এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • অব্যক্ত

    Sukdeb Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৩ জুন ২০২৪ | ১৪৯ বার পঠিত
  • অব্যক্ত

    সৌমর একটা চাকরির খুব দরকার ছিল। বাবা রিটায়ার করে যা পেয়েছিলেন তার প্রায় সবই তাঁর চিকিৎসায় খরচ হয়ে গেছে। রিটায়ার করার কিছুদিন পরেই লিভারে ক্যানসার ধরা পড়ে। মা আর ছেলেতে মিলে সাধ্যমত সবরকম চেষ্টাই করেছে। কিন্তু এ রোগ তো সারার নয়। বছর দেড়েকের বেশি বাঁচান যায় নি।

    এরপর ফ্যামিলি পেনসনের কটা টাকাই ছিল মা ছেলের সম্বল। তাই বিএর রেজাল্টটা হাতে পেতেই যেখানেই সুযোগ পেয়েছে চাকরির জন্য চেষ্টা চালিয়েছে। প্রথম চাকরি পেল একটা প্রাইভেট কম্পানিতে। গ্র্যাজুয়েট ছেলে হিসেবে মাইনে খুবই কম। সৌমর কাছে তখন বাছাবাছির কোন সুযোগ ছিল না। সেখানে কয়েক মাস কাটানর পরে পেল রেলের সহায়ক স্টেশন মাস্টারের এই চাকরিটা। বাবাও রেলে ছিলেন, তাই রেলের প্রতি মা ও ছেলে দুজনেরই দুর্বলতা ছিল। আর কাকতালীয় ভাবে যে স্টেশনে সৌমর প্রথম পোস্টিং হল, বিহারের সেই ছোট্ট কারিসাত স্টেশনেই ওর বাবা রিটায়ার করার কয়েক বছর আগে স্টেশন মাস্টার ছিলেন। সেই সময় সৌম কলেজে পড়াশোনার কারণে কোলকাতায় পিসির বাড়িতে থাকত। কিন্তু একটু বড় ছুটি পেলেই বাবা মার কাছে চলে আসত। ফলে জায়গাটা তার ভালভাবেই চেনা। পাটনা থেকে মোগলসরাই এর দিকে যেতে গেলে কয়েকটা স্টেশনের পরেই কারিসাত। একেবারেই ছোট স্টেশন। কোন মেল এক্সপ্রেস দাঁড়ায় না। আরায় নেমে ওখান থেকে মোকামা প্যাসেঞ্জার ধরে দুপুরের দিকে সৌম কারিসাতে পৌঁছল। মালপত্র নিয়ে ঢুকল অনেক দিনের চেনা অফিস ঘরে। বাবার সাথে এই অফিসে বহু সময় কাটিয়েছে। এত দিনেও ঘর, আসবাবপত্র কিছুই পাল্টায়নি। পাল্টেছে শুধু মানুষগুলো। সবই অচেনা নতুন মুখ। সেটাই স্বাভাবিক। সৌমর বাবা এখানে ছিলেন প্রায় বছর দশেক আগে। সেই সময়ের সকলেরই অন্য স্টেশনে বদলি হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। অফিসের লোকজন ওর দিকে প্রশ্নবোধক চাউনি দিল। পকেট থেকে নিয়োগপত্রটা বার করে দেখাতে যাবে এমন সময় এক বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করল — আপ খোখাবাবু হ্যায় না?
    সৌম্য মাথা নাড়ল। এতকাল পরেও রামদয়াল ঠিক চিনতে পেরেছে। রামদয়াল স্টেশনের খালাশি। বয়সে হয়ত সৌম্যর বাবার থেকে কিছু বড়ই হবে।
    -- রামদয়াল, তুম অভিতক হো!
    -- হাঁ বাবু, আউর আঠ সাল বাকি হ্যায়।
    একজন ফক্কর গোছের কেউ বলল — রামদয়াল কা লড়কা উসসে পহলে রিটায়ার করেগা।

    সৌম্য এরপর ওর আসার কারণ জানিয়ে স্টেশন মাস্টারকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখাল। মাস্টার মশাই বাঙালি। নাম হরিপদ বিশ্বাস। অকৃতদার। মাঝে মাঝে এক আধজন আত্মীয় এসে থাকলেও বেশিরভাগ সময় কোয়ার্টারে একাই থাকেন। অফিসিয়াল ফর্মালিটি সেরে সৌমকে বললেন — ভায়া, কদিন একটু কষ্ট করে আমার কোয়ার্টারে থাকো। তোমার কোয়ার্টার আমার ঠিক পাশেই। ওটা পরিষ্কার করিয়ে একটু বাসযোগ্য করে দিই, তারপর যেও।

    দিন দুয়েক বাদে সৌম্য নিজের কোয়ার্টারে ঢুকল। দুটো ঘর, রান্নাঘর, বাথরুম, দালান, বড় উঠোন, সামনে বারান্দা, সব মিলিয়ে সৌম্যর প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই বড়। শোবার জন্য আপাতত একটা খাটিয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। আর যতদিন না বাসন, উনুন, এসব কেনা হয় ততদিন, হরিয়ার বৌ বাড়ি থেকে রান্না করে খাবার দিয়ে যাবে। হরিপদবাবুই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মানুষটি খুব ভাল। সৌম্য কৃতজ্ঞতা জানাতে ধমক দিয়ে বললেন — দাদার সাথে কেউ ফর্মালিটি করে ? তুমি নতুন এসেছ, যখন যা অসুবিধে হবে আমায় বলবে।
    কিছুদিন বাদে ছুটিছাটা ম্যানেজ করতে পারলে সৌম মাকে নিয়ে আসবে। মা এসে গেলে নিশ্চিন্ত।

    দুপুরে খাওয়ার পর খাটিয়াতে একটু ভাতঘুম দিয়ে সন্ধ্যের দিকে সৌম্য ঘুরতে বেরল। এই কদিন স্টেশন আর কোয়ার্টার ছাড়া অন্য কোথাও যাওয়া হয়নি। স্টেশনের সামনের রাস্তাটা অনেক দূরে একটা বড় বাস রাস্তায় গিয়ে মিশেছে। রাস্তার দু পাশে অধিকাংশটাই হয় ফাঁকা মাঠ নয়ত চাষের জমি। মাঝে মাঝে এক আধটা গ্রাম। স্টেশনের সব থেকে কাছের গ্রামের নাম নওয়াদা। তার কয়েক ক্রোশ দূরে মাসার, আর সবশেষে স্টেশন যে গ্রামের নামে সেই কারিসাত।

    সামনের একটা দোকান থেকে চা খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে সৌম্য দীঘির কাছে পৌঁছল। এই জায়গাটা ওর খুব প্রিয়। বাবার সাথে বহুবার এখানে এসেছে। বিরাট জলাশয়। স্থানীয় লোকেরা এটাকে বলে ‘বন্ধাসুর পোখরা’। কথিত আছে বহুকাল আগে বন্ধাসুর নামে কেউ তার অলৌকিক ক্ষমতাবলে রাতারাতি এই দীঘি তৈরি করেন। বিহারে এইসব অঞ্চলে জলাশয় খুব কম। যাও বা দু একটা আছে তাতে বর্ষা ছাড়া অন্য সময় জল প্রায় থাকেই না। এই দিঘিতে কিন্তু সারা বছর জল থাকে, আর তাতে ফুটে থাকে বড় বড় পদ্মফুল।

    এতকাল পরেও এতটুকু পাল্টায়নি। নির্জন সুন্দর পরিবেশ। দীঘির ধারে একটা পাথরের ওপর সৌম্য বসল। অতীতের স্মৃতিতে বিভোর হয়ে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেছে খেয়াল করেনি। এবার উঠতে হবে। হঠাৎ মনে হল একটা মেয়ে ওর দিকে আসছে। দেখে তো দেহাতি মহিলা বলে মনে হচ্ছে না। কাছে আসতে সৌম্য চিনতে পারল।
    -- পরমা না ?
    -- চিনতে পারলে তাহলে।
    কতকাল পরে দেখা। শেষ যখন দেখেছে তখন ওর বয়স পনের কি ষোল হবে। সবে শাড়ী পরা ধরেছে, আবার ফ্রক পরার অভ্যাসটাও তখনও পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পরমাদের বাড়ি দীঘিটা ছাড়িয়ে আর একটু এগিয়ে নওয়াদা গ্রামে। গ্রামে ওই এক ঘরই বাঙালি পরিবার। তিন পুরুষের বাস। বাবা স্থানীয় স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। পরমার যখন মাত্র সাত বছর বয়স তখন তিনি এক পথ দুর্ঘটনায় মারা যান। তারপর থেকে জীর্ণ বাড়িটার বাসিন্দা কেবল মা আর মেয়ে। আত্মীয় পরিজনদের মধ্যে সেরকম ভরসা দেওয়ার মত কেউ ছিল না তাই শত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও তারা নিজের ভিটে আঁকড়েই থেকে গেল। প্রতিবেশীরা অবশ্য বিপদে আপদে সব সময় পাশে থেকেছে।
    -- কিগো, হাঁ করে কি সাতপাঁচ ভাবছ ? এতদিন পরে দেখা, কথা বলবে না ?
    সৌম্যর ঘোর কাটে।
    -- তুমি জানলে কি করে যে আমি এখানে এসেছি?
    -- ইচ্ছে থাকলেই জানা যায়।
    -- কাকিমা কেমন আছেন?
    -- জেনে আর কি হবে? তোমরা চলে যাওয়ার পর যে কি ভীষণ একা লাগত তা বলে বোঝাতে পারব না। অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতাম তোমাদের একটা চিঠির আশায়। ওই একটা চিঠি যে আমাদের কাছে কত দামী তা যদি বুঝতে তাহলে ঐ সম্পর্কটুকুও তুলে দিতে না।

    সৌম্যর বাবা কারিসাতে বদলি হয়ে আসার পর পরমার মা নিজেই কোয়ার্টারে এসে আলাপ করেন। পরে দুই পরিবারে খুব ঘনিষ্ঠতা হয়। যাওয়া আসা, ভালমন্দ খাবার দেওয়া নেওয়া লেগেই থাকত। কলেজের ছুটি ছাটায় কারিসাতে এলে পরমার মা সৌম্যকে মাঝে মাঝেই এটা ওটা রেঁধে খাওয়াতেন। সৌম্য লাজুক ছেলে। প্রথম দিকে পরমাদের বাড়িতে যেতে একটু সংকোচ হত। কিন্তু ভালমন্দ খাওয়া আর পরমার একটু সান্নিধ্য পাওয়ার লোভে মাঝে মাঝেই চলে যেত। যত লজ্জাই থাক বয়সের ছোঁকছোঁকানি তো একটু থাকবেই। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কথাবার্তা যা হত তা পরমার মার সাথেই। পরমার সাথে ইচ্ছে থাকলেও সহজাত আড়ষ্টতা কাটিয়ে হ্যাঁ হুঁ এর বেশি কথা আর এগোত না। পরমা খুব শান্ত মেয়ে। সারাক্ষণ কাজের অছিলায় মার সাথে সৌম্যর আশপাশে ঘুরঘুর করলেও গল্প করার মত সাহস দেখাতে পারেনি। ফলে মনের কথাগুলো মনেই থেকে গেছে।
    -- আমাদের একেবারেই ভুলে গেলে সৌম্যদা।
    বিব্রত হয়ে সৌম্য বলে – না না কি যে বল। ভুলে যাব কেন?
    -- তাহলে চিঠি লেখা বন্ধ করলে কেন? নিজে থেকে নাই লেখ, আমার লেখা চিঠিরও কি একটা উত্তর দিতে নেই।
    -- আসলে তখন বাবাকে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ি। আর বাবা চলে যাওয়ার পর মা মানসিক ভাবে খুব ভেঙে পড়ে। সংসারের সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ঐ সময় থেকেই চিঠি লেখাও বন্ধ হয়ে যায়।
    -- মাসিমা না লিখুন, তুমি তো লিখতে পারতে।
    -- আলাদা করে চিঠি লেখার অভ্যাস আমার কোন কালেই নেই। মার চিঠির শেষে দু এক লাইন লিখতাম। আর তাছাড়া বাবার মৃত্যু, বেকারত্ব, অভাব, সব মিলিয়ে আমার মন তখন একদম ভাল ছিল না।
    -- অজুহাত দিও না। সেরকম টান থাকলে নিশ্চয় লিখতে। মেসোমসাইএর মারা যাওয়ার খবরও অন্যের মুখে অনেক পরে শুনেছি। আমি মানে আমরা আর তোমার কে বল?

    সৌম্য চুপ করে থাকে। সত্যিই শেষের দিকে পরমাদের বেশ কয়েকটা চিঠির উত্তর দেওয়া হয়নি। তারপর থেকে ওরাও আর চিঠি লেখেনি। পরমা ঠিকই বলেছে, অজুহাত দিয়ে লাভ নেই। আসলে সৌম্য জানত না যে পরমার কাছে তার সামান্য একটা চিঠি এতটা মূল্যবান। তবে কি পরমা তাকে মনে মনে ভালবাসে ! দশ বছর আগের স্মৃতি তো তেমন কিছু বলে না। বয়সের স্বাভাবিক নিয়মে সৌম্যর পরমার প্রতি হাল্কা একটা আকর্ষণ ছিল এটা ঠিক। কিন্তু ভাব ভালবাসার কথা দূরে থাক, পরমা সৌম্যর সাথে কটা কথা বলেছে তা হাতে গোনা যায়। আজকে বরং তাকে অনেক পরিণত আর সহজ মনে হচ্ছে। আগে একবারই তারা ঘনিষ্ঠ হয়েছিল, তাও পরিস্থিতির চাপে। বাবা কারিসাত থেকে বদলি হয়ে যাওয়ার আগে সৌম্য সেইবারই শেষ কারিসাতে গিয়েছিল। পরমার সৌম্যদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল। সৌম্যর বাবা মা দুজনেই ওকে স্নেহ করতেন। কেবল সৌম্য এলেই পরমা একটু গুটিয়ে থাকত।

    একদিন সন্ধ্যাবেলায় জোর বৃষ্টি নেমেছে। সৌম্যর বাবা তখন অফিসে। পরমা সেই সময় ওদের বাড়িতে। রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে সৌম্যর মা পরমাকে ওর বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসার জন্য সৌম্যকে বললেন। একটাই ছাতা খুঁজে পাওয়া গেল। নিজে ভিজেও ছাতাটা যতটা সম্ভব পরমার মাথার ওপর ধরে রাস্তায় বের হল। পরমার এতটা কাছে সৌম্য আগে কখনও আসেনি। কিছুটা যাওয়ার পর হঠাৎ বাজ পড়ার আওয়াজে চমকে উঠে পরমা সৌম্যর একটা হাত জড়িয়ে ধরল। খুবই অল্প সময়ের জন্য হলেও সে এক অদ্ভুত ভাল লাগা। বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেওয়ার পর পরমা তার সমস্ত জড়তা, আড়ষ্টতা কাটিয়ে বলেছিল—আমার জন্য তোমার কত কষ্ট হল। পুরো ভিজে গেলে তো।
    -- না না কষ্ট আবার কি ! এরকম ভেজা আমার অভ্যাস আছে।
    তারপর সৌম্য আর কয়েকদিন মাত্র কারিসাতে ছিল। তারই মাঝে পরমাকে ওর জন্মদিনে একটা পারফিউম দিয়েছিল। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল ঠিকই কিন্তু পরমা যে ওকে ভালবাসে এমনটা ঐ সময় তার মনে হয়নি। সৌম ফিরে আসার দিন পরমা কোয়ার্টারে এসেছিল। ব্যাগটাও কিছুটা গোছগাছ করে দিয়েছিল। চলে আসার আগে ছলছল চোখে অস্ফুট স্বরে বলেছিল — আবার এসো।

    স্মৃতির পাতাগুলো ওলটাতে ওলটাতে এখন সৌম্য বুঝতে পারল যে কথায় প্রকাশ না পেলেও পরমার আচরণে তার প্রতি আকর্ষণের কিছু ইঙ্গিত অবশ্যই ছিল, কিন্তু তার দুর্বল র‍্যাডারে তা ধরা পড়েনি। পরমা ঠিকই বলেছে। টানটা বোধহয় সেরকম ছিল না। চোখের বাইরে চলে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে পরমারা মনের থেকেও কখন যেন হারিয়ে গিয়েছিল। পরমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা উল্টো ছিল, তাই ও এত কষ্ট পেয়েছে।

    পরিবেশটা একটু হাল্কা করার জন্য সৌম্য বলল — টান একটা নিশ্চয় ছিল। তা না হলে রেলের এই চাকরিটাই বা কেন পাব আর কারিসাতে পোস্টিংই বা কেন হবে। এবার তো এসে গেছি দেখো ভবিষ্যতে তোমায় আর অভিযোগ করার কোন সুযোগ দেব না।
    -- সময় কি আর থেমে থাকে সৌম্যদা ! রাত হল, এবার বাড়ি যাও।
    -- চল, তোমায় এগিয়ে দিয়ে আসি।
    -- আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না। তুমি নতুন লোক, সাবধানে বাড়ি ফিরে যাও।

    সৌম্য বুঝতে পারল যে পরমা অভিমান করে একথা বলছে।

    বাড়ি ফিরে করার কিছুই নেই। টিভিও নেই যে দেখে খানিক সময় কাটাবে। তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম আর আসে না। ঘুরে ফিরে কেবলই পরমার মুখটা সামনে চলে আসছে। পরমা তাকে ভালবাসে। আজ দেখা না হলে কোনদিনই ব্যাপারটা জানতে পারত না। যত সমস্যাই থাক এদের সাথে যোগাযোগ না রাখাটা খুবই অনুচিত হয়েছে। অভিমান হওয়া স্বাভাবিক। কালকেই পরমাদের বাড়ি গিয়ে ওর মানভঞ্জন করবে।

    পরের দিন ডিউটি শেষ করে কোয়ার্টারে এসে ফ্রেশ হয়ে বেরোতে গিয়ে একটু দেরী হয়ে গেল। পরমাদের বাড়ি যখন পৌঁছল তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। অন্ধকার হলেও বাড়ি চিনতে অসুবিধে হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। বাড়িটা একইরকম আছে। মনে হচ্ছে ইলেকট্রিক কানেকশন নেই। হয়ত পয়সার অভাবে নিতে পারেনি। শরীরে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ হচ্ছে। এই বাড়িতেই থাকে একটা মেয়ে, যে তাকে ভালবাসে। এটা জানার পর থেকে সেই ভালবাসায় এখন সেও ভাসছে। এগিয়ে গিয়ে কড়া নাড়ল।
    -- কে ?
    -- আমি সৌম্য কাকিমা।
    -- ওমা সৌম্য, কতদিন বাদে এলে বাবা। এস এস ভেতরে এস।

    সৌম্য যে রেলে চাকরি পেয়ে কারিসাতে এসেছে তা জানাল। ঘরে আসবাবপত্র খুবই কম। কিন্তু যে কটা রয়েছে সেগুলো দশ বছর আগের মতই পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। একটা হ্যারিকেন টিমটিম করে জ্বলছে। কাকিমার সাথে কথোপকথন চালিয়ে গেলেও সৌম্যর চোখ তখন বাড়ির দ্বিতীয় ব্যক্তিটাকে দেখার জন্য আকুল। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেও তার দেখা না পেয়ে লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করে ফেলল — পরমাকে দেখছি না। ওকি কোথাও বেরিয়েছে ?
    পরমার মা খাটের ধারে হেলান দিয়ে মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
    -- কাকিমা আপনার কি শরীর খারাপ ?
    -- তোমরা কিছু শোননি? আজ থেকে পাঁচ বছর আগে মেয়েটা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। মাত্র তিন দিনের জ্বরেই সব শেষ হয়ে গেল বাবা।

    কালকে যে পরমার সাথে কথা বলে জীবনের প্রথম ভালবাসার সন্ধান পেল তার সবটাই কি তাহলে মনের ভুল! সৌম্যর শরীর অবশ হয়ে এল।
    কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু বলল — এ হতে পারে না।
    গতকালের ঘটনার কথা পরমার মাকে বলার মত আর মনের অবস্থা ছিল না।
    -- যেন বাবা, মেয়েটা তোমাদের খুব ভালবাসত। তোমাদের চিঠি এলে আনন্দে ওর চোখমুখই পাল্টে যেত। একটা চিঠি কতবার যে পড়ত। আর তুমি যে ওকে একটা সেন্ট দিয়েছিলে, প্রাণে ধরে সেটা কোনদিন ব্যবহার করেনি। মাঝে মাঝে বার করে গন্ধ শুঁকে আবার তুলে রাখত। সৌম্য, আমার একটা কথা রাখবে বাবা ?
    -- কি কথা, বলুন।
    -- আমার একটা বাক্স তুমি নিয়ে যাবে বাবা ?
    -- কিসের বাক্স ?
    পরমার মা ছোট একটা ট্রাঙ্কের মত বাক্স সামনে এনে রাখলেন। তালা লাগান রয়েছে।
    -- এটা আমার মেয়ের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তোমাদের চিঠিগুলো সব এতেই রাখত। হয়ত ওর মনের প্রানের আরও অনেক কিছুই ওতে আছে, সঠিক জানি না। আমি তো কোনদিন খুলি নি। এটা তুমি নিয়ে যাও বাবা।
    -- ওটা আমাকে দিচ্ছেন কেন ?
    -- হয়ত তোমার কাছে এর একটু হলেও মূল্য আছে তাই।
    মা তো তাই মেয়ের অন্তরের খবর তাঁর অজানা ছিল না। সৌম্য না করতে পারেনি। বাক্স হাতে অবসন্ন শরীরে দীঘির পাশ দিয়ে কোয়ার্টারে ফিরছে। সব জানার পরেও দীঘির ধারে একটু দাঁড়িয়ে তার ভালবাসাকে খুঁজেছিল, কিন্তু কটা জোনাকি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি। সারারাত আচ্ছন্নের মত কাটল।

    সকালে অফিসে দেখা হতে হরিপদবাবু পিঠে হাত দিয়ে বললেন — ভায়ার কি শরীর খারাপ?
    -- না না শরীর ঠিক আছে।
    -- তাহলে মুখ চোখ এত শুকনো লাগছে কেন ?
    প্রথমটায় একটু কিন্তু কিন্তু করলেও অভিভাবক তুল্য মানুষটাকে গত দু দিনের ঘটনা সব জানাল।
    --তুমি কি নিশ্চিত যে পরমার মা তোমাকে বাক্সটা দিয়েছেন ?
    -- হ্যাঁ। কেন ?
    -- কারণ তা সম্ভব নয়। একমাত্র সন্তানের মৃত্যু শোক সহ্য করতে না পেরে ভদ্রমহিলা পরের দিনই আত্মহত্যা করেন। আমি সবে তখন কারিসাতে এসেছি। ঘটনাটা মনে এত দাগ কেটেছিল যে তারিখটাও স্পষ্ট মনে আছে - ২৫শে অগাস্ট। আজকে ২৬শে অগাস্ট তো, তার মানে গতকাল আর পরশু মা আর মেয়ের মৃত্যুদিন ছিল। তবে অস্বাভাবিক মৃত্যু হলেও ঐ বাড়িকে ঘিরে কোন ভৌতিক কান্ডের কথা আজ অবধি শুনিনি। তোমার মুখেই প্রথম শুনলাম।

    সৌম্যর মনে হল হরিপদ বাবু ঘটনাটা বিশ্বাস করছেন না। আর কথা বাড়ায়নি। অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে বাড়ি না ফিরে সোজা পরমাদের বাড়ির দিকে রওনা হল। দীঘি পেরিয়ে বাড়িটা চোখে পড়তেই সৌম্য হতবম্ব হয়ে গেল। একটা পোড়ো বাড়ি। সামনের ভাঙা দরজাটা তারটার দিয়ে জড়িয়ে কোনরকমে আটকান। চারিদিকে ধুলোবালি ভর্তি। এখানেই গতকাল সন্ধ্যায় একটা সাজানো গোছানো ঘরে বসে পরমার মার সাথে কথা বলেছিল। এও কি সম্ভব? সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। পরমার ট্রাঙ্ক টাই এযাবৎ ঘটে যাওয়া সমস্ত অলৌকিক কান্ডের একমাত্র লৌকিক চিহ্ন। বাড়ি ফিরে প্রথমেই ট্রাঙ্কটার দিকে তাকাল। ওটা যেমন দেওয়ালের ধারে রাখা ছিল তেমনই আছে। বাক্সটা খোলার পর মন আরও খারাপ হয়ে গেল। সৌম্যদের সমস্ত চিঠি পরপর গুছিয়ে রাখা। পাশে একটা টিশার্ট। মনে আছে ভাল সেলাই করতে পারে বলে মা ওকে ওটা রিপু করতে দিয়েছিলেন। টিশার্টটা বার করে দেখতে গিয়ে ওর ভেতর থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ নিচে পড়ল। সৌম্যকে লেখা একটা চিঠি। মনের ভেতরে জমে থাকা ভালবাসা, অভিমান, কষ্ট সব বেরিয়ে এসেছে ঐ চিঠিতে। সাহস করে পাঠাতে পারেনি। হয়ত লিখে মনটা হাল্কা করেছিল। পারফিউমটাও রয়েছে। পাশেই ‘সৌম্য’ লেখা এমব্রয়ডারি করা একটা রুমাল। কত যত্ন করে করেছে, কিন্তু দেওয়া আর হয়ে ওঠেনি। এরকম টুকিটাকি আরও কত কি।
    এত বছর পরে ঐ পোড়ো বাড়িতে এই বাক্স আর তার ভেতরের জিনিসগুলো অক্ষত থাকার কথা নয়। পরমার মায়ের অশরীরী আত্মাই আগলে রেখেছিল মেয়ের এই ভালবাসার সম্ভার। তার ভাল লাগার মানুষের হাতে সেগুলো তুলে দিয়েই হয়েছে তাঁর মুক্তি। কোন যুক্তি তর্ক দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যাবে না।

    বাক্সের জিনিসগুলো নিয়ে সৌম্য অনেকক্ষণ মগ্ন হয়ে রইল। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে যা রয়েছে সেগুলো স্পর্শ করে অনুভব করার চেষ্টা করল যে নেই তাকে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন