এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ছোটগল্পঃ অথ বকুল-মোহন কথা

    Sagarmay Mandal লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ৩০ বার পঠিত
  • বকুলরা জাতে বাগ্দী, তথাকথিত নিচু জাত। খালে বিলে  মাছ ধরা,  মাঠে গরুর পালের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে গোবর কুড়োনো, গোবর থেকে ঘুঁটে বানিয়ে তা বিক্রি করা ওদের পেশা। বাগদী ঘরে জন্মালেও বকুলের রূপ ছিল অসামান্য। তার রূপের ছটায় অনেকেই ঘায়েল হয়েছিল, কিন্তু তার দাদা বউদির পাহারাদারি ডিঙিয়ে কেউ কাছে ভিড়তে পারেনি। একমাত্র মোহন ছাড়া। মোহনরা সদগোপের ঘরের ছেলে এবং গ্রামটিও সদগোপ প্রধান।  সুতরাং অন্যান্য জাতের তুলনায় তাদের প্রতিপত্তিও বেশি। তাদের অবস্থাও মোটামুটি সচ্ছল। লেখাপড়ার পাট নেই বললেই চলে, কোন রকমে ক্লাস ফোর পাশ দিয়েই চাষের কাজ আর গরুবাছুর নিয়েই দিন কাটায়। তবে সে খুব ভালো অভিনয় করতে পারে। পাড়ার শৌখিন যাত্রাদলে নায়কের রোল ছিল বাঁধা।
    তার যাত্রাপালায় অভিনয় দেখে বকুল বলতো
    -- কি পাট(পার্ট)টাই না করলে গো মোহনদা। আর সাজের পর তো তোমাকে চেনাই যাচ্ছিল না।  রাজপুত্তুর তো একদম রাজপুত্তুর। ঝকমকে পোশাক, বড়বড় কোঁকড়ানো কালো চুল, তার উপরে মাথায় মোটুক (মুকুট) ! চোখ ফেরানো যায় না।
    -- তোর ভাল লেগেছে?
    -- ভাল লাগবে না আবার। কত হাততালি পেলে, দশ টাকার মেডেল পেলে। জান তো, আমার না খুব আনন্দ হচ্ছিল। বুকের ভিতর টা না কেমন যেন করছিল।
    -- থাক, থাক। আর ভনিতা করতে হবে না। কাল তালিমখানার মাঠে ফুটবল খেলা আছে যাস।
    মোহন ভালো ফুটবলও খেলে। অভিনয় আর ফুটবল, এ দুটোই হল তার ধ্যান জ্ঞান। কোথাও ফুটবল টুর্নামেন্ট হচ্ছে শুনতে পেলেই, ছুটে যায় সেখানে। নিজের গ্রামের টিম না খেললেও অন্য টিমের হয়ে ঠিক নেমে পড়তো মাঠে। আর গ্রামের প্রত্যেকটি ম্যাচে দর্শক আসনে থাকে বকুল। মোহন খেলতো ফরোয়ার্ডে। বকুলকে মাঠে দেখলে মোহনের পায়ে ফুটবল ছন্দ খুঁজে পেত। গোল করার পর সে বকুলের দিকে হাত নাড়ত। বকুলও সারা দিত।

    বকুল এবং মোহনের পরস্পরের উপর দুর্বলতা ক্রমশ দানা বাঁধছিল। মোহন যে  মাঠে গরু নিয়ে চড়াতে গেছে, সেই মাঠেই গোবর কুড়োতে যেতো বকুল । কিংবা উল্টোটা। তারা গাছতলায় বসে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করতো। মোহন যাত্রার বই নিয়ে গিয়ে বকুলকে পরে শোনাত। বকুল বিস্ময় ভরা দুচোখে মোহনের দিকে তাকিয়ে থাকতো। মনে হতো সে যেন যাত্রার নায়িকা আর মোহন তার নায়ক। কত স্বপ্ন, কত রং তার চোখে খেলে বেড়াতো। মন চাইত মোহনকে জড়িয়ে ধরে খুব আদর করে। মোহনও চাইত বকুল তার বক্ষলগ্না হয়ে থাকুক। তাই তো তারা বাকি রাখালদের এড়িয়ে চলত। মাঝে মাঝে দুজনে কোথায় যেন হারিয়ে যেত। হয় কোন ক্ষেতের আড়ালে নয়তো কোন খালের ধারে। তাদের প্রেমলীলা হাতেনাতে ধরবে বলে, কত শলা-পরামর্শ হয়েছে, অভিযানও চলেছে, কিন্তু ধরতে পারে নি। এতে আক্রোশ বেড়েছে, হিংসে হয়েছে, কিন্তু তাদেরকে দমাতে পারে নি। কোন দিন দু’জনের একজন না এলে, রাখালেরা তা নিয়ে হাসি-মশকরা করত। ‘আজ আর রাধাকৃষ্ণের যুগল-মিলন দেখা হল না’ বলে ফোড়ন কাটত। কাটবে নাই বা কেন, অনেকের কাছেই বকুল ছিল মগ ডালের ফল। জুলু জুলু ছখে তাকিয়ে দেখত। নাগাল পেত না। আর সেই ফল অন্য কেউ ভোগ করলে গায়ে জ্বালা তো ধরবেই।

    ক্রমে ক্রমে লোকমুখে তাদের সম্পর্কের কথা পল্লবিত হতে হতে সারা গ্রামে রটে গেল। মোহন এবং বকুলদের দুই পরিবারই এতে প্রমাদ গুনলো । শুরু হলো হাতে পায়ে বেড়ি পোড়ানো। বকুলের বাড়ি থেকে বেড়োনো সম্পূর্ণ বন্ধ। কথা না শুনলে বা একটু বেচাল হলে চলত শারীরিক অত্যাচার। দাদা-বৌদির গঞ্জনা। পাড়া প্রতিবেশীর উস্কানি ও কৌতূহল সামাল দিতে না পেরে, দাদা তার পৌরুষ দেখাতে বোনের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করত  না। সোমত্ত মেয়ে, গায়ের যেখানে সেখানে হাত দিয়ে মারা যায় না, তাই জুটতো পাঁচনের বারি। বৌদিও মাথার চুলের ঝুটি ধরে চুল ছিঁড়ে দিত, মুখের উপর চড়-থাপ্পড় মারতো। বলতো,
    -- অমন রূপের মুখে নুড়োর আগুন জ্বেলে দি । যার তার সঙ্গে ঢলানি !
    সঙ্গে মুখে আনতে না পারা গালিগালাজ। বাবা-মা অসহায়ের মতো মেয়ের লাঞ্ছনা দেখতো। হাহুতাশ করতো আর কপাল চাপড়াতো। গোবর কুড়োনো বন্ধ হওয়ায় সংসারের রোজগার কমে যায়। আর তার রোষ পরে বয়স্কা মায়ের উপর। ফলে মাকে মাঠে মাঠে গোবর কুড়োতে যেতে হয় । পাড়া প্রতিবেশীরা উপদেশ দিলো "একটা যা  হোক ছেলে দেখে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দাও । দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে"। বাবাও ছেলে দেখা শুরু করলো।  এমন মেয়ের জন্য ভালো ছেলে পাওয়া দুস্কর। যেখানেই সম্বন্ধ করতে যায়, পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখে পছন্দ করে, কিন্তু পড়শিদের কান ভাঙানিতে কিছুদিন পরে তারা পিছিয়ে যায়।

    অবশেষে গ্রামের মাতব্বরদের চেষ্টায়, গ্রামেরই ছেলে গনশা বাগ্দীর সঙ্গে বকুলের বিয়ের ঠিক হয় । গনশা ছিলো চিররুগ্ন।  শহরের অনেক বড় ডাক্তার দেখিয়েও কিছু হয় নি । এখন সারা বছর ধরে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের ওষুধ খায়। মা বাবা কেউ নাই। একা একটা ভাঙ্গা দোতলা মাটির বাড়িতে থাকে। চালে খড়ও জোটে না সবসময়। গনশা সাবলম্বীও ছিল না। কেউ বিল থেকে মাছ ধরে এনে দিলে, সেটা বাড়ি বাড়ি বিক্রি করলে পেটের ভাত জোগাড় হতো। তাই শত চেষ্টা করেও বিয়ের জন্য কোনো কনে জোগাড় করতে পারে নি।  তা এহেন গনশার সঙ্গে বকুলের মতো রূপসীর বিয়ের ঠিক হলো। গনশার সে কি আনন্দ! বকুলের কথা জানা যায় নি। সে তো গৃহবন্দিনী। লোকে বলাবলি করত এতো “বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা”। প্রতিবেশী মহিলারা কটাক্ষ করে আওড়াত "অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর, অতি বড় রূপসী  না পায় বর"।

    তারপর একদিন শুভ মুহূর্তে ঋষি প্রজাপতির কৃপায়,  চার হাত এক হল। সব থেকে আশ্চর্য ব্যাপার, মোহনও এই বিয়েতে অগ্রণী ভূমিকা নিল। গনশার জন্য জামা কাপড় কেনা, লোকজন খাওয়ানোর জন্য চাল-ডালের ব্যবস্থা করা। সব ব্যাপারে সে গনশার পাশে ছিল। লোকে বলত লোকদেখানো উপকার, আসলে বকুলের প্রতি ভালোবাসার টান মোহনকে বিয়ের আসরে টেনে এনেছে। যাতে বকুলের কোন অসুবিধা না হয়। সে জানে সমাজ তাদের এই সম্পর্ককে মেনে নেবে না। জোর করে কিছু করতে গেলে বকুলের প্রাণ সংশয় হতেও পারে। তাই সে চুপ। সে আরও জানে যে তার সামনেই বকুল গনশার গলায় মালা পড়াবে, তবু সে সেখানে থাকবে, শুধু বকুলকে কনের সাজে দুচোখ ভরে দেখবে বলে। আর বকুল কি একবারও আড় চোখে তার দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারবে ! আপাতত বকুলের ভালো থাকায় তার চরম পাওনা।

    এদিকে মোহনের বাবাও বসে থাকে নি। মোটা টাকার বিনিময়ে গ্রামের একটি বোবাকালা মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়ে দেয়। খূব তড়িঘড়ি করে। মোহন বাধা দেয় নি। বরং সম্মতি দিয়ে ছিলো। মনের পাখি যখন বনে উড়ে যায়, তখন বোবা-কালায় কিই বা এসে যায়!

    সমাজ এবং পরিবারের চাপে দুটি নৌকা, দুটি আলাদা ঘাটে নোঙ্গর ফেলল বটে, তবে যৌবনের প্রবল হাওয়া বারবার ঝটকা মেরে তাদেকে একত্রিত হওয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগল। তারাও অপেক্ষা করে থাকলো এক প্রচণ্ড কালবৈশাখীর, যার দাপটে নোঙর ছিঁড়ে যাবে আর তারা আবার একসঙ্গে মনের আনন্দে পাশাপাশি ভেসে যেতে পারবে। ধারনা ছিল শারীরিক ভাবে অক্ষম গনশা বকুলকে ধরে রাখতে পারবে না। আবার মোহনের বোবাকালা স্ত্রীও মোহনকে রুখতে পারবে না। এতএব দুয়ে দুয়ে চার হতে কোন বাধা নাই।

    বিয়ের পর মোহনের সঙ্গে গনশার  সম্পর্কের বেশ উন্নতি হয়। তারা একসঙ্গে বসে গনশার বাড়িতেই আড্ডা দেয়।  মোহন আপদে-বিপদে গনশাকে সাহায্য করে। গনশার আবার শুকনো-নেশা (গাঁজার নেশা)। মোহন সেসবও দোকান থেকে এনে দেয় । সঙ্গে থাকতে থাকতে মোহনও নেশা করতে শুরু করে। হয়তো বকুলের কথা ভুলে থাকতে কিম্বা নেশার ছলে গনশাকে সঙ্গ দিয়ে বকুলের কাছাকাছি থাকতে।  দুজনেই মাঝে মাঝে মদ-গাঁজা খেয়ে পড়ে থাকে। বাড়ির টুকিটাকি কাজ করার ফাঁকে বকুল দুজনকেই দেখে নেশায় বিভোর হয়ে একজন আর একজনের গলা জড়িয়ে শুয়ে আছে। সে ভাবতো, এরা তার কে ? সেই বা কার ? সেতো খাঁচার ময়না। সাথীকে নিয়ে সুদূর আকাশে ভেসে বেড়ানোর স্বপ্ন আজ ভেঙে চুরমার, চার দেওয়ালে বন্দি। গনশার দেওয়া গলার মালা তার পায়ের শৃঙ্খল, শাঁখা দুটো হাতের বেড়ি, সিঁথির সিঁদুর পোড়া কপালে জ্বলতে থাকা আগুনের শিখা । বকুল কাঁদে, সে কান্নার সাক্ষী তার মাথার বালিশ। গনশা তার পাহারাদার। সে দাঁড়ে এসে  বসলে, গনশা তার সাথীকে এনে দাঁড় করায় তার সামনে, কড়া পাহারায়। সাথী আসে,  দূর থেকে দেখে, চোখ জলে ভিজে যায়। কিন্তু, চোখের জল ফেলতে মানা। চোখের জল চোখেই শুকিয়ে যায়।

    গনশা সুযোগ ও সাহায্য নেয় বটে, কিন্তু মোহনকে সন্দেহ করে। যে মোহন বাগদির ব্যাটা বলে গনশাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতো, সেই মোহন বকুলের সঙ্গে বিয়ের পর তাকে এত খাতির করে কেন ? তবে কি বকুলের বিয়েটা ও মেনে নেয় নি ? ওর অন্য কোন মতলব নেই তো ? খুব সতর্ক থাকতে হবে। বকুলকেও চোখে চোখে রাখতে হবে। এইসব ভাবনা চিন্তায় গনশা অস্থির হয়ে পড়ে। সন্দেহের বীজ একবার বপন হলে তা ক্রমে ডালপালা বিস্তার করে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। কিছুদিন যাওয়ার পর গনশা বকুলকে খুব বকাবকি এমন কি মারধরও করতে শুরু করলো।  কথাটা মোহনের কানে যেতেই সে গনশার বাড়ি চলে যায় এবং গনশাকে শাসায়,  বলে ফের এরকম করলে হাড়গোড়  ভেঙে ফেলে দেবে। এতে গনশার সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। ভাবে, ওদের পিরিতের আগুন এখনও নেভে  নি। হয় এ আগুন নেভাবো, নয়তো জ্বালিয়ে দেব। তবে মুখে কিছু বলে না। আবার সব চুপচাপ। মোহন আবার আসে, গল্প করে, গাজা খায়। কখনো বুঁদ হয়ে  পড়ে থাকে, কখনো একটান দিয়ে চলে যায়।

    সেদিনও সন্ধ্যাবেলায় মোহন ও গনশা মদ আর গাঁজার দুটোই নিয়েছিল। দুজনেই নেশায় বুঁদ হয়ে পড়েছিল। গনশার নেশা কেটে গেলে, দেখে মোহন কাছে নাই।  কোথায় গেল তাহলে ? ওকি বকুলের ঘরে চলে গেছে ! বোধহয় আমাকে এভাবে নেশায় বুঁদ করে দিয়ে রোজই যায় ! আজ ছাড়ছি না।

     গনশার চোখে-মুখে ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠে। হাতের কাছে জ্বলতে থাকা কেরোসিনের কুপিটা হাতে নিয়ে সোজা দোতলায় উঠে বকুলের ঘরের দিকে যায়। বকুল মাটির ঘরের মেঝেয় কাঁথা পেতে শুয়ে ছিলো।  কুপির আলোয় গনশা কি দেখলো কে জানে, সে জোরে চিৎকার করে উঠল –
    -- শালা! আজ তোকে বাগে পেয়েছি, তোকে মারবোই । শালা ! পরের বৌয়ের সঙ্গে ফুর্তি! দেখাচ্ছি মজা।
     এই বলে জ্বলন্ত কুপিটা বিছানায় ছুড়ে মারে। কুপির কেরোসিন সারা বিছানায় ছড়িয়ে পরে আগুন ধরে যায়।  বকুলের মুখেও  তেল ছিটকে পরে, মুখ পুড়ে যায়। গনশা নিজেই জল এনে সে আগুন নেভায়। বকুলের চিৎকারে পাড়াপ্রতিবেশীরা ছুটে আসে। কিছুক্ষনের মধ্যে মোহনও ছুটে আসে। গনশাকে দু’ঘা লাগায়। তারপর বকুলকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে খবর পেয়ে পুলিশ এসে গনশাকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। গ্রামের আর কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে মোহন থানায় যায়। পুরো ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা বলে বর্ণনা করে মুচলেখা দিয়ে গনশাকে ছাড়িয়ে আনে। গনশা তার পায়ে ধরে ক্ষমা চায়, মোহন কিছু বলে না।

    হাসপাতাল থেকে ফেরার পর সবাই দেখে বকুলের মুখ জুরে কালো পোড়া দাগ । মুখের সে লাবণ্য আর নাই । আক্ষরিক অর্থেই সে আজ মুখপুড়ি, পোড়ার মুখি । আগে যে মুখের দিকে তাকালে চোখ ফেরাতে পারত না, আজ সে মুখের দিকে তাকাতে মানুষ ভয় পায়।

    বকুল খূব কাঁদে। এত দিন যে চোখে অভিমানের জল মুক্তর মতো টলটল করতো , আজ পোড়া চামড়া বেয়ে সে জল গায়ে গরিয়ে পড়ে। সে জল মোছানোর কেউ নাই। মোহন দূর থেকে দেখে। কাছে যায় না। আবার কাছে গেলে, দূর থেকে দেখাটাও যদি হারিয়ে যায়। বকুলও তার সামনে আসে আসে না , পাছে তার পোড়া মুখ দেখে তার প্রাণপ্রিয়র ভালবাসায় কোন ব্যাঘাত ঘটে।  
    মোহন বকুলের দুর্দশার জন্য নিজেকেই দায়ী করে। কত তো এরকম শুনেছে, বিয়ের পর দুজনে আলাদা আলাদা সংসার করে সুখে (!) আছে। সেও কি এমনটা করতে পারতো না ! তাহলে তো এই ঘটনা এড়ানো যেতো। আর সেই বা কেন পারেনি বকুলকে না দেখে থাকতে !
    এমনি ভাবেই চলছিল।

    পরের ঘটনা ছ’ বছর পরে ।
     একদিন রাতে গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তারের বাড়ির দরজায় ধাক্কাধাক্কির আওয়াজ । চিৎকার করে মোহন ডাকছে
    -- ডাক্তার তাড়াতাড়ি এস, বকুল বিষ খেয়েছে ।
    ডাক্তার দৌড়ে গেল, সঙ্গে পাড়ার আরও কিছু লোক। কেউ বা পাশে দাঁড়াতে, কেউ বা মজা দেখতে আবার কয়েক জনপ্রার্থিত সান্নিধ্য না পাওয়ার জ্বালা জুড়োতে।
    কিছুক্ষন পরে ডাক্তার বাড়ি ফিরলো মৌন মুখে । অস্ফুট কন্ঠে বললো -
    -সমাজ মেয়েটাকে বাঁচতে দিল না। আমরা পারলাম না, ওকে তার নিজের মতো করে বাঁচতে দিতে। 
    ওদিকে মোহনকে আটকানো যাচ্ছে না। পারলে বকুলকে সে বুকে করে আগলে রাখে। বকুলের অসময়ে ঝরে যাওয়া, সে মানতে পারছে না। সে তো বেশি কিছু চায় নি, শুধু দূর থেকে তার প্রানাধিকা বকুলকে দেখতে চেয়াছিল। সে জানতো তাদের এই সম্পর্ক কেউ মানবে না, তাই সে বিয়েতে না করে নি।  বিয়ের পরে তো গ্রামেই থাকবে, সকাল বিকেল দূর থেকে দু’চোখ ভরে দেখতে পাবে। কিন্তু এখন সে দুরের দেখা থেকেও বঞ্চিত। তীর বেঁধা পাখি তাকে ফাঁকি দিয়ে উড়ে গেছে অজানা গন্তব্যে। হয়তো বকুলরা এভাবেই ঝরে যায়। গনশা উঠোনের এক কোন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল, মোহনকে দেখে আড়ালে সরে যায়।
    এরপর মোহন পুরো নেশাগ্রস্ত হয়ে পরে । চোলাই খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকে। তবে সব সময় পশে থাকে তার বোবাকালা স্ত্রী । রাস্তায় পড়ে থাকলে মাথায় জল ঢালা, চোখেমুখে জল দেওয়া, সবই করে।  একা কোলে তুলে ঘরে নিত পারতো না বলে কাকুতি মিনতি করে পাড়ার লোককে ডেকে ঘরে তুলে নিয়ে গিয়ে সেবা শুশ্রুষা করতো। কথা বলতে পারত না বলে, হাতের ইশারাই, মুখে নানা রকম শব্দ করে সাহায্য চাইত। তার অসহায় চোখেমুখে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ছায়া পড়তো। তার ছোটো ছোটো দুই ছেলে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে স্বামীর সেবা করতো । এক কথাই ওই বোবাকালা স্ত্রীর সেবায় মোহন আবার সুস্থ জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা চালিয়ে যায়। খেলা, অভিনয় --এসবে আবার ডুবে যেতে চায়। কিন্তু চাইলেই তো আর সব হয়ে যায় না। তবু মানুষ চেষ্টা করে অতীতের দুঃখ ভুলে নতুন করে বাঁচার, নতুন স্বপ্ন দেখার। কারো স্বপ্ন সফল হয়, কারো হয় না। অতীতের স্বপ্নের ছায়া কুহেলিকার মতো জড়িয়ে ধরে মোহনকে। সে কাউকে বুঝতে দেয় না। ভিতরে ভিতরে ভাঙতে থাকে। তারপর একদিন সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। চলে যায় তার প্রার্থিতা বকুলের কাছে।

    শেষ
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন