এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভাষারা নদীর মতো, নদীরাও ভাষা: একটি পরিবেশবাদী ইস্তেহার 

    Samir Karmakar লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ মার্চ ২০২৪ | ৪৪৮ বার পঠিত
  • অববাহিকার ছোট ছোট জলধারা একে অপরের সাথে মেশে, ঠিক যে ভাবে মেশে এক ভাষা আরেক ভাষার সাথে।

    বড় বড় ভাষার বা নদীর নাম আমরা জানলেও, ছোট-ছোট ভাষা  ছোট-ছোট নদীরা অপরিচয়ের অন্ধকারে হাতড়ে মরে। 

    গঙ্গা, তিস্তা, সুবর্ণরেখা - কেবল তো আর নদী নয়। নদীর বহমান স্রোতের ধারায় ধরা থাকে অববাহিকার ইতিবৃত্ত। অববাহিকা জোড়া জীবনের চালচিত্রে গঙ্গা, তিস্তা, সুবর্ণরেখারা তাই নিত্য নৈমিত্তিক রীতি রেওয়াজের অংশভাক হয়ে রয়ে গেছে সে কথা প্রায় সকলেই জানি এবং মানিও। কিন্তু কয়জনেই বা আর খবর রাখি খড়কাই, রোরো, কাঞ্চি, হারমু, দোমড়া, কারু, চিংগুরু, ডুলুং, বা খাইজড়ির মতো শীর্ণকায় অভাবী জলধারাগুলির কথা। অথচ, এদের সশরীরি উপস্থিতিই সুবর্ণরেখার অববাহিকার জলবিভাজিকাটিকে স্পষ্ট করে তোলে। লাচেন, রংপো, রঙ্গিতের ধারায় পুষ্ট তিস্তা। আর গঙ্গার জলবিভাজিকায় ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, কংসাবতীর মিশে যাওয়া গঙ্গার সাথে। একই রকমভাবে বাংলার মূল ধারায় মিশে থাকে আধিপত্যকারী অন্যান্য ভাষাগুলির পাশাপাশি সাঁওতালি, ভূমিজ, কড়া, মাহালি, টোটো, মেছ, তুরির মতো অনেকেরই ভাষিক উপাদান। জাতীয় পরিসরে মুখ্য ধারাগুলি, তা সে নদীর ধারায় হোক বা ভাষার ধারা, যতোটা প্রাধান্য পায়, ততোটা প্রাধান্য পায় না মুখ্য ধারাগুলিকে পুষ্ট করে যে অসংখ্য অখ্যাত ধারা - তারা। তাই গঙ্গা বাঁচাও বা বাংলা বাঁচাও নিয়ে উদ্যোগ সংগঠিত হলেও, ডুলুং বাঁচাও বা মাহালি বাঁচাও নিয়ে খুব একটা হেলদোল দেখা যাচ্ছে না। অথচ কে না জানে, অববাহিকার ধারারেখগুলি যেমন নদীর প্রাণভোমরা, ঠিক তেমনি অল্পপরিচিত বা অপরিচিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষাগুলিও আধিপত্যকারী ভাষাগুলির টিকে থাকার জন্যে সমানভাবে অপরিহার্য। 

    বড় নদী আর তার অববাহিকার দুরাবস্থা যদিওবা জাতীয় উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে, ছোট নদী আর তার জলবিভাজিকা কোনভাবেই সেই জাতীয় উদ্বেগে ভাগ বসাতে পারেনা। একই ধরণের অব্যবস্থা ছোট ছোট ভাষাগুলির ক্ষেত্রেও দেখা যায়। অষ্টম তফশীলের ভাষাগুলোর প্রমোশনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ হলেও, অ-তফশীলভুক্ত ভাষাগুলির প্রমোশনের জন্য কোন ব্যয় বরাদ্দ করা হয় না। তাদের জন্যে প্রিজারভেশন বাবদ টাকা বরাদ্দের ব্যবস্থা রয়েছে। ছোট ছোট ভাষাগুলিকে ক্রমশ প্রিসার্ভড স্পেসিমেন বানিয়ে তোলার উদ্যোগও অব্যাহত রয়েছে। 'নদ নদীর জল' আর জল নয়, রাষ্ট্রের চোখে সে রিসোর্স। ভাষাকেও প্রযুক্তির উন্নয়নের স্বার্থে রিসোর্স হিসেবে দেখার একটা চল হয়েছে। তাতে করে কর্পোরেট বা ভাষা প্রযুক্তির বেশ খানিকটা সুবিধে হলেও নদ-নদী বা ভাষাদের আদৌ কোন সুবিধে হয়েছে কিনা সে নিয়ে বিশেষ কোন তথ্য আছে বলে মনে তো হয় না।

    ভারত বহুভাষিক এবং নদীমাতৃক। তবে সব ভাষার মতই সব নদীরা সমান গুরুত্বের নয়। গঙ্গার সংস্করণে কুড়ি হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ হলেও, জলবিভাজিকার স্বাস্থ্যরক্ষায় কি বরাদ্দ হয়েছে, সে সংক্রান্ত সুস্পষ্ট কোন রূপরেখা আদৌ কি দেখা যায়? জলবিভাজিকার স্বাস্থ্যরক্ষা কেবলমাত্র প্রবাহের গতিপথ বা তার নাব্যতা সংক্রান্ত বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। অববাহিকার ভূপ্রকৃতি, জীবনাচার, লোকাচারের সাথে মিলেমিশে সার্বিক একটি পরিমণ্ডলের রূপরেখা নদীদের স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক একটা ভূমিকা পালন করে থাকে। টোটো পাড়া সংলগ্ন হাউরির ধারারেখ তখনই বিপন্ন হয়ে পড়ে যখন সংলগ্ন পাহাড়ি উপত্যকায় চলে মাইনিং-এর কাজ। বিপন্ন হাউরির জলবিভাজিকা টোটোপাড়ার জলকষ্টকে যেমন প্রকট করে, ঠিক তেমনই পরোক্ষে হলেও স্থানীয় ভাষিক বাস্তুতন্ত্রের উপর বিপন্নতার ছায়াকেও দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, ২০১৭য় প্রমোদ গুপ্ত ভারত সরকারের নীতি আয়োগে জমা করা রিপোর্ট Socio Economic Impact Study of Mining and Mining Polices on the Livelihoods of Local Population in the Vindhyan Region of Uttar Pradesh-এ বলেছিলেন ভাষাদের অবলুপ্তির পেছনে মাইনিং-এর ভূমিকার কথা।  

    আশির দশকের হলদিয়া বন্দর  আর পরবর্তীকালের কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের কর্মকাণ্ডে ঘোড়ামারা, লোহাচরা, বেডফোর্ডই যে কেবল বিপন্ন হয়েছে তা নয়, বিপন্ন হয়েছে উদ্বাস্তু হতে থাকা মানুষের মুখের ভাষাও।  ড্যাম নির্মাণ আর উন্নয়নের নামে একদিকে যথেচ্ছ পরিমাণে অরণ্য ধ্বংস করা আর অন্যদিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও ইকো-ট্যুরিজমের রাজনীতি যে নির্বিশেষে প্রকৃতি ও মানুষকে আরও বেশি বিপন্ন করে তুলবে সে নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করতে গিয়ে জাতিসঙ্ঘে কি উচ্চারিত হয় নি, “For over a century, conservation has resulted in cultural destruction and large-scale displacements of tribal people from their ancestral lands”? মধ্যপ্রদেশের কানহা জাতীয় উদ্যানে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের নীতি গোণ্ড এবং বৈইগাদের কিভাবে বিপন্ন করেছে তা একটু কাগজ ঘাঁটলেই জানা যায়।  

    এ কেবল ভারতের গল্প নয়। সারা পৃথিবীর গল্প। আফ্রিকার কালাহারি বুশম্যান, ব্রাজিলের ইয়ানোমামি, বা বোর্নিওর পেনানদের বিপন্নতা ভারতের বিপন্ন জনজাতিদের থেকে খুব একটা আলাদা কিছু নয়। 

    মুষ্টিমেয় নদী বা ভাষাদের জন্যে নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের বিরুদ্ধে আমরা যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে পারি সকল নদী সমস্ত ভাষা সকল মানুষের জন্যে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন