এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • পুজোটুজো (পুরোনো লেখা)

    sangeeta das লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ অক্টোবর ২০২৪ | ১২২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • ২৪ অক্টোবর, ২০২৩
    --------------
    খুব সাদামাটা জীবনে ঘটনা,ফটনা তেমন একটা পাওয়া যায় না। সাধারণত, সিম্পল ঘটনাকেই মশলা ফশলা দিয়ে স্পাইসি বানাতে হয়। এই বিষয়কে মাথায় রেখেই ডেইলি সোপ তৈরি করা হয়। একটা ডেইলিকার ঘটনাকে জল মেরে ফ্যানা ওঠানোর নাম‌ই, ডেইলি সোপ। সকাল বেলা। পরিবারের সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে ওয়েট করছে। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁয়ে ফেললো! নতুন বৌ আসেনি। মানে লজিক্যালি না আসাটাই স্বাভাবিক। সে রাত দশটায় ঘুমোতেও পারেনি। কিন্তু বনেদী বাড়ির গল্প। সেখানে মরলেও, জামদানী পরে মরতে হয়। কাঁটা আটটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ক্যামেরা সিঁড়ি ধরে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে ধুম তা না না না না না বাজছে। সবার মুখে ক্যামেরা ধরা হচ্ছে। তারপর সেই মুখে বাবা লোকনাথের মাথার পিছনের মত দৈব আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। টেবিলে পাঁউরুটি যত নরম হচ্ছে, শাশুড়ির মুখ তত শক্ত হচ্ছে। এই ঘটনাকে আপনি নেগেটিভলি নিয়ে ফেলেছেন। নিজের বাড়ির বৌমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছেন। কিন্তু সিরিয়ালে আর সুলভ শৌচালয়ে ভরসা করলে আপনাকে কঠিন  ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। সিরিয়ালের বৌমার স্পর্ধা দেখে গর্জে উঠেছে শ্বশুর। বারো বছর পর! আচমকা বোবা হয়ে যাওয়া শ্বশুরের মুখে কথা ফুটেছে! বৌমা সমেত সবাই হতবাক! ধুম তানা বদলে গিয়ে বাবা তারকনাথের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চলছে।

    দশমী এইরকম‌ই সহজ সরল ব্যাপার। পুজো শেষ হলে মায়ের বিসর্জন হয়। স্পাইসটা থাকে মাঝখানে। প্রথমটা হল, দেবী বরণ। ছোটোখাটো একচালা ঠাকুর হলে, সমস্যা নেই। বড় ঠাকুর হলে, সমস্যা আছে। ঠাকুরকে মিষ্টি খাওয়ানোর মত ম্যান্ডেটরি বিষয়ে কর্মকর্তাদের প্ল্যানিং করতে হয়। প্ল্যানিং এ মেইন ফোকাস করা হয় দুটো বিষয়ে। বডি ওয়েট আর হাইট। পাড়ার সব চাইতে খাটো মহিলার কথা ভেবে টেবিল, টেবিলের উপর বেঞ্চির ব্যবস্থা। আর, সবচাইতে স্বাস্থ্যবতীর কথা ভেবে টেবিল আর বেঞ্চির মজবুতি। একটা মোটা কাছির দড়িও রাখা থাকে। আগের দিনগুলোয় যেটা বাইরের লাইন ঠেকাতে কাজে লাগে, সেগুলোই বরণের সময় ভিতরের লাইন ঠেকাতে কাজে লাগে।

    আমাদের পাড়ায় দড়ি ধরতে সবচেয়ে করিৎকর্মা বাচ্চাদের কাজে লাগানো হয়। এরা দুপুরবেলা ভাত টাত খেয়েই, টাইট হাফপ্যান্ট পরে মন্ডপে চলে আসে, স্ট্যান্ডিং প্ল্যান ছকে নেয়, দড়ি টানাটানি করে স্কিল চেক করে নেয়। অ্যানাউন্সার আসেন একটু পরে, ঢুলুঢুলু চোখে। তার মধ্যে একটা প্রফেশনাল ক্যাজুয়াল ভাব দেখতে পাওয়া যায়। তিনি মাইক্রোফোন আলগোছে তুলে খুব কায়দা করে 'হ্যালো, ঘোষনা শুনছেন' শুরু করলেই সারা এলাকায় উত্তেজনার শিহরণ বয়ে যায়।

    এবারে পাড়ার পুজোতেও এর অন্যথা হয়নি। ঠিক সময়ে হালকা চালে অ্যানাউন্স শুরু হয়েছে। প্রথমে লোক জমানোর জন্য আহ্বান আর শুভেচ্ছা। মধ্যিখানে 'এলো রে মা আআআ, দূর্গা মা' বাজিয়ে মিউজিক্যাল গ্যাপ, পরে আবার ডাকাডাকি সেশন। একঘন্টায় মোটামুটি চল্লিশ জন বরণপ্রার্থীর লাইন হয়ে গেলে স্ক্রিপ্ট চেঞ্জ। তখন একসাথে কতজন উঠে ঠাকুরের মুখে সন্দেশ গুঁজতে পারবে, জল খাওয়ানো যাবে কি না, অসুর মাংসাশী তাই তাকে সন্দেশ দেওয়ার দরকার কীসের ইত্যাদি বিবিধ ইন্সট্রাকশন ও ইনফো প্রদানের কাজ চলে। একটা মন্ডপে থেকে দেখলাম,অ্যানাউন্সার নিজস্ব ফটোগ্রাফার আনার জন্য, বেঞ্চির উপর বিপজ্জনক পোজে দাঁড়িয়ে সেলফি না তোলার জন্য ভীষণ রিকোয়েস্ট করছেন। দুঃখের বিষয়,কেউ শুনছে না! অজস্র লোকজন সরু বেঞ্চের উপর একসাথে উঠে পড়েছে। সবাই চাইছে তার সন্দেশ আগে খাওয়ানো হোক্। চারদিকে সেলফি উঠছে খিচিক খিচিক করে। কর্মকর্তারা হাতে পায়ে ধরে অনুরোধ করছেন নীচে নেমে আসতে, ভয় দেখাচ্ছেন, না নামলে বৌদি সমেত বিসর্জন দিয়ে দেবেন, তাও নামছে না!

    ছেলেমেয়েদের হাতে ব‌ই। এক ধারসে ঠাকুরের পায়ে ছুঁ‌ইয়ে যাচ্ছে। ইঁদুর থেকে অসুর, কারোর পা ছাড়ছে না। খাবলা মেরে মালা থেকে ফুল নিয়ে ব‌ইয়ে ঢোকাচ্ছে। একটা বদ বাচ্চা ফুল হাতের কাছে না পেয়ে অসুরের খানিকটা বাবরি চুল ছিঁড়ে নিলো। অসুর নির্বিকার।

    ওদিকে মেইন রোড লোকে লোকারণ্য। সেখানে একের পর এক প্রসেশন যাচ্ছে। সামনে কচি বাচ্চাদের নিয়ে মায়েরা, তার পিছনে ঢাক, তার পিছনে ঠাকুরদের লাইন, তার পিছনে ডিজে এবং তারপর পৃথিবীর সব ট্যালেন্টেড ডান্সার, সিঙ্গার, মিউজিক কম্পোজার ও মিউজিক ডিরেক্টর, হসপিটালিটি, নিব্বা নিব্বি ইত্যাদি। আট, আঠেরো, আটান্নতে কোনো ভেদাভেদ নেই। গানেও নেই। এ পাড়ার ডিজে কীর্তনে মিশে গেছে ও পাড়ার আইটেম সঙ। সর্ব সুর সমন্বয়ের আশ্চর্য সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা। এক দাদু খুব উত্তেজিত হয়ে জলন্ত ধুনুচি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। লুঙ্গি ডান্স গানের সাথে অদ্ভুত রিদম মিলিয়ে ধুনুচি নৃত্য করছেন। এক কাকু সমস্ত মিউজিক অদৃশ্য কাঠি দিয়ে অর্গানাইজ করছেন। অনুতপ্ত দাদা পথের উপরে  নতজানু হয়ে বৌদির কাছে বিগত কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইছেন। কর্তব্যরত পুলিশরা তাকে সাধ্য সাধনা করছেন উঠে দাঁড়ানোর জন্য। দাদা দাঁড়াচ্ছেন না। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের মত রাস্তায় শুয়ে পড়েছেন!
    বৌদি, নীতিপুলিশ বাঙালীর মত তাকে শ্লেষ, গঞ্জনা ইত্যাদি দিয়ে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন, কাজ হচ্ছে না!

    ওদিকে বাইক ওড়ানো হিরোকে পুলিশ রেগে গিয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, আমরা কি এমনি এমনি দাঁড়িয়ে আছি? আমরা কি বোকাছেলে? হ্যাঁ, বোকাছেলে?!  বাইক-হিরোর স্যাভেজ উত্তর,আমি কী করে বলব?
    চারপাশে চটাপট হাত্তালি উঠলো। বাইকের পিছনে হিরোইন নিয়ে, হিরো উত্তাল চালিয়ে চলে গেল!

    দশমী সর্টেড।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ২৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:২০538857
  • চমৎকার কোলাজ! 
    আরও হোক।
  • sangeeta das | ২৫ অক্টোবর ২০২৪ ২০:১৪538865
  • ধন্যবাদ রঞ্জনবাবু! নিশ্চিত হবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন