যে লোক নিজেকে বর্তমানের কবি বলে ঘোষণা করে, উচ্চকিত হুল্লোড়ে জীবন বাঁচে, কোনো দলে না থেকে ঠিক মাঝের সীমানায় দাঁড়িয়ে জীবন কাটাতে চায়, যে সচেতনভাবে নিজের ইমেজ তৈরিতে সময় দেয় না, যার শিল্পের মূল মাধ্যম শব্দ অথচ জীবনের শেষ তিরিশ বছর যার সঙ্গী নৈঃশব্দ্য — তার কথা, লেখা, গান, কবিতা, দর্শন মনে রাখার ক্ষমতা কোনো দরিদ্র, হুজুগে জাতির নেই। তবু, মৃত্যুর প্রায় অর্ধ-শতাব্দী পরে তার গানের সুরারোপ নিয়েই তরজায় নামে বাঙালি।
তিনিও 'মিম' হন।
সে রাস্তায় না গিয়ে, চলুন লোকটার জীবনের একটা দিনের ছবি তুলি—
"...নজরুলের আগমনবার্তা যারা পেয়ে গেছে এর মধ্যে, একে একে আসতে থাকে তারা, কেউ বসে, দাঁড়িয়ে থাকে কেউ। কবি ঢোকেন যখন, তড়িতাবিষ্টের মতো দাঁড়িয়ে থাকে নজরুল কয়েক মুহূর্ত, তার পরেই দৌড়িয়ে এসে তাঁর পায়ে মাথা রাখে। পায়ে-মাথা-রাখা অবস্থায় সময় কেটে যায় অনেকটা, কবিকে দেখে বোঝা যায় তিনি বিব্রত বোধ করছেন, তারপর সহসা নীচু হয়ে নজরুলের মাথায় হাত রেখে বলেন, ওরে পাগল, আমার পা যে ভিজে গেল। হাঁটু-ভাঙা অবস্থাতেই নজরুল মাথা তোলে, সেই অবস্থাতেই কবির মুখের দিকে তাকায়, তার চোখ-ভরা জল, বলে, আমি কাকে দেখছি? আল্লাহ্ যিশু ভগবান, কাকে? কবি হেসে বলেন, উন্মাদ তুই, রবি ঠাকুরকেই দেখছিস, আমি ওরকম সেজে থাকি!
সবাই বসবার পর প্রথম কথা বলেন শহীদুল্লাহ্ সাহেব, আজ আসবার সময় ট্রেন-এ সারা রাস্তাটাই নজরুল আপনার গীতাঞ্জলির গান গাইতে গাইতে এসেছে, একটার পর একটা গান।
বলেন কী! – বিস্মিত রবীন্দ্রনাথ, পুরো রাস্তাটাই? গীতাঞ্জলির ক'টা গান মুখস্থ তোর? – নজরুলকে আবার জিজ্ঞাসা করেন কবি।
নজরুল হাসে, জবাব দেন শহীদুল্লাহ্, সবটাই, গোটা গীতাঞ্জলি।
সে কী রে, এ ক্ষমতা তো আমারও নেই, আশ্চর্য স্মৃতিশক্তি তো, স্বগতোক্তির মতো শোনায় রবীন্দ্রনাথের গলা। তারপর সরাসরি নজরুলের দিকে তাকিয়ে বলেন, আমাকে কোন গান শোনাবি আজ?..."
২০২৪, নজরুল-এর ১২৫ তম জন্মবার্ষিকী। তাঁকে নিয়ে আলোচনা করার ক্ষমতা আদৌ আমাদের আছে কিনা সন্দেহ হয়। মনে হয়, আজকের দিনে বসে এক জন্মসূত্রে সুন্নি মুসলমান একদিকে শ্যামাসঙ্গীত লিখলে আর অন্যদিকে খিলাফত আন্দোলনের বিরোধিতা করলে, গরুর চামড়া গায়ে-ঝোলানো বুনো নেকড়ের দল তাঁকে ছিঁড়ে খেত। আবার, এ-ও মনে হয়—হয়তো এই বানানো বিভেদের গেরুয়া গরলের সব দোষ কেটে যেত তাঁর একটা স্লোগান বা দুটো কালজয়ী গানে।
কে জানে?
যা জানি—নজরুলকে মাপার ক্ষমতা না থাকলেও, তাঁকে মনে রাখার দায় আমাদের সবার। এই এত বছরেও তাঁর জীবন নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাসের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। সেই শূন্যস্থান পূরণ করার দায়িত্ব নিয়েছেন শেখর মুখোপাধ্যায়। গত এক বছর ধরে গুরুচণ্ডা৯-র সাইটে লিখছিলেন নজরুলের জীবনাশ্রয়ী ঐতিহাসিক উপন্যাস – 'সীমানা'। প্রথম খণ্ড প্রকাশ পেয়েছে এই বইমেলায়।