এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সমাজ চিন্তন ও স্বদেশপ্রেমের আলোকে স্বামী বিবেকানন্দ || কলমে ঈশ্বর অধ্যাপক ডক্টর নিমাই বন্দ্যোপাধ্যায়

    Saheli Bandyopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৪ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৩২ বার পঠিত
  • পর্ব ৩ :

    তাই অন্তরের পরম আকুলতা ও প্রবল আত্মজিজ্ঞাসা নিয়ে পিছন ফিরে ভারতের বীরত্বব্যঞ্জক ও জীবনবৈদ্যুতীপূর্ণ সংস্কৃতিকে আবার নতুন করে বর্তমানে পাদপ্রদীপের সম্মুখে তুলে ধরতে হবে। সেটাই হবে প্রকৃত জাতীয় শিক্ষা। আর তার থেকেই জেগে উঠবে প্রকৃত জাতীয়তাবোধ। এই তীব্র দেশপ্রেমের উদাত্ত আহবানে যে পবিত্র যজ্ঞান্ন বিবেকানন্দ প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন, তাতেই পুত সমিধ নিক্ষেপের জন্য স্বাধীনতাকামী দেশপ্রেমিকের, বিশেষ করে যুবসমাজের অন্তরাত্তা সহস্র শিখায় জ্বলে উঠেছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের “আনন্দমঠ” উপন্যাসে সর্বস্ব-নিবেদিত প্রাণ যে সন্তানেরা দেশের জন্য আত্মবলিদানে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। তিনি লিখেছিলেন — “সত্যানন্দ যে আহবান জালিয়া গেলেন তাহা সহজে নিভিল না।” বিবেকানন্দ দেশপ্রেমের সেই আগুনকে নিজের বুকের মধ্যে জ্বালিয়ে রেখে ঘুমিয়ে-পড়া জাতির মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে প্রবল উদ্দীপনার প্রচন্ড উত্তাপ সঞ্চার করেছিলেন। স্বদেশী-আন্দোলনের ইতিহাস একটু ঘাঁটলেই দেখা যায়, নরমপন্থী কংগ্রেসীদের ইংরেজ বাহাদুরের কাছে মাথা নত করে আবেদন-নিবেদনের যে আর্জি, তাকে স্বামীজী যে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছিলেন। জানিয়েছিলেন, সংগ্রামের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়, অনেক বাধা বিঘ্ন সংঘাতের সম্মুখীন হয়ে রক্তাক্ত পদচিহ্নে এঁকে তবেই তাকে অর্জন করতে হয়। ভাবতে অবাক লাগে, একজন সর্বত্যাগী নিকিঞ্চন বৈদ্যান্তিক সন্ন্যাসী আধ্যাত্মিকতার তুরীয় মার্গ ছেড়ে দিয়ে কেমন করে স্বদেশ প্রেমের আগ্নেয়মন্ত্রে নিজেকে উজ্জীবিত করে অপরকে দীক্ষিত করতে পেরেছিলেন। তাই বিশ্বজীবনের তরঙ্গে তরঙ্গে আন্দোলিত হতে হতে আকুল আর্ত জিজ্ঞাসায় উজ্জীবিত করে অপরকে দীক্ষিত করতে পেরেছিলেন। তাই বিশ্বজীবনের তরঙ্গে তরঙ্গে আন্দোলিত হতে হতে আকুলআর্ত জিজ্ঞাসায় উন্মোথিত প্রাণ স্বামীজী যখন ধ্যানে বসলেন কন্যাকুমারীকার সমুদ্রগর্ভোথিত একটা প্রস্তরখন্ডে, একটি আকুলি বিকুলি করা তাঁর অন্তরাত্মার সম্মুখে দাঁড়িয়েছিল আর কেউ নয়, কোটি কোটি অসহায় ক্ষুধিত কঙ্কালসার ম্লানমুখ ভারতবাসী। যাদের অন্ন নেই, চিকিৎসা নেই, শিক্ষা নেই — আছে কেবল নির্মম বঞ্চনা, নিষ্ঠুর অত্যাচার আর হৃদয়হীন উপহাস। এই প্রবল আর্ত আত্মজিজ্ঞাসা থেকেই জাগ্রত হয়েছিল স্বামীজীর অকৃত্রিম দেশপ্রেম।

    সমাজের বেশিরভাগই যখন অখ্যাত অবজ্ঞাতদের ভিড়ে তখন তাদের বাদ দিয়ে স্বদেশ-চিন্তা ও সামাজিক পরিবর্তনের কথা বাতুলতা এবং বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর। যে কালের তথাকথিত জননেতারা উচ্চ শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই এই স্বদেশপ্রেম-সমাজ চিন্তন ইত্যাদির কথা সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন। বিপিনচন্দ্র পালের মতো অগ্রণী তেজস্বী নেতাও সাধারণ মানুষের রাজনীতিতে ও সামাজিক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণের কথা চিন্তা করতে পারেননি। তিনি মনে করতেন, এতে দেশে অরাজকতা ও ধ্বংসাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে। স্বামীজীর স্বচ্ছচিন্তা সে ধারণাকে নস্যাৎ করে দিতে চেয়েছিল। এ বিষয়ে ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের চিন্তাগর্ভ প্রবন্ধ “স্বামী বিবেকানন্দের অবদান” থেকে কিছু অংশ তুলে ধরি — “সর্বপ্রথমে তিনি দেববাসীকে ক্লৈব্য হইতে জড়ধর্মী তমোগুণ হইতে, আত্মঘ্ন আত্মতৃপ্তি হইতে রক্ষা করিয়াছেন। ...... তাহার অগ্নিবাসীর স্পর্শে আমাদের জড়ত্ব ও নিষ্ক্রিয়তা ভস্মীভূত হইয়া গিয়াছে। যে দর্শন মানুষকে দেবতা বলিয়াছে, তাহার ভ্রান্ত ব্যাখ্যার ফলে আমরা আমাদের ভাইয়ের প্রতি আমাদেরই আত্মার অপর প্রকাশের প্রতি অবিচার করিয়াছি। তাই তিনি এই সমস্ত অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করিবার জন্য আমাদের আহবান করিয়াছেন।”

    এই নিরন্তর অপরাধবোধ এবং বিবেকের দংশন থেকে শিক্ষা লাভ করে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে – অকৃপণ ভালোবাসার হস্ত প্রসারিত করে সকল শ্রেণীর সকল সম্প্রদায়ের সকল ধর্মের মানুষকে উদার বক্ষেআলিঙ্গন করতে হবে। সে কারণেই জাতিভেদ প্রথা ও অস্পৃশ্যতা বস্তুটিকে স্বামীজি তীব্রভাবে ঘৃণা করতেন। “Don’t touchism” শব্দটি তাঁরই সৃষ্টি। সমাজে যারা অবিচারের বলি, উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে যারা সমাচ্ছন্ন, তিনি তাদের সকলকে নিঃশেষে ভালোবেসে তাদের মানবিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন — “ সদর্পে বলো — আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই, বল মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।” এ সুস্থির বিশ্বাসে তিনি দৃঢ়ীকৃত – “ নতুন ভারত বেরুক লাঙ্গল ধরে, চাষার কুটির ভেদ করে, জেলে মালো মুচি মেথরের ঝুপড়ির মধ্য হতে, হাট থেকে, বাজার থেকে” ইত্যাদি একজন প্রখর সমাজচেতন হিসেবে “বর্তমান ভারত” গ্রন্থে তিনি ঐতিহাসিক প্রমাণ উল্লেখ করে দেখিয়েছেন যে আগামী দিনে যে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটবে তাতে নেতৃত্ব দেবে শূদ্র জনগণ। যাদের একদিন পশ্চাতে ফেলে রেখেছি আবর্জনার স্তূপের মধ্যে, সভ্যতার রথের চাকা যাদের পরিশ্রমে অবিরত সম্মুখের দিকে এগিয়ে চলেছে, মার খেতে খেতে তারা একদিন পাল্টা জবাব দেবে। এবং চালকের আসনে বসে পুরোভাগে সমাজকে একদিন তারা পরিচালনা করবেই। স্বামীজীর এ সিদ্ধান্ত ইতিহাসসম্মত। তাঁর ভাষায় – “ সর্বংসহা ধরিত্রীর ন্যায় সমাজ অনেক সহেন কিন্তু একদিন না একদিন জাগিয়া ওঠেন এবং যে উদ্বোধনের বীর্যে যুগযুগান্তরের সঞ্চিত মলিনতা ও স্বার্থাপড়াতাড়াশী দূরে নিক্ষিপ্ত হয়।” ইউরোপ-এশিয়ার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তার এই ভবিষ্যৎবাণী সার্থক বলে প্রমাণিত হয়েছে। 1897 খ্রিস্টাব্দে বিভ্রান্ত অশ্বিনী কুমার দত্তকে তাই স্বামীজি জানিয়েছিলেন যে কয়েকটা বাস্তব বোধহীন শুষ্ক প্রস্তাব পাস করলেই দেশের স্বাধীনতা আসবে না। জনসাধারণের মধ্যে যে বিস্ফোরক আগ্নেয়গিরি ঘুমিয়ে আছে তাকে জাগাতে হবে। প্রভূত তার শক্তি। তার জন্য আগে অন্নবস্ত্র সংস্থান চাই। ধর্ম প্রসঙ্গে বলেছিলেন -- “ যে ধর্ম মানুষকে শক্তি দেয় না সে ধর্মই নয়, যে ধর্ম ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন দিতে পারেনা, বিধবার চোখে জল মুছে দিতে পারে না, সে ধর্মকে আমি ঘৃণা করি।” তাই শিক্ষক অশ্বিনী কুমার দত্তকে বিবেকানন্দ নির্দেশ দিয়েছিলেন, " ছাত্রদের আপনি বজ্রের মতো করে তুলুন। বাঙালি যুবকদের হাড় থেকে বজ্র তৈরি হয়ে ভারতবর্ষের দাসত্বকে চূর্ণ করবে। আর আপনারা চলে যান অছুদদের কাছে, মুচি মেথর ঝাড়ুদারদের কাছে। তাদের বলুন তোমরাই জাতির প্রাণ তোমাদের মধ্যে আছে পৃথিবীতে বিপ্লব ঘটানোর শক্তি। তোমরা উঠে দাঁড়াও, শিকল ছিঁড়ে ফেলো। পৃথিবী অবাক হয়ে তোমার দিকে চেয়ে থাকবে।”

    (Copyright January 2006)
    কন্যা সহেলি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় প্রকাশিত

    ক্রমশঃ .....
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন