এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • একটি ফুল(কপি)গাথা

    Angsuman Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৬ মার্চ ২০২৪ | ৪২১ বার পঠিত
  • (বিঃ দ্রঃ জনৈক অতিবাচালের অক্ষরবিন্যাশ। স্বভাব গম্ভীর পাঠক এই অপলিখনী পাঠে বিরত থাকবেন।)

    আই লাভ ফুলকপি

    পাড়ায় নতুন একটা মোমোর দোকান হয়েছে। শুনলাম সেখানে নাকি ফুলকপির মোমো পাওয়া যাচ্ছে। সকাল সকাল তারই খবর নিতে যাচ্ছিলাম, রাস্তায় ফুলকপির সঙ্গে দেখা। পাতাশুদ্ধ ডাঁটাগুলো দুলিয়ে দুলিয়ে যাচ্ছে। পকেট থেকে চিরুনী বার করে চুলটা ঠিক করে বললাম - কোথায় চললে?
    - বিউটি পার্লারে
    - এই সাত সকালে বিউটি পার্লার? এখনো তো পার্লারবালাদের দাঁত মাজা জিভ ছোলা, হোয়াটসঅ্যাপে গুড মর্নিং পাঠানো কিছুই হয়নি!
    - যত বাজে কথা। এখন সাত সকাল নয় দশ সকাল। সকাল দশটা বাজে
    - তা ঠিক। সকালে দশটা বাজা খুব বাজে। ছোটবেলায় দশটায় স্কুলে যেতে হত, এখন দশটায় অফিসে যেতে হয়, দশটায় অফিসে না পৌঁছতে পারলে দশানন মার্কা বসের কাছে দশকথা শুনতে হয়, দশটার সময় বাসে ভীষন ভীড় থাকে, রাস্তায় দশগুণ বেশি গাড়ি চলে, লোকে হন্তদন্ত হয়ে দশদিকে হাঁটাচলা করে, বাজারে গেলে কিছু পাওয়া যায় না, একেবারে দুর্দশা। এই দশটাতেই যেন সুখী(!) জীবনের বারোটা বেজে যায়। আমি বুঝতে পারিনা যে আলাদা করে ঘড়িতে বারোটা বাজার দরকার কী? দশটা আর বারোটা মার্জ করিয়ে দিলেই হয়, পাবলিক সেক্টর ব্যাঙ্কগুলোর মত।
    - যত্ত সব ! বোকা বোকা কথা
    একথা বলে নিজের পাতার ভেতর থেকে সবুজ সবুজ নরম নরম রেলগাড়ির মত দেখতে একটা দশপদী পোকা আমাকে ছুঁড়ে মারল।
    আমি টুক করে সেটাকে হাত দিয়ে ধরে হাজমোলার মত মুখে পুরে বললাম - বিউটি পার্লারে কেন যাচ্ছ বললে না তো?
    - কেন আবার পাতা কাটতে। একটাও পাতা রাখব না। ক্লিন শেভড
    - সেকি! না না না ওকাজ কর না। নেড়া নেড়া টেকো টেকো বাজে দেখতে লাগবে
    - ফুলকপির পাতা কেউ পছন্দ করে না আর এখন এটাই ট্রেন্ড
    - তা বলে সব কেটে ফেলবে? পাতাশুদ্ধ কী সুন্দরই না দেখতে লাগে তোমাকে। ভেবেছিলাম তোমার পাতায় পাতায় কবিতা লিখব -

    ফুলকপি তোমার সঙ্গে ডালনা জীবন কাটাব
    তোমার সঙ্গে কুচিকুচি ভাজা জীবন কাটাব ফুলকপি
    ফুলকপি তোমার সঙ্গে সিঙাড়া জীবন কাটাব
    থালা বাটি তুমি আর আমি মুখোমুখি....

    - জঘন্য। বলে ফুলকপি মুখ বেঁকালো -
    নিজের লেখার ক্ষমতা নেই জয় গোস্বামীর কবিতার প্যারোডি লিখছে, তাও যদি...
    আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
    - তুমি জয় গোস্বামী পড়েছ? এসব কবিতা টবিতা জান?
    - ডু নট আন্ডারেস্টিমেট দ্য নলেজ অফ আ পুওর ফুলকপি
    - ও আচ্ছা, কিন্তু ঠিক করে রান্না করতে পারলে ফুলকপির পাতা, বেগুন, আলু আর মাছের মাথা দিয়ে দুর্দান্ত ল্যা- সরি ছ্যাঁচড়া হয়
    - অতই যদি ভালো লাগে তো বাজারে কেনার সময় পাতাগুলো ফেলে দিয়ে আস কেন? ঘরে আনলেই তো পার
    - সে কী আর নিজের ইচ্ছায় ফেলি? আমার ইয়ে মানে তোমার বৌদি একদম পছন্দ করেনা। বলে দিয়েছে ফুলকপি আনলে পাতা ছাড়িয়ে আনবে নাহলে তোমারই...
    - নাহলে কী?
    - সে যাকগে, ঘরের কথা ঘরেই থাকুক। কিন্তু এই ভাবে আপন সুদৃশ্য পত্রাবলি স্বেচ্ছায় অপাত্রে মুণ্ডন করা কপি স্বাধীনতার ফুল অপব্যবহার। মমদিদা বলেছেন আঁচল বা পাতা দিয়ে ফুলকপি ঢেকে রাখা উচিত। পাতা ছাড়া ফুলকপি অত্যন্ত অশ্লীল, সন্ধেবেলায় রাস্তার ধারে ল্যাম্প পোস্টের নিচে বিক্রি হওয়া ইতর ফুলকপির মত, খেলো। আগের যুগ হলে আমি মনুদাদুকে বলে দাদুর লেখা লাইফস্টাইল গাইডলাইন জীবন সংহিতায় একটা নির্দেশ যোগ করাতাম যাতে ফুলকপিরা স্বেচ্ছায় পত্রচ্ছেদ না করাতে পারে। জোর করে করতে গেলে যেন সামাজিক বাধা আসে
    - শোন, তোমার মমদিদা মনুদাদু রেখে দাও। ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না
    ফুলকপির চোখে আগুন জ্বলে উঠল
    - ওসব তালিবানি সংস্কার আর মনুবাদী ফতোয়া এযুগে চলবে না। অনেক অত্যাচার অনেক পীড়ন সহ্য করেছি আমরা। যখন আগুন জ্বলে উঠবে কেউই রেহাই পাবে না, সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।
    একথা বলে গটমট করে হাঁটা শুরু করে আবার একটু থেমে ফিরে এসে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলল- এক দুখী ফুলকপি কি দিল তুম কেয়া সমঝোগে মানুষ পুরুষ?
    মুখ বেঁকিয়ে পাতার ঝাপটা মেরে হনহন করে ফুলকপি চলে গেল।
    ফুলকপি চলে গেল এবছরের মত।
    যদিও ফুলকপির সঙ্গে থাকলে শুধু 'ফুলবাতাস' বয়, লোকে দু কথা শোনায়, তবুও আমি বলব আমি ফুলকপি ভালবাসি।

    কদিন আগের কথা -

    আমাদের ফ্ল্যাট বাড়ির ওপর তলার বাসিন্দা অশেষকাকুর অনেক বয়স হলেও তাঁর অশেষ এনার্জি। এখনও নিজের হাতে প্রতিদিন বাজার দোকান করেন। সেদিন আমি বাজার করে ডান হাতে ব্যাগ আর বাঁ হাতে বড় বড় দুটো ফুলকপি নিয়ে গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে সবে মাত্র লিফ্টে উঠেছি। আমি একা, তাই লিফট তখন 'ফুলবাতাসী'। এমন সময় দেখি অশেষকাকু টুকটুক করে আসছেন, তাঁরও হাতে বাজারের ব্যাগ। কাকুকে দেখে লিফ্টের দরজা খুলে আসতে বললাম। উনি ভেতরে চলে আসার পর দরজা বন্ধ করে সুইচ টিপতেই লিফ্ট চলতে আরম্ভ করল। অশেষকাকু তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বের করে নাকে চেপে ভ্রুকুঞ্চিত করে বললেন- ওরে ব্বাপরে.. থামাও থামাও... আমি এক্ষুনি লিফ্ট থেকে নেমে যাব।
    লিফ্ট থেমে যেতে উনি পড়িমরি করে বেরিয়ে গিয়ে বললেন
    - সিঁড়ি ভেঙেই বাকিটা উঠি। লিফ্টের মধ্যে দমবন্ধ হয়ে আধ-মরার চেয়ে সিঁড়ি ভেঙে হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে পাঁচ তলায় উঠে হার্ট এ্যাটাক করে ফুল মরাই ভালো। ভুলে গিয়েছিলাম যে বাজারে ফুলকপি খুব সস্তা হয়েছে আর তুমি রোজ ফুলকপি খাও
    - আপনি কী করে জানলেন কাকু?
    - তোমার কাকিমাকে তোমার গিন্নী গল্প করেছে তো!

    অশেষকাকু পিতৃতুল্য। একটু বকাঝকা দিলেন বটে, আমি কিন্তু কিছু মনে করিনি।
    আমি ফুলকপি ভালবাসি।

    লাঞ্চের পর জি এম মিটিং ডেকেছিলেন। বাড়ি থেকে আনা ফুলকপির ডালনা আর পরোটা দিয়ে লাঞ্চ করে মিটিংএ উপস্থিত হলাম। মিটিং যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তখন অসাবধানে ও সশব্দে হেঁচে ফেললাম আর নিঃশব্দে একটু ফুলবাতাস বয়ে গেল। সৌজন্য বশতঃ সরি বললাম। মিটিংএ ব্যস্ত থাকায় সেই মুহূর্তে কেউ কোন প্রতিক্রিয়া জানালো না বটে কিন্তু একটু পরেই সবাই উসখুস করে উঠলো। জি এম বেল বাজিয়ে খাস খানসামাকে ডেকে বললেন হরিপদ, শিগগির দরজা খুলে দাও, এসির ফ্যান হাই স্পীড কর আর রুম ফ্রেশনার স্প্রে কর। তাড়াতাড়ি।
    আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আজকের সবকটা এ্যাজেন্ডাই ডিসকাস করা হয়েছে। সুতনুকা আপনাকে মিনিটস মেল করে দেবে, আপনি এখন আপনার সিটে চলে যেতে পারেন।
    হ্যাঁ স্যার, সেইই ভাল, ডিসগাস্টিং। জিএম এর পিএ সুতনুকা তার ঘনঘন খসে যেতে অভ্যস্ত মশারির মত সব কিছু দেখতে পাওয়া শাড়ির আঁচলটা তুলে নাকে চেপে ফোড়ন কাটল।
    আমি চলে আসছিলাম। জিএম আবার বললেন - শুনুন, যতদিন বাজারে ফুলকপি এ্যাভেলেবল ততদিন আপনি মিটিংএ ভিসিতে এ্যাটেন্ড করবেন। অফিসে থাকলেও।
    মুখে বললাম ইয়েস স্যার। মনে মনে তিন না চার অক্ষরের কী একটা শব্দ বলেছিলাম এখন আর মনে নেই।

    আই লাভ ইউ ফুলকপি।

    বেশ কয়েক বছর আগে, ভাইপোর জন্মদিনে গিয়ে সকালের জলখাবারে লুচি আর আলু ফুলকপির তরকারি খেয়ে মাসতুতো দাদার পিসতুতো শালীর সঙ্গে একটু ইয়ে করার চেষ্টা করছিলাম। তখন শীতকাল শেষ হয়ে বসন্ত আসব আসব করছে। বললাম - মৌশালী মধুর বসন্তের এই মধুশালায় তোমার কেমন লাগছে?
    - আমার নাম মৌশালী নয় পৌষালী। আমার পৌষ মাসে জন্ম তাই।
    - ঠিক ঠিক। পৌষ মাসে জন্ম যে শালীর সে ই তো পৌষালী। মৌশালী বললে মনে হয় মোষের মত শালী, সেটা ঠিক না। কবিগুরু তোমার কথা ভেবেই আমার জন্য লিখেছিলেন:
    সেদিন পৌষ মাস
    তুমি জন্মে লিখে দিলে
    আমার সর্বনাশ...
    - এটা আবার কোন কবিতা? পৌষালী জিজ্ঞেস করে
    - সে যাই হোক, মৌশালী পৌষালী বৈশালী যে শালীই হও না কেন, বড় কথা তুমি আমার দাদার শালী।
    আমি কৌশলী হয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ করার চেষ্টা করলাম
    - চল না দুজনে এই কোলাহলের হলাহল ছেড়ে 'কাছাকাছি-দূরে' কোথাও চলাচল করে আসি। যেখানে শুধু -
    তুমি আর আমি আর উবরের ড্রাইভার
    এই আমাদের পৃথিবী
    তুমি ফুল আমি কাঁটা
    তুলতে এলে লাগবে ব্যথা ...

    পৌষালী লজ্জাবতীর মত মুখে 'না' চোখে 'হ্যাঁ' ভাব করে নিমরাজি থেকে উচ্ছেরাজির পর্যায়ে উন্নীত হয়ে ফুলরাজি হব হব করছে ঠিক সেই সময়েই , ঠিক সেই সময়েই ফুলবাতাস বইল।
    নাকে আঁচল চাপা দিয়ে পৌষালী বলে উঠলো - এঁ ম্যাগোঁ... ঈসসস
    আমি দেখিনি বুঝিনি ভাব করে বললাম - উবরটা তাহলে বুক করেই ফেলছি
    - এঁকদঁম না। আমি যাঁব না। নাকে আঁচল চাপা দিয়ে পৌষালী নাকি সুরে বলল।
    - ঠিক আছে উবর নয় থাক, ওলা বুক করি?
    - ওঁলা উঁবর কিঁচ্ছু না
    - তবে চল টোটো চড়ে যাই কিংবা রিক্সা
    - ওঁলা উঁবর টোঁটো কোনটাঁই নয়। আঁপনার সঁঙ্গে থাঁকা অঁসম্ভব। দিঁদি বাঁর বাঁর আমাকেঁ সাঁবধান কঁরে দিঁয়েছিল- আমার মাঁসতুঁতো দেঁওরটার ধাঁরে কাঁছে এঁকদঁম থাঁকবি না। খুঁব ফুঁলকঁপি খাঁয় আঁর কিঁছুক্ষণ পঁর পঁর...
    পৌষালী ছুটে চলে গেল, আর ধারে কাছে এলনা। কোনদিন।

    সে সব দিনের কথা ভাবলে কষ্ট হয়। কষ্ট হলে গিন্নীকে বলি ফুলকপির বড়া ভাজতে। গরম গরম ফুলকপির বড়া খাওয়ার পর অবশ্য মনটা ভালো হয়ে যায়।

    আমি যে ফুলকপি ভালবাসি।

    কয়েক দিন আগে একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল। একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার রীতিমতো অপদস্থ করলেন ফুলকপির কারণে। না না, কোন পদস্খলনের কারণে অ-পদস্থ হতে হয়নি। আমি তখন ট্যাক্সির সিটেই বসেছিলাম। চলন্ত বাস বা দুরন্ত ট্রেন হলে পদস্খলনের সম্ভবনা থাকে কিন্তু ট্যাক্সিতে নয়।
    একটা বিশেষ কাজে বেহালা ঠাকুরপুকুর যাবার দরকার ছিল। সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র রয়েছে। অফিস টাইমে বাসে যা ভীড়, ঐ সব কাগজপত্র নিয়ে বাসে চড়ে যাবার সাহস হল না। হারিয়ে গেলে বিপদে পড়তে হতে পারে। বালীগঞ্জের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে ট্যাক্সিতে উঠলাম। ট্যাক্সি ড্রাইভার একজন পক্ককেশ বয়স্ক বিহারী ধর্মপ্রাণ মানুষ। গাড়ির ড্যাসবোর্ডে রামের ছবি রয়েছে, কমলা রঙের গাঁদাফুলের মালা দেওয়া। চলতে শুরু করার আগে উনি রামের ছবিতে নমষ্কার করে বললেন
    - কাঁহা যায়েঙ্গে বাবু?
    - ঠাকুরপুকুর চলুন
    - জ্যায় শ্রীরাম

    গাড়ি গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলল। বাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়া করেই বেরিয়েছি। গিন্নী বলেছিল ফিরতে ফিরতে হয়তো দেরি হবে তাই একেবারে খেয়ে বেরোও। সকাল সকাল উঠে সে রান্না করে দিয়েছে - ভাত, কুচি কুচি ফুলকপি আর কড়াইশুঁটি দিয়ে ডাল, ফুলকপির বড়া, আলু দিয়ে ফুলকপি দিয়ে লাল টকটকে ডালনা আর ফুলকপি দিয়ে ভেটকি মাছের কালিয়া। আমার বৌ ফুলকপির কোন টক বা মিষ্টি পদ রাঁধতে জানে না। ওকে বলেছি ফুলকপির চাটনি বা ফুলকপির পায়েসের রেসিপি ইউটিউব দেখে শিখে রাখতে।
    সেদিনও বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ছিল। ট্যাক্সির ড্রাইভারের পাশের জানলাটা সামান্য ফাঁক করে রাখা ছাড়া সব জানলার কাঁচই তোলা ছিল। গড়িয়াহাটের কাছাকাছি বোধহয় রাস্তায় ছোটখাটো কোন গর্তে পড়ে গাড়িটা একটু ঝাঁকুনি খেল আর আমিও সামান্য ইয়ে মানে ফুলবাতাস মুক্ত করে ফেললাম নিঃশব্দে।
    ট্যাক্সি ড্রাইভার 'জ্যায় রামজীকি' বলে সামনের দুটো জানলার কাঁচ নামিয়ে দিলেন। সামান্য ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে, তবে বেলা বেড়েছে বলে অসুবিধা হচ্ছে না। পণ্ডিতিয়ার কাছে একটা অটোরিকশা এমন ভাবে আমাদের গাড়ির সামনে চলে এল যে ড্রাইভার কষে ব্রেক চাপলেন। হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় আমিও সিট থেকে হড়কে একটু এগিয়ে গেলাম আর নড়াচড়াতে সামান্য ...। ড্রাইভারজী এবার আমার দিকে ফিরে বললেন - বাবু আপ কৃপায়া জানলা কা সীসা উতর দিজিয়ে। দোনো কা।
    আমার দুপাশের জানলার কাঁচ নামিয়ে দিলাম।

    দেশপ্রিয় পার্কের সিগন্যাল সবুজ থেকে হঠাৎ লাল হয়ে যেতে ট্যাক্সিটা আবার আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল আর আমি...
    বৃদ্ধ ড্রাইভার নিজের মনে বললেন - জ্যায়শ্রীর (খক খক) আম
    লেক মার্কেটের সামনে সাইড করে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে যেতে আমি জিজ্ঞেস করলাম
    - এখানে দাঁড়ালেন কেন?
    - জী ভগোয়ানজীর জন্য একটা ফুলের মালা লিব। যাদা টাইম লাগবে না।
    একথা বলে ট্যাক্সি থেকে নেমে রাস্তার ধারে বসা এক ফুল বিক্রেতার কাছ থেকে একটা জুঁইয়ের মালা এনে রামের ছবিতে দিয়ে প্রণাম করলেন। আমি এক দেড় মিনিট গাড়িতে বসে বসে ফুটপাতে ফুলকপি বিক্রি দেখছিলাম, সেই অবসরে একটু...
    সিটে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিতেই ড্রাইভার বুঝতে পেরে করুণ মুখে আমার দিকে তাকালেন।
    রাসবিহারী মোড়ের কাছে একটি ছেলে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাছে গিয়ে লাল, হলুদ বা সাদা রঙের ঝাড়ন বিক্রি করে। ড্রাইভারজী ছেলেটিকে ডেকে একটা সাদা ঝাড়ন কিনে মাস্কের মত করে নিজের নাক মুখ ঢাকা দিয়ে বেঁধে গাড়ি চালাতে শুরু করলেন।

    রাসবিহারী মোড় পেরিয়ে চেতলা ব্রিজ পেরিয়ে চেতলা অগ্রগামীর সামনে দিয়ে শর্টকাট করে ট্যাক্সি যখন দুর্গাপুর ব্রিজে উঠল, সেই সময়েই আরও একবার ফুলবাতাস...
    ড্রাইভারজী এবার 'জ্যায় শ্রীরাম' না বলে হতাশ কন্ঠে বলে উঠলেন 'হে রাম'!

    নিউ আলীপুর মোড় ছাড়াতেই গাড়ির গতি যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেল। সাঁ সাঁ করে আমাদের গাড়ি নিউ আলীপুর ত্রিকোন পার্কের সামনে এসে ইউ টার্ন নিয়ে সুলভ শৌচালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি কিছু বলতে যাবার আগেই বৃদ্ধ ড্রাইভার হাত জোড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন - বাবুজি ইয়ে গাড়িকো ম্যায় মন্দির মানতা হুঁ। ইখানে রামজীর ছবি আছে। রামজী কি আশীর্বাদ সে অর আপ লোগোকা শুভ্ কাম‌্না সে আমি কিসি গ্যারেজ কা টেনিয়া সে আজ ট্যাক্সির মালিক হয়ে গেছি।
    - সে তো খুব ভালো কথা, আপনি মেহনত করে বড় হয়েছেন, খুবই প্রশংসনীয় কিন্তু এখানে গাড়ি থামালেন কেন?
    - বুরা মত মানিয়ে বাবু আপনি কৃপা করে শৌচালয় ঘুরে আসুন। বালীগঞ্জ থেকে ইখান পর্যন্ত আপনি ট্যাক্সিতে বদবু ভরে দিয়েছেন। সব জানলা খোল দিয়া, জুহি কা মালা লাগবায়া, আপনা মুহ্ মে কাপড়া বান্ধা, কিসিমে কাম নহি হুয়া। অর ম্যায় সহে নহি সকতা, রামজী কা ভি অপ‌্মান হোগা এ্যায়সা গন্দা .... লাগতা হ্যায় আপনি খুব ফুলগোবি খান! ম্যায় ইঁহা ইন্তেজার কর রহা হুঁ, আপনাকে ওয়েটিং চার্জ দিতে হোবে না পর একবার শৌচালয় যান।

    ফুলকপির গল্প এখানেই শেষ।

    আমাদের বাড়ির কাছাকাছি সরু গলির ভিতরে একটা উপাসনা গৃহ আছে। কখনো কখনো ঐ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই। দিন কয়েক আগে সন্ধেবেলায় ঐ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। গলিটা অন্ধকার অন্ধকার মত, বোধহয় রাস্তার আলো জ্বালেনি। উপাসনা গৃহের কাছে যেতেই একটা সুন্দর গলায় গান শুনতে পেলাম। কে যেন দোতারা বাজিয়ে গাইছে, মীরার ভজন-

    হে রি ম্যায় তো প্রেম দিওয়ানি
    মেরা দর্দ না জানে কোই

    আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত দাঁড়িয়ে পড়লাম। কী অপূর্ব গলা। গান শুনতে শুনতে এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম যে গান শেষ হবার পরেও দাঁড়িয়ে ছিলাম। আলো আঁধারের ভিতর থেকে একজন এগিয়ে এলেন। ভালো করে বুঝতে পারছি না, বোরখা পরা না ঘোমটা দেওয়া নাকি সবুজ রঙের চাদর জড়ানো। আমার দিকে হাত জোড় করে বললেন - নমস্কার
    আমি প্রতি নমস্কার জানিয়ে বললাম - কী অপূর্ব গানের গলা। আপনি গাইলেন?
    তিনি হেসে বললেন - হ্যাঁ। আপনার ভালো লেগেছে?
    - খুব। অসাধারণ গানের গলা আপনার। আপনি কি এখানেই থাকেন?
    - আমি সর্বত্র থাকি
    - তাহলে আগে কি কখনো আপনাকে আমি দেখেছি? আপনার গান শুনেছি?
    - নিশ্চয়ই দেখেছেন, শুনেছেন‌ও, কিন্তু মনে রাখেননি। হয়তো মন জুড়ে অন্য কেউ ছিল, তাই
    -কিন্তু কে আপনি?
    - আমি বাঁধাকপি।

    ---------------------------

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • manimoy sengupta | ২৭ মার্চ ২০২৪ ১২:৫২529867
  • বাঁধাকপি নিয়ে কিছু লিখুন। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন