এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মৃত্যু উপত্যকা

    সবিতা সেন
    ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ১০৬ বার পঠিত
  • আয়োজন ছিলো অনেক। আকাশে পঞ্চমীর চাঁদ ছিলো, খুব কাছ দিয়ে বইছিলো শান্ত স্রোতস্বিনী, উতলা বাতাস ছিলো, নাম না জানা ফুলের সুগন্ধ ছিলো, দুজনের বুকে ভালোবাসা জমাট হয়ে ছিলো। নদীর ধারে একটি ছোট পার্কের বেঞ্চে দুটি ছেলেমেয়ে পাশাপাশি বসে – কিন্তু চুপ। হৃদয়ের কথা বলা খুব সহজ নয়। একটু হাতটা ধরতে ইচ্ছে, কিন্তু সাহস নেই। আবছা জোৎস্নায় দুজনকে বড়ো মায়াবী দেখচ্ছে।
    কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ছেলেটি উদ্যোগী হয়ে কথা শুরু করলো – ‘‘কাল সকাল দশটায় আমার ট্রেন।’’ মেয়েটি প্রশ্ন করে – 
    - ‘‘কোথায় যাবে? কেন যাবে?’’
    - ‘‘যাবো একটু কাজে। সেখানেই যাই, সেখানে তো তুমি থাকবে না। তুমি না থাকলে, আমার কাছে সবই এক।’’
    - ‘‘তার মানে, কোথায় যাচ্ছো, সেটা আমাকে বলবে না, তাই তো?
    - ‘‘এভাবে বোলো না। সেখানেই যাই, তোমার হয়েই থাকবো চিরদিন।’’
    - ‘‘কবে ফিরবে? ফিরবেতো আমার কাছে? আমি তো তোমার পথ চেয়েই থাকবো।’’
    ছেলেটির চোখে জ্বলে উঠলো চিরকালীন ভালোবাসার আলো। সাহস সঞ্চয় করে মেয়েটির হাত নিজের হাতে তুলে নিলো। ঘামে ভেজা ছোট্ট একটা হাত, একটু কাঁপছে। সেই হাত ছেলেটির হাতকে আঁকড়ে ধরলো – ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দ, আর আগামী বিচ্ছেদের আশঙ্কায়। ছেলেটি ওর সবল দুটি বাহু দিয়ে, নিজের দিকে আকর্ষণ করলো মেয়েটিকে – ‘‘একটু আদর করি তোমায়? এতোদিন তো শুধু দূর থেকেই দেখেছি। আবার কতোদিন যে দেখা হবে না কে জানে! তুমি যে আমার কাছে বড্ড দেরী করে এলে!’’ শুধু আলিঙ্গন কতোটাই বা কাছে আনতে পারে মানুষকে? পঞ্চমীর চাঁদ দেখলো – গভীর চুম্বনে আবিষ্ট দুটি প্রেমার্ত হৃদয়।
    পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সন্ধ্যাটি দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেলো। প্রতিশ্রুতি বিনিময় হলো। কিন্তু না, সেদিনের পর আর কোন খবর পাঠায়নি ছেলেটি। কোন চিঠিও আসেনি। একবুক ভালোবাসা নিয়ে কোথায় যে হারিয়ে গেলো ! শোনা যায় এখন নাকি অতিবাম রাজনীতির একজন অন্যতম পুরোধা সে। সবাই তাকে ‘কমরেড’ বলে ডাকে। 
    একদিন এক শিউলি ঝরা সকালে, মেয়েটি বাড়ীর বারান্দায় বসে ছিলো। একটি ঝাঁকড়া চুলের, বড় বড় চোখ ছেলে, প্রবল গতিতে সাইকেল চালিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে এলো। গড়গড় করে বললো – ‘‘কমরেড আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। পুরোনো জায়গায় চলে আসুন সন্ধ্যা সাতটায়।’’
    মেয়েটি সাতটা বাজার আগেই চলে এসেছে – ছেলেটির পছন্দের লাল পাড় সাদা শাড়ীতে সেজে। সেই সেদিনের মতো আজও আকাশে চাঁদ, বাতাসে মায়া, বুকে অপেক্ষা। অপেক্ষার প্রহর গোনা বড় কঠিন। আটটা বেজে গেলো, এখনও তো এলো না। কিছু দূরে শোনা যাচ্ছে হুইস্‌ল এর শব্দ, ভারী গাড়ী চলার শব্দ, একটু ছোটাছুটির আভাস। কিন্তু সে কোথায়? ভয় নিয়ে কতোক্ষণ অপেক্ষা করবে তার জন্য – পার্কে একজন মানুষও নেই। তার বদলে আবার এলো সেই ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটি রকেট গতিতে সাইকেল চালিয়ে – হাঁপাতে হাঁপাতে বললো – ‘‘পুলিশ জানতে পেরে গেছে। কমরেড আসতে পারবে না। একটা রিক্সা নিয়ে এসেছি, তাড়াতাড়ি বাড়ী চলে যান।’’ হতাশ মেয়েটি ফিরে গেলো।
    পৃথিবীর নিয়মে, আরো দুটি বসন্ত পার হয়ে গেছে। সেই মেয়েটি কোন দরকারী কাজে যাচ্ছিলো। পথে একটি পরিচিত ছেলে ওর রাস্তা আটকালো। বললো, ‘‘আমাদের কমরেড এখন পুলিশের হাতে। প্রচণ্ড অত্যাচারের পর ভর্ত্তি করা হয়েছে, সদর হাসপাতালে।’’ যা বলেনি, তা হলো, সন্ত্রস্ত ও হতবাক ডাক্তাররা দেখে জানিয়েছে কমরেড মৃত। ভীষণ ভাবে মৃত। পুরোপুরি। কিছু না জেনে মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে রিক্সা ঘুরিয়ে হাসপাতালের দিকে চললো সব কাজ ভুলে। এরকম মুহূর্ত ওর জীবনে এর আগে কখনও আসেনি। ঐ হাসপাতালের গেটের কাছে মেয়েটি একা দাঁড়িয়ে রইলো কি জানি কার প্রতীক্ষায়। সাদামাটা চেহারা, চাপা গায়ের রং, লম্বা একটা বিনুনী, পরণে সাদা শাড়ী – এটাই ওর সব সময়ের পোষাক। ভয়ে হাসপাতালের গেট দিয়ে ঢুকতে পারছে না। চারদিকে গিজগিজ করছে পুলিশ। চিন্তায় দিশাহারা। একজন পুলিশ ওর কাছে এসে প্রশ্ন করলো, ‘‘কেন দাঁড়িয়ে আছো এখানে? কি চাই?’’
    মেয়েটি জবাবে কমরেডের নাম করে বললো – ‘‘সে অসুস্থ বলে শুনেছি। তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’’ কথাটা শুনে পুলিশটি কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বড় অফিসারের কাছে গিয়ে নীচু স্বরে কিছু বললো। অফিসার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ওকে যথাস্থানে নিয়ে যেতে বললো। পুলিশ কে অনুসরণ করে ও পৌঁছলো একটা ঘরে – তার দরজা জানালা সব বন্ধ। টিমটিম করে জ্বলছে একটা আলো। একটি মাত্র চেয়ার রাখা ঘরের মাঝখানে। আলো-বাতাসহীন ঘরটিতে গুমোট গরম – ভ্যাপসা একটা গন্ধ – সেটা কি বাসী রক্তের? বমি আসছিলো মেয়েটির। এ কেমন ঘরে ওকে আনা হয়েছে? এটা তো হাসপাতালের লম্বা ওয়ার্ড নয় – যেখানে অনেক রোগীর চিকিৎসা হয়! একটু ভয় হোলো, পুলিশটিকে প্রশ্ন করলো, ‘‘কোথায় আমাদের কমরেড?’’ নির্বিকার পুলিশকে আবার প্রশ্ন – ‘‘কথা বলছেন না কেন? জবাব দিন। কোথায় রাখা হয়েছে ঐ আহত ছেলেটিকে? আমাকে কেন এই ঘরে আটকে রেখেছেন?’’
    নির্বাক পুলিশ দুই ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকতে বললো। মেয়েটি মুখ বন্ধ করেছে। ভয়ে, আতঙ্কে এবার তার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। বুকের মধ্যে যেন হাতুড়ি পিটছে – এ আমি কোথায় এলাম? কমরেড কোথায়, কেমন আছে?
    নির্বাক পুলিশের কণ্ঠ শোনা গেলো, ‘‘সঙ্গে আসুন’’। একগাদা পুলিশের উর্দিধারী দুপেয়ে জীবের মাঝখান দিয়ে এগোতে হলো। তাদের মুখে কুশ্রী মন্তব্য, নোংরা হাসি। এবার সামনে একটা খোলা চাতাল। কি ভয়ানক ! সেখানে শোয়ানো আছে বেশ কয়েকটি দেহ, সাদা চাদরে ঢাকা। এসব কি? এই সব মৃতদেহ কাদের? সবচেয়ে সামনের চাদর ঢাকা দেহটির কাছে এসে সঙ্গী পুলিশটি থামলো। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো – ‘‘এই আপনাদের কমরেড, প্রাণভরে দেখুন। কোন বাধা নেই দেখুন! চাদরটা সরিয়ে ভালো করে দেখুন।’’
    মেয়েটির পা যেন মাটিতে আটকে গেছে। চোখ ঝাপসা অনিশ্চিত ভয়ে। সময় যেন থমকে গেছে, সামনে শোয়ানো মানুষগুলো, না, না, সাদা চাদরে ঢাকা দেহগুলো একাকার হয়ে যাচ্ছে। যেন একটাই আতঙ্কের চাদর, ওর সামনে একটা সাদা দেওয়াল তৈরী করেছে। কি করতে হবে ও জানে না। ঐ সব চাদরের নীচে কি কমরেডের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা রয়েছে? রবি, অতনু, সঞ্জু, আরও কে কে আছে কে জানে? ওর মন বলছে, কমরেড নিশ্চয়ই বেঁচে আছে, হয়তো অন্য কোথাও নিরাপদে আছে, ওকে শেষ করা এতো সহজ নয়। কিন্তু এখন কি করতে হবে ও জানে না। এতো মৃত্যুর সামনে ও কি করবে?
    ‘‘কি হোলো? এতো হাঁকপাক করছিলেন যাকে দেখার জন্য – তাকে দেখুন ভালো করে, লজ্জা কিসের? শেষ বারের মতো দেখে নিন। লড়াই করতে করতে জামাকাপড়গুলো খুলে গেছে আর কি। আর সব ঠিকই আছে।’’ পুলিশটি এই বলে, রক্তমাখা চাদরটা একটানে সরিয়ে দিলো। হে ঈশ্বর, এ আমি কি দেখছি? এটা কি একটা মানুষের দেহ? নগ্ন একটা পুরুষদেহ। এই আমার কমরেড? পেটের ওপরে যেন একগুচ্ছ স্থলপদ্ম। পেটের অন্ত্র বেরিয়ে এসেছে গুলির ফুটো দিয়ে প্রবল অত্যাচারের অভিঘাতে। একটু নীচে ছিন্ন ভিন্ন পুরুষাঙ্গ সব সমেত ভয়াবহ ভাবে দৃশ্যমান। ঠিকমতো উপলব্ধি করার আগেই মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।
    এরপর মেয়েটি নিজেকে আবিষ্কার করলো, সেই বন্ধ ঘরের একমাত্র চেয়ারটিতে। একজন মহিলা পুলিশ ওর চোখেমুখে জল ছেটাচ্ছে – ‘‘এবার চোখ খুলুন, অনেক নকশা হয়েছে, আমার সঙ্গে আসুন।’’ মেয়েটি মহিলা পুলিশের পিছে পিছে বাইকের খোলা হাওয়ায় এলো। প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিলো – অনেকগুলি জীবন্ত মানুষ দেখে। তার পরেই আবার ওকে দুঃসহ ভয়টা চেপে ধরলো। এবার কি হবে? গলায় শক্তি এনে অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘‘আমি কি এখন বাড়ী যেতে পারি?’’
    ‘‘হ্যাঁ পারেন। কিন্তু এখানে যা দেখলেন, সে বিষয়ে কোথাও যেন মুখ খুলবেন না।’’ মেয়েটি অবসন্ন পায়ে গেটের দিকে এগোতে শুরু করলো। একটু এগোতেই পেছন থেকে জলদগম্ভীর গলা শোনা গেল – ‘‘দাঁড়ান, আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে।’’ পা দুটো পাথর হয়ে ওখানেই আটকে গেলো। কমরেডের ঐরকম মৃত্যুর আবহে, মৃত্যুমিছিলের মধ্যে, পুলিশের নাগপাশে আটকে পড়া একটি অসহায় পাখী। বাইরের চাতালে একটা বেঞ্চে পুলিশদের সঙ্গে বসিয়ে দেওয়া হোলো মেয়টিকে। কতোক্ষণ ধরে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো, মনে নেই। দিন শেষ হয়ে আসছে। মস্তো নিমগাছটা থেকে পাতা ঝরছে হালকা বাতাসে। হাসপাতালে ভিতরে বাইরে আলো জ্বলে উঠছে। 
    কর্কশ শব্দ করে একটা কালো রংচটা পুলিশ ভ্যান এসে দাঁড়ালো। তার পেছনেই একটা জীপ গাড়ি। মহিলা পুলিশটি ওকে নিয়ে জীপএর পেছনে বসলো। সামনে একজন বন্দুকধারী পুলিশ আর ড্রাইভার। একটা বোঁটকা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছে। তাকিয়ে দেখলো পায়ের কাছে কিছু কাপড় জামা পড়ে আছে, শুকনো রক্তমাখা। পুলিশের দিকে তাকাতেই সে বললো – ‘‘ওগুলো আপনার কমরেডের জামা, প্যান্ট, চাদর এইসব। আপনার ভালো লাগবে বলে ওখানে রাখা। দেখবেন, পা যেন না লাগে – প্রিয় কমরেডের স্মৃতি বলে কথা।’’
    ‘‘কমরেড কোথায়? আমরা কোথায় যাচ্ছি?’’
    ‘‘আমরা যাচ্ছি মামাবাড়ী। উনি আসছেন রাজার মতো, বড়ো গাড়িতে – আপনার পেছন পেছন।’’ জীপ চলতে লাগলো দ্রুত গতিতে – জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে ঘুরপথে। এ যেন এক অনন্ত যাত্রা। অবশেষে এক সময় থানার সামনে এসে থামলো জীপ।
    ‘‘চুপচাপ বসে থাকুন। আগে লাশ নামবে।’’ হায় কমরেড, এখন তোমার পরিচয় শুধুই ‘লাশ’। এই থানাটা এতোদিন দূর থেকে দেখেছে, এর ভেতরে কখনো ঢুকতে হবে, ওর দূরতম চিন্তাতেও ছিলো না। জীপ থেকে নেমে, থানার সামনের বড় ঘরটাতে ওকে নিয়ে যাওয়া হোলো। ঘরটায় একটা টেবিল চেয়ার আর কয়েকটা হাতলওয়ালা বেঞ্চ বসার জন্য। একটাতে বসলো মেয়েটি। উপস্থিত সকলেই ওকে মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো। এরকম চেহারার চোর ডাকাত বড় একটা দেখা যায় না তো। একটু বাদে, একজন দুঁদে অফিসারের প্রবেশ। মেয়েটিকে ওর সামনে বসিয়ে নানা রকমের প্রশ্ন করতে শুরু করলো। এই মৃত ছেলেটির সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র, প্রেম ছিল কিনা, কেন ওর সঙ্গে কোন action এ গিয়েছিলো কিনা, কেন এসেছিলো হাসপাতালে, কে খবর দিলো? চারু মজুমদার কে, রেড বুক পড়া আছে কিনা, তার সঙ্গে কোন যোগাযোগ আছে কিনা, বাড়ীতে আর কেউ এরকম অপকর্মে যুক্ত কিনা – এই সব প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারে বারে এক ঘণ্টা ধরে চললো। মেয়েটি ভাবছে, প্রশ্ন কি আর কোনদিন শেষ হবে না?
    এই সময় – দুজন হাবিলদার একটা রোগা পটকা ছেলেকে কোমরে দড়ি বেঁধে, ঘাড় ধরে, টেবিলের সামনে এনে ফেললো। - ‘‘স্যার পেয়েছি ব্যাটাকে, একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বসেছিলো।’’ প্রশ্নরত পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘‘ওকে জিজ্ঞেস কর, চোরাই মাল কোথায় রেখেছে?’’ এবার দুই হাবিলদার শুরু করলো তর্জন গর্জন। তাতে বিশেষ কাজ না হওয়াতে, ওরা মোটা লাঠি বার করে ছেলেটিকে মারতে শুরু করলো – অমানুষিক মার। ছেলেটি যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। যতো বলে ‘‘আমি কিছু জানি না’’ মার আরো বেড়ে যায়। অপেক্ষমান একজন লোক সখেদে বললো, ‘‘মারতেই যদি হয়, তো এখানে কেন? ভেতরে নিয়ে গিয়ে মারলে তো হয়!’’ পাশে লোকটি ফিসফিস করে বললো, ‘‘আরে এসবতো ভ্যান্তারা। ওই ম্যাডামকে ভয় দেখাবার।’’
    মেয়েটি এমন দৃশ্য কখনও দেখেনি এর আগে। ছেলেটির চিৎকার ওর বুকে সরাসরি ধাক্কা দিচ্ছিলো। কমরেডকেও কি ওরা এ ভাবে অত্যাচার করেছে? কথাটা মনে হতেই কাঁপুনি শুরু হোলো ওর সারা শরীরে। গলা শুকিয়ে কাঠ – জল চাইবেই বা কার কাছে? অনেকক্ষণ বাদে যখন হাবিলদাররা ক্লান্ত হয়ে মার বন্ধ করলো, ছেলেটি পড়ে থাকলো মেঝেতেই, একই জায়গায়। আবার সেই প্রশ্নকর্তা অফিসারের আবির্ভাব হতেই শরীরের সর্বশক্তি এক করে মেয়েটি বললো, ‘‘বাড়ীতে একটা খবর দিতে চাই। বাবা চিন্তা করবেন।’’ - ‘‘সে আমরা দিয়ে দেবো’’। বাড়ীতে ফোন আছে?’’
    - ‘‘না, নেই।’’
    ‘‘শোন, এখানকার পরিবেশ তো ভালো নয়। তুমি বরং আমার থানা লাগোয়া কোয়ার্টারে চলো। বিশ্রাম নেবে, চা খাবে। আমি আবার মেয়েদের কষ্ট মোটেই সহ্য করতে পারি না।’’
    - ‘‘না, না, আমি এখানেই ঠিক আছি।’’
    - ‘‘আরে চলোই না। একটু বিশ্রাম নেবে, ফ্রেশ হয়ে, সময় হলেই এখানে চলে আসবে। আমি তো আছি তোমার জন্য।’’
    - ‘‘কমরেড কোথায়?’’
    - ‘‘ওর কথা ভেবে কোন লাভ নেই। ও তো ভোগে চলে গেছে। এবার নিজের কথা ভাবো।’’
    - ‘‘কমরেডের অন্ত্যেষ্টি কখন হবে? আমাকে এভাবে আটকে রাখবে কারণ কি? আমি তো কোন কিছুতেই নেই। আমার বাড়ী ফেরা খুব দরকার।’’
    - ‘‘হবে, হবে, সব হবে। তার আগে তোমাকে একটু খাতির যত্ন করতে দাও। তুমি যদি কিছুই না জানো, তবে এসব বাজে ছেলের সঙ্গে এতো পিরীত কিসের, কেন?’’
    - ‘‘বাজে কথা বলবেন না। কমরেডের বাকি মৃত বন্ধুরা কোথায়?’’
    - ‘‘ওসব ভেবে কোন লাভ নেই খুকু। আগে নিজে তো বাঁচো!’’
    দরজার সামনে ভারী জুতোর আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখলো – কয়েকজন ষণ্ডা চেহারার মানুষ ঘরের মধ্যে ঢুকছে। জানা গেলো, এরা সবাই C.B.I. এর লোক, মাওবাদী নিধনের জন্য বিশেষ দায়িত্ব ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। মেয়েটি আর এক প্রস্থ অজানা ভয়ে সিঁটিয়ে গেলো। ওর তো একটাই অপরাধ, ও কমরেডকে ভালোবাসতো, ওর দোষ গুণ সমেত পুরো মানুষটাকেই ভালোবাসতো – যে ভালোবাসা অবস্থা গতিকে প্রস্ফুটিত হবার সুযোগই পায়নি। তাই কমরেড হাসপাতালে ভর্তি আছে শুনে, আগুপিছু কিছু চিন্তা না করেই তাকে দেখতে চলে এসেছিলো। বুঝতেই পারে নি – এটা ছিলো একটা ফাঁদ।
    C.B.I. এর লোকগুলো ওকে ঘিরে কাছাকাছি বসে কথা শুরু করলো প্রায় হিতৈষীর মতো। নাম, ধাম, পিতৃপরিচয়, শিক্ষাদীক্ষা, মাওবাদী আন্দোলন সম্পর্কে ওর ধারণা ও জ্ঞান, কখনো action-এর নাম করে খুন করেছে কিনা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা কি, ইত্যাদি সাত সতেরো ... তারপর শুরু হলো, অপ্রাসঙ্গিক ও কদর্য সব প্রশ্ন। কি বলবে ও জানে না। প্রায় জ্ঞানহারা অবস্থায় কি জবাব দিয়েছিলো আজ আর সেসব মনে নেই। চোখের সামনে কেবল বাবা আর ছোট বোনের মুখটা ভেসে উঠছিলো। মেয়েটির জবাবে সন্তুষ্ট নয় C.B.I., তাই ওদের কণ্ঠস্বর ক্রমেই কঠিন এবং শয়তানীভরা হয়ে উঠলো। কোথায় কোথায় দেখা হতো কমরেডের সঙ্গে, ওর বন্ধুদের পরিচয়, কারা আসতো দেখা করতে, কোথায় ছিলো গোপন ডেরা ইত্যাদি। উত্তরে অসন্তুষ্ট C.B.I. অফিসারটি বিকট চিৎকারে ফেটে পড়লো – ‘‘বলুন, কথা বলুন, মুখ বন্ধ রাখলে হবে না। বন্ধ মুখ খোলার উপায় কিন্তু আমাদের জানা আছে।’’
    সেই বিপদের মুহূর্তে দেবদূতের মতো একজন মানুষের প্রবেশ ঘটলো। সেই মানুষটি মেয়েটির পরিবারের খুবই পরিচিত। সেই সঙ্গে ভদ্রলোক থানার পরিবেশেও খুব স্বচ্ছন্দ। একটু হেসে মেয়েটির কাছে এসে বললেন, ‘‘আরে, তুমি এখানে যে। কি করছো এখানে? বাড়ী যাও। তুমি তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে M.A. পড়ছো। ছুটিতে এসেছো নাকি?’’
    মেয়েটি এতোগুলো প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই, আরও একজন কাছে এসে দাঁড়ালেন। তিনি মেয়েটির বাবা – একটা কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। মেয়ের কাছে এসে, ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘‘ঠিক আছিস তো? দাঁড়া আগে O.C. র সঙ্গে দেখা করে আসি উনিই আমাকে খবর পাঠিয়েছিলেন। মেয়েটির মনে তখন কমরেড ও তার সঙ্গীদের চিন্তা একটু ফিকে হয়ে এসেছে। কেবল মনে হচ্ছিলো – O.C. র ঘরে এখন কি ধরণের কথাবার্তা চলছে! বাবা কি সেখানে কাকুতি মিনতি করছেন, ওর মুক্তির জন্য? কিন্তু বাবা তো নরম প্রকৃতির মানুষ হলেও সহজে মাথা নোয়াবার বান্দা নন। তবে কি ওর বাড়ী ফেরার রাস্তা বন্ধ?
    বেশ কিছুক্ষণ বাদে বাবা বেরিয়ে এলেন। দেখেই মনে হচ্ছে প্রবল স্নায়ু যুদ্ধে ক্লান্ত। মেয়েকে বললেন, ‘‘বাড়ী চলো, আমাদের কাজ হয়ে গেছে।’’ রিক্সা করে বাড়ী ফেরার পথে খোলা বাতাসে মেয়েটির মধ্যে ধীরে ধীরে প্রাণ সঞ্চার হতে লাগলো। বাবা শুধু বললেন – ‘‘পরে সব শুনবো। বাড়ীতে সবাই অপেক্ষা করে আছে।’’
    সেই রাতটা যখন শেষের দিকে, একটা প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হলো। প্রকৃতি যেন হাহাকার করে কাঁদছে কমরেড আর তার সঙ্গীদের জন্য। এই প্রথম মেয়েটির চোখেও নেমে এলো অশ্রুধারা – নৃশংস হত্যালীলার আতঙ্কে যেটা আটকে ছিলো বুকের মধ্যে। এক সময় ঝড় বৃষ্টি থামলো, জীবন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হয়ে আসতে লাগলো। কমরেড ও তার দলবলকে হত্যার উল্লাস প্রশাসন মহলেও থিতিয়ে এলো পরবর্তী আরো ভয়ানক সব হত্যার প্রস্তুতির জন্য। সোনার টুকরো ছেলেরা সব রাজনীতির চক্করে বোকা বনে গেলো, মরে গেলো, শেষ হয়ে গেলো। যে বাঁশিওয়ালারা ওদেরকে ভুল স্বপ্ন দেখিয়ে ঘর থেকে টেনে বার করেছিলো, মৃত্যুর মুখোমুখি হবার জন্য, তারাও আর বেঁচে নেই। শুধু যারা কোন কিছুই করতে পারেনি – আজও তাদের কেউ কেউ বেঁচে আছে, জীবন ধারণের অপরিসীম গ্লানি নিয়ে। 
    অনেক সাহস সঞ্চয় করে, একদিন মেয়েটি তার প্রিয় কমরেডের মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো। শ্রীহীন, দারিদ্র্যের প্রতিমূর্ত্তি একটা ঘরে, কয়েক মিনিট বসে অপেক্ষা করার পর তিনি ঘরে ঢুকেছিলেন। একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর আঘাতে তাঁর চোখের জল তখন শুকিয়ে গিয়েছিলো, তার বদলে চোখে ছিলো আগুন। ভাঙা গলায়, তেজীস্বরে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন – ‘‘কে তুমি? কী চাই?’’
    মেয়েটির মুখে কোনো উত্তর যোগায়নি। আস্তে আস্তে উঠে, মাথা নীচু করে সে বেরিয়ে এসেছিলো। 
    মেয়েটি এখনো চাঁদনি রাতে মাঝে মাঝে পার্কের সেই বেঞ্চটাতে এসে বসে। কী ভাবে, কে জানে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শ্রীমল্লার বলছি | ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০১:৫৭734420
  • এককথায় চমকে গিয়েছি! দারুণ, দারুণ লেখা! 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন