এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কৌওম আর নেশন

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৮ আগস্ট ২০২৫ | ১০৯ বার পঠিত
  • স্বদেশীকতা বা প্যাট্রিয়টিজম এক অতি প্রাচীন ধারণা। সিরাজদ্দৌলা যখন ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়তে গেলেন তখনও তাঁর মানসিকতায় এক মোঘল সাম্রাজ্যীয় স্বদেশীকতার কথা বললেন ঐতিহাসিক রজতকান্ত রায়। আর এক ইতিহাসকার সি এ বেইলি সিরাজ বা মহাবিদ্রোহের সময় হিন্দু মুসলিম সব কৌওমের লোকেদের একজোট হয়ে লড়াইকে টুপিওলা ফিরিঙ্গীদের বিরুদ্ধে পাগড়িওলাদের ঐক্যের কথা বলেছেন। নেশনের ধারণা এসেছে সুরেন্দ্রনাথ বাড়ুজ্জের হাত ধরে কংগ্রেস হয়ে। রামমোহনেও নেশনের ধারণা ছিল না। তিনি বিলেতে মোঘল বাদশাহের হয়ে দরবার করতে গিয়ে ১৮৩১ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বড় কত্তাদের কাছে লেখা চিঠিতে নেশনস অফ হিন্দুস্থানের কথা বলেছেন। পঞ্চাশ বছর পর যিনি কিনা রাষ্ট্রগুরু সেই সুরেন্দ্রনাথ গড়ে উঠার প্রক্রিয়ায় থাকা এক নেশনের কথা বই অন্য কিছু বলেন না। ১৮৫৭র মহাবিদ্রোহের নেতা নেত্রীদের কৌওমের ধারণাই ছিল, নেশনের নয়। সেই ধারণার বশ্যবর্তী হয়ে তাঁরা মোঘল বাদশাহকে তখতে বসিয়ে তাঁদের মোঘল স্বদেশীকতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। কৌওম বর্গটা এক পারসিক ধারণা যার মানে বহুবিধ। কৌওম বলতে জনগণ, গোষ্ঠী, ধর্মীয় সম্প্রদায়, উপজাতি, ভাষা গোষ্ঠী, স্থানীয় জনগোষ্ঠী, জাতি সংক্ষেপে নানারকম জন সমষ্টিকেই বোঝাতে পারে। এ ধারণাগুলো আমাদের দেশে অনবরত বদলেছে, আজকের জন সমষ্টি কালকে আর সেরকম ভাবে চোখে নাও পড়তে পারে। এদের মধ্যে দুটো ধারণা ব্যাপক আর দীর্ঘস্থায়ী — হিন্দুর ধারণা আর মুসলমানের ধারণা। যদিও আজকে হিন্দু বা মুসলমান বলতে যা বোঝায় সেই ধারণাই আজন্ম একইরকমের ছিল তা নয়। গ্রিকদের অপভ্র্রংশ ইন্ডিয়ার ধারণা আর আরবীয়দের আল হিন্দের ধারণা একটা সর্বভারতীয় কৌওমের দিক নির্দেশক। তৈমুর যখন দিল্লী ছারখার করলেন তখন তিনি হিন্দুয়ান এ গাবর বলে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সবাইকেই কচুকাটা করলেন। ওই জন্য ইরফান হাবিব বলছেন তৈমুরের ধারণায় হিন্দুস্থানের হিন্দু বলতে মুসলমানরাও পড়ত। তৈমুর মুসলমান বলে, একই কৌওমের লোক বলে এখানের মুসলমানদের রেয়াৎ করছেন না। ওই জন্যই ইন্দো-মুসলিম লেখকরা হিন্দুস্থানের লোকেদের হিন্দি বলে উল্লেখ করে এসেছেন কয়েক শতক ধরে। ওই ‘হিন্দি’ জন সমষ্টিকে একটা একক কৌওম ধরেই সেটা করা হয়েছিল।

    অমুসলিম জন সমষ্টিকে হিন্দু বলা ঠিক কবেই বা শুরু হলো?

    সিনথিয়া ট্যালবটের গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে চতুর্দশ শতকের এখনকার অন্ধ্র বলতে যা বোঝায় সেখানে জনৈক প্রলয় নায়েক নামের সামন্ত প্রভু দাবি করছেন তিনি তুর্কদের অভিযানে তাঁর রাজ্য যে অপবিত্র হয়েছিল তাকে শুদ্ধ করে, বৈদিক আচার ফিরিয়ে এনে, শাস্ত্রমতে কৃষক প্রজাদের ফসলের অংশ রাজস্ব নিচ্ছেন। ট্যালবট বলছেন মুসলমানরা আসার আগে থেকেই ব্রাক্ষ্মণের মধ্যে একটা স্বাভিমান থাকার কথা। মুসলিমরা আসার পর বরং সমাজে চূড়ান্ত বৈরিভাব তৈরি হবার বদলে সহিষ্ণুতা বাড়ে। বিজয়নগরের কিছু রাজা নিজেদের সুলতান উপাধি দিচ্ছেন। তাঁরা নিজেদের হিন্দু রায়া সুরাট্রানা বলতেন। এটাই আবার অমুসলিমদের চিহ্নিতকরণের জন্য হিন্দু বলে উল্লেখ করার প্রাচীনতম নমুনা।

    কৌওমের ধারণা তাই এক ডায়নামিক ধারণা। বিবেকানন্দ যেমন বলেছেন সনাতন ধর্ম বলে উল্লেখ করলে হিন্দু নামক পারসিক পরিচিতির থেকে মুক্ত এক আদি ও অকৃত্রিমতার প্রাইমোর্ডিয়াল বিশুদ্ধ ধারাবাহিকতা সুচিহ্নিত হয় তেমন কোন ধারাবাহিকতা আদৌ ছিল বলেই মনে করেন না ইতিহাসকাররা। বহু কৌওমের উপস্থিতির জন্য ভারতে নেশনও কী যেমনটা সুরেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন সেরকমই, এখনও তৈরি হওয়ার পর্যায়েই নেই? নেহেরুর ভারতে নেশন এক একক বলে যে ভাবে ভাবা হতো মোদীর ভারতে কি তা একই আছে? এক সচেতন প্রয়াসে সেই আগেকার নেশন কী হিন্দু কৌওমের দিকে ঝুঁকে পড়ে নি? বিপরীত এক সচেতন প্রয়াসে সেকুলার নেশনের ধারণা প্রতিষ্ঠা না হলে মুক্তি কোথায়?

    সূত্র The Felt Community, Commonalty and Mentality Before the Emergence of Indian Nationalism, Rajat Kanta Ray
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন