাহায্যে আগাম বলা সম্ভব নয়। তাহলে? তাহলে কি এই ১২ কোটি মানুষ বাড়তি হয়ে যাবেন? ঘটনাচক্রে এঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, মোবাইল ইত্যাদি যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে এরা তো প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত হয়ে যাবেন ‘বেআইনি’ হিসেবে অথচ আদপে ব্যাপারটা আদৌ তা নয় ! সমস্যা হল, অন্য পরিচয়পত্রের ক্ষেত্রে (পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভোটার কার্ড ইত্যাদি ) সেই পরিচয়পত্র যিনি প্রদান করছেন কার্ডে তার নাম ও সই থাকে ফলে কোথাও ভুল হলে সেই আধিকারিকের একটা দায়বদ্ধতা থেকে যায় এবং প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ারও সুযোগ থাকে, কিন্তু আধার কার্ডে কারোর স্বাক্ষর থাকে না ফলে দায়বদ্ধতার জায়গাটা অস্পষ্ট।এই বিষয়টা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে যার কোনও বিশ্বাসযোগ্য জবাব আমাদের কানে আসেনি।

    অন্যদিকে, আমাদের মতো দেশে যেখানে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা বেশি সেখানে নাগরিকদের আঙ্গুলের ছাপ পাওয়া তুলনায় কঠিন কারণ কায়িক শ্রমের ফলে অনেকেরই হাতের ছাপ অস্পষ্ট হয়ে যায়। এই মানুষদের জন্য বিকল্প কী ব্যবস্থা হবে তা কিন্তু এখনও অজানা। অথচ এই মানুষগুলোর ক্ষেত্রেই আধার কার্ডের প্রাসঙ্গিকতা বেশি। সম্পন্নশ্রেণির মানুষদের ভর্তুকি বা সরকারি সাহায্য প্রয়োজন হয় তুলনায় অনেক কম।এর পরেও আছে বয়সজনিত কারণে বা কোনও দুর্ঘটনার কারণে যদি নাগরিকের হাতের ছাপ বা চোখের গড়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তখন তারা কী করবেন? অসুস্থ বা অক্ষমরা কি একটি কার্ডের জন্য পথে পথে ঘুরে বেড়াবেন? একটি কার্ডের নিরিখে যদি দেশের মানুষ আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যান সে তো এক গভীর সঙ্কট ! আশঙ্কা সেই বিপর্যয়ের দিকেই চালিত করতে চাইছেন বিবেকহীন সরকার।

    এর পরে আরও প্রশ্ন।আধার থেকে প্রাপ্ত এই বিপুল ব্যক্তিগত তথ্য যেভাবে নাগরিকদের থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে বাধ্যতামূলকভাবে এই আগ্রাসন কোথাও কি নাগরিকদের গোপনীয়তার অধিকারকে বিপন্ন করে না? দেশের সর্বোচ্চ আদালত ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, গোপনীয়তার অধিকার নাগরিকের মৌলিক অধিকার কিন্তু সরকার সেই রায়ে কর্ণপাত করেছেন এমন খবর নেই। আধার মানেই একটা সব পেয়েছির দেশে পৌঁছে যাওয়ার ছাড়পত্র এই প্রচারে তারা উদ্বাহু।

    অন্য একটি কথা ভয়ে ভয়ে বলি। আধার কর্মসূচির একটা রাজনৈতিক দিক আছে যা আসলে গুপ্ত, যাকে বলে হিডন অ্যাজেন্ডা। কংগ্রেস প্রদর্শিত পথে ভাজপা যে এই কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে চলেছে তার পেছনে এই অভিমুখ যে একদম নেই তা বলা যাবে না। আমাদের মতো বহুদলীয় গণতন্ত্রের দেশে কোনও রাজনৈতিক মত ও দলের বিরোধী পরিসর কাঠামোগতভাবে অনুমোদিত। কোনও রাজনৈতিক শক্তি যদি নিজেদের সীমানা ছাড়িয়ে সংসদীয় পথের বাইরে স্বৈরী উপত্যকার দিকে এগিয়ে চলে তখন তার বিরোধিতা করতে হয় বিপরীত পথের পথিকদের। রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যবর্তিতায় সেই লড়াই না করলে দেশ রসাতলে যাওয়ার আশঙ্কা। প্রতিটি ক্ষেত্রে আধার-এর সংযুক্তি কিন্তু এই প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় বিপদ। মাঝে মাঝেই বিরোধী রাজনীতির নেতৃত্ব (যে দলেরই হোক) অভিযোগ করেন রাজনৈতিক কারণে তার ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে তার ব্যক্তিগত গোপনতাকে বিপন্ন করে ---- এই অভিযোগ অমূলক তা নয়। বহু ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটে আসলে যা সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতার অপব্যবহার।

    ভেবে দেখতে বলি, সমস্ত পরিষেবার সঙ্গে আধার নম্বর জুড়ে দেওয়ায় ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের হাতে একটা সংবিধান-বহির্ভূত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে যাচ্ছে। মনে করা যাক, জরুরি অবস্থার কথা। সারাদেশে তখন একটা কণ্ঠরোধের রাজনীতি ও বিরোধীমতের পরিসরকে নিকেশ করার মহাযজ্ঞ। তখনও কিন্তু বেশ কিছু বিরোধীদল ও গোষ্ঠী কিছুটা আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে কাজ করতে পেরেছে, দেশের একজায়গা থেকে অন্যত্র যেতে পেরেছেন, সংগঠিত করতে পেরেছেন নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচি। ভাজপা দলের একদা প্রবল পরাক্রমী নেতা আদবানিজিও সেই দলে ছিলেন। কিন্তু আজ যদি ওই একই অবস্থা হয়? বিরোধীদের শায়েস্তা করতে সরকার অনায়াসে বন্ধ করে দেবেন ফোন পরিষেবা, তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট। এইসব তেএঁটে নেতারা যদি গোপনে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যত্র যেতে চান, রেল বা বিমানের টিকিট তারা পাবেন না। এবং তাঁদের আত্মগোপন করে থাকার পথ আর তেমন থাকবে না। এই আধার সংযোগ আদপে একটা গণতান্ত্রিক কাঠামোকে পর্যুদস্ত করার অমোঘ আয়ুধ নয় তো?

    অথচ দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের কথা যখন উঠলই তখন আরও দু চারটে কথা বলি। সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ইউ আই ডি আই এই আধার প্রকল্পের জন্য প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির জন্য যেসব সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছেন – সেই ওয়ান আই ডি সলিউশন, মরফো ও সাফ্রান তিনটি সংস্থাই কিন্তু মার্কিন দেশ ও ফ্রান্সের প্রতিরক্ষা দফতরের কাজের সঙ্গে যুক্ত। দেশের সকলের গোপন তথ্য যদি সরকারের কাছে যায় তাহলে দেশের সেনাবাহিনির সদস্যরাও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তথ্য যারা সংগ্রহ করছেন ও বিশ্লেষণ করছেন তারা যদি অন্য দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার শরিক হন সব কি ঠিক ঠিক চলবে? উইকিলিক্স জানাচ্ছে মার্কিন গোয়েন্দা দফতরের একটা শাখা বায়োমেট্রিক তথ্য অপ হরণে নাকি দড় তারা যে প্রযুক্তি সংস্থাকে কাজে লাগায় তাদেরই ভারতীয় শাখা আধারের সঙ্গে যুক্ত। কী বলবেন?

    এরপরেও এই আধার সংযোগ করে দেশের সন্ত্রাসীদের যদি ধরা যায় সে বড় ভাল কথা ( এমন একটা কথা আমরা নোট বাতিলের সময়ও শুনেছিলাম না? ) কিন্তু একটা দেশে তো শুধু সন্ত্রাসীরাই থাকেন না , তার থেকে ঢের বেশি থাকেন গণতান্ত্রিক চেতনার মানুষ আর আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচিত সরকার নিজেরাই গণতন্ত্রের বিপদ ডেকে আনেন বেশি বেশি করে। আধার তাঁদের অপকর্ম ঢাকবার হাতিয়ার হয়ে উঠবে না, এই কথা আমরা কি হলফ করে বলতে পারব?

    শেষ মুহূর্তে খবর পাওয়া গেল, কেরালায় পানাখারি পঞ্চায়েতের এক বাসিন্দা ইতিমধ্যেই দুটি আধার কার্ড পেয়েছেন। যদি ধরেও নিই, তিনি তার ব্যক্তিগত তথ্য ইচ্ছে করেই দুবার দুরকম দিয়েছেন কিন্তু তার চোখ ও আঙুল কী বলল? জয় শ্রীরাম??

    প্রবুদ্ধ বাগচী
  • অরিত্র | 103.77.***.*** | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২০:৩৫740908
  • গণতন্ত্রের প্রশ্নটাই বড়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন