এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • দর্শক ও থিয়েটারের সম্পর্ক  

    Sandipan Majumder লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১০২ বার পঠিত
  • মহাভারতের নাট্যরূপের জন্য আমাদের কাছে সুপরিজ্ঞাত পরিচালক পিটার ব্রুক তাঁর থিয়েটার বিষয়ক বই ‘The Empty Space’ শুরুই করেছিলেন একটা চমৎকার উদাহরণ দিয়ে। একটা খালি স্পেস, একজন লোক সেখানে পায়চারি করছে আর আরেকজন তাকে দেখছে – এটাই একটা থিয়েটারের সূত্রপাত হতে পারে। লক্ষ্য করার বিষয় এই উদাহরণে, দর্শকের ভূমিকাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানে সে না দেখলে এটা থিয়েটারই হয় না। বলা হয় যে নাটক লেখাই হয় দর্শকের উপস্থিতির কথা মাথায় রেখে, শুধু পঠিত হবে বলে কেউ নাটক লেখেন না। অর্থাৎ নাটকের টেক্সট পূর্ণাঙ্গ পরিণতি পায় থিয়েটার হয়ে ওঠায় আর সেখানে দর্শক আছে কেন্দ্রীয় চরিত্রে।

    থিয়েটার বা নাটক দর্শকের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি করছে সেটা নিয়ে নাটকের আদিযুগ থেকেই ভাবনা শুরু হয়েছে। অ্যারিস্টটল ও তার কাব্যতত্ত্ব থেকে প্রেরণা নিয়েই রচিত হয়েছিল গ্রীক ট্র্যাজেডি। সেখানে ট্রাজেডির নায়কের জীবন অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়ে দর্শকের আবেগের পরিশুদ্ধি ও নবায়ন ঘটবে, তার আবেগের Cathersis ঘটবে এটাই ছিল নাট্যদর্শন। জেনে বা না জেনে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকি লোকনাট্যের বয়ানেও দর্শকের সঙ্গে নাটকের সম্পর্কে এই উদ্দেশ্যমূলকতা স্থান পেয়েছে। রামকৃষ্ণদেব বোধহয় একারণেই বলেছিলেন, থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়।

    গোল বাঁধল পুঁজিবাদী যুগে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের বাড়বাড়ন্তের সময়। যখন থেকে দর্শক টিকিট কেটে থিয়েটারে ঢুকতে আরম্ভ করল তখন থেকে যেন সেই প্রবেশমূল্যের বিনিময়ে বিনোদন প্রাপ্তি তার অধিকারে চলে এল একটা সামাজিক চুক্তির মত। ফলে দর্শকের চাহিদা দ্বারাই নির্ধারিত হতে শুরু করল সব কিছু। সেখানে অভিনয় থেকে নাটকের পাঠে একটা স্ট্যান্ডার্ডাইজড রূপকে অনুসরণ করা, সেই রূপের অনুসারী হওয়ার কৃৎকৌশলকে প্রয়োগ করার মধ্যেই সাফল্যের সংজ্ঞা সীমায়িত থাকছিল। ফলে থিয়েটার তার সত্য দর্শনের অনুসন্ধান থেকে বিচ্যুত হচ্ছিল, বিচ্যুত রাখছিল দর্শককে। যাঁরা এই সহজ দেনাপাওনা এবং থিয়েটারের বঞ্চনাকে মেনে নিতে পারেন নি তাঁরা তাই দর্শকের প্রত্যাশার মধ্যে অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে তাকে বারবার নতুন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চেয়েছেন। সেইজন্য দর্শককে তার স্বস্তিযাপনের সুযোগ না দিয়ে তাকে বিব্রত করা,অস্বস্তিতে ফেলা এমনকি তাকে চ্যালেঞ্জ করা -- আধুনিক থিয়েটারের অনেক স্রষ্টা বিশেষত অ্যাবসার্ড থিয়েটারের প্রবক্তারা এই কাজগুলি করেছিলেন। এটা আরো বেশি করে প্রমাণ করে থিয়েটারের বিবর্তন তার দর্শককে কেন্দ্রে রেখেই হয়।

    বের্টোল্ট ব্রেশট তার গোটা থিয়েটার দর্শনটাই তৈরি করেছিলেন দর্শকের নির্লিপ্তি খণ্ডন করার জন্য। দর্শককে বিনোদিত নয় নন্দিত করতে হবে – এটা তাঁর ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু এই নন্দন আসবে “জানার আনন্দ’’ থেকে। বাস্তবোচিত উপস্থাপন নয় -- বাস্তবকে একটু অচেনা করে দিয়ে, থিয়েটারের মঞ্চমায়াকে ভেঙ্গে দিয়ে, টেক্সট থেকে দর্শককে বাঞ্চিত দূরত্বরচনার সুযোগ দিয়ে তার নিস্ক্রিয় পাঠউপভোগকে পুরোপুরি আক্রমণ করাই ছিল ব্রেশটের উদ্দেশ্য। ব্রেশটের এই নাট্যদর্শন কিন্তু একটা রাজনৈতিক বাস্তবতার অনুষঙ্গেই উঠে এসেছে। তৎকালীন জার্মানিতে ব্রেশট দেখেছিলেন নাৎসি মতাদর্শের বিপুল নাটকীয় প্রচারের সামনের মানুষের নিষ্ক্রিয় আত্মসমর্পণ। এখন এই সমাজমাধ্যমের দাপাদাপির যুগে মানুষের মধ্যে এই নিষ্ক্রিয় উপভোগের সংস্কৃতি কিন্তু আবার জাঁকিয়ে বসেছে। অদ্ভুত মিল নয়া নাৎসিবাদের দেশে দেশে উথ্বানের সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে। সেই অবসরে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা, নারীবিদ্বেষ এবং সহিংসতার চাষ বাড়ছে। ফলে সেই দর্শককে নতুন দর্শক হিসেবে পুনর্গঠিত করার জন্য থিয়েটারের সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে প্রতি মুহূর্তেই ভাবতে হবে। থিয়েটারের অদ্যাবধি প্রচলিত তত্ত্ব ও প্রয়োগরীতি দিয়েই শুধু নয়, প্রয়োজনে নব উদ্ভাবনের মাধ্যমেই সেই কাজ করা দরকার। মোট কথা, থিয়েটারকে শেষাবধি দর্শকের কথাই ভেবে যেতে হবে। এর মানে দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী নাট্য পরিবেশন নয়। প্রয়োজনে দর্শকের চেতনার মুখোমুখি হয়ে তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে জীবন্মৃত অবস্থা থেকে বাঁচানোটাও থিয়েটারের কাজ। থিয়েটার ও দর্শক একসঙ্গেই বাঁচবে যদি না অতি সামাজিক দুর্বিপাকে সহমরণের পরিণতি তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন